জামেয়া ওয়েবসাইট

বৃহস্পতিবার-১২ই শাবান, ১৪৪৬ হিজরি-১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইহুদিদের সশস্ত্র তাণ্ডব

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইহুদিদের সশস্ত্র তাণ্ডব

(এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সংখ্যা)

২০২১ সালের ১১ দিনে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে এ পর্যন্ত ৫০০জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। এর মধ্যে ৮০% মানুষ নারী ও শিশু। জাতিসংঘের তথ্যমতে ৭০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুতহয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। ইসরাইলি যুদ্ধবিমান গাজায় অবস্থিত আল-জাজিরা ও এপি অফিসভবন গুড়িয়ে দিয়েছে। স্কুল, হাসপাতাল ও বিদ্যুৎ কার্যালয় ধ্বংস করে দিয়েছে। ২০ লাখ জন অধ্যুষিত ৩৬৫ বর্গ কিলোমিটারের গাজা উপত্যকা এখন যমপুরী। গাজা মূলত পাখির খাঁচা। দু’দিকে ইসরাইল, একদিকে ভূমধ্যসাগর অপর দিকে মিসর দ্বারা অবরুদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিটি প্রস্তাব ঠেকিয়ে দিচ্ছে। ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, গাজায় ইহুদিদের তাণ্ডব চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরাইলের কাছে ৭৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে বারবার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে ইসরাইলকে উদ্ধত বানিয়েছে এবং ফিলিস্তিনিদের রেখেছে দমিয়ে।

বিশ্বের শক্তিধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ মদদে ইসরাইল বেপরোয়াভাবে ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালাবার সাহস পাচ্ছে, এ সত্য দিবালোকের মত স্পষ্ট। ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসী শক্তি রূপে দাঁড় করানোর জন্য আমেরিকা বার্ষিক ৩.৪বিলিয়ন ডলার সাহায্য প্রদান করে থাকে। শক্তির ভারসাম্য না থাকার কারণে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো নিবীর্য ও স্থানু। জনমতের তোয়াক্কা না করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে স্বৈরাচারীচক্র ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে রেখেছে বংশ পরম্পরায়। দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকার উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের ২২টি দেশ নিয়ে গঠিত আরবলীগ একটি বিবৃতি পর্যন্ত দিতে পারেনি। আসলে তাঁদের কিছু করার শক্তিও নেই, সাহসও নেই অথচ ফিলিস্তিন আরবলীগের সদস্য।

তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগান, পাকিস্তানও ইরানের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ছাড়া গোটা পৃথিবীর নীরব ভূমিকা কেবল দুঃখজনক নয়, লজ্জাজনকও বটে। মুসলমানগণ আজ অভিভাবকহীন। অন্য কোন জাতিগোষ্ঠী বিশেষত হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও ইহুদি জাতির ২০০ মানুষ যদি মুসলমানরা মেরে ফেলতো তাহলে এতক্ষণে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠতো। মুসলমানের শত্রু মুসলমানই। জাতিসংঘ এবং ১৭৫ কোটি মুসলমানের প্রতিনিধিত্বকারী ওআইসি কাগুজে বাঘ। অধিবেশন ডেকে আলোচনা ও হালকা বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব শেষ। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত মিসরের জনগণের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। ইখওয়ানের সংগ্রামী কর্মিদের ওপর মুসলমানদের প্রবল আস্থা। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের সরকার প্রধান নিজেদের গদি রক্ষার স্বার্থে ইহুদি সন্ত্রাসবাদের মুকাবেলায় কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না এবং নেবেন না। আফসোস! কিছু আরব রাজা মুক্তিকামী হামাস যোদ্ধাদের বলছে সন্ত্রাসী অথচ এটা ইহুদিদের পরিভাষা। আরব দেশসহ গোটা মুসলিম বিশ্বে দু’চারটি ব্যতিক্রম ছাড়া জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নেই। রাজতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক, সামরিক সরকার ক্ষমতায়। জনসম্পৃক্ততার অভাবে এসব সরকার স্বাভাবিকভাবে মেরুদণ্ডহীন, দুর্বল ও ভীতু। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটেপুটে খাওয়ার প্রতিযোগিতা সর্বত্র। তাদের কাছে ক্ষমতার মসনদ মুখ্য, ইসলামের প্রতি মায়া, উম্মাহ চেতনা, মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ গৌণ।

রাজা-বাদশাহদের মুখের দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। আজ যদি শক্তিশালী খিলাফত ব্যবস্থা চালু থাকত, তাহলে খলীফাতুল মুসলিমীনের ডাকে সারা বিশ্বের মুক্তিযোদ্ধারা ফিলিস্তিনের নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের রক্ষায় এগিয়ে আসত। দুতিয়ালি, আলোচনা, যুদ্ধবিরতি, সংলাপ এসব স্থায়ী সমাধান নয়। গেল রমজানে নামাযরত অবস্থায়ও সশস্ত্র ইসরাইলি সেনা মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মসজিদুল আকসায় ইহুদিরা বহুবার হামলা চালিয়েছে এবং ১৯৬৯ সালে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। ইসরাইল সরকারের তত্ত্বাবধানে মসজিদের নিচে এবং চার পাশে খনন চালিয়ে সুরঙ্গ তৈরি করা হচ্ছে, যাতে মসজিদটি ভেঙে হাইকল সুলায়মানী নামক মন্দির (Temple Mount) স্থাপন করা যায়। জেরুজালেমকে ইহুদিমুক্ত করা না গেলে মসজিদ আল-আকসার পবিত্রতা রক্ষা সম্ভব নয়।

ইঙ্গ-মার্কিন-রুশ অক্ষশক্তির ষড়যন্ত্রের ফসল মধ্যপ্রাচ্যের বুকে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্যার আর্থার জেমস বেলফোর আরব বিশ্বের বুকে এ বিষ ফোঁড়ার জন্ম দেন। ১৯৪৮ সালের পূর্বে পৃথিবীতে ইসরাইল নামক কোনো স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের অস্থিত্ব ছিল না। ডেভিড বেন গুরিয়ন ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর ইসরাইলের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়নের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আদ্রে গ্রোমিকো ১৫ নভেম্বর এ স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি ও অনুমোদন দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানালে আমেরিকা, সোভিয়েট ইউনিয়ন ও ইংল্যান্ডসহ ৩৩টি দেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। নবগঠিত ইসরাইলের কোনো আন্তর্জাতিক সীমানা, কোনো সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী, কোনো বৈধ সরকার, পার্লামেন্ট বা সার্বভৌমত্ব ছিল না। এটা মূলত একটি পুতুল রাষ্ট্র (Satellite State)।

ঈমানি চেতনাকে শাণিত করা গেলে, মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হলে এবং মুসলিম দেশে বৈশ্বিক মানের উন্নততর অস্ত্রশস্ত্র তৈরির কারখানা স্থাপন করতে পারলে এক দিনেই মসজিদে আকসা উদ্ধার হয়ে যাবে, অন্যথায় এটা স্বপ্ন থেকে যাবে। মুসলমানদের মাঝে বিভেদের কারণে আজ ইহুদিরা মুসলমানদের প্রাণের নগরী জেরুসালেম দখল করে নিয়েছে। ইসরাইলের রাজধানী বানিয়ে ফেলেছে জেরুসালেমকে। মুসলমানরা যদি ঐক্যবদ্ধ না হয়, সেদিন বেশি দূরে নয় তারা মসজিদে আকসা গুড়িয়ে দেবে এবং কাবাগৃহও দখলের চেষ্টা করবে। মুসলমানরা ইহুদি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজেরা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। এক অপরকে হত্যা করছে। সংকীর্ণতা পরিহার করে দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করতে হবে। দৃষ্টিশক্তি বড় না করলে নেতৃত্ব দেওয়া যায় না।

দেড় হাজার বছর আগে মহানবী + ঘোষণা করেন যে, ‘আলা ইন্নাল কুওয়াতা আর রামইউমান আলিমার রামইয়া ছুম্মা নাছিয়া ফালাইছা মিন্না।’ (জেনে রেখো দূর নিক্ষেপণ হচ্ছে শক্তি। দূর নিক্ষেপণ প্রযুক্তি যে শিখলো, অতঃপর ভুলে গেল সে আমার উম্মত নয়।’) হযরত রাসূলুল্লাহ +-এর বাণী অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। বর্তমান বিশ্বে আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র যেসব দেশের আছে, সেসব দেশ সুপার পাওয়ার। বিশ্বখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন শায়খ ইবনে কসীরের ভাষ্যমতে রাসুল + দু’জন সাহাবী গায়লান ইবনে আসলাম ও উরওয়াহ ইবনে মাসউদ F-কে দামেস্কে পাঠিয়েছিলেন ট্যাংক (দাব্বাবা) কিভাবে বানায়, হাতে কলমে তার প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। দীর্ঘদিন প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় হুনায়েনের যুদ্ধে তাঁরা অংশ নিতে পারেননি। সুতরাং উন্নততর অস্ত্র নির্মাণের প্রশিক্ষণ নেওয়া সুন্নতে রাসূল। এজন্য মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের এগিয়ে আসতে হবে। মুসলমানরা আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ও দুরপাল্লার রকেট উদ্ভাবন করতে পারলে বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি হতে মোটেই সময় লাগবে না। মুসলমানরা আমেরিকা-ব্রিটেন-ফ্রান্স থেকে অস্ত্র কিনে জেরুসালেম জয় করতে পারবে না, নিজেদেরকে অস্ত্র তৈরি করতে হবে। শত্রুশক্তির আগ্রাসন প্রতিরোধ, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব সুসংহতকরণ এবং নিরবচ্ছিন্ন শান্তির জন্য সামরিক শক্তি অর্জন অপরিহার্য। সামরিক শক্তির কারণে এক কোটি ইহুদি ২শ’ কোটি মুসলমানকে পাত্তা দিতে চাচ্ছে না।

এ কথা আমাদের মানতে হবে যে, কেবল সামরিক শক্তি থাকলে বিজয় নিশ্চিত হবে এ কথাও সত্য নয়। অবশ্যমুসলমানদেরকে ঈমান ও আমলকে সুদৃঢ় করতে হবে। এটা পূর্বশর্ত। তাই বলে সামরিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ +  ও সাহাবাগণ আল্লাহঅলা হওয়া সত্ত্বেও প্রতিটি যুদ্ধাভিযানে অস্ত্র হাতে নিয়েছেন। যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে সিজদাবনত হয়ে আল্লাহ তাআলার দরবারে প্রার্থনা করেন। মানজানিক নামক অস্ত্র আবিস্কার করেন। সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা রহমতের ওপর ভরসা করেন। আল্লাহ তাআলার দয়া ও সামরিক শক্তির সমন্বয় ঘটাতে পারলে বিজয় সুনিশ্চিত।

মুসলমানদের হতাশ হলে চলবে না। মুসলমানদের হাতে আছে দক্ষ ও অদক্ষ বিপুল মানব-সম্পদ। তেল, গ্যাস, স্বর্ণ, লোহা, কয়লা, তামাসহ অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। একা সৌদি আরব প্রাকৃতিক সম্পদের মজুদের দিক দিয়ে গোটা বিশ্বে দ্বিতীয়। এর পরিমাণ ৩৪.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। তুরস্কের রয়েছে কৃষ্ণসাগর জুড়ে তেল ও গ্যাসের মজুদ। গোটা দুনিয়ায় মোট ৮০ ভাগ তেল ও গ্যাস, ৬০ ভাগ কয়লা, ৬৫ ভাগ স্বর্ণ, ৭৫ ভাগ রাবার ও পাটের এবং ১০০ ভাগ খেজুরের মজুদ মুসলিম দেশের হাতে। কেবল সম্পদ থাকলে হয় না। সম্পদকে ইতিবাচক পন্থায় কাজে লাগাতে হয়। মুসলমানরা যদি আল্লাহ তাআলা কে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে প্রযুক্তির সাহায্যে প্রাকৃতিক সম্পদকে নিজেদের স্বার্থে এবং মুসলিম বিশ্বের কল্যাণে কাজে লাগায় এবং সামরিক শক্তি অর্জনে পাশ্চাত্য নির্ভরশীলতা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনতে পারে, সফলতা আসতে দেরি হবে না।

মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা দুনিয়ায় যেসব মুক্তিসেনা বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে নবীন প্রভাতের সূচনা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তাদের এগিয়ে আসতে হবে আগ্রাসন প্রতিরোধে। ফিলিস্তিনের শাহাদতপ্রাপ্ত নারী পুরুষের প্রতিটি রক্ত ফোটা বুলেট হয়ে ইহুদি ও তাদের দোসরদের আঘাত হানবে, এটা কেবল সময়ের ব্যাপার। হামাস ও ফাতাহের বিভাজন রেখা মুছে ফেলতে হবে। ফিলিস্তিনের প্রতিরোধযোদ্ধাদের সাহস যোগাতে হবে, তুলে দিতে হবে তাদের হাতে রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। আল্লাহ তাআলার সাহায্য সন্নিকটে। মুজাহিদীনের কুরবানির বদৌলতে গাজায় বদরের মতো পরিস্থিতি-পরিবেশ আবার তৈরি হোক এটাই শান্তিকামি মানুষের কামনা ও মুনাজাত।

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