মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সম্মান ও মর্যাদা
কাজী সিকান্দার
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। সকল যুগের সকল নবীর সর্দার। সকল মহামানবের মহান। জিন ইনসানসহ পৃথিবীর সকল জাতির নবী। যিনি শেষ নবী। পৃথিবীল রহমতস্বরূপ যিনি এ পৃথিবীতে এসেছেন তিনি হলেন মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর মর্যাদা ও সম্মানের কথা স্বয়ং আল্লাহ থেকে শুরু করে এ জগতের সকল নবী বলেছেন। তিনি দয়ার নবী, মায়ার নবী তিনি রহমতের কাণ্ডারী। তিনি দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানী।
রাসূল (সা.) সম্পর্কে কুরআন
আল্লাহ ফেরেশতার ও মানবকুল থেকে রাসূল মনোনীত করে থাকেন। (সূরা আল-হজ: ৭৫) প্রত্যাদেশকৃত অহী ভিন্ন তিনি মন থেকে কোন কথা বলেন না। (সূরা আন-নাজম: ৩-৪) অবশ্যই তারা ছিল আমার মনোনীত উত্তম বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। (সূরা সুয়াদ: ৪৭) আর আল্লাহ তাঁর রিসালাতের ভার কার ওপর অর্পণ করবেন তা তিনিই ভাল জানেন। (সূরা আল-আনআম: ১২৪) আর এমন কোন জাতি নেই যাদের কাছে সতর্ককারী বা ভীতি প্রদর্শক প্রেরিত হয়নি। (সূরা ফাতির: ২৪) আর প্রত্যেক উম্মতের জন্যই রয়েছে রাসূল। (সূরা ইউনুস: ৪৭)
রাসূল (সা.)-এর কাজ
তোমাদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন যিনি তাদেরকে তাঁর আয়াতসমূহ পড়ে শোনান, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন। অথচ ইতঃপূর্বে তারা সুস্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল। (সূরা আল-জুমুআ: ২)
ধ্বংস করেন না যে পর্যন্ত রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদেরকে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন এবং আমি জনপদসমূহকে তখনই ধ্বংস করি যখন তার বাসিন্দারা যুলুম করে। (সূরা আল-কাসাস: ৫৯) আমি সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী রাসূল প্রেরণ করেছি যাতে রাসূল আগমনের পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের কোন অভিযোগ না থাকে। আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়। (সূরা আন নিসা: ১৬৫)
আমার প্রতি এ কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে যাতে আমি তোমাদেরকে এবং যাদের কাছে এ কুরআন পৌঁছেছে সবাইকে ভীতি প্রদর্শন করি। (সূরা আল-আনআম: ১৯)
আল্লাহর পথে মানুষকে হিকমত ও উত্তম উপদেশ সহকারে দাওয়াত দাও। (সূরা আন-নাহল: ১২৫) এটাই আমার পথ যে আমি আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাই। (সূরা ইউসুফ: ১০৮) হে রাসূল আপনি তাদেরকে উপদেশ দিন আপনি কেবল উপদেশদাতা আপনাকে দারোগা বানিয়ে পাঠানো হয়নি যে আপনি তাদেরকে বাধ্য করবেন। (সূরা আল-গাশিয়া: ২১-২২) নিশ্চয় আপনার দায়িত্ব শুধু পৌঁছানো। (সূরা আর-রা’দ: ৪০) তা আপনাকে ক্লেশ দেওয়ার জন্য আমি আপনার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করি নি, কিন্তু এটা তাদেরই উপদেশের জন্য যারা ভয় করে। (সূরা তাহা: ১-৩)
মুহাম্মদ (সা.) সবার রাসূল এবং রহমত
বলুন হে মানবজাতি! আমি তোমাদের সবার প্রতিই আল্লাহর রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। (সূরা আল-আ’রাফ: ১৭৫)
আমি আপনাকে সমগ্র জগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি। (সূরা আল-আম্বিয়া: ১০৭) আমি তোমাদের প্রতি রাসূল পাঠিয়েছি সত্যের সাক্ষ্যরূপে, যেমন রাসূল পাঠিয়েছিলাম ফিরআউনের প্রতি। (সূরা আল-মুয্যাম্মিল: ১৫)
এভাবে আমরা তোমাদের একটি উত্তম জাতিরূপে গড়ে তুলেছি যাতে করে তোমরা গোটা মানবজাতির জন্য সত্যের সাক্ষ্যদাতা হতে পার এবং রাসূল (সা.) যেন তোমাদের সাক্ষ্য বা নমুনা হন। (সূরা আল-বাকারা: ১৪৩) যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় তখন আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দীনে প্রবেশ করতে দেখবেন। (সূরা আন-নাসার: ১-২)
মুহাম্মদ (সা.) সুসংবাদদাতা ও উজ্জ্বল প্রদীপ
হে নবী! আমরা আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা, ভীতি প্রদর্শক ও উজ্জল প্রদীপরূপে। (সূরা আল-আহযাব: ৪৫-৪৬) যেমন আমরা তোমাদের থেকেই তোমাদের মাঝে একজন রাসূল পাঠিয়েছি। সে তোমাদের কে আমার আয়াত পড়ে শুনাবে, তোমাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ ও বিকশিত করে তুলবে। (সূরা আল-বাকারা: ১৫১) তিনিই উম্মীদের মধ্যে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন যে তাদের নিকট আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে। তাদেরকে পবিত্র করবে এবং শিক্ষা দিবে কিতাব ও হিকমত। (সূরা আল-জুমুআ: ২)
মুহাম্মদ (সা.)-কে ভালবাসা, তাঁর আদর্শ ও চরিত্র
হে নবী! আপনি বলে দিন যে, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস তাহলে আমার অনুকরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন। (সূরা আলে ইমরান: ৩১)
নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর জীবনেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। (সূরা আল-আহযাব: ২১) নিশ্চয় আপনি উত্তম চরিত্রের ওপর অধিষ্ঠিত। (সূরা আল-কলম: ৪)
‘আলিফ লাম রা। এটি একটি গ্রন্থ, যা আমি আপনার প্রতি নযিল করেছি, যাতে আপনি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন, পরাক্রান্ত ও প্রশংসার যোগ্য রবের নির্দেশে তাঁরাই পথের দিকে। (সূরা ইবরাহীম: ১)
মুহাম্মদ (সা.)-এর মর্যাদা নিয়ে কয়েকটি হাদীস সর্বপ্রথম রাসূল (সা.) বেহেশতে প্রবেশ করবেন
হযরত আনাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন আমি বেহেশতের দরজায় এসে দরজা খুলতে বলব। তখন বেহেশতের প্রহরী এসে বলবে, আপনি কে? আমি বলব মুহাম্মদ, তখন বেহেশতের প্রহরী বলবে, আপনার বিষয়ে আমাকে আদেশ দেওয়া হয়েছে, যেন আপনার পূর্বে আর কারো জন্য দরজা না খুলি। (মুসলিম শরীফ, মিশকাত: ৫১১)
মুহাম্মদ (সা.) সমস্ত মানুষের নবী
হযরত জাবের (রাযি.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, আমাকে এমন পাঁচটি বৈশিষ্ট্য প্রদান করা হয়েছে যা ইতঃপূর্বে কোন নবীকে দেওয়া হয়নি।
- একমাসের পথের দূরত্ব পর্যন্ত শত্রুপক্ষের অন্তরে আমার ভীতি সঞ্চারিত করে আমাকে সাহায্য করা হয়েছে।
- সমগ্র ভূ-খণ্ডকে আমার জন্য মসজিদ এবং পবিত্রকারী অর্থাৎ নামায ও তায়াম্মুমের উপযুক্ত বানানো হয়েছে।
- আমার জন্য গনীমতের মাল হালাল করা হয়েছে, যা ইতঃপূর্বে কোন নবীর জন্য হালাল করা হয়নি।
- আমাকে মহান সুপারিশের দায়িত্ব দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে।
- পূর্বেকার সকল নবী নিজ জাতির কাছেই প্রেরিত হতেন আর আমি পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কাছে প্রেরিত হয়েছি।
মুসলিম শরীফের এক রেওয়ায়েতে এ হাদীসে এঅংশটুকু বাড়ানো হয়েছে যে, আমাকে শব্দ কম অর্থ ব্যাপক এমন বাণী সম্ভার প্রদান করা হয়েছে। আমার মাধ্যমে নতুন নবী আগমনের ক্রমধারা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। (সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত: ৫১২)
সকল নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ঝাণ্ডার নিচে থাকবেন
হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, একবার সাহাবায়ে কেরাম পরস্পর বসে নবীদের সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় হুযূর পাক (সা.) ঘর থেকে বাইরে তাশরীফ আনলেন এবং তাদের এই আলোচনা শুনতে পেলেন। একজন বললেন আল্লাহপাক হযরত ইবরাহীম (আ.)-কে তার বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করছেন। অন্যজন বললেন, হযরত মুসা (আ.)-এর সাথে আল্লাহপাক কোন মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি কথা বলেছেন। আরেকজন বললেন, হযরত ঈসা (আ.) তো আল্লাহর বাণী অর্থাৎ তিনি বাহ্যিক কোন উপকরণ ছাড়াই আল্লাহর একটি বাক্য ‘হয়ে যাও’-এর মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছেন এবং শৈশবকালে দোলনা থেকেই তিনি মানুষের সাথে কথা বলেছেন এবং তিনি আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ রূহ। আরেক জন বললেন, হযরত আদম (আ.)-কে আল্লাহ পাক বিশেষভাবে সম্মানিত করেছেন। অতঃপর (নবীদের সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুমের এ আলোচনা চলাকালে) হুযূর পাক (সা.) তাঁদের সামনে উপস্থিত হলেন এবং বললেন, আমি তোমাদের কথা এবং নবীদের মহান সম্মানের ব্যাপারে আশ্চর্যান্বিত হওয়া ইত্যাদি শুনছিলাম। তোমরা বলছিলে হযরত ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর বন্ধু। তিনি এরকমই। হযরত মুসা (আ.) আল্লাহর সাথে কথা বলেছেন। নিঃসন্দেহে তিনি এরকমই। হযরত ঈসা (আ.) আল্লাহর বাণী এবং তার রূহ। নিশ্চয়ই তিনি তাই। হযরত আদম (আ.)-কে আল্লাহ সম্মানিত করেছেন।
তিনিও বাস্তবে তাই ছিলেন। কিন্তু শুনে রাখ, আমি হলাম আল্লাহর হাবীব অর্থাৎ প্রিয়তম। এটা আমি অহংকার করে বলছি না। আর কিয়ামতের দিন আমিই প্রশংসার ঝাণ্ডা উড্ডীন করবো,যার নিচে থাকবেন হযরত আদম (আ.)-সহ অন্যরাও। কিয়ামতের দিন আমিই প্রথম সুপারিশকারী হব এবং আমার সুপারিশই সর্বপ্রথম কবূল হবে। এতে কোন অহংকার নেই। আমিই প্রথম ব্যক্তি হিসেবে বেহেশতের দরজায় কড়া নাড়ব। অতঃপর আল্লাহ বেহেশতের দরজা খুলে আমাকে প্রবেশ করাবেন। সেই সময় আমার সাথে থাকবে গরীব মুসলমানরা। তাও আমি অহংকার করে বলছি না। পূর্বাপর সমস্ত মানুষের মধ্যে আল্লাহর কাছে আমিই সর্বাধিক সম্মানিত। তাও অহংকার করে বলছি না। (সুনানে তিরমিযী, সুনানুদ দারিমী, মিশকাত: ৫২৩)
সকল নবীদের ইমাম ও সবার সুপারিশকারী হবেন মুহাম্মদ (সা.)
হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাযি.) থেকে বর্ণিত হুযূর (সা.) ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন আমি সমস্ত নবীদের ইমাম ও খতীব হব এবং আমি সবার সুপারিশকারী হব। একথা আমি অহংকার ছাড়াই বলছি। (সুনানে তিরমিযী, মিশকাত ৫১৩)
ভাল কাজের পূর্ণতার জন্য মুহাম্মদ (সা.) এসেছেন
হযরত জাবের (রাযি.) থেকে বর্ণিত নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহ পাক আমাকে সচ্চরিত্র এবং ভাল কর্মসমূহের পূর্ণতা বিধানের জন্য পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ মানুষ যেন সচ্চরিত্র ও ভাল কাজে পূর্ণতা অর্জন করতে পারে তার জন্যেই আমার আগমন। (মিশকাত: ৫১৪)
মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে পূর্বেকার মহামানবগণের উক্তি
আদি পুরুষ হযরত আদম (আ.) হতে সপ্তম মহাপুরুষ ইনোচ ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, প্রভু তাঁর দশ হাজার সাথীসহ আগমন করবেন সকলের ওপর ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে এবং সকল পাপকার্য ও সকল অন্যায় বাক্য মোচন করতে। (old testament General epistle of jude 1:14-15) রাসূল (সা.) দশ হাজার সাথী নিয়ে মক্কা বিজয় করেছেন।
নবী হযরত সুলায়মান (আ.) বলেন, আমার প্রিয় ব্যক্তি শুভ্র ও গোলাপী তিনি দশ সহস্রের নেতা। (soloman: 5:13)
জন স্বীকার করলেন যে, তিনি Chirist নন, তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, তাহলে আপনি কে? আপনি কি Elias? তিনি বললেন না, তারপর তাঁকে জিজ্ঞাস করা হল, আপনি কি সেই প্রতিশ্রুত নবী? তিনি বললেন, না। তারা তাঁকে জিজ্ঞাসা করল আপনি যদি Chirist বা Elias বা সেই নবী না হন, তাহলে আপনি অভিষেক করেছেন কেন? এমন একজন আছেন যাঁকে তোমরা যান না। তিনি আমার পরে আসবেন, তাঁর জুতার ফিতে খুলে দেবারও যোগ্য অমি নই। (John 1:20-27)
যিশুখ্রিস্টের ভবিষ্যদ্বাণী
আর আমি তোমাদের সঙ্গে বেশি কথা বলবো না। কারণ এই বিশ্বের সম্রাট আসছেন এবং আমার মধ্যে কিছুই নেই। (John 14:30)
জিন্দাবিস্তারের ভবিষ্যদ্বাণী
আমি ঘোষণা করছি, হে জরথুস্ট্র, পবিত্র আহমদ (ন্যায়বানদিগের আর্শীবাদ) নিশ্চয় আসবেন, যাঁর নিকট থেকে তোমরা সৎচিন্তা, সৎবাক্য, সৎকার্য এবং বিশুদ্ধ ধর্মলাভ করবে। (Zend Avesta, part 1, Tranlatated by Max Muller, p. 260)
হিন্দুদের বেদে, ইদং জনা উপশ্রুত নরাশংস স্তবিষ্যতে। অর্থাৎ নরাশংস (প্রশংসিত মানুষ, মুহাম্মদ) বেদ অবতরণের পরবর্তী যুগের মানুষ হবেন। (অথর্ববেদ সংহতি ২০/১২৭/১ (২০ কাণ্ড, অনুবাদক: ১৩, সুক্ত: ১ শ্লোক) এভাবে পূর্বেকার সকল ধর্ম বা মহামানব ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে। তেমনি ভাবে পরবর্তীগণ যারা মুসলিম হননি এমন বিখ্যাতরাও মুহাম্মদ (সা.)-কে সকল দিক দিয়ে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন।
রাসূল (সা.) সম্পর্কে বিখ্যাত কয়েকজনের উক্তি
স্যার জর্জ বার্নাড শ দ্য জেনুইন ইসলাম বইয়ের প্রথম খণ্ডে লিখেছেন, মুহাম্মদের ধর্মের প্রতি আমি সবসময় সুউচ্চ ধারণা পোষণ করি কারণ এর চমৎকার প্রাণবন্ততা। আমার কাছে মনে হয় এটাই একমাত্র ধর্ম যেটা সদা পরিবর্তনশীল জীবনযাত্রার সাথে অঙ্গীভূত হওয়ার ক্ষমতা রাখে যা প্রত্যেক যুগেই মানুষের হৃদয়ে আবেদন রাখতে সক্ষম। আমি তাঁর (মুহাম্মদ) সম্বন্ধে পড়াশোনা করেছি, চমৎকার একজন মানুষ এবং আমার মতে খ্রিস্টবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে অবশ্যই মানবতার ত্রাণকর্তা বলতে হবে।
আমি বিশ্বাস করি তাঁর মতো ব্যক্তির নিকট যদি আধুনিক বিশ্বের একনায়কতন্ত্র অর্পণ করা হতো তবে এর সমস্যাগুলো তিনি এমনভাবে সফলতার সাথে সমাধান করতেন যা বহু প্রতীক্ষিত শান্তি ও সুখ আনয়ন করতো। আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি যে মুহাম্মদের ধর্মবিশ্বাস আগামীদিনের ইউরোপের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, যা ইতোমধ্যে বর্তমান ইউরোপে গ্রহণযোগ্যতা পেতে আরম্ভ করেছে।
থমাস র্কালাইল হিরোস হিরো অ্যান্ড হিরো ওয়ারসপ অ্যান্ড হিরোইক ইন হিস্ট্রি বইতে লিখেছেন, এ লোকটিকে (মুহাম্মদ) ঘিরে যে মিথ্যাগুলো (পশ্চিমা অপবাদ) পুঞ্জীভূত হয়ে আছে- যার ভালো অর্থ হতে পারে ধর্মান্ধতা, তা আমাদের নিজেদের জন্যই লজ্জাজনক।
মহাত্মা গান্ধী তাঁর ইয়ং ইন্ডিয়া বইতে লিখেন, আমি জীবনগুলোর মধ্যে সেরা একজনের জীবন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম যিনি আজ লক্ষ কোটি মানুষের হৃদয়ে অবিতর্কিতভাবে স্থান নিয়ে আছেন, যেকোন সময়ের চেয়ে আমি বেশি নিশ্চিত যে ইসলাম তরবারির মাধ্যমে সেইসব দিনগুলোতে মানুষের জীবন-ধারণ পদ্ধতিতে স্থান করে নেয়নি। ইসলামের প্রসারের কারণ হিসেবে কাজ করেছে নবীর দৃঢ় সরলতা, নিজেকে মূল্যহীন প্রতিভাত করা, ভবিষ্যতের ব্যাপারে সতর্ক ভাবনা, বন্ধু ও অনুসারীদের জন্য নিজেকে চরমভাবে উৎসর্গ করা, তাঁর অটল সাহস, ভয়হীনতা, ঈশ্বর এবং তাঁর(নবীর) ওপর অর্পিত দায়িত্বে অসীম বিশ্বাস। এ সব-ই মুসলমানদেরকে সকল বাধা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। যখন আমি মুহাম্মদের জীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড বন্ধ করলাম তখন আমি খুব দুঃখিত ছিলাম যে এই মহান মানুষটি সম্পর্কে আমার পড়ার আর কিছু বাকি থাকলো না।
ড. উইলিয়াম ড্রেপার তার বই হিস্ট্রি অব ইনটেলেকচুয়াল ডেভলপমেন্ট ইন ইউরোপ বইতে লিখেন, জাস্টিনিয়ানের মৃত্যুর চার বছর পর, ৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে আরবে একজন মানুষ জন্মগ্রহণ করেন যিনি সকলের চাইতে মানবজাতির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, অনেক সাম্রাজ্যের ধর্মীয় প্রধান হওয়া, মানবজাতির এক তৃতীয়াংশের প্রাত্যহিক জীবনের পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করা এসবকিছুই সৃষ্টিকর্তার দূত হিসেবে তাঁর উপাধির যথার্থতা প্রমাণ করে।
আলফানসো দ্য লে মার্টিনি তার বই দ্য হিস্টি দ্য লে টেরকিতে বলেন, উদ্দেশ্যের মহত্ব, লক্ষ্য অর্জনের উপায়সমূহের ক্ষুদ্রতা এবং আশ্চর্যজনক ফলাফল যদি অসাধারণ মানুষের তিনটি বৈশিষ্ট্য হয় তবে কে মুহাম্মদের সাথে ইতিহাসের অন্য কোন মহামানবের তুলনা করতে সাহস করবে? বেশিরভাগ বিখ্যাত ব্যক্তি শুধুমাত্র সেনাবাহিনী, আইন এবং সাম্রাজ্য তৈরি করেছেন। তাঁরা যদি কিছু প্রতিষ্ঠা করে থাকেন সেটা কিছুতেই জাগতিক ক্ষমতার চাইতে বেশি কিছু নয় যা প্রায়ই তাদের চোখের সামনে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই মানুষটি শুধুমাত্র সেনাবাহিনী, আইন, সাম্রাজ্য, শাসক, লোকবলই পরিচালনা করেননি সেইসাথে তৎকালীন বিশ্বের লক্ষ-লক্ষ মানুষের জীবনকে আন্দোলিত করেছিলেন; সবচেয়ে বড় কথাহলো তিনি দেব-দেবী, ধর্মসমূহ, ধারণাগুলো, বিশ্বাসসমূহ এবং আত্মাগুলোকে আন্দোলিত করেছিলেন।
দার্শনিক, বাগ্মী, বার্তাবাহক, আইনপ্রণেতা, নতুন ধারণার উদ্ভাবনকারী ধারণাকে বাস্তবে রূপদানকারী, বাস্তব বিশ্বাসের পুনরুদ্ধারকারী বিশটি জাগতিক এবং একটি আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এই হলো মুহাম্মদ। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব পরিমাপের যত মাপকাঠি আছে তার ভিত্তিতে বিবেচনা করলে আমরা নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে পারি- মুহাম্মদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কেউ আছে কি?
পৃথিবী বিখ্যাত বই বিশ্বের একশ জন প্রভাবশালী বইয়ের লেখক মাইকেল এইচ হার্ট তার বইতে বলেন, মুহাম্মদকে সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় শীর্ষস্থান দেয়াটা অনেক পাঠককে আশ্চর্যান্বিত করতে পারে এবং অন্যদের মনে প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে, কিন্তু ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সেক্যুলার এবং ধর্মীয় উভয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ পরিমাণ সফল ছিলেন। সম্ভবত ইসলামের ওপর মুহাম্মদের তুলনামূলক প্রভাব খ্রিস্টান ধর্মের ওপর যিশু ও সেন্ট পলের সম্মিলিত প্রভাবের চেয়ে বেশি। আমি মনে করি, ধর্মীয় ও সেক্যুলার উভয় ক্ষেত্রে প্রভাবের এই বিরল সমন্বয় যোগ্য ব্যক্তি হিসেবেই মুহাম্মদকে মানবেতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী একক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভুত করেছে।
মন্টেগোমারী ওয়াট তার মুহাম্মদ ইন মক্কা বইতে বলেছেন, আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সকল প্রকার কষ্ট সহ্য করা, তাঁকে যারা বিশ্বাস করতো এবং নেতা হিসেবে অনুসরণ করতো তাদের সুউচ্চ চারিত্রিক গুণাবলি, এবং মুহাম্মদের অর্জনের বিশালত্ব এ সবকিছুই তাঁর সততার সাক্ষ্য দেয়। আমরা যদি মুহাম্মদকে সামান্য পরিমাণও বুঝতে চাই তবে অবশ্যই প্রয়োজনীয় সততা ও ন্যায়পরায়ণতা সহকারে তাঁকে বিচার করতে হবে। আমরা যদি আমাদের অতীত থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ভুলগুলো সংশোধন করতে চাই তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে চূড়ান্ত প্রমাণ আপাতদৃষ্টিতে যা সত্য বলে প্রতীয়মান হয় তারচেয়ে অনেক কঠিন শর্ত এবং এই ব্যাপারে প্রমাণ অর্জন সত্যিই দুঃসাধ্য হবে।
ডি জে হোগার্থ তার আরব বইতে বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ অথবা তুচ্ছ, তাঁর দৈনন্দিন প্রতিটি আচার-আচরণ একটি অনুশাসনের সৃষ্টি করেছে যা লক্ষ-কোটি মানুষ বর্তমানকালেও সচেতনতার সাথে মেনে চলে। মানবজাতির কোন অংশ কর্তৃক আদর্শ বলে বিবেচিত আর কোন মানুষকেই মুহাম্মদের মতো এতো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করা হয়নি। খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতার আচার-আচরণ তাঁর অনুসারীদের জীবন-যাপনকে নিয়ন্ত্রণ করেনি। অধিকন্তু কোন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাই মুসলমানদের নবীর মতো এরকম অনুপম বৈশিষ্ট্য রেখে যায়নি।
গিবন তার দ্য ডিক্লেইন ফেইল অব রোমান অ্যাম্পেয়ার (১৮২৩) বইতে বলেছেন, মুহাম্মদের মহত্বের ধারণা আড়ম্বড়পূর্ণ রাজকীয়তার ধারণাকে অস্বীকার করেছে। স্রষ্টার বার্তাবাহক পারিবারিক গৃহকর্মে নিবেদিত ছিলেন; তিনি আগুন জ্বালাতেন; ঘর ঝাড়ু দিতেন; ভেড়ার দুধ দোয়াতেন; এবং নিজ হাতে নিজের জুতা ও পোষাক মেরামত করতেন। পাপের প্রায়শ্চিত্তের ধারণা ও বৈরাগ্যবাদকে তিনি অস্বীকার করেছেন। তাঁকে কখনো অযথা দম্ভ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি, একজন আরবের সাধারণ খাদ্যই ছিলো তাঁর আহার্য। (নিউজ ৩৯, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ খ্রি.)
এমন মহামানব, যে শত্রু মিত্রু সবার কাছে সমান প্রশংসার যোগ্য তার ঝান্ডা তলে সমবেত হই। তাকে ভালবাসি তার সুন্নাতকে আকড়ে ধরি। হযরত আনাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা হুযুর (সা.) আমাকে বললেন হে বৎস! তোমার অন্তরে কারো সম্পর্কে হিংসা বিদ্বেষবিহীন অবস্থায় যদি তুমি সকাল-সন্ধ্যা কাটাতে পারো, তবে তুমি তা কর। অতঃপর রাসূল (সা.) বললেন হে বৎস এটা আমার সুন্নাত। আর যে আমার সুন্নাতকে ভালবাসল নিঃসন্দেহে সে আমাকে ভালবাসলো। আর যে আমাকে ভালবাসলো সে বেহেশতে আমার সাথেই থাকবে। (সুনানে তিরমিযী, মিশকাত: ৩০)
লেখক: পরিচালক ইসলাহ বাংলদেশ, আশরাফাবাদ, ঢাকা-১২১১
PDF ফাইল-
[button link=”http://at.jamiahislamiahpatiya.com/wp-content/uploads/2019/11/November19.pdf”]ডাউনলোড করতে আমাকে ক্লিক করুন[/button]