পারিবারিক বন্ধন: একাল ও সেকাল
মাহমুদুল হক আনসারী
পারিবারিক বন্ধন একাল ও সেকাল সে অনেক কথা। পরিবার ছাড়া সমাজ হয় না। সমাজ ছাড়া রাষ্ট্র চলে না। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্মিলিত একটি শক্তির নাম। পারিবারিক বন্ধন আবহমানকাল থেকে ছিল। এখনও আছে, তবে ইদানিং সমাজে পারিবারিক বন্ধন অনেকটা ছোট-খাটো ঘটনায় ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ছে। মাতা-পিতা, ভাই-বোন, অপরাপর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সেকালে মধুর পারিবারিক বন্ধন ছিল। একত্রে একচালে ছাউনিতে বসবাস ছিলো।
এককভাবে রান্নাবান্না হতো, একসাথে পারিবারিক কাজকর্ম, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিয়ে-শাদি, পারিবারিক অনুষ্ঠানাদি সম্মিলিতভাবে তখন ছিলো। সে ছিল এক পারিবারিক আনন্দ ও সুখ শান্তির কেন্দ্রবিন্দু। ভাই ভাই বোনে বোনে, চাচাতো, জেঠাতো, ফুফাতো, খালাতো, মামাতো ভাই বোনদের এক আনন্দময় পরিবেশ দেখা যেতো। একে অপরের অনুষ্ঠানে যাতায়াত ছিলো বিনা শর্তে। সুখে-দুঃখে, অসুখ-বিসুখে আত্মীয়তার বন্ধনে পারিবারিক দায়িত্বে সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণ ছিলো।
সামাজিক, পারিবারিক সাংঘর্ষিক সমস্যার সমাধান হতো পারিবারিক ও সামাজিকভাবে। ছোট-খাটো সংগঠিত অপরাধ সমাধান মহল্লায় সমাজে পারিবারিক বৈঠকে সমাধান মিলতো। ছোট-খাটো এলাকাভিত্তিক সমস্যার জন্য ইউপি পরিষদে যেতে হতো না। এখনকার মতো তখন ইউনিয়ন পরিষদে স্থানীয় এলাকার এতো মামলার জট হতো না। এখন ইউপি আদালতে মুরগি চুরি থেকে শুরু করে জমি-জমা বাড়ি-ভিটা মারামারি নানা প্রকারের মামলার স্তুপ দেখা যায়।
এসব মামলা কারণে-অকারণে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় হয়ে যাচ্ছে। এগুলোর পেছনে কতিপয় স্থানীয় দুষ্টচক্রের হাত দেখা যায়। ওরা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ভিন্নভিন্ন আঙ্গিকে সমাজের বিভিন্ন পরিবারে হাত ঢুকিয়ে পারিবারিক শান্তিকে অস্থির করে দেয়। তারা উৎপেতে থাকে কখন কার পরিবারে কিভাবে চক্রান্তের জাল বিস্তার করা যায়। সুযোগ বুঝে ওই চক্র পরিবার-সমাজে অশান্তির দাবানল জ্বালিয়ে দেয়। তখন সে আগুন পরিবার থেকে মহল্লা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সমাজে সমাজে অস্থিরতা, মামলা আর মোকদ্দমায় জড়িয়ে যায় সমাজ ও রাষ্ট্র। শুরু হয় পারিবারিক ও সামাজিক অশান্তি আর অস্থিরতা।
মামলা হয়ে যায় ইউপি পরিষদে, পারিবারিক আদালতে এবং শেষ পর্যন্ত কোর্টে পর্যন্ত গড়ায়। এভাবে পারিবারিক বন্ধন ক্রমেই বিলুপ্ত হচ্ছে। পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত এ প্রবণতা আজকের সমাজে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক হৃদতা, আন্তরিকতা, ভালবাসা ক্রমেই হ্রাস হচ্ছে। এখনকার সমাজে পারিবারিক ছোট-খাটো সমস্যা থেকে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
যেমন- স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-সন্তান, মা-বাবা ইত্যাদির মধ্যে সামাজিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতায় সমাজ একপ্রকার অন্ধকার যুগের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সমাজ যতো নানাভাবে উন্নতি অগ্রগতি হচ্ছে বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সে তুলনায় পক্ষান্তরে পারিবারিক অস্থিরতায় সমাজ ও পরিবেশ ভারি হচ্ছে। ইলেক্ট্রনিক্স ও প্রিন্টমিডিয়া সাম্প্রতিক সময় প্রকাশিত অনেকগুলো প্রতিবেদনে এসব চিত্র উঠে আসছে। পারিবারিক বন্ধন ছোট হচ্ছে, পরিবার ভেঙে-ছুড়ে ছারখার হচ্ছে। কয়েকজন ছেলে সন্তানের গোছালো সংসার পর্যন্ত এখন ছোটখাটো তুচ্ছ ঘটনায় কথায় কথায় ভেঙে যাচ্ছে।
পারিবারিক আদালত, সামাজিক মানবাধিকার সংস্থা, লিগ্যাল এইড কমিটির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে পারিবারিক-সাংসারিক জীবন তুচ্ছ ঘটনায় ভেঙে যাচ্ছে। যা মানবিক এসব সংগঠনও রক্ষা করতে পারছে না। চট্টগ্রাম জেলা মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মুখলিসুর রহমান ফরহাদি বলেন, প্রতি মাসে কম করে হলেও বিশটির অধিক পারিবারিক, সাংসারিক নারীঘটিত মামলা তাদের হাতে আসে। এসব মামলায় বেশিরভাগ অভিযোগ আসে স্ত্রীর পক্ষ হতে। নারী নির্যাতন, ভরণপোষণ, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব অবহেলা ও শারিরীক মানসিক নির্যাতন সংক্রান্ত মামলার আধিক্য বেশি।
এসব মামলায় পরিবারকে জোড়া লাগানো খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে। অনেক সময় বেশিরভাগ মামলায় বিচার বিবেচনায় সংসার ভেঙে যায়। তিনি বলেন, এখানে দেখা যায় অনেকের একজন দুইজন সন্তানাদিও থাকে। তবুও তাদের সংসার রক্ষা করা আমাদের পক্ষ থেকে আপ্রাণ চেষ্টা থাকার পরও পারা যায় না। তাহলে তার বক্তব্য মতে, এ জাতীয় অনেকগুলো মামলা নারী পক্ষ হতে বিভিন্ন লিগ্যাল এইড সংস্থার কাছে সমাধানের জন্য শরণাপন্ন হয়।
শুধু একটি সংস্থা নয় বাংলাদেশে অসংখ্য এ ধরনের সংস্থা রয়েছে যারা পারিবারিক সামাজিক মামলাগুলো দেখাশোনা করে থাকে। কিন্তু কমসংখ্যক মামলার সমাধানে পরিবারকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। অসংখ্য-অগণিত পারিবারিক বিচার প্রক্রিয়ায় সংসার রক্ষা করা যায় না। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সেকালের যৌথপরিবার সংসার সমাজের জন্য অনেকাংশে কল্যাণকর ছিল। এখন মানুষ গ্রাম থেকে শহরমুখী হয়েছে নানাভাবে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সেখানে শহর জীবনে ছোট পরিবারে অশান্তি আর বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি আশঙ্কাজনক। বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রী দুইজন চাকরিজীবী হলে সেখানে সমস্যা আরো প্রকট। আবার তাদের ঘরে আসা ছেলে-সন্তানদের ভরণ-পোষণ লেখাপড়া, এই স্কুল ওই স্কুলে ভর্তি নানাবিদ চাহিদার কারণে সাংসারিক শান্তিপূর্ণ জীবনে নেমে আসে করুণ দুর্ঘটনা।
দেখা যায় স্বামী-স্ত্রী একে অপরের যুক্তি-তর্কে সমন্বয় করতে পারল না, সে জায়গায় ভাঙনের ইস্যু তৈরি হলো। স্ত্রীর চাকরির টাকার ভাগ ভাটোয়ারা নিয়ে স্বামীর সাথে বাক-বিতন্ডা সেটাও একটি সমস্যা। স্ত্রী চাকরি না করলে তার আধুনিক এ সময়ের চাহিদা পূরণ করতে শহুরে পরিবেশে খাপ খেয়ে চলতে ও চলাতে ব্যার্থ হলে সেখানেও স্ত্রীর সাথে স্বামীর ঝগড়া-ঝাটি লেগেই থাকে।
স্বামী-স্ত্রীর সংসারে শ্বশুর-শশুড়ির বৈধ-অবৈধ হস্তক্ষেপেও অনেকগুলো সাজানো সংসার সেকেন্ডেই চুরমার হচ্ছে। এ চিত্র এখন সমাজে চলমান। অহরহ সংসার ভাঙছে। সিটি কর্পোরেশনের বিয়েবিচ্ছেদ আদালতের বক্তব্য মতে ঘণ্টায় দুটি করে সংসার ভেঙে পড়ছে। এসব সংসারে অনেকের ছেলে সন্তানও আছে। তবুও সংসারগুলো জোড়া লাগানো যায় না। সেখান থেকে অশান্তি-বিশৃঙ্খলা স্বামী-স্ত্রীর কারণে সন্তানরাও আঘাতপ্রাপ্ত। ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের জীবন। আগামী জীবন তাদের জন্য হয়ে উঠে অনিরাপদ ও অনিশ্চয়তায়। পারিবারিক সুখ শান্তি পেতে হলে পরিবার ও সমাজকে অতি লোভ ও লালসা ত্যাগ করতে হবে। সামর্থ্যের মধ্যে খরচ নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে।
অতিচাহিদা নিবারণ করতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন সুখময় শান্তিময় করতে হলে উভয়ের আয় ব্যয় সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আয়ের সাথে মিতব্যয়ী হতে হবে। একে আপরের প্রতি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিষয়গুলো পরিষ্কার রাখতে হবে। অল্পতে তুষ্ট থাকার ইচ্ছা উভয়ের থাকতে হবে। সামর্থ্যের বাইরে পরিকল্পনা ও খরচের খাত কখনো চিন্তা করা উচিত নয়। সমাজকে পরিবার সমাজ রাষ্ট্রকে শৃঙ্খলায় রাখতে অবশ্যই সামাজিক আয় ব্যয় নিরূপণ করে রাষ্ট্র চালাতে হবে। জনগণের আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে চলার মতো পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আসুন সামাজিক শান্তি, পারিবারিক নিরাপত্তায় ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলি।
লেখক: কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক