তালিবুল ইলমদের জন্য কয়েকটি আরবি গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
মাহফুয আহমদ
এক.
رسائل الإمام زاهد الكوثري r إلى العلامة محمد يوسف البنوري r
উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী (বানুরী) রাহিমাহুল্লাহর প্রতি লেখা আল্লামা যাহিদ আল-কাউসারী রাহিমাহুল্লাহর চিঠিগুলো অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করলাম। শায়খ সুউদ ইবনে সালিহ আসসারহান চিঠিগুলো শায়খ বিন্নুরী রাহিমাহুল্লাহর ছেলে থেকে সংগ্রহ করেছেন। ৪৫ টি চিঠি স্থান পেয়েছে এই বইয়ে। তবে শায়খ আল-কাউসারীকে লেখা বিন্নুরীর চিঠিগুলোর হদিস এখনও মেলেনি। চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ২৮৮ পৃষ্ঠার এই কিতাবটি সংগ্রহ অতঃপর অধ্যয়ন করে খুবই উপকৃত হলাম, আল-হামদুলিল্লাহ! উভয় মনীষী সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে চিঠির ভাষা ও ভাষ্য, বিষয় ও ভাবার্থ থেকে যে কয়েকটি দিক লক্ষণীয় সেগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করছি।
- আল্লামা যাহিদ আল-কাউসারী রাহিমাহুল্লাহর জীবনের নানা দিক ও প্রসঙ্গ ফুটে উঠেছে চিঠিগুলোতে। যেমন-
- কায়রোতে তিনি কোথায় অবস্থান করেছেন।
- তাঁর শারীরিক সুস্থতা ও অসুস্থতার বর্ণনা। এই সময়ে তিনি বেশ কয়েকটি কাজ খুব দ্রুত করে রেখেছিলেন; পরবর্তী সময়ে অপারগ হয়ে যাওয়ার ভয়ে। তাছাড়া কিছু কাজ করতে তিনি অপারগতাও পেশ করেছেন। শায়খ বিন্নুরী রাহিমাহুল্লাহ তাঁকে শারহু মাআনিল আসারের ওপর কাজ করার অনুরোধ করলে প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, আমার শারীরিক অসুস্থতা এই কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
- তাঁর জীবনসঙ্গিনীর সুস্থতা ও অসুস্থতার বর্ণনা।
- আল-কাউসারী রাহিমাহুল্লাহর চারিত্রিক গুণাবলিও চিঠিগুলো থেকে প্রস্ফুটিত হয়েছে। যেমন-
- তাঁর শারাফত ও আত্মসম্মানবোধ। যখনই আল্লামা বিন্নুরী কোনো কিতাব হাদিয়া পাঠিয়েছেন তখনই আল-কাউসারী মিসর থেকে বিন্নুরীর জন্য নিত্যনতুন কিতাবের হাদিয়া পেশ করেছেন।
- তাঁর ধৈর্য ও অবিচলতা। চিঠিতে তিনি নিজের শারীরিক অসুস্থতা ও অক্ষমতার কথা খুব কমই উল্লেখ করেছেন। বরং সেদিকে ইঙ্গিত করতেও যেন সতর্কতা অবলম্বন করেছেন; যাতে অন্যদের কষ্টের কারণ না হয়। একান্ত কোনো বিষয়ে অপারগতা পেশ করতে হলে অসুস্থতার কথা বলেছেন।
- তাঁর বিনয়। আল্লামা বিন্নুরী চিঠিতে আল্লামা আল-কাউসারীকে যেসব অভিধায়ে স্মরণ করেছেন, যেমন- ইমাম, আল্লামা ইত্যাদি ব্যবহার না করতে আল-কাউসারী তাঁকে বারবার অনুরোধ জানিয়েছেন।
- ইলমের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও আকর্ষণ। যেমন-
- ইলমি কাজের খোঁজ-খবর নেওয়া। প্রায় প্রত্যেকটি চিঠিতেই দেখা যায় তিনি হিন্দুস্তানি, বিশেষত দেওবন্দী আলেমদের ইলমি কাজের আপডেট জানতে চেয়েছেন। অমুক কিতাবের কাজ কেমন হয়েছে, তমুক কিতাব কি ছেপে এসেছে?।
- কিতাব সংগ্রহের আকাঙ্ক্ষা। আল-কাউসারী কখনও বিন্নুরী থেকে পার্থিব কিছু চাননি। তবে কিতাব সংগ্রহ করে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন বহুবার। এক্ষেত্রে আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রাহিমাহুল্লাহ, আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী রাহিমাহুল্লাহ, আল্লামা যফর আহমদ উসমানী রাহিমাহুল্লাহ এর কিতাবগুলোর কথা সবিশেষ উল্লিখিত হয়েছে।
- আলেমদের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা ও আন্তরিকতা। যেমন-
- আলেমদের সার্বিক খোঁজ-খবর নেওয়া। বেশ কয়েকটি চিঠিতে আল্লামা আশরাফ আলী থানবী ও মুফতি মাহদী হাসান শাহজাহানপুরী রাহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ আহলে ইলমের কথা তিনি সযত্নে জিজ্ঞেস করেছেন।
- আলেমদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন করা। বিশেষত তিনি আল্লামা বিন্নুরীকে ইলমি কাজ আঞ্জাম দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও অসুস্থতার প্রতি খেয়াল রাখতে তাগিদ করেছেন।
- আলেমদেরকে ইলমি কাজ সম্পাদনায় অনুপ্রেরণা দান। বিশেষত আল্লামা বিন্নুরীকে তাঁর মাআরিফুস সুনানের কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে তিনি বারবার পরামর্শ ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।
এখানে সামান্য কয়েকটিমাত্র দিকের কথা বললাম। চিঠিগুলোতে সমৃদ্ধ হওয়ার মতো অনেক উপাদান রয়েছে। কিতাবটি প্রকাশ করেছে জর্ডানের দারুল ফাতহ। ঢাকার মাকতাবাতুল আযহার থেকে এই কিতাবসহ দারুল ফাতহ এর অন্যান্য কিতাব সংগ্রহ করতে পারবেন আশা করি।
দুই.
مباحث في عقائد أهل السنة
আল্লামা খলীল আহমদ সাহারানপুরী রাহিমাহুল্লাহ (জন্ম: ১২৬৯ হি. = মৃত্যু: ১৩৪৬ হি.) আরব-আজম সর্বত্র পরিচিত একজন হাদীস ব্যাখ্যাতা। সুনানে আবু দাউদের ওপর রচিত তাঁর বৃহৎ ব্যাখ্যাগ্রন্থ বাযলুল মাজহুদ বোদ্ধামহলে সমাদৃত। ১৩২৩ হিজরীতে হিন্দুস্তানি কিছু লোক আরবের আলেমদের একথা বোঝাতে চেষ্টা করে যে, দেওবন্দ পড়ুয়া এবং দেওবন্দের সঙ্গে সম্পৃক্ত আলেমগণের আকীদায় সমস্যা আছে, তারা ওয়াহাবী। এরকম অবাস্তব কতগুলো মিথ্যা অভিযোগ তারা পেশ করতে থাকে। দিনদিন সেই প্রোপাগান্ডা বাড়তে থাকে। শায়খুল ইসলাম সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহিমাহুল্লাহ তখন মদিনায় অবস্থান করছিলেন। হাদীস অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ১৩২৫ হিজরীতে তিনি দেওবন্দের আলেমগণ সংক্রান্ত সেখানকার আলেমদের কয়েকটি প্রশ্ন লিখে পাঠান হিন্দুস্তানে। আর আল্লামা সাহারানপুরি রাহিমাহুল্লাহ তখন ওইসব প্রশ্নের জবাব পেশ করেন। পরবর্তীতে ওই উত্তরমালা সত্যায়ন করে সাক্ষর করেন তৎকালীন আরব বিশ্বের একাধিক নির্ভরযোগ্য আলেম। বস্তুত ১৩২৫ হিজরীতে ওইসব উত্তর এবং ওই আলেমদের সাক্ষরসহ আল-মুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদ নামক বইটি প্রকাশিত হয়।
