কেমন ছিলেন প্রিয়তম নবী (সা.)
কামরুল হাসান
بَلَغَ الْعُلَى بِكَمَالِهِ
كَشَفَ الدُّجَىٰ بِجَمَالِهِ
حَسَنَتُ جَمِيْعُ خِصَالِهِ
صَلُّوْا عَلَيْهِ وَآلِهِ
‘তিনি নিজ কৃতিত্ব ও পূর্ণতার গুণে পৌঁছেছেন মর্যাদার শীর্ষে, অন্ধকার বিদূরিত হয়েছে তাঁর সৌন্দর্যে। তাঁর চরিত্রাবলি সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়েছে, দরুদ তাঁর এবং তাঁর বংশধরগণের ওপর।’[1]
৬৩ বছরের মহান জীবনের সবটুকু সময় যিনি ব্যয় করেছেন সকল অনাচার আর পাপাচারের বিষবৃক্ষের মূল নির্মূলে। যিনি কায়েম করেছেন অসভ্য পৃথিবী থেকে সভ্যের পৃথিবী। যার শুভ আগমনে বদলে গেল জাহিলিয়াতের বর্বর যুগ, মানুষ পেল মুক্তির বার্তা। তিনি যে আর কেউ নন। তিনি সৃষ্টির সেরা সাইয়েদুল মুরসালীন, হাবীবে ইলাহী, প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। সেই প্রিয়নবীর শুকরিয়া ও সৌন্দর্য বর্ণনা করা কি আমাদের কর্তব্য নয়?
জীবনের সর্বক্ষেত্রে তিনি আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ রেখে গেছেন। কীভাবে কথা বলতে হবে, কীভাবে চলতে হবে, স্বামী হিসেবে, পিতা হিসেবে, বন্ধু হিসেবে এমনকি আত্মীয় ও প্রতিবেশী হিসেবে কী করণীয় তার আদর্শ নমুনা খুঁজে পাওয়া যায় প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর জীবনাদর্শে। সেই প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা.) দেখতে কেমন ছিলেন একজন নবীপ্রেমিক মাত্রই জানতে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বলেন,
وَاِنَّكَ لَعَلٰى خُلُقٍ عَظِيْمٍ۰۰۴
‘(হে নবী!) নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’[2]
তিনি আরও বলেন,
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللّٰهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ يَرْجُوا اللّٰهَ وَالْيَوْمَ الْاٰخِرَ وَذَكَرَ اللّٰهَ كَثِيْرًاؕ۰۰۲۱
‘যারা আল্লাহ এবং শেষ দিবসের প্রতি আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে, নিশ্চয়ই তাদের জন্য রাসুলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।’[3]
তিনি আরও বলেন,
اَلنَّبِيُّ اَوْلٰى بِالْمُؤْمِنِيْنَ مِنْ اَنْفُسِهِمْ ؕ ۰۰۶
‘নবী (আপনি) মুমিনদের কাছে তাদের নিজেদের চাইতে বেশি আপন।’[4]
রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত হাদীসের ওপর ভিত্তি করে তিনি দেখতে কেমন ছিলেন, তাঁর ব্যক্তিত্ব কেমন ছিলো এবং তাঁর জীবনীর ছোট-বড় যাবতীয় খুটিনাটি বিষয়ের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিয়ে ইমাম তিরমিযী (রহ.) সুন্দর একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম হচ্ছে আশ-শামায়িলুল মুহাম্মাদিয়া। বইটি শামায়েলে তিরমিযী নামেও পরিচিত।
রাসুলুল্লাহ (সা.) কেমন ছিলেন তা জানার আগ্রহ পৃথিবীর সব মুসলমানের। মুমিন হৃদয়ের একান্ত কামনা। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন এমন একজন রাসুল যাকে সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) এত ভালবাসতেন যে তারা তার দিকে তাকাতে পারতেন না। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি তীব্র ভালবাসার কারণে তারা তাকে দেখতে চাইতেন আর প্রবল ভক্তির কারণে তারা মাথা নিচু করে তাকতেন। বিষয়টি সবচেয়ে সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন সাহাবী আমর ইবনে আস (রাযি.) তিনি বলেন তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা এতই তীব্র ছিল যে, আমি কখনো তার দিকে চোখ তুলে থাকাতে পারিনি তাই কেউ যদি আমাকে তার দৈহিক সৌন্দর্য বর্ণনা করার অনুরোধ করত তখন আমি পারতাম না।
আর তাই আল্লাহ রাসুল (সা.)-এর চেহারাকে বর্ণনা দিয়েছেন সূর্যের সাথে আবার কেউ চাঁদের সাথে। প্রিয় নবীর আকার-আকৃতি সম্পর্কে অনেক সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) থেকে বর্ণনা পাওয়া যায়।
একটি মজার বর্ণনা আমরা পাই হযরত জাবির ইবনে সামুরা (রাযি.) থেকে, তিনি বলেন একদিন পূর্ণিমা রজনীতে মহানবীকে লাল রঙয়ের চাদর পরিহিত অবস্থায় অবলোকন করলাম। আমি একবার রাসূলের দিকে আর একবার চাঁদের দিকে তাকাচ্ছিলাম। আমার পর্যবেক্ষণে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে চাঁদের চেয়েও সুন্দর মনে হল। (তিরমিযী শরীফ)
তাইতো কবি বললেন,
ওরে, ও চাঁদ উদয় হলি কোন জোসনা দিতে?
দেয় অনেক বেশি আলো আমার নবীর পেশনীতে।
তবে সবচেয়ে বিখ্যাত যে বর্ণনাটি পাওয়া যায় সেটা হল উম্মে মা’বাদের বর্ণনায়: হিজরতের সময় মহানবী (সা.) কিছুক্ষণ উম্মে মা’বাদের তাঁবুতে অবস্থান করেছিলেন। তাঁবু থেকে মদীনার দিকে রওয়ানা হওয়ার পর উম্মে মা’বাদ স্বামীর কাছে নবীজীর যে পরিচয় তুলে ধরেছিল, তা নিম্নরূপ: চমকানো গায়ের রং, উজ্জ্বল চেহারা সুন্দর গঠন, সটান সোজা নয়, আবার ঝুঁকে জড়াও নয়। অসাধারণ সৌন্দর্যের পাশাপাশি চিত্তাকর্ষক দৈহিক গঠন, সুরমা রাঙ্গা চোখ, লম্বা পলক, ঋজু কণ্ঠস্বর, লম্বা ঘাড়, চমকানো কালো চুল। চুপচাপ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, কথা বলার সময় আকর্ষণীয়। দূর থেকে দেখে মনে হয় সবার চেয়ে উজ্বল ও সৌন্দর্যমণ্ডিত। পিছন থেকে দেখলে মনে হয় তিনি সুন্দর ও সুমহান পুরুষ। কথায় মিষ্টতা ও প্রকাশভঙ্গি সুস্পষ্ট। কথা খুব সংক্ষিপ্ত নয়, আবার অতিদীর্ঘও নয়। কথা বলার সময় মনে হয় যেন মুখ থেকে দাঁতের ফাঁক দিয়ে মুক্তোর দানা ঝরছে।
হযরত আলী (রাযি.) যখনই নবী (সা.)-এর আকৃতির বর্ণনা দিতেন, তখন বলতেন, নবী (সা.) অত্যধিক লম্বাও ছিলেন না এবং একেবারে বেঁটেও ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন লোকদের মধ্যে মধ্যম আকৃতির। তাঁর মাথার চুল একেবারে কোঁকড়ানো ছিল না এবং সম্পূর্ণ সোজাও ছিল না; বরং মধ্যম ধরনের কোঁকড়ানো ছিল। তিনি অতি স্থূলদেহী ছিলেন না এবং তাঁর চেহারা একেবারে গোল ছিল না; বরং লম্বাটে গোল ছিল। গায়ের রং ছিল লাল-সাদা সংমিশ্রিত। চক্ষুর বর্ণ ছিল কালো এবং পলক ছিল লম্বা লম্বা| হাড়ের জোড়াগুলো ছিল মোটা। গোটা শরীর ছিল পশমহীন, অবশ্য পশমের চিকন একটি রেখা বক্ষ হতে নাভি পর্যন্ত লম্বা ছিল। হস্তদ্বয় ও পদদ্বয়ের তালু ছিল মাংসে পরিপূর্ণ। যখন তিনি হাঁটতেন তখন পা পূর্ণভাবে উঠিয়ে মাটিতে রাখতেন, যেন তিনি কোনো উচ্চ স্থান হতে নিচের দিকে নামছেন। যখন তিনি কোনোদিকে তাকাতেন তখন ঘাড় পূর্ণ ফিরিয়ে তাকাতেন। তাঁর উভয় কাঁধের মাঝখানে ছিল মোহরে নুবুওয়ত বা নবী হওয়ার অলৌকিক নিদর্শন। বস্তুত তিনি ছিলেন খাতামুন নাবিয়্যিন (নবী আগমনের ধারাবাহিকতা সমাপ্তকারী)। তিনি ছিলেন মানুষের মধ্যে অধিক দাতা, সর্বাপেক্ষা সত্যভাষী। তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা কোমল স্বভাবের এবং বংশের দিক থেকে সম্ভ্রান্ত। যে ব্যক্তি তাঁকে হঠাৎ দেখত, সে ভয় পেত। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি পরিচিত হয়ে তাঁর সঙ্গে মিশত, সে তাঁকে অনেক ভালবাসতে থাকত। নবী (সা.)-এর গুণাবলি বর্ণনাকারী এই কথা বলতে বাধ্য হন যে, আমি তাঁর আগে ও পরে তাঁর মতো কাউকে কখনো দেখতে পাইনি। (তিরমিযী শরীফ)
হযরত জাবির (রাযি.) বলেন, যে পথ দিয়ে নবী যেত বোঝা যেত এ পথ দিয়ে নবীজী গেছে। কারণ সারা পথ খোশবুতে মাতোয়ারা ছিল। (মিশকাত শরীফ)
হযরত আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) তোমাদের মতো দ্রুত কথা বলতেন না। তিনি এমনভাবে কথা বলতেন যে, কেউ তা (শব্দ সংখ্যা) গণনা করতে চাইলে সহজেই গণনা করতে পারত। (সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম)
হযরত কা’ব ইবনে মালিক (রাযি.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন কোনো ব্যাপারে আনন্দিত হতেন তখন তাঁর চেহারা মোবারক উজ্জ্বল হয়ে উঠত। মনে হতো যেন তাঁর মুখমণ্ডল চাঁদের টুকরা। বস্তুত আমরা সবাই সেটা অনুভব করতে পারতাম। (সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম)
