সামাজিক অবক্ষয় রোধে সীরাতুন্নবী (সা.)-এর পয়গাম
ড. মুহাম্মদ সাদিক হুসাইন
বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যা এবং সুনামগঞ্জে নিষ্পাপ শিশু তুহিন হত্যার নৃশংসতা ও নির্মমতায় গোটা দেশ স্তম্ভিত। সাম্প্রতিক এ দুটি হত্যাকাণ্ড স্মরণকালের খুন, রাহাজানি, ধর্ষন, দুর্নীতি, ইভটিজিং, ছিনতাই, ব্যাংক-লুট, মানুষের সম্পদ-আত্মসাত, সরকারি অর্থ-তসরুপের সকল ভয়াবহ অপরাধকে ছাপিয়ে গেছে। মাঝখানে যোগ হয়েছে ক্যাসিনো ও জুয়া সংস্কৃতির লোমহর্ষক সব ঘটনা। এসবের তলে ধামাছাপা পড়েছে নুসরাত ও রিফাতের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড। বাকিগুলোর ফিরিস্তি নাই বা বললাম। পূর্বে অপরাধ করত সমাজের একশ্রেণির চিহ্ণিত অংশ। এখন নিম্নশ্রেণি থেকে উচ্চশ্রেণি, সাধারণ ও রাজনীতিক, সরকারি ও বেসরকারি, কিশোর থেকে বৃদ্ধবয়সের লোকও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়েছে মারাত্মক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। যে দেশের ডিসি নারীকেলেঙ্কারির কারণে ওএসডি হয়, ডিআইজি প্রিজন ঘুষ-দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার হয়, এমপির মতো জনপ্রতিনিধি ইয়াবা-ব্যবসার সঙ্গে অভিযুক্ত, শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রী-শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে, বাবার কোলে সন্তান খুন হয়, সন্তানের হাতে লাঞ্ছিত হয় মা-বাবা.. সে-দেশের সামাজিক অবক্ষয় কী পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তা বোঝার জন্য উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন নেই। অর্থলোভ ও ক্ষমতালিপ্সা এমন বৃদ্ধি পেয়েছে যে, ব্যবসায়ীরা এখন রাজনীতি করেন। আর রাজনীতিকরা করেন ব্যবসা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সম্মানজনক পদ ছেড়ে দলীয় সংগঠনের নেতা হবারও অভিপ্রায় ব্যক্ত করছেন কেউ কেউ। উপরে যা যা উল্লেখ করলাম সবই সংবাদপত্রের বর্ণনা। চলমান সত্য ঘটনা।
সমাজের এহেন পচন রোধ করতে সরকার তথা আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা নানা কৌশল অবলম্বন করছেন। ব্যাপক ধর-পাকড়ও চলছে। সরকার স্বয়ং শুদ্ধিঅভিযান শুরু করেছে নিজ দলের ভেতর। পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে অনেক দাগি আসামী ও সন্ত্রাসী নিহতও হচ্ছে। তাতেও কি অপরাধ কমছে? মোটেই না। বরং দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মধ্যেও অপরাধপ্রবণতা মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছে ইদানিং। এটা মারাত্মক উপসর্গ। যে-কোনো সমাজের জন্য তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যে সর্ষে দিয়ে ভূত তাড়াবেন সেই সর্ষের পরতে পরতে এখন ভূতের তাণ্ডব। এমন পরিস্থিতির জন্যই হয়তো কবি বলেছেন,
بربادِ گلستاں کرنے کو ایک ہی اُلّو کافی ہے
ہر شاخ پہ اُلّو بیٹھا ہے انجام گلستاں کیا ہوگا
সামাজিক অবক্ষয়ে সাধারণ মানুষও কম উদ্বিঘ্ন নয়। সংসদের ভেতরে-বাইরে যেমন এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনও নিয়ত সভা-সেমিনার করে যাচ্ছে। সমাজের বিজ্ঞ ও বিদগ্ধজনরা প্রতিকার খুঁজছেন গভীরভাবে। অবক্ষয় রোধে নানা উপায় তালাশ করছেন। সরকারকে বিভিন্ন ধরনের শলা-পরামর্শ দিচ্ছেন। দেশের গবেষণা সংস্থাগুলোও তৎপর। বিদ্যমান গৃহীত ব্যবস্থাগুলো ব্যর্থ হওয়ায় অনেকটা বাধ্য হয়েই বলা হচ্ছে, সমাজের এই ভয়াবহ অবক্ষয় রোধ করতে হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। কেউ বলছেন, পরিবার থেকেই এই নৈতিকতা শিক্ষা দিতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই এসবের জন্য দায়ী। প্রমাণিত অপরাধের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এধরনের আরো অনেক নীতিবাক্য.. সুন্দর সুন্দর পরামর্শ। গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, এসব প্রস্তাবনা মূলত ইসলামী শিক্ষারই নীরব স্বীকৃতি| আজ যা তারা অনুভব করছেন এবং প্রচলিত পদ্ধতিতে ব্যর্থ হয়ে যা করার জন্য বলছেন তা আজ থেকে চৌদ্দশ বছর পূর্বে ইসলাম বলেছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। বরং বর্তমানের চেয়ে আরও নিকৃষ্ট ও নষ্ট সমাজকে তিনি পরিবর্তন করে পৃথিবীকে সোনার মানুষ উপহার দিয়েছেন।
ইতিহাস সাক্ষী, যে-সমাজে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্ম নিয়ে ছিলেন তা ছিল এক নিকৃষ্ট মানবসমাজ। অপরাধের এমন কোনো ধরন ছিল না যা সেখানে সংঘটিত হতো না। চুরি, রাহাজানি, বর্বরতা, হত্যা, মদ, জিনা-ব্যভিচার.. ইত্যাদি সবই ছিল। অবক্ষয়ের শেষ সীমায় উপনীত ছিল তখনকার আরবসমাজ। যে মদকে সকল অপরাধের মূল বলা হয় সেই মদের প্রায় একশটি নাম ছিল। এখান থেকে সহজেই অনুমেয়, অন্তত একশ প্রকার মদ ও মাদকদ্রব্য প্রচলিত ছিল তখন। খুন ও রাহাজানির অবস্থা এমন শোচনীয় ছিল যে, মানুষ একা একা কোথায় বের হতে সাহস করতো না। সঙ্গবদ্ধভাবে কাফেলা হয়ে সফরে বের হতো। কারণ একাকী বের হলে নিরাপদ ছিল না কেউ। বদমাশি ও অশ্লীলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, উত্তমবংশের জন্য নিজের স্ত্রীকে অন্যের বিছানায় পাঠিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করতো না। কোনো কোনো মহিলার একাধিক স্বামী থাকতো। যখন বাচ্চার জন্ম হতো, হাত-পায়ের রেখা-বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিতো। এ-ধরনের বিয়েকে ‘নিকাহে রাহত’ (نكاح الرهط) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। (সহীহ আল-বুখারী, ২/৭৬৯) নির্লজ্জতার অবস্থা ছিল এমন, অশ্লীল ও গর্হিত কাজ করার পর তা লিখে কাবা শরিফের গিলাফে ঝুলিয়ে রাখতো। গর্বভরে কবিতায় তা বর্ণনা করতো নির্দ্বিধায়। মারামারি ও হানাহানি তো ছিল তাদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। যুদ্ধ একবার লাগলে বছরের পর বছর চলতো। বিশ্ববরেণ্য ইসলামি চিন্তাবিদ আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদবী (রহ.)-এর ভাষায়- মানবতা তখন মুমূর্ষু অবস্থায় ছিল।
মানবতার এমন নাজুক মুহূর্তে আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আবির্ভূত হন। ইসলামের কালজয়ী শিক্ষায় অপরাধভরা পুরো জঙ্গলটাকেই তিনি সততা, নিষ্ঠা, ভালবাসা ও বিশ্বস্ততার নগরীতে পরিণত করলেন। এ-জন্য তিনি তিনটি পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন।
এক. মানুষের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে তাদের চিন্তা-চেতনায় বিপ্লব সৃষ্টি করা।
দুই. সেসব উপায়-উপকরণ বন্ধ করে দিলেন যা অপরাধ করতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে, উদ্দীপিত করে।
তিন. মারাত্মক অপরাধের ক্ষেত্রে কঠোর ও কঠিন শাস্তির বিধানপ্রবর্তন। এই তিনপন্থার মাধ্যমেই তখনকার আরবের অপরাধপ্রবণ নষ্ট সমাজকে বদলে দিয়েছিলেন মহানবী (সা.)। মানবতার খুনীকে মানবতার রক্ষকে পরিণত করে ছিলেন। পৃথিবী পেয়েছে অনুপম, উৎকৃষ্ট, অনুকরণীয় এক সভ্যসমাজ।
প্রথমেই তিনি মনযোগ দিলেন মানুষের অন্তর ও আকিদা-বিশ্বাসের ওপর। চেষ্টা করলেন, কীভাবে মানবহৃদয়ে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করা যায়, পরকালের জবাবদিহিতার অনুভূতি তৈরি করা যায়। মানুষ যাতে দুনিয়াতেই মৃত্যুর ওপারের জীবন উপলব্ধি করতে পারে। আখেরাতের পূর্বেই আখেরাত তার সামনে দৃশ্যমান থাকবে। অনুভব করবে, সে সর্বদা আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে। আল্লাহ তাকে দেখছেন। প্রতিনিয়ত। প্রতিটি মুহূর্ত। হৃদয়জগতে এমন বিপ্লব ও পরিবর্তনের ফলেই সাহাবিরা অতি সাধারণ গোনাহেও অস্থির হয়ে যেতেন। সীমাহীন অপরাধবোধ করতেন।
সীরাত ও হাদীসের গ্রন্থসমূহে মা‘য়েজ ও গামিদিয়া নামক এক সাহাবী ও এক সাহাবিয়ার ঘটনা প্রসিদ্ধ। রাযিয়াল্লাহু আনহুমা। মানবিক তাড়নায় তারা অপরাধ করে বসেন। তাঁদের এ অপরাধ কেউ দেখে নি, কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করেনি মহানবীর দরবারে। একমাত্র আল্লাহর ভয়ে অপরাধবোধের কারণে তাঁরা অস্থির ও বেচেইন হয়ে উঠে ছিলেন। ঈমান্দীপ্ত অন্তরের তাগিদেই তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে হাজির হয়ে ছিলেন। জানতেন, এমন অপরাধের শাস্তি অত্যন্ত কঠিন ও দৃষ্টান্তমূলক। তারপরেও অপরাধ স্বীকার করলেন। বলেননি, ভুল করে ফেলেছি আমি; বরং বলেছেন, إني هلكت يا رسول الله (হে আল্লাহর রাসূল! আমি তো ধ্বংস হয়ে গেলাম।) পাপকে তাঁরা নিজের জন্য বরবাদি মনে করতেন। রাসূল (সা.) তাঁদেরকে বারবার সুযোগ দিলেন। চেষ্টা করলেন, তাঁরা যেন স্বীকারোক্তি পরিবর্তনের পর্যাপ্ত সময় পান। কিন্তু তাঁরা প্রতিবার একই কথা বলেছেন, ‘আমাকে পবিত্র করুন।’ ‘আমাকে পবিত্র করুন।’ তাঁদের অনড় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির প্রেক্ষিতে একসময় শরয়ী হদ তাদের ওপর প্রয়োগ করা হয়। এ-কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পুরো জীবদ্দশায় মাত্র ছয়টি এমন অপরাধের সন্ধান পাওয়া যায় যার ওপর শরয়ি হদ নির্ধারিত।
মানবিক বিবেক জাগ্রত করতে এবং হৃদয়ের গহীনে অপরাধবোধ সৃষ্টি করতে মহানবী (সা.) মানুষের মন-মানসকে গুরুত্ব দিতেন। মনন ও মানসিকতা অনুযায়ী মানুষকে তরবিয়ত দিতেন। জনৈক সাহাবি এসে আল্লাহর রাসূল (সা.)কে বললেন, অন্যসব গোনাহ থেকে তো তিনি বিরত থাকতে পারেন; কিন্তু ব্যভিচার থেকে নিজেকে নিবৃত রাখতে পারেন না। ব্যভিচারের অনুমতি চাইলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে বললেন, কেউ যদি তোমার মায়ের সঙ্গে এমন গর্হিত কাজ করে তোমার ভালো লাগবে? তিনি না-সূচক জবাব দিলেন। একইভাবে বোন, স্ত্রী, কন্যার উদাহরণ দিয়েও তাকে প্রশ্ন করলেন। এমন কাজে তুমি রাজি হবে? প্রতিবার ওই সাহাবি নেতিবাচক উত্তর দিলেন। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সা.) বললেন, তুমি যে মহিলার সঙ্গে ব্যভিচার করবে সেও তো কারো না কারো মা, বোন, কন্যা বা স্ত্রী..। তখন কথা বুঝে আসলো জিজ্ঞাসু সাহাবির। সঙ্গে সঙ্গে তাওবা করলেন গর্হিত কাজ থেকে। মহানবী (সা.) বলেন, বেগানা মহিলার ওপর যদি নজর পড়ে এবং অন্তরে কামনা জাগ্রত হয়, তোমার নিজের ঘরে চলে যাও। কারণ তোমার স্ত্রীর কাছেও তা আছে যা ওই মহিলার রয়েছে। অর্থাৎ তোমার শারীরিক চাহিদা পূরণের সব সামান তো তোমার স্ত্রীর কাছেও রয়েছে।
সাধারণত মানুষ অপরাধ ও দুর্নীতি করে অর্থের লোভে। এ লোভ-লালসা দূর করতে আল্লাহর রাসূল (সা.) যারপরনাই জোর দিতেন। পার্থিব জীবনে ধন-সম্পদের অস্থায়িত্ব, দুনিয়ার অসারতা তুলে ধরতেন। আখিরাতের প্রতি মুহাব্বত সৃষ্টি করতেন মানুষের হৃদয়ে। যখনই আরাম-আয়েশের মানসিকতা অনুভব করতেন বলতেন, لا عيش إلا عيش الآخرة (প্রকৃত জীবন তো আখিরাতের জীবন)। জাহান্নামের ভয়াবহতা বর্ণনা করতেন। জান্নাতের প্রতি অনুপ্রাণিত করে তুলতেন। জান্নাত-জাহান্নামের চিত্র এমনভাবে তুলে ধরতেন যে, সাহাবিদের মন-মেজাজ পাল্টে যেতো। লোভনীয় কিছু সামনে পড়লেও, আখিরাত তাজা হয়ে যেতো তাঁদের অন্তরে। ফলে সম্পদের পাহাড় দেখলেও তাঁরা বিগলিত হতেন না। হাজারো সুযোগ থাকলেও অন্যের সম্পদে হাত লাগাতেন না। যে-দায়িত্বই দেওয়া হতো তাঁদের, আমানতদার প্রমাণিত হতেন। ক্ষমতাবানরা রাষ্ট্রীয় অর্থের পাহারাদার ছিলেন।
দ্বিতীয়ত আল্লাহর রাসূল (সা.) সেসব পথ বন্ধ করে দিলেন যা পাপ ও অপরাধের দিকে মানুষকে প্রলুব্ধ করে। গোনাহের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামে জিনা-ব্যভিচার হারাম। তাই জিনা-ব্যভিচারের পথ সুগম করে এমন সবধরনের উপায় ও পন্থা রুদ্ধ করে দিলেন তিনি। পর্দার বিধান জারি করলেন। একাকী বেগানা মহিলার সঙ্গে সাক্ষাত নিষিদ্ধ করলেন। বিয়ের প্রতি উৎসাহিত করলেন। সময় ও সুযোগ থাকার পরেও বিয়ে বিলম্ব করাকে অপসন্দ করতেন। অশ্লীল কর্মকাণ্ডকে কঠোরভাবে নিষেধ করলেন। শিক্ষা, ইবাদত, সফর.. সবক্ষেত্রে মহিলাদের নিঃসঙ্গ বের হওয়াকে পসন্দ করতেন না তিনি। ব্যভিচারের দিকে নিয়ে যায় এমন সবপথ ও সুযোগ যখন বন্ধ করে দিলেন, ব্যভিচার এমনিতেই কঠিন হয়ে গেল। জিনা থেকে পরহেয করা মানুষের পক্ষে সহজ হয়ে গেল।
মদ ও মাদকতার প্রতি তো এমন কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন যে, কেবল মদপান নিষিদ্ধ করেন নি; মদের ক্রয়-বিক্রয়, মদতৈরি, মাদকদ্রব্য বহন.. সব নিষিদ্ধ ও হারাম করে দিলেন। ফলে মদ আর সহজলভ্য রইলো না। কোনো সমাজে যদি মাদকাসক্তির প্রবণতা থাকে, আর সেখানে যদি মাদকদ্রব্য দুষ্প্রাপ্য হয়, তখন মাদকাসক্তরা বাধ্য হয়েই মদপান থেকে বিরত থাকবে। ধীরে ধীরে একসময় তা অভ্যাসে পরিণত হবে। এটাই যুক্তিসঙ্গত। পবিত্র কুরআনে কত চমৎকার করে এই নিরাময়-শিক্ষা দিয়েছে! প্রথমে মদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করল। অত:পর মাদকাসক্ত হয়ে নামাযে আসতে নিষেধ করল। তারপর চূড়ান্ত পর্যায়ে সরাসরি মদ নিষিদ্ধ করে দিল।
অপরাধ নিরোধে মহানবী (সা.)-এর তৃতীয় পন্থা ছিল আইন ও সাজা। কারণ কিছু কিছু মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতি এমন যে, আপনি যতই ভালবাসা ও গুরুত্ব দিয়ে বোঝান না কেন, তাদের বুঝে আসে না। যতই উপদেশ দিন, আদেশ-নিষেধ করুন, মন গলে না। সংশোধন বা সতর্ক হয় না। শক্ত না হলে তারা ভক্ত হয় না। কঠোর সাজা না হলে তারা নিবৃত হয় না। এমন প্রকৃতির লোকের জন্য কঠোর ও কঠিন আইন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান প্রয়োজন। বর্তমানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আসামিকে বাঁচানোর পায়তারা চলে। অপরাধের তথ্য ও দলিল দুর্বল করার কসরত পরিলক্ষিত হয় কোর্ট-আদালতে। ফলে আইনের ফাঁক দিয়ে আসামী বের হয়ে যায়। তখন ওই আসামী দ্বিগুণ উৎসাহে পুরনায় একই অপরাধ করে। সমাজের জন্য আরও মারাত্মক হয়ে উঠে। এ-জন্য প্রমাণিত অপরাধের জন্য ইসলাম কঠোর শাস্তির বিধান রেখেছে। তবে অপরাধপ্রমাণের জন্য যথেষ্ট কড়াকড়িও দেখিয়েছে। যাতে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি হয়রানির শিকার না হয়। অহেতুক শাস্তি ভোগ করতে না হয়। যথাযথ সাক্ষী-দলিল দিয়ে একবার অপরাধ প্রমাণিত হলে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োগই একমাত্র সমাধান। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি মানসিকভাবে শান্ত হয়, স্বস্তিবোধ করে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। অন্যথায় প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে। সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। তখন সমাজে আরো হানাহানি হয়। আরও রক্ত ঝরে, মানুষ মারা যায়। পক্ষান্তরে দোষী ব্যক্তির যথাযথ শাস্তি হলে, অনেক প্রাণ রক্ষা পায়। এজন্যই আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,
وَلَكُمْ فِي الْقِصَاصِ حَيٰوةٌ ۰۰۱۷۹
‘তোমাদের জন্য কিসাস (অর্থাৎ হত্যার বদলে হত্যার বিধান)-এ জীবন রয়েছে।’[1]
সামাজিক অবক্ষয় রোধে মহানবী (সা.)-এন এসব পন্থা পরীক্ষিত ও প্রমাণিত সত্য। মুসলিম রাষ্ট্রে তো বটেই; ভারতের মতো কট্টরহিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে পর্যন্ত পরোক্ষভাবে ইসলামের সেসব শ্বাশত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হচ্ছে। স্মর্তব্য, ভারতের ক্রমবর্ধমান অপরাধে যখন সবাই অতিষ্ঠ। বিশেষত ধর্ষনের ন্যায় ভয়াবহ অপরাধ মারাত্মকহারে বৃদ্ধি পেল, তখন উদ্বেগ প্রকাশ করতে গিয়ে জনৈক লিডার ও প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজের মতামত জানিয়ে বললেন, জোরপূর্বক ধর্ষনকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত। একইভাবে স্কুল-কলেজে মেয়েদের উত্যক্তকরণ এবং ইভটিজিংয়ের প্রেক্ষাপটে দিল্লির সাবেক বিজেপি সরকার অভিমত ব্যক্ত করল, স্কার্টের পরিবর্তে ইউনিফরম হিসেবে মেয়েদের শার্ট, সেলোয়ার-কামিস ও উড়না পরিধান বাধ্যতামূলক করা দরকার। তারা বিলক্ষণ বুঝেছে, বেপর্দার পরিবেশ বলবৎ রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ইভটিজিং বন্ধ করা যাবে না, ধর্ষন-সমস্যার সমাধান হবে না। একইভাবে অশ্লীল সিনেমা, টিভি চ্যানেল, পর্নোগ্রাফি সমাজে অব্যাহত রেখে.. সমাজের অবক্ষয় কখনো রোধ করা যাবে না। যে-সমাজে মানুষের মন-মানসিকতা পরিবর্তন না হবে, আত্মশুদ্ধি না ঘটবে, সে-সমাজ কখনো অপরাধমুক্ত হবে না। একইভাবে প্রমাণিত অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলে, নিত্যনতুন অপরাধী জন্ম নেবে। পুরাতন অপরাধী হবে আরো ভয়ংকর। সমাজের জন্য আরও ক্ষতিকর।
বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে এ-কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সমাজের বর্তমান পচন ও অবক্ষয় রোধ করতে হলে, বিদ্যাপীঠ থেকে সত্যিকার নাগরিক তৈরি করতে হলে, নারীর হারানো সম্মান ও অধিকার পুনরুদ্ধার করতে হলে, সর্বোপরি সমাজকে অপরাধমুক্ত করতে হলে.. আবার সোনালি অতীতে ফিরে যেতে হবে। মানবতার বিস্মৃত শিক্ষা পুনরায় অর্জন করতে হবে। সেই বাতি আবার জ্বালাতে হবে যা অসভ্য আরবসমাজে মানবতার শিক্ষক মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) জ্বালিয়ে ছিলেন। নববি শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে ছিলেন। ইসলামের যে-চেরাগ এতোদিন অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে ছিল, তা-ই এখন জ্বালাতে হবে আরেকবার।
মোদ্দাকথা সমাজের ক্রমবর্ধমান নৃশংসতা, নির্মম অপরাধপ্রবণতা, অসহনীয় দুর্নীতি রোধ করতে হলে সেই তিনপন্থাই গ্রহণ করতে হবে যা ইসলামপূর্ব নিষ্ঠুর আরবে সমাজপরিবর্তনের জন্য মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) করেছিলেন। অর্থাৎ মানুষের আত্মশুদ্ধি এবং চিন্তা-চেতনায় বিপ্লব আনতে হবে। সেসব উদ্দীপক বিষয়গুলো বন্ধ করতে হবে যার কারণে অপরাধ সংঘটিত হয়। প্রমাণিত অপরাধের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কবি সুন্দর বলেছেন,
فضول جان كر جسكو بجها ديا تم نے
وہي چراغ جلاو تو روشني ہوگي
ফালতু মনে করে নিভিয়ে দিয়েছিলে যেটা,
সেই দ্বীপ জ্বালাও, তো আলো আসবেই।
[1] আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:১৭৯
PDF ডাউনলোড করতে নিচে ক্লিক করুন…
[button link=”http://at.jamiahislamiahpatiya.com/wp-content/uploads/2019/11/November19.pdf”]ডাউনলোড করতে আমাকে ক্লিক করুন[/button]