ধর্ষণের সংবাদ: কোড অব এথিক্স ও আইন
তারেকুল ইসলাম
সম্প্রতি একজন ঢাবিছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। একটি টিভিচ্যানেলে একজন সাংবাদিক ভুক্তভোগীর পরিচয় প্রকাশ করে দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। এটি সাংবাদিকতার কোড অব এথিক্সের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। শুধু তা-ই নয়, যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের সংবাদ পরিবেশনকালে ভিকটিম শিশু ও নারীদের নাম, ছবি ও পরিচয় প্রকাশ আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০-এর ১৪ নং ধারায় বলা আছে, এ জাতীয় অপরাধ সংবাদমাধ্যম বা অন্য কোনো মাধ্যমে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে, যাতে করে ভুক্তভোগী শিশু বা নারীর পরিচয় প্রকাশ না পায়। এমনকি উক্ত ধারার উপধারা (২)-এ এটাও বলা আছে যে, এই বিধান লঙ্ঘন করলে দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেককে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা ১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সংবাদমাধ্যমে মাঝেমধ্যে এজাতীয় অপরাধের সংবাদ উপস্থাপনের সময় প্রোস এন্ড কনস না ভেবে প্রায়ই ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশ করে দেওয়া হয়।
রোমানিয়ার সাংবাদিকদের কোড অব এথিক্সের ২.১.৪ ধারায় বলা হয়েছে, The identity of the victims, mainly those sexually abused, should not be revealed with the exception of the situation in which there is a consent from those victims or when there is a major public interest that prevails (অর্থাৎ যৌন নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীদের পরিচয় প্রকাশ করা উচিত নয়, যদি না ভুক্তভোগীরা সম্মতি দেয় কিংবা জনগণের আগ্রহের বিষয়টি বড় হয়ে দেখা না দেয়)। এছাড়া নিউইয়র্ক টাইমসের সাবেক সহকারী ব্যবস্থাপনা সম্পাদক অ্যালান এম সিগ্যাল এ ব্যাপারে তার পত্রিকার অবস্থান সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এই পত্রিকার সম্পাদকরা রেপ ভিকটিমদের নাম প্রকাশ করবেন কি করবেন না- সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন প্রত্যেক ঘটনাকে আলাদা করে বিবেচনা করার পর। কিন্তু তারা নাম প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নন (২৫ জুন ১৯৮৯ নিউইয়র্ক টাইমস)।’
এছাড়া, আদালতের বিচারে অভিযুক্ত ব্যক্তি খালাস পেয়ে গেলে এবং তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা ও আক্রোশপূর্ণ প্রমাণিত হলে অভিযোগকারীর (plaintiff) পরিচয়ের সেই বিশেষ প্রাইভেসি আর অনুসৃত হবে না।
সাধারণত অনেক দেশেই ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর ভুক্তভোগীর পরিচয় জানাজানি হলে সামাজিকভাবে তার সম্মান হানি ঘটে এবং এটি তার মানসিক ট্রমাকে আরো গভীর ও প্রলম্বিত করে দেয়। শারীরিক ও মানসিক আঘাত কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি সামাজিক অবস্থান নিয়েও তাকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। তার ভবিষ্যতও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ফলে মানবিক বিবেচনায় রেপ ভিকটিমদের নাম ও পরিচয় প্রকাশের বিষয়টিকে খুবই স্পর্শকাতর হিসেবে দেখা হয় এবং জনসম্মুখে যথাসম্ভব প্রকাশ না করাকেই (anonymity) কোড অব এথিক্স হিসেবে গণ্য করা হয়।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার ভিকটিমদের পরিচয় প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। কারণ হিসেবে বলেছিল, ‘সমাজে এ ধরনের ভিকটিমদের ‘অচ্ছুত’ (untouchable) হিসেবে দেখা হয়, যা দুঃখজনক।’ ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে মিডিয়ার উদ্দেশ্যে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, Media should be cautious not to sensationalise such cases and though they have an obligation to report such matters, they are also duty bound not to disclose the identity of such victims, including minors. Reportage of such cases should be done sensitively keeping the best interest of the victims, both adult and children, in mind. Sensationalising such cases may garner Television Rating Points (TRPs) but does no credit to the credibility of the media (11 Dec. 2018, Outlook). অর্থাৎ মিডিয়ার সতর্ক হওয়া উচিত, যাতে তারা এমন ঘটনাগুলোকে সেনসেশনালাইজ না করে। এসব ব্যাপারে রিপোর্ট করা তাদের দায়িত্ব হলেও একইসাথে ভিকটিমদের (নারী ও শিশু) পরিচয় প্রকাশ না করার ক্ষেত্রেও তারা দায়বদ্ধ। ভুক্তভোগীর সর্বোচ্চ কল্যাণ বিবেচনায় রেখে সতর্কতার সাথে এসব ঘটনার রিপোর্ট করা উচিত। সেনসেশনালাইজ করে রিপোর্ট করলে টিআরপি বাড়ানো যেতে পারে, কিন্তু সেটা মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ায় না।
দেশটির সুপ্রিম কোর্ট একইসাথে ভুক্তভোগীদের নাম ও পরিচয় যেন জনসম্মুখে আসতে না পারে সেজন্য পুলিশ ও কর্তৃপক্ষকেও কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে। তবে ভিকটিম যদি প্রাপ্তবয়স্ক হয় এবং নিজেই যদি জনসম্মুখে তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলতে সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সেক্ষেত্রে কোনো আপত্তি নেই। উল্লেখ্য, গত বছরের জানুয়ারিতে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার প্রদেশ ও ইউনিয়ন অঞ্চলগুলোতে পাঠানো এক নির্দেশনায় রেপ ভিকটিমদের নাম প্রকাশ করার শর্ত হিসেবে বলেছে, ‘কেবল কোর্ট থেকে অনুমতিসাপেক্ষেই ভিকটিমদের নাম জনসম্মুখে প্রকাশ করা যাবে (২৫ জানুয়ারি ২০১৯, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)।’
উদাহরণস্বরূপ না বললেই নয়, গত বছর ফেনীর আলোচিত মাদরাসাছাত্রী নুসরাত যখন তার প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ দিতে থানায় যায়, তখন সেখানের দায়িত্বরত ওসি মেয়েটির অনুমতি ছাড়াই তার জবানবন্দি মোবাইলে ভিডিওচিত্রে ধারণ করে এবং পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করে দেয়। পরে নুসরাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা মিডিয়ায় আসলে আমাদের দেশের সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী সেই ওসির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছিল। মিডিয়া থেকে প্রশাসন সবক্ষেত্রেই এই ধরনের সংবেদনশীল ভিকটিমদের নাম ও পরিচয় গোপন রাখা সাধারণ কোড অব এথিক্সের পর্যায়ে পড়ে। এই কোড অব এথিক্স লঙ্ঘন করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ!
আরেকটি জরুরি বিষয় হলো, প্রিন্ট ও ব্রডকাস্ট মিডিয়ায় ‘ধর্ষিতা’ বিশেষণটি ব্যবহার করা উচিত নয়। ধর্ষণের শিকার একজন ভুক্তভোগী নারী সাধারণত প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে জর্জরিত থাকেন। তা সত্ত্বেও ‘ধর্ষিতা’র মতো একটা নেতিবাচক বিশেষণ দিয়ে সামাজিকভাবে কেন তাকে ট্যাবু করে রাখা হবে? ধর্ষণের শিকার একজন নির্যাতিতা নারী কি তা ডিজার্ভ করে? নিশ্চয়ই না।
কয়েক বছর আগে দেশের একটি আলোচিত ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলাম তাদের এক বিবৃতিতে বলেছিল, মিডিয়া ও সাংবাদিকদের প্রতি অনুরোধ তাদের ‘ধর্ষিতা’ বলে অভিহিত করবেন না। এটি ভুক্তভোগী নারীর জন্য অবমাননাকর। ধর্ষণের কারণে ধর্ষক শাস্তিযোগ্য অপরাধী, কিন্তু ধর্ষণের শিকার কোনো নারীকে ‘ধর্ষিতা’ বলাটা অবিচারের শামিল। কারণ ‘ধর্ষক’ এবং ‘ধর্ষিতা’ শব্দ দুটোই আমাদের সমাজে নেতিবাচক। তাই আমরা নির্যাতিতা নারীদের সম্মান ও ভবিষ্যত রক্ষার্থে ‘ধর্ষিতা’ শব্দের ব্যবহারের বিরোধী (হেফাজতের বিবৃতি, ২০ মে ২০১৭, বাংলা ট্রিবিউন)।’
হেফাজত কিন্তু ‘ধর্ষক’ বা ‘ধর্ষণ’ শব্দ দুটো নিয়ে কোনো আপত্তি করেনি। এ দুটো যথারীতি ব্যবহৃত হবে। ধর্ষককে ‘ধর্ষক’ বলেই অভিহিত করা যেতে পারে এবং ধর্ষণের অপরাধে তার বিচারও হবে। এটুকু নিশ্চিত করার জন্য ধর্ষণের শিকার কোনো নারীকে ‘ধর্ষিতা’ বলে অভিহিত করা আবশ্যক নয়। তাছাড়া কী ধরনের নির্যাতন সেটা তো স্বাভাবিকভাবেই নিউজ, রিপোর্ট বা মামলার এজাহারে সবিস্তারে বর্ণিত থাকবে। সুতরাং, এখানে বিভ্রান্তি বা অস্পষ্টতার কোনো সুযোগ দেখি না।
এছাড়া ইংরেজি ভাষার নিউজ ও রিপোর্টগুলোতে ধর্ষণ বা যেকোনো নির্যাতনের শিকার কাউকে লিঙ্গনির্বিশেষে ‘ভিকটিম’ বলে অভিহিত করা হয়। ‘ধর্ষিতা’র মতো কোনো বিশেষ লিঙ্গভিত্তিক টার্ম ইংরেজি ভাষায় নেই। এমনকি The raped woman এভাবে বিশেষায়িত করেও লেখা হয় না। কিন্তু বাংলা ভাষায় এ বিষয়ে আমাদের সবারই সচেতন হওয়া দরকার। সাধারণত ‘ধর্ষিতা’ শব্দটি শুনলে বা পড়লে ভিকটিমের প্রতি সহমর্মিতা বা সমবেদনা জাগার চেয়েও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই প্রকাশ পায় বেশি। ‘ধর্ষক’ ও ‘ধর্ষিতা’ উভয়ের কনটেক্সট বিবেচনায় শব্দগত দিক থেকে এতটা সমান্তরাল করা অবিচার ও অনুচিত। ‘ধর্ষিতা’ শব্দ ব্যবহার না করে এর পরিবর্তে ‘ভিকটিম’, ‘নির্যাতিতা’ বা ‘ভুক্তভোগী’ বিশেষণগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক