মহাপ্রাচীর পেরিয়ে সভ্য দুনিয়ায় চীনের গোপনীয় কোন খবর আসা বড্ড কঠিন। তারপরও বিভিন্ন সূত্রে যে খবর পাওয়া যাচ্ছে তা কেবল উদ্বেগজনক নয় বরং লোমহর্ষক। শিনজিয়াং প্রদেশে বিদেশি কোন মিডিয়াকর্মির প্রবেশের সুযোগ নেই। স্যাটিলাইটে ধারণকৃত কিছুচিত্র ও কোনক্রমে পালিয়ে আসা কতিপয় ব্যক্তির সাক্ষাৎকার থেকে বিভিন্ন বন্দিশিবিরে ১০ লাখ উইঘুর মুসলমানদের ওপর ভয়ংকর নির্যাতন ও যৌননিপীড়নের আলেখ্য ফুটে উঠেছে। বেইজিং কর্তৃপক্ষ এসব বন্দিশিবিরকে নাম দিয়েছে ‘পুনঃশিক্ষণ’(Re-Education) কেন্দ্র। উইঘুরসহ সংখ্যালঘুদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ওইসব ক্যাম্পে বেইজিং এমন দাবি করলেও আসলে ওইগুলো হিটলারের আমলে জার্মানির নাজি সিক্রেট বাহিনী গেস্টাপোর Concentration Camp-এর মতো ভিন্নমত নিবর্তনকেন্দ্র। উত্তর-পশ্চিম চীনের শিনজিয়াং প্রদেশের তুর্কি বংশোদ্ভুত মুসলিমসংখ্যালঘু এই উইঘুরদের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ।
কমিউনিস্ট পার্টির কর্মিদের সহায়তায় গোয়েন্দা বাহিনী মুসলিম নারী-পুরুষদের ঘর থেকে ধরে নিয়ে ক্যাম্পে আটকে রাখে বছরের পর বছর। অতি উচ্চপ্রাচীরে ঘেরা এবং সার্ভিল্যান্স ক্যামেরায় নিয়ন্ত্রিত এসব ক্যম্পের অভ্যন্তরে কী চলে বাইর থেকে জানা অনেকটা অসম্ভব। একদলীয় চরম কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরশাসন শাসন (Autocratic and Authoritarian rule) চালু থাকায় এখানে আইনের শাসন, মানবাধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নেই। ক্যাম্পের ভেতরে বন্দিদের কমিউনিজমের আদর্শ গ্রহণেরজন্য চাপ দেয়া হয়। দাড়ি রাখা, টুপি পরিধান করা, হিজাব ব্যবহারকে নিরোৎসাহিত করা হয়। নতুন মসজিদ নির্মাণের অনুমতি নেই। পুরোনো মসজিদ সংস্কার বা পুনঃনির্মাণ করতে চাইলে বৌদ্ধমন্দিরের স্থাপত্যিক আদলে নির্মাণ করতে হয়। বিশেষ জোর প্রয়োগ করা হয় হান বৌদ্ধদের সংস্কৃতি অবলম্বনের ওপর। এর সরল অর্থ হল ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন বর্জন। এ কাজগুলো করার জন্য মুসলিম নামধারী অনেক বৃত্তিভোগী এজেন্ট রয়েছে। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, চীনা সরকার উইঘুরদের ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য স্বাধীনতা হরণ করে চলেছে এবং গণ-নজরদারি, চলাফেরায় বাধা, বন্দিত্ব, মগজ ধোলাই, উইঘুর তরুণীদেরকে তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বুড্ডিস্ট ছেলেদের সাথে বিয়ে দেয়া এবং জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ পর্যন্ত করানোর এক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, যাতে আগামীতে মুসলমানদের সংখ্যা হ্রাস পায়। চীনা প্রেসিডেন্ট শিজিনপিং এই নীতির উদগাতা। ২০১৪ সালে উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের চালানো এক সন্ত্রাসী হামলার পর তিনি শিনজিয়াংয়ে দমননীতি গ্রহণ করেন। ব্যক্তির অপরাধের জন্য গোটা সম্প্রদায়কে তিনি আসামির কাঠগড়ায় তুলতে দ্বিধা করেননি। চীন সরকারের লক্ষ্য হল ধীরে ধীরে উইঘুর মুসলিম জাতিসত্তাকে নিঃশেষ (Ethning cleansing) করে দেওয়া। মার্কিন সরকার শিনজিয়াংয়ে চীনের এসব মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড গণহত্যার শামিল বললেও চীন বরাবর একে ‘মিথ্যা ও উদ্ভট অভিযোগ’ বলে বর্ণনা করেছে।
স্মর্তব্য যে, সপ্তম শতাব্দীতে সমুদ্র ও স্থলপথে চীনে ইসলামের আগমন ঘটে। ইসলাম চীনে চতুর্থ স্বীকৃত ধর্ম। চীনের সমগ্র জনসংখ্যার ০.৩১% হচ্ছে উইঘুর মুসলিম। ডিএনএ এনাইলাইস নির্দেশ করে উইঘুর হল ককেশিয় ও পশ্চিম এশিয়ার নৃগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ। ৮ম শতাব্দীতে উইঘুর জাতিগোষ্ঠী চীনে বিস্তৃতি লাভ করে। শিনজিয়াং ও হুনান প্রদেশে উইঘুরের সংখ্যা বেশি। উইঘুররা সুন্নি মতাদর্শে বিশ্বাসী। শিনজিয়াং ও হুনান প্রদেশের বাইরেও বিপুলসংখ্যক মুসলমানদের বসবাস রয়েছে। বিভিন্ন প্রদেশে ৩ কোটি মুসলমানের বাস।
সবচেয়ে বেদনার বিষয়হল বেইজিং কর্তৃক উইঘুর নারীদের প্রতি নজিরবিহীন সহিংসতা ও যৌননিপীড়নের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ বা চীনকে বাধ্য করারমত শক্তিধর আন্তর্জাতিক কোন কর্তৃপক্ষ নেই বললেই চলে। ওআইসি বা আরব লীগ নখরদন্তহীন এক ক্লান্ত ব্যঘ্র। ৫৭টি মুসলিম দেশ চীনা পৈশাচিকতার তাণ্ডব নৃত্যের নীরব দর্শক মাত্র। ২০১৯ সালে ওআইসিভুক্ত ৫৭টি দেশেরমধ্যে ৩৭টি দেশ চীনে উইঘুর নির্যাতন বন্ধের দাবিতে তৈরি এক বিবৃতিতে স্বাক্ষর করলেও ২০টি দেশ স্বাক্ষর প্রদানে বিরত থাকে। বিবৃতি দেওয়ার সাহস পর্যন্ত নেই। মুসলিম ভ্রাতৃত্বের চেয়ে ডলারের মূল্য বেশি। অনেক দেশ চীনের ইবষঃ ধহফ জড়ধফ Infrastructure Programme-এর কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল মুসলিম দেশগুলো চীনের সাথে কোটি কোটি ডলারের বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। রাবাত থেকে জাকার্তার মুসলিমজন পদের অবকাঠামোগত উন্নয়নে চীনের বিনিয়োগ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তান, মিসর, সৌদি আরব, আরব-আমিরাত উইঘুরদের ব্যাপারে একেবারে নীরব। পাকিস্তানে ৬০ বিলিয়ন ডলারের চীনা বিনিয়োগ থাকায় ইমরান খান জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণে চীনে মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে টু-শব্দ উচ্চারণ করেননি। অথচ কাশ্মীর সম্পর্কে তাঁর উদ্বেগ ব্যক্ত করেন। সৌদি আরব থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধে পাকিস্তান নতুন করে চীন থেকে ২ বিলিয়ন ডলার কর্জ নেয়। ২০১৭ সালে মিসরের শাসকবর্গ দু’শ উইঘুর মুসলিমকে হোটেল রেস্তোরাঁ থেকে ধরে চীন সরকারের হাতে তুলে দেয়। উইঘুর মুসলমানদের নিয়ে সৌদি আরবের কোন বক্তব্য বা উদ্বেগ নেই। ২০১৭ সালে সৌদি আরব ও চীন ৭০ বিলিয়ন ডলার নতুন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ইরানের ভূমিকাও দায়সারা গোছের। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়ের এরদোগান বন্দীশিবিরে উইঘুরদের দুর্দশাকে ‘মানবতারজন্য চরম লজ্জা’ হিসেবে উল্লেখ করলেও এখন ইউটার্ণ নিয়েছেন। শিনজিয়াং এ নির্যাতন বন্ধে ২২ জাতির প্রতিবাদপত্রে স্বাক্ষর করতে তুরস্ক অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। নেপথ্যে রয়েছে ভূরাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থ। জ্বালানি ও পরিবহন খাতে তুরস্ক ৩.৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা পেয়েছে চীন থেকে।
চীনের বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও কুটনৈতিক সম্পর্ক বহাল রেখেও উইঘুর জাতিগোষ্ঠীর সাথে মানবিক আচরণ করার প্রসঙ্গ দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় অ্যাজেন্ডাভুক্ত করা যেতে পারে। বিবিসি যেভাবে বহুদিন যাবৎ উইঘুরদের নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করছে তেমনি আল-জাজিরাসহ মুসলিম দেশের মিডিয়াগুলো ডক্যুমেন্টারি স্টোরি প্রচার করলে ইতিবাচক ফল পাওয়া যেত বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পৃথিবীর মানবতাবাদী মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে উইঘুর জাতিগোষ্ঠীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর মানসে।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন