জামেয়া ওয়েবসাইট

সোমবার-৯ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-১৪ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুহাদ্দিস মাওলানা ছৈয়দ আকবর (রহ.): জীবন ও অবদান

মুহাদ্দিস মাওলানা ছৈয়দ আকবর (রহ.): জীবন অবদান

হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর

 

আমাদের শোকার্ত আর্তনাদ যেন থামছেই না! দিনদিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে অভিভাবকতুল্য মুরব্বিদের চিরবিদায়ের মিছিল। অনেক দরদি অভিভাবকদের ছায়া-মায়া থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ছি আমরা। আল্লাহ তাআলা বুযুর্গ বান্দাহদের একে একে নিয়ে যাচ্ছেন। আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চিরতরে চলে গেলেন আমাদের অত্যন্ত দরদি অভিভাবক, বিদগ্ধ মুহাদ্দিস, মাওলানা ছৈয়দ আকবর (রহ.)। কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী দীনী শিক্ষাকেন্দ্র রামু চাকমারকুল জামিয়া দারুল উলুমের প্রবীণ মুহাদ্দিস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি রামু উপজেলার উপদেষ্টা, চাকমারকুল ইসলামী ঐক্য পরিষদের প্রধান অভিভাবক, কীর্তিমান এ আলেমে দীন গত ২০ আগস্ট (বৃহস্পতিবার), বাদ মাগরিব ৬ টা ৫০ মিনিটে চাকমারকুল আলী হুসাইন সিকদার পাড়ার নিজ বাড়িতে ইন্তিকাল করেন ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৭১ বছর। তিনি স্ত্রী, ২ ছেলে, ২ মেয়েসহ অসংখ্য ছাত্র-ভক্ত ও গুণগ্রাহী রেখে যান।

উস্তাযুল আসাতিযা মাওলানা ছৈয়দ আকবর হুযুর (রহ.)-এর ইন্তিকালে জেলাজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। হুযুরকে শেষবারের মতো একনজর দেখতে এবং নামাযে জানাযায় শরীক হতে নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন বিশিষ্ট আলেম-ওলামা, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ, মরহুমের ছাত্র-ভক্তসহ অসংখ্য মানুষ। ২১ আগস্ট (জুমাবার) সকাল সাড়ে ১০ টায় মরহুমের দীর্ঘ কর্মজীবনের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যবাহী দীনী শিক্ষাকেন্দ্র রামু চাকমারকুল জামিয়া দারুল উলুমের মাঠে নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। বিপুল সংখ্যক শোকার্ত তাওহীদী জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত বিশাল নামাযে জানাযায় ইমামতি করেন মরহুমের বড় ছেলে বিশিষ্ট আলিম মাওলানা মুহাম্মদ ছৈয়দ আরমান।

জানাযার পূর্বে সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন, কক্সবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ সাইমুম সরওয়ার কমল, রামু জোয়ারিয়ানালা ইমদাদুল উলুম মাদরাসার নায়েবে মুহতামিম মাওলানা হাফেজ আবদুল হক, মরহুমের বিশিষ্ট ছাত্র বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির যুগ্ম-মহাসচিব ও কক্সবাজার জেলা আমীর মাওলানা হাফেজ ছালামতুল্লাহ, চাকমারকুল মাদরাসার প্রবীণ শিক্ষক মাওলানা মুফতি ফিরোজ আহমদ, জেলা হেফাজতে ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা ইয়াছিন হাবিব, কক্সবাজার জেলা পরিষদ সদস্য নুরুল হক কোম্পাফন, চাকমারকুল ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম সিকদার, চাকমারকুলের সাবেক চেয়ারম্যান মুফিদুল আলম, মরহুমের ভাতিজা ইউপি সদস্য মোস্তাক আহমদ, মরহুমের ছেলে ও রামু লেখক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আহমদ ছৈয়দ ফরমান, ইসলামী ছাত্রসমাজ নেতা হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর ও চাকমারকুল ইসলামী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মাওলানা হুমায়ুন কবির প্রমুখ।

সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ পর্ব সঞ্চালনা ও সমন্বয় করেন চাকমারকুল মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা আবদুর রাজ্জাক, মরহুমের একান্ত ছাত্র চাকমারকুল ইসলামী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা হাফেজ দেলোয়ার হুসাইন।

নামাযে জানাযা শেষে চাকমারকুল আলী হুসাইন সিকদার পাড়া কবরস্থানে মরহুমকে দাফন করা হয়। ৭১ বছরের জাগ্রত এ মনীষী আজ মাটির কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত। তিনি আমাদের মাঝে থেকে চিরবিদায় নিয়ে গিয়েছেন, তবে রেখে গিয়েছেন দীর্ঘ জীবনের বহু কীর্তি ও অবদান। এ রকম গুণীজনদের জীবন-কর্ম আমাদের আদর্শিক পথচলায় প্রেরণার সঞ্চার করে। আমি ২০১৬ সালের শেষ দিকে প্রবীণ এ আলেমে দীনের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহের নিমিত্তে তাঁর সাথে এক সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হই। তিনি আমাকে চাকমারকুল মাদরাসার সাবেক শায়খুল হাদীস মাওলানা মুহাম্মদ শফী (রহ.)-এর (বোনের ঘরের) নাতি হিসেবে খুবই স্নেহ করতেন। সেই সাথে আকাবিরে দেওবন্দের হাতে গড়া সংগঠন নেজামে ইসলাম পার্টি ও ইসলামী ছাত্রসমাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণেও আমাকে অধিক মুহাব্বত করতেন। এছাড়াও আমি যেহেতু হুযুরের অভিভাবকত্বে দীর্ঘকাল ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসা রামু কলঘর বাজারের ঐতিহাসিক ইসলামি মহাসম্মেলনে প্রতিবছর সঞ্চালনার দায়িত্ব থাকি সে সুবাদে বরেণ্য এ আলেমে দীনের সাথে সম্পর্কের সেতুবন্ধন আরও সুসংহত হয়। ফলে হুযুরের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে গেলে তিনি অতিশয় আনন্দিত হন, গভীর মমতায় কাছে ডেকে বসান, হৃদ্যতাপূর্ণ মেহমানদারি করেন এবং আমার প্রশ্নাবলির আলোকে নিজের জীবনের নানাপর্বের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত প্রদান করেন। সেদিন হুযুরের কাছ থেকে সরাসরি প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তাঁর জীবন-কর্ম ও অবদানের ওপর লেখাটি রচনা করি।

মাওলানা ছৈয়দ আকবর (রহ.) একজন বিজ্ঞ মুহাদ্দিস, আদর্শ শিক্ষক, বিপ্লবী সমাজ সংস্কারক ও যোগ্য অভিভাবকের নাম। তিনি সুন্নাতে নাওয়াবী (সা.)-এর প্রতি অতীব যত্নবান, আকিবেরে দেওবন্দের বাস্তব প্রতিচ্ছবি একজন প্রাজ্ঞ আলেমে দীন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ইলমে দীন চর্চা, দীনী দাওয়াতের প্রসার ও সমাজশুদ্ধির মিশনে নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সাথে আত্মনিবেদিত ছিলেন। তিনি সর্বমোট ৪৫ বছরের কর্মজীবনে সুদীর্ঘ ৪০ বছর কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী দীনী শিক্ষাকেন্দ্র জামিয়া দারুল উলুম চাকমারকুলের মুহাদ্দিস হিসেবে দরসে হাদীসের মসনদে অতিবাহিত করেন।

জন্ম

মাওলানা ছৈয়দ আকবর (রহ.) ১৯৪৯ সালে রামু উপজেলার চাকমারকুল ইউনিয়নের আলী হুসাইন সিকদার পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা: মরহুম বদিউর রহমান, মাতা: মরহুমা আমীর খাতুন। ৬ ভাই, ২ বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়।

দীনী শিক্ষা অর্জন

ছোটবেলা থেকেই দীনী শিক্ষা অর্জনে হযরতের প্রবল আগ্রহ ছিল। বাবা ভর্তি করিয়ে দিলেন ঐতিহ্যবাহী চাকমারকুল মাদরাসায়। সেখানে তিনি বিজ্ঞ উস্তাদগণের তত্ত্বাবধানে জামায়াতে নাহুম পর্যন্ত পড়া-লেখা করেন। এ শিক্ষায়তনে তখনকার পরিচালক মাওলানা নুরুল হক (রহ.), মুহাদ্দিস মাওলানা ছৈয়দ আহমদ (রহ.)সহ বরেণ্য বুযুর্গানে দীনের ছাত্রত্ব লাভ ও সান্নিধ্য গ্রহণে তিনি জীবনের প্রথম থেকেই পরম সৌভাগ্যের অধিকারী হন। জামায়াতে হাস্তুম থেকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত দীর্ঘকাল তিনি আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ায় কৃতিত্বের সাথে পড়া-শোনা করেন। অবশ্য ১৯৭১ সালে তিনি জামিয়া আরবিয়া ইসলামিয়া জিরিতে জামায়াতে কামিলাইন অধ্যয়ন করেন। সেই সুবাদে জিরির তৎকালীন পরিচালক প্রখ্যাত বুযুর্গ মাওলানা মুফতি নুরুল হক (রহ.) ও মাওলানা ওয়াহিদ (রহ.)-এর ছাত্রত্ব লাভের সুযোগ পান। জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত বহু আধ্যাত্মিক মনীষী ও ওলামা-মশায়েখের কাছ থেকে উচ্চতর ইলমে দীন হাসিল করেন। যাঁদের মধ্যে খতীবে আযম আল্লামা সিদ্দিক আহমদ (রহ.), শায়খুল আরব ওয়াল আযম আল্লামা হাজী ইউনুস (রহ.), আল্লামা আমীর হুসাইন (মীর সাহেব হুযুর) (রহ.), আল্লামা মুফতি ইবরাহীম (রহ.), আল্লামা ইসহাক গাজী (রহ.), আল্লামা দানিশ (রহ.), আল্লামা মুফতি আবদুর রহমান (রহ.) সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে রয়েছেন জোয়ারিয়ানালা ইমদাদুল উলুম মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুল্লাহ তাজ, বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মুহাদ্দিস মাওলানা হাফেজ ইমদাদুল হক, মাসিক আত-তাওহীদের সাবেক সম্পাদক মাওলানা হাফেজ আনোয়ার (রহ.), চকরিয়া ইমাম বুখারী মাদরাসার পরিচালক মাওলানা আবদুর রহীম বুখারী (রহ.), চাকমারকুল মাদরাসার সাবেক মুহাদ্দিস মাওলানা আইয়ুব আনসারী (রহ.), পটিয়ার মীর সাহেব হুযুরের ছেলে মাওলানা হাফেজ কাসেম (রহ.), রাজারকুল আজিজুল উলুম মাদরাসার মরহুম সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা আবদুস সালাম কদীম (রহ.), রামু ইসলামি সম্মেলন পরিষদের সাবেক সহ-সভাপতি মাওলানা নুরুল ইসলাম (রহ.), রাজারকুল সিকদার পাড়ার মাওলানা ছলিমউল্লাহ মনসুরী (রহ.), অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মাওলানা নুরুল হক ও মাওলানা মোখতার আহমদ প্রমুখ।

দীনী শিক্ষাদানের খেদমত

প্রাতিষ্ঠানিক লেখা-পড়া সমাপ্তির পর তিনি কুতুবে জামান আল্লাম মুফতি আজিজুল হক (রহ.)-এর সাহেবজাদা মাওলানা হাফেজ মাহবুবুর রহমান (রহ.) পরিচালিত দোহাজারী আজিজুল উলুম মাদরাসায় দীনী শিক্ষার খেদমতে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে কর্ম-জীবনের সূচনা করেন। সেখানে দুই বছর শিক্ষকতার খেদমত আনজাম দেওয়ার পর রুহানি মুরব্বিগণের পরামর্শে কক্সবাজারের প্রাচীন দীনী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান চাকমারকুল দারুল উলুম মাদরাসায় যোগদান করেন। এই ঐতিহ্যবাহী দীনী শিক্ষায়তনে তিনি সুনামের সাথে তাফসীরে জালালাইন ও মুসলিম শরীফসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদির দরস দান করেন। এছাড়াও এ প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত মুহতামিম, শিক্ষা-পরিচালক, ছাত্রাবাস তত্ত্বাবধায়ক ও কোষাধ্যক্ষ পদেও তিনি বিভিন্ন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। শারিরীক অসুস্থতা সত্ত্বেও জীবন সায়াহ্নকাল পর্যন্ত সাধ্যের অনুকূলে প্রবীণ এ আলেমে দীন দরসে হাদীসের খেদমতে সম্পৃক্ত ছিলেন।

এখানে উল্লেখ্য যে, আশির দশকের শুরুর দিকে কয়েক বছর তিনি রশিদনগর আশরাফুল উলুম মাদরাসায় শিক্ষকতার খেদমত আনজাম দেন। পরবর্তীতে মুরব্বিদের আগ্রহে তিনি চাকমারকুল মাদরাসায় প্রত্যাবর্তন করেন। এ বিষয়ে ২০ জুন ১৯৮৩ তারিখে হযরতের বড় ভাইতুল্য মুরব্বি মরহুম মাস্টার তাজুল মুলুক (মাওলানা হাফেজ আবদুল হকসহ সাতজন হাফেজ ও আলেমের পিতা) কর্তৃক খতীবে আযম আল্লামা সিদ্দিক আহমদ (রহ.) সমীপে লিখিত একটি পত্রও আমার হস্তগত হয়েছে। যেখানে পত্র-লেখক বেশ অনুরাগ নিয়ে মাওলানা ছৈয়দ আকবর (রহ.)-কে পুনরায় চাকমারকুল মাদরাসায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে খতীবে আযম (রহ.)-এর সহযোগিতা চেয়েছিলেন। কারণ তিনি আশাবাদী ছিলেন, মাওলানা ছৈয়দ আকবর (রহ.) খতীবে আযম (রহ.)-এর একান্ত ছাত্র হিসেবে তাঁর কথা রাখবেন। হয়েছেও তাই। কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় তিনি এ দীনী শিক্ষা কেন্দ্রে উৎসর্গ করেছেন।

হযরতের বহু ছাত্র-শিষ্য দেশ-বিদেশে বিভিন্ন অঙ্গনে ইসলাম ও জাতির সেবায় নিবেদিত রয়েছেন। অনেকে কবরবাসীও হয়েছেন। মরহুমের ছাত্রদের মধ্যে চাকমারকুল মাদরাসার সাবেক নির্বাহী পরিচালক মাওলানা ইবাদুল্লাহ (রহ.), ফেনী মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা হাফেজ জুনাইদ, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা আবদুল মাজেদ আতহারী, দৈনিক ইনকিলাবের কক্সবাজার আঞ্চলিক প্রধান শামসুল হক শারেক, চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামিক ইউনিভার্সিটি ট্রাস্টি বোর্ডের অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি প্রফেসর কাজী দীন মুহাম্মদ, বাংলাদেশ নেজাম ইসলাম পার্টির যুগ্ম-মহাসচিব ও কক্সবাজার জেলা আমীর মাওলানা হাফেজ ছালামতুল্লাহ, চাকমারকুল মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা মুফতি কামাল হুসাইন, কক্সবাজার হাশিমিয়া কামিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ মাওলানা আজিজুল হক, রামু মাজহারুল উলুম মাদরাসার পরিচালক মাওলানা মুহাম্মদ হারুন, লেখক ও গবেষক মাওলানা আ. হ. ম. নুরুল কবির হিলালী, চাকমারকুল দারুল উলুম মাদরাসার বর্তমান নির্বাহী পরিচালক মাওলানা সিরাজুল ইসলাম সিকদার, শিক্ষক মাওলানা ছৈয়দ আহমদ, ধাওনখালীর মাওলানা আতাউল্লাহ, উম্মাহাতুল মুমিনীন (রাযি.) বালিকা মাদরাসার পরিচালক মাওলানা আবদুর রাজ্জাক, হুফফাযুল কুরআন ফাউন্ডেশন কক্সবাজার জেলা সভাপতি ও চাকমারকুল ইসলামী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা হাফেজ দেলোয়ার হুসাইন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

পারিবারিক জীবন

পারিবারিক জীবনে তিনি একজন আদর্শ পিতা ও সফল অভিভাবক। তিনি ১৯৭৪ সালে দক্ষিণ মিঠাছড়ি উমখালী নিবাসী মাওলানা রশিদ আহমদ (রহ.)-এর মেয়ে ও উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দীন মাওলানা মুহাম্মদ রামুভীর প্রপৌত্রি রাজিয়া বেগমের সাথে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি দুই ছেলে ও দুই মেয়েসহ চার সন্তানের জনক। বড় ছেলে মাওলানা মুহাম্মদ ছৈয়দ আরমান দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে দাওরায়ে হাদীস ডিগ্রি লাভ করেন। অপর ছেলে রামু লেখক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আহমদ ছৈয়দ ফরমান একজন সুশিক্ষিত তরুণ, মাদরাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি জনকল্যাণে লেখা-লেখি ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত রয়েছেন।

ইসলামি রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা

মাওলানা ছৈয়দ আকবর (রহ.) সরাসরি পদবিধারী না হলেও ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি সচেতন। বিশেষত নিজের উস্তাদ খতীবে আযম আল্লামা সিদ্দিক আহমদ (রহ.)-এর মত দার্শনিক আলিম ও রাজনীতিবিদ ওলামা-মশায়েখের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তিনি অনুপ্রাণিত। দীন ও জাতির প্রয়োজনে শিক্ষক ও রুহানি মুরব্বিগণের নির্দেশনায় ছাত্রজীবন থেকে যেকোন কর্মসূচিতে তিনি রাজপথে নেমে আসতেন। তিনি বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির চাকমারকুল ইউনিয়ন শাখার সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। শেষ জীবনে তিনি নেজামে ইসলাম পার্টি রামু উপজেলার উপদেষ্টা হিসেবে মুরব্বিয়ানা করেন।

সমাজশুদ্ধির খেদমত

তরুণ বয়স থেকেই মাওলানা ছৈয়দ আকবর (রহ.) ছিলেন উদ্যমী, সাহসী ও সমাজ সংস্কারে প্রত্যয়ী। শিরক-বিদআতসহ যাবতীয় কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতি নির্মূলে তিনি ছিলেন একজন নির্ভীক সিপাহসালার। আদর্শ সমাজ গড়ার লক্ষ্যে তরুণ যুবকদের সু-পথে সংগঠিত করার প্রয়াসে ১৯৮০ সালে তিনি গড়ে তুলেন পশ্চিম চাকমারকুল দারুল উলুম ইসলামী তরুণ সংস্থা নামে একটি সামাজিক সংগঠন। ১ নভেম্বর ১৯৮০ তারিখে সে সমাজ সেবামূলক সংগঠনটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিবন্ধন লাভ করে। ১৯৮৬ সালে এলাকার কিছু যুবক যাত্রা গানের আয়োজনে উদ্যোগী হলে হুযুর তাদের সুন্দর নসীহতের মাধ্যমে তা থেকে বিরত রাখেন এবং এর পরিবর্তে একটি মাহফিল আয়োজনে উদ্ধুদ্ধ করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কলঘর বাজার প্রতিষ্ঠালগ্নে ইসলামী যুবসমাজের ব্যানারে সর্বপ্রথম ইসলামি সম্মেলন আয়োজন করেন। বর্তমানে দুই দিনব্যাপী ঐতিহাসিক ইসলামি মহাসম্মেলন হুযুরের ইখলাসপূর্ণ প্রচেষ্টার সুফল। কলঘর বাজার ইসলামী সম্মেলন কমিটির ব্যানারে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসা এ ইসলামি মহাসম্মেলন ৮/১০ বছর ধরে চাকমারকুল ইসলামী ঐক্য পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে হুযুর এ ইসলামি মহাসম্মেলনের প্রধান অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। তিনি ছিলেন চাকমারকুল ইসলামী ঐক্য পরিষদের প্রধান মুরব্বি।

মাওলানা ছৈয়দ আকবর (রহ.)-এর সার্বিক অভিভাবকত্বে অনুষ্ঠিত হয়ে আসা এ ইসলামি সম্মেলন যে সকল দেশবরেণ্য ওলামা-মশায়েখের আগমনে ধন্য হয়েছে তাঁদের মধ্যে রয়েছেন, আল্লামা হাবিবুল্লাহ মিসবাহ (রহ.), আল্লামা হারুন ইসলামাবাদী (রহ.), আল্লামা নুরুল ইসলাম অলিপুরী, আল্লামা শাহ মুহাম্মদ তৈয়ব (রহ.), আল্লামা মুফতি আবদুল হালিম বুখারী, আল্লামা শাহ মুহাম্মদ আইয়ুব (রহ.), মাওলানা জামাল উদ্দিন গাজী (রহ.), ড. আ. ফ. ম. খালিদ হোসেন, মাওলানা আশরাফ আলী গাজী, মাওলানা রুহুল আমিন খান (খুলনা), মাওলানা আজিজুল হক আল-মাদানী, মাওলানা জুনাইদ আল-হাবিব, মাওলানা ওমর ফারুক সন্দ্বীপী, মাওলানা হাফেজ জাহেদ উল্লাহ (সাহবেজাদা, হাজী সাহেব হুযুর রহ.), মাওলানা হাফেজ আবদুল হক, মাওলানা ছৈয়দ আলম আরমানী, মাওলানা ওবাইদুল্লাহ হামযা, মাওলানা খোরশেদ আলম কাসেমী, মাওলানা আবদুল বাসেত খান সিরাজী, মাওলানা ফরিদ উদ্দিন আল-মুবারক ও মাওলানা কাজী আখতার হুসাইন প্রমুখ। যে সকল বিদগ্ধ ওলামায়ে কেরাম ঐতিহ্যবাহী ইসলামি সম্মেলনে সভাপতিত্ব করে স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁদের মধ্যে শায়খুল হাদীস মাওলানা শাহ আখতার কামাল (রহ.), মাওলানা মুহাম্মদ সুলাইমান (রহ.), মুহাদ্দিস মাওলানা মুহাম্মদ শফী (রহ.), মাওলানা হুসাইন আহমদ (রহ.), মাওলানা আমান উল্লাহ সিকদার (রহ.), মুহাদ্দিস মাওলানা জাকের আহমদ (রহ.), মাওলানা নুরুল ইসলাম (রহ.), মাওলানা আবুল হাসান (রহ.) ও মাওলানা ইবাদুল্লাহ (রহ.) অন্যতম।

মাওলানা ছৈয়দ আকবর (রহ.) রামু ইসলামী সম্মেলন পরিষদের উদ্যোগে ঐতিহ্যবাহী ইসলামি সম্মেলনের সূচনা ও পরিচালনায়ও তিনি একনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। দীনী ও সামাজিক অঙ্গনে হুযুরের এরকম নিষ্ঠাপূর্ণ বহু অবদান রয়েছে। যা হুযুরের কীর্তিময় অবদান হিসেবে ইতিহাসের পাতায় চির অম্লান হয়ে থাকবে। আমরা দু’আ করি আল্লাহ তাআলা মরহুম বিদগ্ধ এ মুহাদ্দিসকে জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চ মকাম নসীব করুন। আর বর্তমানে জীবিত বুযুর্গ মুরব্বিদের ছায়া আমাদের ওপর উত্তরোত্তর দীর্ঘায়িত করুন। আমিন।

যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, কক্সবাজার ইসলামী সাহিত্য গবেষণা পরিষদ

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