মাদকবিরোধী যুদ্ধ
২০১৮ সালে যখন ‘মাদক বিরোধী যুদ্ধ’ শুরু হয় জনগণের মাঝে আশার সঞ্চার হয়েছিল। তাদের প্রত্যাশা ছিল যে, মাদক চোরাচালান, পরিবহণ ও বিপণন একেবারে বন্ধ না হলেও সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে এবং মাদক কারবারি ও গডফাদারগণ বিদ্যমান আইনের আওতায় বিচারের সম্মুখীন হবে। ইতোমধ্যে বিপুল সংখ্যক ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে এবং বিপুলসংখ্যক মাদক কারবারি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতারও হয়েছে। কিন্তু ইয়াবা ব্যবসা নির্মূল করা যায়নি। বাহক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা কারবারি ধরা পড়লেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত গডফাদার ও সিন্ডিকেট সদস্যগণ রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এতে বোঝায় যায় মাদকসংশ্লিষ্ট রাঘব বোয়ালরা কত শক্তিশালী।
বিগত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে পেশাজীবী এবং নানা বয়সি মানুষ বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে ‘ইয়াবা’ আসক্তি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন মতে, ২০১৭ সালে বিভিন্ন সংস্থা উদ্ধারই করেছে ৪কোটি ইয়াবা, যা ২০১৫ সালের দ্বিগুণ। এ থেকেই ইয়াবাসেবীদের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই ১৪ মাসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও কোস্ট গার্ড মিলে উদ্ধার করেছে তিন কোটি ৫৩ লাখ ২৫ হাজার ৬১০ পিস ইয়াবা। জানা গেছে, মিয়ানমারে প্রতি পিস ইয়াবার দাম পড়ে গড়ে ৩০ টাকা। এই হিসেবে উদ্ধার হওয়া ও উদ্ধারের বাইরে থাকা সব মিলিয়ে ৩০ কোটি ইয়াবার মূল্য বাবদ ৯০০ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে মিয়ানমারে (ডয়চে ভেলে, ১৯ জুন ২০১৮; কালের কণ্ঠ, ২৬ আগস্ট ২০২০)
মাদকবিরোধী যুদ্ধাভিযান শুরুর পরপরই দেখা গেল মিয়ানমার-কক্সবাজার সীমান্তে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘এনকাউন্টার’ বেড়ে গেল আশংকাজনক হারে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ১৫ মে থেকে ২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট পর্যন্ত মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ৪২৪ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত ১১৯ জন, পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ২১৫ জন, গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৪৮ জন, বিজিবি ও র্যাবের যৌথ অভিযানে ৩ জন এবং বিজিবি’র সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৩৯ জন নিহত হয়। এর বাইরে ৩২ জনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বিবিসির মতে মাদকবিরোধী যুদ্ধে প্রতিদিন একজন করে মানুষ ক্রসফায়ারে মারা যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর গুলিবর্ষণের অন্যান্য ঘটনার মতো এই ঘটনাও তদন্ত করা হবে। এটা আমরা সবসময় বলছি, কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বা অন্যায়ভাবে কিছু করে থাকে, তারতো একটা ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল এনকোয়ারি হচ্ছে এবং হবে। সেখানে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তারও বিচার হবে। সেটা আমরা সবসময় বলে আসছি।’
পৃথিবীর কোন দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা চালিয়ে মাদকব্যবসা বন্ধ করা যায়নি। মাদকাসক্তির কবল থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মেক্সিকো, ব্রাজিল ও কলাম্বিয়াসহ এশিয়া এবং ল্যাটিন অ্যামেরিকার বেশ কয়েকটি দেশ ‘ক্রসফায়ার’ সংস্কৃতি চালু করে কিন্তু তাদের সব প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সামাজিক পরিসরে ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়, সরকারের পরিবর্তন ঘটে এমনকি গণতান্ত্রিক ধারবাহিকতা বিনষ্ট হয়। মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে ২০০৩ সালে ‘বন্দুকযুদ্ধ সংস্কৃতি’ চালু করেন থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা। ২,৮১৯ জনের মৃত্যু হয় মাত্র তিন মাসে। থাকসিনের সে অভিযান সফল হয়নি, দেশকে মাদকমুক্ত করতে পারেননি। প্রথম দিকে কিছুটা জনসমর্থন থাকলেও পরবর্তীতে দেশে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য তৈরি হয় এবং সে সুযোগে ২০০৬ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেয়।
২০১৬ সালে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান ঘোষণা করেন। হিউম্যানরাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে জানা যায়, পুলিশ এবং তাদের এজেন্টরা আত্মরক্ষার মিথ্যে অজুহাতে এই হত্যায় অংশ নেয়। ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত মাদকবিরোধী যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ২০ হাজার ৩২২টি। গড়ে প্রতিদিন ৩৯.৪৬ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তা সত্ত্বেও মাদকসমস্যা নির্মূল হয়নি। মেক্সিকো, ব্রাজিল এবং কলাম্বিয়াও বিচার-বহির্ভূত হত্যা চালিয়ে মাদক সমস্যা মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়েছে।
১৯৯০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত কলাম্বিয়ায় মাদক সংশ্লিষ্ট হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা সাড়ে চার লাখ। মেক্সিকোতে ২০১৩ সালে নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার। আর গুম হয়েছেন ২৭ হাজার। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ব্রাজিলে মাদকবিরোধী যুদ্ধের পুলিশের অভিযান মানেই মৃত্যু। সরকারি তথ্য অনুসারে, ২০১৪ সালেই ব্রাজিল পুলিশ ৩ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে।
এসব দেশে মাদকবিরোধী যুদ্ধে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটলেও সফলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ জাতিসংঘ। বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক সংস্থার প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ সালে অন্তত একবার মাদক গ্রহণ করেছেন এমন মানুষের সংখ্যা ২৫ কোটি। এদের মধ্যে প্রায় তিন কোটি (২৯.৫ মিলিয়ন) মানুষ মাদকসংশ্লিষ্ট রোগে আক্রান্ত (বাংলা ট্রিবিউন, ২৮ মে ২০১৮)।
বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা আমাদেরই ভাই ও সন্তান। জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তৎকালীন ইপিআর ও পুলিশ বুকের রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। সীমান্ত রক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, চোরাকারবার, মাদক পাচার, অপরাধ ও সন্ত্রাস নির্মূলে তাঁদের ভূমিকা গৌরবোজ্জ্বল। সাম্প্রতিক করোনা পরিস্থিতিতে পুলিশ সদস্যরা আর্তমানবতার সেবায় যে অবদান রেখেছেন তা গর্ব করার মত। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদেরকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে গড়ে তোলার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ বাহিনীর মধ্যে বিপুল সদস্য আছেন সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন। সড়কে দায়িত্ব-পালনকারী পুলিশের একহাতে লাঠি অপরহাতে তাসবিহ দেখা যায় তখন মানুষ আশাবাদী হয়ে ওঠে।
সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে পুলিশ বাহিনীর সংস্কার নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এরপর এটা ধামাচাপা পড়ে যায়। সংস্কার সময়ের দাবি। পুরনো আইন ও বিধি বেশি দিন চলতে পারে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কমবেশি প্রতিটি সরকারের আমলে রাজনৈতিক ও দলীয় স্বার্থে পুলিশের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বিরোধী দলের কর্মি-নেতাদের দমনে পুলিশের ব্যবহারের ফলে পেশাদারিত্বের অপরিহার্য গুণ লোপ পেতে থাকে ধীরে ধীরে। ফলে পুলিশ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’ এই ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে হবে। র্যাব বা পুলিশ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা নয়, তাঁরা আমাদের সমাজের অংশ। সমাজকে পরিশুদ্ধ করা না গেলে, তাঁদের কাছ থেকে শতভাগ শুদ্ধাচার আশা করা যায় না। ব্যক্তি বিশেষের অপরাধ ব্যক্তির অপরাধ হিসেবে গণ্য করা উচিৎ। এর জন্য নির্দিষ্ট বাহিনী বা সংস্থা দায়ী হতে পারে না।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ বছরে ১ লাখ ২০ হাজার ১৯১টি ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারা সবাই কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার। মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ঘুষ, নানাভাবে হয়রানি, বিয়ের পর স্ত্রীকে ভরণ-পোষণ না দেওয়া ও যৌতুকের জন্য নির্যাতন, ভুক্তভোগীর মামলা দায়েরের পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়া, জমিজমা-সংক্রান্তসহ নানা অভিযোগে তাদের বিভাগীয় শাস্তি দেওয়া হয়। ২০১৭ সালে ১৪ হাজার ৬৫৮ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ১১ হাজার সদস্যই কনস্টেবল থেকে সাব ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার। এই বছর এএসপি থেকে তদূর্ধ্ব মাত্র ৮ কর্মকর্তাকে লঘুদণ্ড (তিরস্কার, দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি) দেওয়া হয়েছে। ২০১৭ সালে এএসপি থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের কেউ গুরুদণ্ড পাননি। ২০১৬ সালে এএসপি থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে দুইজনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে একজনকে লঘুদণ্ড, অন্যজনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। এই গুরুদণ্ড পাওয়া ব্যক্তি হলেন স্ত্রী মিতু খুন হওয়ার ঘটনায় আলোচিত এসপি বাবুল আক্তার (বাংলা ট্রিবিউন, ঢাকা, ৭ অক্টোবর ২০১৯)।
প্রয়োজনে সিভিল ও ফৌজদারি দণ্ডবিধি, ও আইনের ধারা সংশোধন করে বিচার-ব্যবস্থাকে সহজলভ্য করা একান্ত দরকার। আইন কমিশন গঠন করে বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকা বা রাখার যে নিয়ম চালু হয়েছে তা ভাঙতে হবে। বিচার-বহির্ভূত হত্যা বন্ধ করা না গেলে আইনের শাসন ভেঙ্গে পড়বে এবং বিচারব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে। সব নাগরিকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তার অধিকার রক্ষায় সহযোগিতা করতে পুলিশের বাধ্যবাদকতা রয়েছে। দেশের প্রতিটি নাগরিকের বিচারপ্রার্থী হওয়ার এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ না থাকলে উন্নয়নের চাকা আটকে যাবে।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন