আলাউদ্দীন ইমামী
আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন প্রথম মানুষ আদম (আ.)-কে। আদম থেকে হাওয়া (আ.)-কে। নারী ও নরের পূর্ণতা এবং মানব বংশ বিস্তারের জন্য যৌনতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন অনেক পুরুষ ও নারী। নারীর সর্বোত্তম একটি পরিচয় তিনি মা। আর একটি পরিচয় তিনি মেয়ে। আর একটি পরিচয় তিনি বোন। আরেকটি পরিচয় তিনি স্ত্রী। স্বস্ব স্তরে সবার নিজস্ব একটি পরিচয়, মর্যাদা, অধিকার, দায়িত্ব ও সীমা আছে। প্রত্যেকে নিজ নিজ সীমার মধ্যে থেকে ইসলামী বিধান মত জীবন যাপন করলে সমাজে অনাচার এবং নারীর প্রতি সহিংসতা অনেক কমে যাবে যেমন কমে গিয়ে ছিল খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে। ইসলামী অনুশাসন অনুশীলনের কারণে। নারীর চারটি পরিচয়ের তিনটি পরিচয় অত্যন্ত পবিত্র এবং রক্তের সম্পর্ক। ৪র্থ যে পরিচয় তা প্রেম-প্রীতি ভালবাসা, প্রশান্তি ও মানব বংশ বৃদ্ধির জন্য যৌনতার সম্পর্ক।
আল্লাহ বলেন, ‘হে মানুষেরা! তোমাদের রবকে ভয় কর যিনি তোমাদের একদেহ থেকে সৃষ্টি করেছেন। যার থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া। তাদের থেকে বিস্তার করেছেন অনেক পুরুষ ও নারী।’ (আল-কুরআন)
নারীকে সৃষ্টি করে আল্লাহ তাদের ব্যাপারে পুরুষকে বললেন, ‘তারা তোমাদের আচ্ছাদন, তোমরা তাদের আচ্ছাদন। (আল-কুরআন)
তারপর উভয়কে সমান মর্যাদা দিয়ে বলেন, ‘তোমাদের যেমন অধিকার আছে তাদের ওপর, তাদেরও অধিকার আছেন তোমাদের ওপর।’ (আল-কুরআন)
সমান দায়িত্ব দিয়ে বলেন, মুমিন নর-নারী পরস্পর পরস্পরের অভিভাবক ও বন্ধু। (আল-কুরআন)
অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাদের স্বামী-স্ত্রী হিসেবে জোড়াজোড়া সৃষ্টি করেছি।’ (আল-কুরআন)
আরেক আয়াতে যৌন-উচ্ছৃঙ্খলতা বন্ধ এবং যৌনক্ষুধা নিবারণের জন্য বলেন, ‘তোমরা বিয়ে কর যাকে তোমাদের পছন্দ হয়। দুই, তিন অথবা চারজন। অথবা একজন।’ (আল-কুরআন)
সহিংসতা কি?
নারী নির্যাতন, নারী অপহরণ, নারী ধর্ষণ ও খুন-হত্যাই হলো নারীর প্রতি সহিংসতার চরম প্রকাশ। নারীকে অসম্মান, অবজ্ঞা, নারীর প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন, নারীর সাথে অসৎ আচরণ, কটূক্তি ও টিটকারীমূলক মন্তব্য, যৌন-উস্কানিমূলক উক্তি, ইভটজিং করা ইত্যাদি নারীর প্রতি চরম সহিংসতা। এসিড নিক্ষেপ করে নারীর মুখ ও শরীর ঝলসে দেওয়াও নারীর প্রতি চরম সহিংসতা। নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রদানে গড়িমশি করাও নারীর প্রতি সহিংসতার অংশ।
সহিংসতা কেন করে
নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বেশি সংঘটিত হয় যৌনকারণে। এসব ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত বেশিরভাগই তরুণ, যুবক, ছাত্র ও ছাত্রী। প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকার পাতা উল্টালে প্রতিটি পাতায় দু’চারটি করে নারীর প্রতি সহিংসতার খবর পাওয়া যাবেই। নারী-পুরুষ ও ছেলে-মেয়ে এবং ছাত্র-ছাত্রীর অবাধ মেলামেশা ও ফ্রিমিক্সিং প্রধানত এর জন্য দায়ী। প্রায় সময় দেখা যায়-নারীকে অপহরণ ও ধর্ষণ করা হয়েছে। এসিড মারা হচ্ছে প্রেমে রাজি না হওয়ায়। বিয়ে অথবা চাকরির প্রলোভনে নিয়ে তাকে ধর্ষণ ও খুন করা হচ্ছে। কারণ যে মেয়ে বা নারীকে অপহরণ বা ধর্ষণ করা হচ্ছে, সে মেয়ে বা নারী তার সাথে প্রেমে জড়িয়ে ছিল। ধর্ষণকারী তা খুব নিকটের হওয়ার কারণে অথবা ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তাকে খুন করেছে। এপ্রেম ও অপহরণ আর এ খুনের জন্য কী শুধু ধর্ষণকারী অপহরণকারী খুনিরাই দায়ী? নাকি এ অবুঝ কিশোর-কিশোরীদের সম্পর্কের এমন এক জটিল ও ভয়ঙ্কর পর্যায়ে চলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য তার অভিভাবক, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ও দায়ী?
সহিংসতার অন্য কারণ হলো যৌতুক। যৌতুকের জন্যও নারীর প্রতি সহিংসতা হচ্ছে। যারা যৌতুকের জন্য স্ত্রীর ওপর অত্যচার করছে এ যৌতুকলোভী লম্পটদেরই কি এ যৌতুক লালন করছে? যৌতুক আদান-প্রদানে ভরা এই সমাজে যৌতুক বন্ধ করা যৌতুকলোভী লম্পটদেরই কী দায়িত্ব? আইনের ধারক, বাহক ও আইন করেন তারাই যেখানে এ যৌতুক লালন করেন সেখানে যৌতুকলোভীরা কী লোভে পাপ, পাপে মৃত্যুর শিকার হবে না? পত্র-পত্রিকায় দেখা যাচ্ছে যৌতুকলোভী শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী, ভাসুর, ননদ সবাই যৌতুকের জন্য নববধূকে অত্যাচার করছে। মেরে ক্ষত-বিক্ষত করছে, এসিড মেরে, গরম লোহার শেকা দিয়ে শরীর ঝলসিয়ে রাতের আঁধারে অবলা নববধূকে ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে। এ ধরনের ঘটনার ত্বরিত এবং দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি হচ্ছে না। এর জন্যও কী যৌতুকলোভীরাই শুধু দায়ী?
নারীর প্রতি সহিংসতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অপর কারণটি হলো বেপর্দা, অশ্লীল, অর্ধউলঙ্গ ও যৌনউত্তেজনা সৃষ্টিকারী পোশাক এবং ভঙ্গিমায় নারীর মেয়েদের অবাধ চলাফেরা এবং সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রিন্ট ও ইকেট্রনিক মিডিয়ায় নারী-দেহের যৌন-আবেদনময়ী প্রচারণা ও গান-বাজনা। এর জন্যও কি শুধু ইভটিজিংকারী কিশোর আর ধর্ষণকারী যুবকই দায়ী। যৌনক্ষুধায় ভরপুর যুবক যখন বিপরীত লিঙ্গের তার কাঙ্ক্ষিতজনকে সামনে ঘুরঘুর করে আকর্ষণীয় ভঙ্গিমায় হেলেদুলে চলতে দেখবে তখন কি সে নিথর পাথরের মতো নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে? সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবার কি তাকে সুন্দরী দেখলে চোখ নিচু করে রাখার নৈতিক শিক্ষা দিচ্ছে, নাকি বিভিন্নভাবে তার যৌনশক্তিকে উত্তেজিত করে তাকে সুন্দরী ললনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার যৌন-উস্কানি দিচ্ছে। যে কিশোরের যৌনতা ও তারুণ্য এখন অস্থির ও চঞ্চল তাকে যৌনপত্রিকা, নোভেল, নাটক, সিনেমা, গান, টিভির সুন্দর নারী-দেহের প্রদর্শন এবং পত্রিকায় যৌন-আবেদনময়ী নারীর দৃশ্য দেখিয়ে নারী-দেহের নরম ও গরম ছোয়া নিয়ে, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কি তাকে সুন্দর নারী দেখলে আসতাগফিরুল্লাহ পড়ার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে?
ধর্মীয় নির্দেশনা
ইসলামের দৃষ্টিতে শারীরিক ও মানসিক যেকোনো ধরনের সহিংসতাই হারাম। সহিংসতা সৃষ্টি হওয়ার কারণ ও উপকরণগুলো ও হারাম। অশ্লীলতা হারাম, বেপর্দগী হারাম। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা হারাম। ব্লুফ্লিম, পর্নোগ্রাফি হারাম। নাচ-গান হারাম। অশ্লীল কথা, কাজ প্রচারণা হারাম। যারা ইসলামী সমাজ ও মুসলমানদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়ায় তাদের ঠিকানা জাহান্নাম। এ ধরনের অপকর্ম ও হারাম কাজে যারা লিপ্ত হয় তাদের শাস্তি হলো বেত মারা, জরিমানা করা, জেলে দেওয়া। এছাড়াও যেমন অপরাধ তেমন প্রতিরোধের ব্যবস্থা ও ইসলাম রেখেছে। অপরাধ প্রমাণে ইসলাম দোষ স্বীকার, শপথদান, দুই হতে ৪জন পর্যন্ত সাক্ষীর বিধান রেখেছে।
ইসলাম নারীর প্রতি সহিংসতা কেনা জায়েজ ও হারাম ঘোষণা করে সহিংস আচরণকারীদের শাস্তির বিধানও দিয়েছে। অপরাধ যেমন শাস্তি ও তেমন। জরিমানা করা, বেতমারা, জেলে দেওয়া, এমন কী অবস্থাভেদে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত বিধান রেখেছে।
আল্লাহ বলেন,
- আল্লাহর একনিদর্শন এই তিনি তোমাদের থেকে তোমাদের জোড়াসৃষ্টি করেছেন যেন তোমরা শান্তি পাও। আর তিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মধ্যে দয়া ও ভালবাসা।
- নারীদের অংশ অধিকার আছে মাতা-পিতার রেখে যাওয়া সম্পদে।
- নারীদের মোহরানা তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে আদায় করে দাও। আল্লাহ তোমাদের যা দিয়েছেন তার থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী স্ত্রীদের জন্য ব্যয় কর।
- আল্লাহ তোমাদের অশ্লীল ও অন্যায় কাজে বারণ করছেন।
- হে রাসূল, আপনি বলুন আমার রব গোপন ও প্রকাশ্য অশ্লীলতাকে হারাম করেছেন।
- তোমরা যিনার কাছেও যেয়ো না।
প্রিয়নবী (সা.) বলেন,
- কোনো স্থানে একজন পুরুষ ও নারী থাকলে সেখানে ৩য়জন শয়তান থাকে।
- দুইস্ত্রীর মাঝে সমতাবিধান না করলে কিয়ামতের দিন স্বামীর গালের একপাশ ঝুলতে থাকবে।
- তাদের (স্ত্রী)-কে পোশাক ও খাদ্যদান করা তোমাদের দায়িত্ব।
- দয়ূসগণ (অর্থাৎ যারা নারীদের বেপর্দা চালায়) বেহেস্তে প্রবেশ করবে না।
- হাতের যিনা, মুখের যিনা ও চোখের যিনার পর মানুষ আসল যিনায় লিপ্ত হয়।
- যে নারী-পুরুষের বেশ ধারণ করে তার ওপর আল্লাহর লানত।
- তোমরা ধন-লালসায় তাদের ব্যভিচারে বাধ্য করিও না।