হযরত হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সম্মুখের দাঁত দুটির মাঝে কিছুটা ফাঁক ছিল। যখন তিনি কথাবার্তা বলতেন, তখন মনে হতো উক্ত দাঁত দুটির মধ্য দিয়ে যেন আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। (সুনানুদ দারিমী)
হযরত আয়িশা (রাযি.) মহানবী (সা.)-কে সৌন্দর্যের আকর আখ্যা দিয়ে আবেগভরা ছন্দে আবৃত্তি করেন, একটি সূর্য আমাদের আর একটি সূর্য সেই নভোমণ্ডলের, আমার সূর্য অতুলনীয় চাইতে সেই জাগতিক ভাস্করের। জগতের সেই সূর্য সকালে উদিত হয়ে চারিদিকে ফর্সা করে, আমার সূর্য রাতকে রওশন করে উদয় হয় ইশার পরে। (মিশকাত শরীফ)
সত্য দিনের সূর্য নিভে যখন রাতের আঁধার নেমে আসতো, তখন হযরত আয়িশা (রাযি.) ঘরে আরেক নতুন সূর্যের উদয় দেখতে পেতো। একদিন রাতের বেলা আয়িশা (রাযি.) জ্বলন্ত প্রমান পান। তিনি বলেন, ‘একদিন রাতের বেলা আমি কাপড় সেলাই করছিলাম। হঠাৎ আমার হাত থেকে সুঁই পড়ে গেল। আমি সুঁইটি তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম, কিন্তু কোথাও পেলাম না। এমনি সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) এসে হাজির হলেন। ফলে তাঁর পবিত্র চেহারার নূরানীর আভায় সুঁইটি স্পষ্ট দেখতে পেলাম।
হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) হতে সুন্দর কাউকে আমি কখনো দেখিনি। মনে হতো যেন সূর্য তাঁর মুখমণ্ডলে ভাসছে। আর রাসুল (সা.) অপেক্ষা চলার মধ্যে দ্রুতগতিসম্পন্ন কাউকে দেখিনি। তাঁর চলার সময় মনে হতো মাটি যেন তাঁর জন্য সংকুচিত হয়ে এসেছে। আমরা তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলতাম। অথচ তিনি স্বাভাবিক নিয়মে চলতেন। (তিরমিযী শরীফ)
হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাযি.) থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ (সা.) আলুথালু চুলবিশিষ্ট এক ব্যক্তিকে দেখে বললেন, তোমাদের কোনো ব্যক্তি নিজেকে কুশ্রী বানায় কেন? অতঃপর তিনি হাতের ইশারায় তার চুল ছেঁটে পরিপাটি করতে বললেন। (তাবারানীর আল-মুজামুস সগীর)
একবার নবীজী (সা.) উম্মে সুলাইমের গৃহে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। নবীজী (সা.) পবিত্র দেহ ঘর্মাক্ত হলে উম্মে সুলাইম একটি শিশির মধ্যে সেই পবিত্র শ্বেত বিন্দু জমা করতে লাগলেন। ইতোমধ্যে নবীজী জাগ্রত হয়ে ইরশাদ করলেন, উম্মে সুলাইম একি করছো তুমি, জবাব এলো ইয়া রাসূলুল্লাহ এ হচ্ছে আপনার পবিত্র বদনের ঘাম মুবারক। আমরা এটি আমাদের খোশবুর সাথে মিলিয়ে নেব। কেননা এটি উত্তম সুগন্ধি। (মুসলিম শরীফ)
নীলাভ আকাশের পূর্ণিমার চাঁদও রাসুল (সা.)-এর সৌন্দর্যের কাছে হার মানতে বাধ্য।
মহান আল্লাহ যেন আমাদের স্বপ্নে হলেও নবী (সা.)-কে দেখার সৌভাগ্য নসিব করেন। আমিন।
[1] শায়খ সা’দী, গুলিস্তাঁ, দানিশ, তেহরান, ইরান (প্রথম সংস্করণ: ১৩৭৪), পৃ. ৪
[2] আল-কুরআন, সুরা আল-কলম, ৬৮:৪
[3] আল-কুরআন, সুরা আল-আহযাব, ৩৩:২১
[4] আল-কুরআন, সুরা আল-আহযাব, ৩৩:৬
PDF ফাইল…
[button link=”http://at.jamiahislamiahpatiya.com/wp-content/uploads/2019/11/November19.pdf”]ডাউনলোড করতে এখানে টাচ করুন বা ক্লিক করুন[/button]