বাংলা ভাষা ও ইসলামচর্চা
ড. আহমদ আবদুল কাদের
প্রত্যেক মানুষের একটি ভাষা আছে। এটি তার মাতৃভাষা। সে ভাষায়ই মানবশিশু প্রথম কথা বলতে শিখে। ভাবপ্রকাশ ও পারিপার্শ্বিক জগতের সঙ্গে পরিচিতির মাধ্যম মাতৃভাষা। তবে মাতৃভাষা শুধু ভাবপ্রকাশের মাধ্যমই নয়, বরং মানুষের মনঃস্তত্ত্বের সাথেও গভীরভাবে সম্পৃক্ত। তাই ভাষা কখনো কখনো জাতীয়তাবোধের, ঐক্যবোধের উৎস হয়ে দাঁড়াতে পারে। হতে পারে বাহন। ভাষার মাধ্যমে একটি জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। পরিচিতির মাধ্যম বা বাহন হিসেবে ভাষার ভূমিকা এত স্পষ্ট যে তা ব্যাখ্যার দরকার নেই। একটি সাধারণ ভাষা যত দ্রুত একজন আরেকজনকে জানার সুযোগ করে দেয়, বোঝার সুযোগ করে দেয় অন্য কোনোভাবে তা সম্ভব হয় না। অন্য মাধ্যমগুলো হচ্ছে পরোক্ষ আর ভাষা হচ্ছে প্রত্যক্ষ। একে অন্যের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন ভাষার মাধ্যমেই সম্ভব। অতএব ভাষা আল্লাহর সেরা দান। ভাষা না থাকলে সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠা সম্ভব হতো না, হতো না সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশ। মানুষকে যে সম্ভাবনা দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে সে সম্ভাবনা বিকাশে মানুষের বাকশক্তি ভাষা এক অপরিহার্য শর্ত। তাইতো আল্লাহ যেমন মানুষ সৃষ্টি করেছেন ঠিক তেমনি কথা বলার শক্তি দান করেছেন, দিয়েছেন ভাষা:
خَلَقَ الْاِنْسَانَۙ۰۰۳ عَلَّمَهُ الْبَيَانَ۰۰۴
‘তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে কথা বলা শিক্ষা দিয়েছেন।’[1]
পৃথিবীর প্রথম মানবজোড়া একই ভাষায় কথা বলতেন। পরবর্তী সময়ে মানবজাতির বিস্তৃতির সাথে সাথে ভাষার ক্ষেত্রেও পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। গড়ে উঠেছে অনেক ভাষা। বর্তমানে ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীতে ছয় থেকে সাত হাজার ভাষা রয়েছে। অবশ্য অধিকাংশ ভাষায়ই খুব অল্প সংখ্যক লোক কথা বলে। দশ লক্ষ বা ততোধিক লোক কথা বলে এমন ভাষার সংখ্যা প্রায় ২০০। আবার পাঁচ কোটি বা ততোধিক লোক কথা বলে এমন ভাষার সংখ্যা মাত্র ২৩টি। তবে দশ কোটি বা ততোধিক লোক কথা বলে এমন ভাষার সংখ্যা মাত্র বারোটি। লোকসংখ্যা বিচারে এই বারোটি ভাষা হচ্ছে, (১) মান্ডারিন চীনা, (২) ইংরেজি, (৩) স্পেনিশ, (৪) হিন্দি, (৫) আরবি, (৬) বাংলা, (৭) রুশ, (৮) পুর্তগিজ, (৯) জাপানি, (১০) জার্মান, (১১) মালয়-ইন্দোনেশীয় ও (১২) ফরাসি। প্রথমে বহু ভাষা গড়ে উঠলেও বিভিন্ন কার্যকারণে ও প্রক্রিয়ায় বর্তমানে মাত্র স্বল্পসংখ্যক ভাষায়ই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ কথা বলে।
ভাষার পার্থক্য সৃষ্টি হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই সমভাষাভাষী লোকদের মধ্যে সম্পর্ক-সম্বন্ধ, সমাজ গড়ে তোলা সহজতর হলো। ভাষার মাধ্যমে এক একটি গোষ্ঠী পরিচিতি লাভ করলো, ঐক্য সৃষ্টি হলো। অবশ্য একই ভাষায় কথা বললেই যে ঐক্য গড়ে উঠবে, অন্য পরিচয় পরিহার করে ভাষাভিত্তিক পরিচিতি প্রাধান্য লাভ করবে এটি অনিবার্য নয়। একই ভাষাভাষী মানুষের মধ্যেও বর্ণ, গোত্র, অঞ্চল, ধর্ম, সংস্কৃতি ঐতিহ্য ইত্যাদি কারণে পার্থক্য গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু এ কথা সত্য যে ভাষা ঐকমত্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আবার ভাষা কখনও কখনও বিরোধ সৃষ্টির কারণও হয়েছে। যাহোক প্রাকৃতিক-সামাজিক কারণেই ভাষার বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়েছে। বৈচিত্র্যই পৃথিবীর নিয়ম। গোটা সৃষ্টি জগতেই বৈচিত্র্য বিরাজমান। বৈচিত্র্য না থাকলে গোটা বিশ্ব তখন আর সৃজনশীলতা ও কুশলতাপূর্ণ সৃষ্টি হতো না। হতো একটি জড়পিণ্ড বা শক্তিপুঞ্জ। সৃষ্টি জগতে তাকান। দেখবেন রকমারি আর বৈচিত্র্যের সুষমা সুশোভিত করে রেখেছে সারা বিশ্বকে| শুধু মানবজাতির দিকেই তাকিয়ে দেখুন না! মানুষ কত বৈচিত্র্যপূর্ণ! বর্ণ, গড়ন, স্বাস্থ্য, আকার-আকৃতি ইত্যাদি কত দিক দিয়েই রয়েছে বিপুল ব্যবধান। একইভাবে ভাষার ক্ষেত্রেও রয়েছে অনেক পার্থক্য। বস্তুত ভাষা, বর্ণ ইত্যাদির পার্থক্য আল্লাহতায়ালার সৃষ্টিকুশলতারই নিদর্শন। আল কুরআনের ভাষায়:
وَمِنْ اٰيٰتِهٖ خَلْقُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَاخْتِلَافُ اَلْسِنَتِكُمْ وَاَلْوَانِكُمْ١ؕ اِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَاٰيٰتٍ لِّلْعٰلِمِيْنَ۰۰۲۲
‘আর তার নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টি আর তোমাদের ভাষা ও বর্ণের পার্থক্য। এতে অনেক নিদর্শন রয়েছে জ্ঞানী লোকদের জন্য।’[2]
কোনো ভাষাই মন্দ নয়। ভাষার পার্থক্য যেহেতু আল্লাহর নিদর্শন, তাই সব ভাষাই আল্লাহর অনুমোদিত ভাষা। কোন ভাষাই ভাষা হিসেবে মন্দ নয়। আর কোনো ভাষাই নৈতিক বিচারে শ্রেষ্ঠ নয়। নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সব ভাষাই ভালো ও গ্রহণযোগ্য। দেশ ও বর্ণের কারণে যেমন কাউকে মন্দ বলা বা ভালো বলা ইসলামে অনুমোদিত নয় ঠিক তেমনি ভাষার কারণেও মর্যাদার পার্থক্য নির্দেশ করার সুযোগ ইসলামে নেই। তাই আমাদের ভাষা আর ওটা শত্রুদের ভাষা অথবা এটা ইসলামি ভাষা, ওটা অইসলামি ভাষা এ ধরনের স্থায়ী ধারণা পোষণ করা কোনো রকমেই সঙ্গত নয়। হিব্রো ভাষা বর্তমানে ইসলামের কট্টর বিরোধীদের ভাষা। অথচ সেই (আদি) হিব্রো ভাষাতেই তাওরাত নাযিল হয়েছিল। কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী জানা যায় যে,
وَمَاۤ اَرْسَلْنَا مِنْ رَّسُوْلٍ اِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهٖ ؕ ۰۰۴
‘যখনই কোনো জাতির মধ্যে নবী পাঠানো হয়েছে তখন সে জাতির ভাষায়ই অহী নাযিল করা হয়েছে।’[3]
আবার কুরআন এও বলছে যে,
وَلِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍؒ۰۰۷
‘প্রত্যেক জাতির নিকট কোনো না কোনো পথ প্রদর্শক পাঠানো হয়েছে।’[4]
এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে প্রাচীন সভ্যতার দেশ ভারতীয় উপমহাদেশে কোন না কোন নবী এসে থাকতে পারেন। যদিও এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য আমাদের কাছে নেই। আর নবী এসে থাকলে তার ওপর যে অহী নাযিল হতো তা প্রাচীন ভারতের ভাষাই (সম্ভবত আদি সংস্কৃত ভাষা) নাযিল হয়েছিল। অথচ সংস্কৃত ভাষা এখন হিন্দু ভাষা হিসেবে পরিচিত। ফার্সি এককালে অগ্নিপুজকদের ভাষা হিসেবে সুপরিচিত ছিল কিন্তু কালপরিক্রমায় ফার্সি একটি শক্তিশালী ইসলামি ভাষায় পরিণত হয়েছে। আরবিও এর ব্যতিক্রম নয়। আরবি হচ্ছে পবিত্র কুরআন ও শেষ নবী ও রাসূল (সা.)-এর ভাষা। বিগত দেড় হাজার ধরে ইসলামি জ্ঞান চর্চার মূল ভাষাগত মাধ্যম হচ্ছে আরবি।
অথচ প্রাথমিক কালের ইসলাম বিরোধীদের ভাষাও ছিল আরবি। কুরআন নাযিল হওয়ার পূর্বে প্রায় দুই বা আড়াই হাজার বছর পর্যন্ত আরবে কোন নবী আসেননি। আরবি বা আরবি মুবিন (যা কুরআনের ভাষা) মূল সামী বা প্রটো-সেমিটিক ভাষা পরিবার থেকে উদ্ভূত হয়ে বিভিন্ন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। সাহিত্যের অস্তিত্ব বিচারে আরবি হচ্ছে সর্বকনিষ্ঠ সেমিটিক ও সামী ভাষা। তবে আরবি ভাষাকে অবিকৃত থাকার বিচারে মূল সামী ভাষার নিকটতম ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বস্তুত দীর্ঘকাল পর্যন্ত আরবি ছিল ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কহীন লোকদের ভাষা। অথচ বিগত প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে আরবিই হচ্ছে ইসলামের মূল ভাষা। কাজেই এটি স্পষ্ট করেই বলা যায় যে কোনো ভাষাই ধর্মীয় বিচারে অগ্রহণযোগ্য নয়।
ভাষা হচ্ছে একটি সামাজিক-প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ। ভাষা হচ্ছে কোন জনগোষ্ঠীর ভাব প্রকাশের মাধ্যম। সে ভাব ভালো হতে পারে, আবার মন্দও হতে পারে। ভাষার মাধ্যমে সব ভাবই প্রকাশ করা যায়। তাই ভাষার নিজস্ব কোন চরিত্র থাকে না। কোন স্বতন্ত্র আদর্শ থাকে না। ভাষা সব ধরনের আদর্শ ও চিন্তার বাহন। একই ভাষার মাধ্যমে পরস্পর বিপরীতধর্মী আদর্শ ও মতবাদের প্রচার করা যায়। কাজেই ভাষার ভাষা হিসেবে সুনির্দিষ্ট কোন আদর্শিক চরিত্র নেই, থাকার কথাও নয়। ভাব প্রকাশক কিভাবে ভাব প্রকাশ করবেন তার দ্বারাই তার ভাষার চরিত্র নির্ধারিত হবে, তিনি কোন ভাষায় কথা বলছেন তার দ্বারা নয়। বিষয়বস্তুই চরিত্র নির্ধারক, প্রকাশের মাধ্যম নয়। বস্তুত প্রকৃতি বিচারে সব ভাষাই ভাব প্রকাশের নিরপেক্ষ মাধ্যম মাত্র। ভাষা প্রকৃতি বিচারে ভাব প্রকাশের নিরপেক্ষ মাধ্যম হলেও এর একটি গভীর সাংস্কৃতিক দিকও রয়েছে। ভাষা নিরেট কোন স্থির ও নিশ্চল কোন বিষয় নয়। এরমধ্যে রয়েছে প্রবহমানতা। একটি ভাষা ঐতিহাসিক পরিক্রমায় কোন একটি সংস্কৃতি নির্ভর বিশিষ্ট রূপ ধারণ করতে পারে।
কোন ভাষা যখন দীর্ঘদিন ধরে নির্দিষ্ট কোন ধর্ম ও সংস্কৃতির পরিচর্যার মাধ্যম রূপে চর্চিত হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই সে ভাষায় সে ধর্ম ও সংস্কৃতির ছাপ পরিলক্ষিত হবেই। সে ভাষায় সে সংস্কৃতির ধারণ ক্ষমতাও বাড়বে। এ দিক থেকেই আরবিকে ইসলামের মূল ভাবপ্রকাশক বলা হয়। কারণ ইসলামের মূল গ্রন্থ আল-কুরআন আরবি ভাষায় নাযিল হয়েছে। শেষ নবী (সা.)-এর ও ইসলামের প্রাথমিক কালের সঙ্গী-সাথীরাও ছিলেন আরবি ভাষী। তাছাড়া প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে ইসলামি জ্ঞান চর্চার মাধ্যম হয়ে আছে আরবি। আবার কাল পরিক্রমায় ফার্সি-উর্দু ইত্যাদিও ইসলামের বলিষ্ঠ ভাব প্রকাশক বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। তারও কারণ সেসব ভাষায় ইসলামের চর্চা আরবির পরেই অধিকতর হয়েছে। মূল কথা এসব ভাষা ভাষাগত বৈশিষ্ট্যে বা যোগ্যতার কারণে নয় বরং দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্ত ভাষা ইসলামের ভাবধারা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে বলেই এগুলোর মধ্যে ইসলামি ভাবধারার ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে কোন ভাষা ঐতিহাসিক কারণে বাস্তব ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন সংস্কৃতির বাহন হয়ে পড়তে পারে।
বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটে দক্ষিণ ভারতের মধ্যদিয়ে। প্রথমে মৌখিকভাবেই ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটে। ১২০৩ সালে বাংলায় ইসলামের সূত্রপাত হলেও ১৩৫০ সাল পর্যন্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা হয়নি বললেই চলে। মূলত ইলিয়াস শাহী আমল থেকে মুসলিম শাসকদের পৃষ্টপোষকতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। হুসাইন শাহী আমলে (১৪৯৩-১৫৩৮) বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা ব্যাপক রূপ লাভ করে। তবে সে সময়কার ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় ইসলামের প্রভাব ছিল প্রায় অনুপস্থিত। অবশ্য মুসলিম শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে ১৮৩৬ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা ফার্সি থাকার কারণে সমাজে ফার্সির প্রভাব অবশ্যই পড়ে। তাছাড়া সুলতানী আমলে সোনারগাঁও, পান্ডুয়া, সীতাকুণ্ড প্রভৃতি স্থান ছিল ইসলামের ব্যাপক চর্চাকেন্দ্র। এগুলোর প্রভাবও বাংলা ভাষায় পড়েছে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। মোঘল আমল থেকেই বাংলা ভাষায় ইসলামের চর্চা ও মুসলিম ঐতিহ্যসমৃদ্ধ সাহিত্য রচনার প্রয়াস চলে। পুঁথিসাহিত্যের যুগটাই হচ্ছে বাংলা ভাষায় তথা জনগণের আটপৌরে ভাষায় মুসলিম ঐতিহ্য সমৃদ্ধ সাহিত্য চর্চার যুগ। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলা ভাষায় ইসলামের পঠন পাঠন ও চর্চা ছিল তখন পর্যন্ত অত্যন্ত সীমিত। ব্রিটিশ আমলের প্রথম দিকে ইসলাম চর্চা ছিল দিল্লীকেন্দ্রিক তথা ফার্সিনির্ভর। এবং মধ্য ভাগে ছিল কলকাতা ও দেওবন্দকেন্দ্রিক তথা প্রথানত উর্দুনির্ভর। ফলে তখন বাংলা ভাষায় ইসলাম চর্চা ও সাহিত্য সৃষ্টি খুবই অনুল্লেখযোগ্য। বিশ শতকের প্রথমার্ধে ও পাকিস্তান আন্দোলনের গোড়ার দিকে বাংলা ভাষায় ইসলামি ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের প্রয়াস চলে। তবুও ইসলাম চর্চার মূল মাধ্যম উর্দ-ফার্সিই থেকে যায়। পাকিস্তান আমলে ইসলাম চর্চায় উর্দুর প্রাধান্যের তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশ আমলে মাতৃভাষায় ইসলাম চর্চার ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি সাধিত হলেও এখন পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষার সর্বস্তরে ও সর্বমহলে মাতৃভাষার গুরুত্ব উপযুক্তভাবে স্বীকৃত হয়নি যদিও সচেতনতা ও উদ্যোগ দিন দিন বাড়ছে।
বাংলা ভাষায় ইসলাম চর্চা এ পর্যন্ত যা হয়েছে তা অত্যন্ত অকিঞ্চিতকর। বাংলা ভাষা ইসলাম চর্চা বা ইসলামি শিক্ষার মাধ্যম কোন কালেই ছিল না। এমনকি এককালের সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত মুসলমানগণ বাংলা ভাষা, মুসলমানদের ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হতে পারে বলে wek^vmB করতে পারেননি। বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলার কারণে ইসলামি জ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রও এখানে সীমিত। বাংলা ভাষায় মৌলিক ইসলামি চিন্তানায়ক ও প্রতিভার আবির্ভাবও অত্যন্ত কম। এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে আমাদের মনে হয় মাতৃভাষায় ইসলামের ব্যাপক চর্চার অভাবে চিন্তার ক্ষেত্রে মৌলিকত্ব অর্জন ও স্বাধীন চিন্তার স্ফুরণে বাধার সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই মৌলিক চিন্তার উন্মেষ প্রসারের জন্য অবশ্যই নিজেদের ভাষায় অধ্যয়ন ও অনুশীলনের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
একটি ইসলামি সমাজ বিনির্মাণ করতে হলে সে দেশের জনগণের ভাষায়ই তাদের নিকট দাওয়াত পৌঁছাতে হবে। যে ভাষা জনগণ বুঝে না সে ভাষার মাধ্যমে জনগণকে জাগিয়ে তোলা যায় না। পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করলে জানা যে নবী-রাসূলগণ (আ.) সব সময় তাদের নিজ নিজ জাতির ভাষায় দাওয়াত দান করেছেন। নবীগণ কখনও এমন ভাষায় দাওয়াত দেননি যে ভাষার সাথে জনগণের কোন সম্পর্ক ছিল না। স্বীয় জাতির ভাষাই ছিল তাদের পয়গাম পৌঁছানোর মাধ্যম। আল-কুরআনের বক্তব্য:
وَمَاۤ اَرْسَلْنَا مِنْ رَّسُوْلٍ اِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهٖ لِيُبَيِّنَ لَهُمْؕ ۰۰۴
‘আমি আমার বাণী পৌঁছানোর জন্যে যখন যেখানেই কোন রাসূল (আ.) পাঠিয়েছি তার জাতির ভাষায়ই পয়গাম পৌঁছিয়েছি যেন সে তাদের নিকট খুব ভালোভাবেই কথা প্রকাশ করে বলতে পারে।’[5]
শেষ নবী (সা.)-এর প্রাথমিক কর্মক্ষেত্র ছিল মক্কা ও তার আশপাশের এলাকা আর তাদের ভাষা ছিল আরবি। তাই কুরআনের ভাষা হলো আরবি। আল্লাহ বলছেন,
وَكَذٰلِكَ اَوْحَيْنَاۤ اِلَيْكَ قُرْاٰنًا عَرَبِيًّا لِّتُنْذِرَ اُمَّ الْقُرٰى وَ مَنْ حَوْلَهَا وَتُنْذِرَ يَوْمَ الْجَمْعِ لَا رَيْبَ فِيْهِ١ؕ ۰۰۷
‘আর (হে নবী!) এরূপেই এ আরবি কুরআনকে আমি তোমার প্রতি অহী করেছি যে তুমি জনপদের কেন্দ্রস্থল (মক্কানগরী) ও তার আশ-পাশের বসবাসকারীদের সাবধান করতে পারো।’[6]
মোটকথা নিজের মাতৃভাষায় কোন দাওয়াতের উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তা খুবই স্পষ্ট। তাই ইসলামচর্চার জন্যও মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
ইসলামি সমাজ গঠনে মাতৃভাষার গুরুত্ব অন্য একটি দিক থেকেও বিবেচনা করা যায়। মাতৃভাষায় যখন কোন কিছু লেখা বা বলা হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই তাতে সে দেশের সমাজ ব্যবস্থা, সংস্কৃতি ও সময়ের অবস্থা প্রতিফলিত হয়। ফলে সে বক্তব্য হয় বাস্তব ও গণমানসিকতার উপযোগী। তাই অনুবাদ নির্ভর সাহিত্য দিয়ে জনগণের বাস্তব ও মনঃস্তাত্ত্বিক চাহিদা ও বুুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়োজন পুরোপুরি পূরণ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। এজন্য বাংলাদেশের সমাজকে ইসলামের আলোকে বিনির্মাণ করতে হলে বাংলা ভাষায় বাংলাদেশের আঙ্গিকেই সাহিত্য রচনা করতে হবে, বক্তব্য তুলে ধরতে হবে। ইসলামি ভাবধারা প্রসারে মাতৃভাষার আরেকটি ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি মাতৃভাষায় ইসলামি আদর্শের চর্চা ও সাহিত্য রচনা করা হয় তাহলে এমন এক সময় আসে যখন সমগ্র ভাষার মধ্যে সে আদর্শের ভাবধারা অনুপ্রবিষ্ট হয়। আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক দিকে সে ভাষাটি সমৃদ্ধ হয়ে উঠে। ফলে গোটা বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে আদর্শের আলোকে পুনর্গঠন করা সহজতর হয়। তাছাড়া এর প্রভাব সাধারণ সাহিত্যের মাঝেও প্রতিফলিত হয়। এবং সাধারণ পাঠকরা পর্যন্ত অতিসহজে সে আদর্শ সম্পর্কে অবগত হতে পারে। মূলত আদর্শিক দিক দিয়ে মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করতে হলে বাংলা ভাষায় ইসলামের ব্যাপক চর্চা অপরিহার্য। বস্তুত বাংলা ভাষায় একটি শক্তিশালী ইসলামি ধারা সৃষ্টি ও বিকাশ আজ সময়ের অপরিহার্য দাবি। আমাদের মাতৃভাষাকে একটি শক্তিশালী ‘ইসলামি ভাষায়’ রূপান্তরের জন্যে প্রয়োজন একটি সাংস্কৃতিক জিহাদ, প্রয়োজন একটি সৃজনশীল আন্দোলনের। এটিই আজকের প্রত্যাশা।
লেখক: মহাসচিব, খেলাফতে মজলিস
[1] আল-কুরআন, সুরা আর-রাহমান, ৫:২Ñ৩
[2] আল-কুরআন, সুরা আর-রূম, ৩০:২২
[3] আল-কুরআন, সুরা ইবরাহীম, ১৪:৪
[4] আল-কুরআন, সুরা আর-রা’দ, ১৩:৭
[5] আল-কুরআন, সুরা ইবরাহীম, ১৪:৪
[6] আল-কুরআন, সুরা আশ-শূরা, ৪২:৭