মহানবী (সা.)-এর মনোবিজ্ঞান
মূল: ডা. মুতিউর রহমান
অনুবাদ: খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ
সৃষ্টিগতভাবে মানুষ কুদরতের এক অপার বিস্ময়। নিপুণতম সৌকর্য। চিন্তা, বোধ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নিজের চারপাশের পরিবেশ থেকে প্রভাব গ্রহণের সহজাত যোগ্যতা আছে তার। ভালো পরিবেশে থাকলে, ভালো নির্দেশনা পেলে সে ভালো কাজের কৃতিত্ব প্রদর্শন করে। সুশিক্ষা থেকে বঞ্চনা, ভুল শিক্ষা, অসৎ সঙ্গ, অনাদরে এবং বলিষ্ঠ আশ্রয়ের ছাউনীর বাইরে যদি বেড়ে ওঠে তবে সে নিজস্ব চিন্তা থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হয়। হয়ে ওঠে বেপরোয়া এবং জড়িয়ে পড়ে নানাবিধ অপরাধে।
পাশ্চাত্যের কিশোর অপরাধীদের কেস স্ট্যাডির পর দেখা দেখে গেছে; তাদের অধিকাংশই সেসব ছেলে যাদেরকে মাতা-পিতা ছোটবেলা থেকেই ছেড়ে চলে গেছে। এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, থাইল্যান্ডে এমন ৩০ হাজার আশ্রয়হীন ছেলে অলিগলিতে দাপিয়ে বেড়ায়; যাদের নিজের ঘর নেই। যারা তাদেরকে নৈতিক মূল্যবোধ, সভ্যতা-ভব্যতা, আদব-কায়দা শেখাবে তারা ওদের ছেড়েই চলে গেছে। এখন তারা চোর-ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীদের ডেরায় বেড়ে উঠছে। ওদের শরণেই তারা বেঁচে থাকে। মাদক ব্যবসা তাদের একমাত্র জীবিকার অবলম্বন|
আমাদের চারপাশে এসব সমস্যা এতো গভীর, ব্যাপক ও সর্বগ্রাসী যে, চাইলেই চোখ বন্ধ করে বসে থাকার উপায় নেই। বরং এই সংকট থেকে যারা বুঁজে থাকবে তারাও এই অপরাধের পরোক্ষ মদদদাতার দায় বহন করবে। আজকের সমাজে মানুষ জীবন-জটিলতার এক আবর্তে ফেঁসে গেছে যে, কেউ অন্যের কিছু সময় ব্যয় করবেন সেই মানসিকতা কারও নেই! পাশ্চাত্য ‘জীবনবোধ’ পৃথিবীকে ব্যক্তিস্বাধীনতার এক অদ্ভুত তত্ত্ব উপহার দিয়েছে; ‘ব্যক্তি (নিজের স্বার্থের বাইরে) অন্যের ভালোমন্দ কোনো বিষয়ে মাথা ঘামানোর আগ্রহ দেখাবে না। অন্যের বিষয়ে বিষয়ে মাথা ঘামানো সভ্যতা পরিপন্থী। ঠিক এভাবে; কাশ্মিরে ভারতীয় জুলুমের বিরুদ্ধে কথা বলা ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপে’র শামিল! কাজেই ভারত এই ধরনের নিন্দা ও প্রতিবাদ আমলে নিতে নারাজ।
সম্প্রতি অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক শিক্ষিত তরুণ ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। অভাবের পীড়ন কিংবা দারিদ্র্য তাকে ছিনতাই করতে তাড়িত করেনি। তার প্রয়োজন পূরণের জন্য সামর্থ্যবান অভিভাবক ছিলো। সে নিজেই পড়ালেখা জানা মানুষ। স্বচ্ছল পরিবারে জন্ম নেওয়া এসব তরুণ না চাইতেই উন্নত জীবনের সমুদয় উপকরণ হাতের কাছে পেয়েছে। অভাব কখনও তাদের স্পর্শ করেনি। তা সত্ত্বেও তারা এরূপ অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। হতে পারে যে, তাদের পিতা-মাতা নিজেদের ‘একান্ত ব্যস্ততায়’ এতো বেশি ডুবে ছিলেন যে, সন্তানের গতিবিধি লক্ষ্য করার মতো ফুরসৎ তাদের হয়ে উঠেনি।
ঘটনার নেপথ্য কারণ বিশ্লেষণ করলে আপনার আগামীর জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ শিক্ষা গ্রহণ করা যাবে। কিন্তু দেশের প্রত্যেকটি সন্তানের ভুল আচরণ ও অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ডের কারণ নিয়ে গবেষণার জন্য এতো প্রশিক্ষিত ও বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞানী কোথায় পাবেন? যারা অসংখ্য ছেলে-মেয়ের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করার জন্য মাঠে নেমে পড়বেন!
মাতা-পিতা নিজেরাই পেরেশান যে, সন্তান কেন তাদের কথা শোনে না! তাদের পরীক্ষার ফলাফল মা-বাবার প্রত্যাশার অনুরূপ নয়। বরং আজকালের অভিভাবক নিজের অর্থ-বিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে ছলে-বলে প্রত্যাশিত ফলাফল ‘ঘরে তোলার’ জন্য মরিয়া। ‘টিউশন-প্রাইভেট’ এসব সন্তানের মনস্ত্তাত্ত্বিক উন্নতির জন্য সহায়ক নয় কিন্তু অভিভাবক নিরুপায় হয়ে অনেকটা আত্মসর্ম্পণ করে।
উপর্যুক্ত সমস্যাগুলো কোনো ভালো ও টেকসই সমাধান দাবি করে। আধুনিক মনোবিজ্ঞান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে বটে কিন্তু এমন সমাধান উপস্থাপন করে না যা প্রত্যেকের জন্য প্রযোজ্য। এমন কোনো সমাধানও পেশ করে না যাতে বখে যাওয়া সন্তানটি শোধরায় অথবা মাদকের ছোবলে নিঃশেষিত লোকটিকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়। এই মনোবিজ্ঞান তো মানুষকে পশুর কাতারে নামিয়ে এনেছে। তার মনুষ্যত্বকে উজ্জীবিত করার পরিবর্তে ব্যক্তিত্বকে আঘাত করেছে। মানুষের ভাবনা, চিন্তা ও প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি মানসিক অবস্থা যান্ত্রিক বিন্যাসের মতো নয়; মানুষও যন্ত্র নয়। মানুষের ওপর বিভিন্ন অবস্থার প্রতিফলন আরও আলাদা কিছু। যার মধ্যে বড় একটি দিক হলো আত্মাসংশ্লিষ্ট। আল্লাহর অস্ত্বিত সত্য, মহাসত্য। তিনি মানুষের জীবন সহজে পরিচালিত হবার জন্য পৃথিবীকে একটি সিস্টেম বা ব্যবস্থাপনাপদ্ধতির মধ্যে সাজিয়েছেন। এই ব্যবস্থাপনা থেকে উপকৃত হবার জন্য নিয়মনীতি ও রীতিপদ্ধতি শেখানোর প্রয়োজনে পথপ্রদর্শক পাঠিয়েছেন। তিনি ব্যবহারিক জীবনের মানবীয় সমস্যাবলির সঙ্গে আমাদেরকে কেবল পরিচিতই করাননি—বরং নিজের কর্মধারাকে আমাদের জন্য আদর্শ ও নমুনা হিসেবে তুলে ধরে বাতলে দিয়েছেন।
মনোদৈহিকভাবে সুস্থ থাকার সঠিক পন্থা কী। এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজীদ মহানবীর জীবনাদর্শে অন্যদের কল্যাণ নিহিত থাকা সম্পর্কে বলছে,
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللّٰهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ ؕ۰۰۲۱
‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ (সুরা আহযাব: ২১)।
তাঁর চলন-বলন, আচার-আচরণ, আহার-বিহার, পোশাক-পরিচ্ছদ প্রভৃতি কেবল আনুষ্ঠানিকতার ক্ষেত্রে নয় বরং সামগ্রিক সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠ নমুনা ছিলো। তাঁর কথা বলার ধরন ও আঙ্গিক এমন ছিলো যে, মুহূর্তেই মানুষের মন জয় করে নিতেন। তাঁর জীবনজুড়ে ছিলো অনুপমসব সৌন্দর্যের সমাহার, অবাক বিস্ময়ের আধার। কখনও তিনি স্নেহবৎসল পিতা, কখনও পরম সহনশীল বন্ধু। কখনও তিনি এমন জানবাজ যোদ্ধাদের কমান্ডার যারা চোখের ইশারাতে জীবন দিতে পারাকে গৌরবের বিষয় গণ্য করে। সদাচার থেকে আত্মীয়তার সম্পর্ক সুরক্ষা, বিচার-ইনসাফ থেকে জীবনযাপন, মনোবিজ্ঞান থেকে চিকিৎসাবিদ্যা পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয়ের সকল পদক্ষেপ মানবসন্তানের জন্য অনুসরণীয়।
‘উন্নত’ সভ্যতার দাবিদাররা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিজিত অঞ্চলসমূহে যে লজ্জাজনক কর্মকাণ্ড করেছে মানবসভ্যতা আজ পর্যন্ত সেই ক্ষত সেরে উঠতে পারেনি। অন্যদিকে বিজয়ের জন্য মরণপণ লড়াকু মক্কা বিজয়ী সৈন্যদেরকে তিনি যে শিক্ষা দিয়েছেন—তার স্বরূপ বুঝতে হলে পরাজিত সৈন্যদের কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে; তাদের অনুভুতি কীরূপ ছিলো যখন তাদেরকে বলা হলো- ‘যাও তোমাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিবো না। তোমরা মুক্ত।’ তরবারির জোরে নয়—চারিত্রিক সুষমা আর ভালবাসা দিয়ে বিশ্বজয়ের কৌশল শিখিয়েছেন তিনি। মানুষের ফিজিক্স ও মনোজগতের বিবর্তন-বিক্রিয়ার ডায়াগনোসিস ও প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিষয়ে তাঁর জ্ঞানভাণ্ডার এতো বিস্তীর্ণ ছিলো যে, অনাগত প্রজন্মের সাইকোলজিক্যাল সূত্রগুলো সুন্দরভাবে পেশ করে গেছেন। তিনি হীনমন্যতা ও তার প্রতিকারে বৈষম্য আর নীচতাবোধকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছেন। কৌলিন্যবোধের অহমিকায় উড়ন্ত অভিজাত আরব জাতির কন্যা কর্তৃক কৃষ্ণকায় হাবশী পুরুষকে বিয়ে করার রীতি প্রতিষ্ঠা করে তিনি পৃথিবীকে দেখিয়েছেন মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নাই। গায়ের বর্ণ আর শারিরিক বৈচিত্র্যের ভিত্তিতে ভালো-মন্দের বিচার হয় না। বরং বড়ত্ব প্রমাণিত হয় জ্ঞান, সেবা ও চরিত্রের গুণে। ‘সমাজের সেবায় যিনি অগ্রণী তিনিই তাদের নেতা।’
তাঁর নির্মিত সমাজকাঠামো নানারূপে গঠিত। যেই দিক (অ্যাঙ্গেল) থেকেই দেখবেন একেকটি কল্যাণকর বিষয় ভেসে উঠবে। যেমন নামাজ কেবল আল্লাহর ইবাদতই নয় বরং একাকীত্বের সংকীর্ণ কুঠুরী থেকে জনসমাজের উন্মুক্ত উদ্যানে সকলের সঙ্গে একাত্ম হবার সুন্দরতম ব্যবস্থা। যারা নামাজের জামাআতে শরিক হবে না; সে নিজেকে একাকীত্বের কষ্টে ডুবে থাকে, জনবিচ্ছিন্নতায় ছিটকে পড়ে। ইসলাম প্রকৃত একটি পারস্পরিক কল্যাণের ছবি। এসব কল্যাণকর দিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে রাসুলের মূল্যবান নির্দেশনাসমূহ যেন ঠিক বৃষ্টির প্রথম ফোঁটার মতো। বৃষ্টির এই প্রথম পশলায় প্রাত্যহিক জীবনের ভাসা ভাসা পর্যালোচনা নয়, বরং জীবনসমস্যা নিখুঁত ব্যবস্থাপত্র সন্নিহিত।
লেখক: মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কনসালটেন্ট, পাকিস্তান সেনাবাহিনী