ইংল্যান্ডের লেস্টার শহরে অবস্থিত দারুল ইফতা এর ডাইরেক্টর, মুফতি মুহাম্মদ ইবনে আদম আল-কাউসারী হাফিযাহুল্লাহ বইটির ওপর কিছু কাজ করেন। বইয়ে উল্লিখিত ব্যক্তি ও জায়গার নাম এবং পরিভাষাগুলো ব্যাখ্যা করেন তিনি। তাঁর টীকাযুক্ত বইটি জর্ডানের দারুল ফাতহ থেকে মাবাহিস ফি আকাইয়িদি আহলিস সুন্নাহ নামে প্রকাশিত হয়। ইতোমধ্যে দেড়শত পৃষ্ঠার এই বইয়ের তিনটি সংস্করণ বের হয়ে গেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, বইটি মূলত আকীদার মৌলিক কোনো বিষয়ের ওপর রচিত হয়নি। উপরন্তু বইয়ের মধ্যে আলোচিত দিকসমূহ আকীদার শাখাগত কয়েকটি মাসায়েল। মুফতি মুহাম্মদ ইবনে আদম আল-কাউসারী সাহেবের টীকা সংবলিত সংস্করণের ভূমিকায় দারুল উলুম করাচির সাবেক মুহাদ্দিস ও সহকারী মুফতি শায়খ মাহমুদ আশরাফ উসমানী রাহিমাহুল্লাহ এ প্রসঙ্গটি তুলে ধরেছেন। বই পাঠের পূর্বে তাঁর ওই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি অবশ্যই পড়ে নেওয়া দরকার মনে করছি।
তিন. كُتَّاب النبي ﷺ
শায়খ মুসতাফা আযমী (জন্ম: ১৯৩২, মৃত্যু: ২০১৭) বিদ্বান মহলে খুবই পরিচিত একটি নাম। দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ১৩৭২ হিজরীতে ফারিগ হন। তারপর মিসরের জামেয়া আযহারে অধ্যয়ন করেন। অধ্যাপনা জীবনে তিনি ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে কয়েকবছর হাদীসের লেকচারার ছিলেন। পরে মক্কা ও রিয়াদে অধ্যাপনার কাজ করেন। মুশতাশরিকিন বা ওরিয়েন্টালিস্ট (প্রাচ্যবিদ)-দের খণ্ডনে তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৪০০ হিজরীতে বাদশাহ ফায়সাল পুরষ্কারেও তিনি ভূষিত হয়েছিলেন।
বৃক্ষের পরিচয় ফলে। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ তাঁর ইলমি অবস্থা ও অবস্থানের জানান দেয়। এটিও তাঁর একটি চমৎকার বই। সাধারণত আমরা কাতিবে ওহি হিসেবে কয়েকজন সাহাবায়ে কেরামকে চিনি। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর যখন ওহি নাজিল হতো, তখন তিনি কোনো এক কাতিবে ওহিকে হুকুম করতেন সেটা নির্ধারিত জায়গায় লিখে রাখতে। ড. মুসতাফা আযমী রাহিমাহুল্লাহ তাঁর বইয়ে শুধু কাতিবে ওহি সাহাবিদের নিয়ে আলোচনা করেছেন এমন নয়। বরং তিনি পুরো লেখার বিষয়টা নিয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধান করার প্রয়াস পেয়েছেন। নববী যুগে লেখার পদ্ধতি কেমন ছিলো, ওহি ছাড়া তখন কাতিবে ওহি সাহাবিগণের আর কী লেখার দায়িত্ব ছিলো, নবীজির চিঠি ও ফরমানগুলো লেখার কাজ কারা আঞ্জাম দিতেন, কোন কাতিবে ওহি কতদিন লিখেছেন, তাঁদের কাউকে কি কখনও লেখার কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিলো এরকম বহু প্রশ্নের তাত্ত্বিক সমাধান পাওয়া যায় তথ্যবহুল এই বইয়ে। শতাধিক পৃষ্ঠার এ মূল্যবান গ্রন্থটি বয়রুতের আল মাকতাবুল ইসলামি প্রথম ছাপায় ১৩৯৪/১৯৭৪ সালে। এরপর বইটির একাধিক সংস্করণ বের হয়েছে।
চার.
لمحات من التربية الفقهية
শায়খ আবদুল হালিম নু’মানী হাফিযাহুল্লাহ আল্লামা আবদুর রশিদ নু’মানী রাহিমাহুল্লাহর ছোটভাই। প্রখ্যাত একজন আলেম। পাকিস্তানের করাচিস্থ বিন্নুরী টাউন মাদরাসায় তিনি উচ্চতর হাদীস বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইতোমধ্যে তাঁর একাধিক কিতাব প্রকাশিত হয়েছে। মিশকাতুল মাসাবীহের জগদ্বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ আল্লামা মোল্লা আলী কারী রাহিমাহুল্লাহ প্রণীত মিরকাতুল মাফাতীহের জন্য তিনি পরিচিতিমূলক একটি চমৎকার ভূমিকা লিখেছেন; যা আল-বিযাআতুল মুযজাহ লিমান উতালিউল মিরকাহ নামে ছাপা হয়েছে।
এটিও তাঁর লেখা সুন্দর একটি বই। তথ্যের বাহুল্য বইটির সৌন্দর্য ও গ্রহণযোগ্যতা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিয়েছে। ৮০ পৃষ্ঠার এ পুস্তকটি প্রথমে ১৪২৫/২০০৪ সালে পাকিস্তানে ছাপা হয়। তারপর ১৪৩৫/২০১৪ সালে আরবের স্বনামখ্যাত প্রকাশনী জর্ডানের দারুল ফাতহ থেকে প্রকাশ পায়। ফিকহী অনুশীলনের পটভূমি, ইতিহাস এবং ক্রমধারা নিয়ে তিনি এই গ্রন্থে প্রামাণিক আলোচনা করেছেন। নবীজি (সা.) কীভাবে সাহাবীগণকে ফিকহ শিক্ষা দিতেন বা ফকিহ হিসেবে গড়ে তুলতেন, সাহাবায়ে কেরাম ফিকহ ও ফতওয়ার বেলায় কোন কর্মপন্থা অবলম্বন করেছিলেন, তাঁদের নিকট ফিকহ এর কীরূপ গুরুত্ব ছিলো, তাবেয়িগণ কীভাবে এই ধারা চালু রেখেছিলেন ইত্যাকার নানান প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত অথচ প্রশান্তিদায়ক ব্যাখ্যা পেশ করেছেন প্রাজ্ঞ এই আলেম।
বইয়ের সংক্ষিপ্ত ভূমিকায় শায়খ আবদুল হালিম নু’মানী বলেন, ১৪২২ হিজরী সনে বর্তমান বিশ্বের বিখ্যাত হাদীস বিশারদ ড. বাশশার আওয়াদ মারুফ আমাদের এখানে করাচিতে আগমন করেন। তাঁর সঙ্গে এবিষয়ে আমার কথাবার্তা হয়। জিজ্ঞেস করলাম, এই বিষয়ে কোনো বই রচিত হয়েছে? মাথা নেড়ে জানালেন, এ বিষয়ে কোনো বই আছে বলে তাঁর জানা নেই। হাদীসে নববি এর প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা ও গভীর সম্পৃক্ততার খাতিরে তিনি নিজের জন্য এবং স্বীয়পুত্র বুনদার এর জন্য আমার নিকট হাদীসের সনদের ইজাযত চেয়ে বসলেন! (পৃ. ৬)
পাঁচ.
الصبر على الزوجات والحلم عليهن
বইটি আমার সংগ্রহে এসেছে মাস তিনেক আগে। জর্ডানের দারুল ফাতহ বইটি প্রথম ছেপেছিল ২০১৬ সালে। এরপর থেকে একাধিক সংস্করণ বের হয়ে গেছে। বইয়ের সম্মানিত লেখক ইউসুফ আবজেক আসসূসী সম্পর্কে আমার তেমন জানাশোনা নেই। তবে বইয়ের জন্য তিনি যে বিষয় বা শিরোনাম চয়ন করেছেন তা আকর্ষণীয়। ৯১ পৃষ্ঠার এই বইয়ে তিনি স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কিত বিবিধ টপিক নিয়ে কথা বলেছেন। অবশ্য পুরো বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, পূর্ববর্তী নবীগণ, ওলি, আলিম ও বিজ্ঞজন কীভাবে তাঁদের স্ত্রীগণকে ট্রিট করেছেন, কীভাবে স্ত্রীদের জ্বালাযন্ত্রণা ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করে গেছেন এবং কীভাবে নিজেদের মহানুভবতা ও উৎকৃষ্ট চরিত্রের পরিচয় দিয়েছেন ইত্যাদি।
আমাদের মনে রাখা দরকার, বইটি স্ত্রীগণ সম্পর্কে নেগেটিভ বা নেতিবাচক কোনো ধারণা সৃষ্টি করার জন্য রচিত হয়নি। বরঞ্চ স্ত্রী তার স্বামীকে কোনোভাবে কষ্ট দিয়ে থাকলেও স্বামীর জন্য স্ত্রীকে কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না এবং তার জন্য ধৈর্য ধারণ করাই বুদ্ধিমত্তার কাজ হবে- এটাই বইয়ের মূল মেসেজ বা মৌলিক বার্তা।আমাদের কাছে তো কত মানুষ কত অভিযোগ নিয়ে আসে নিজেদের স্ত্রীদের ব্যাপারে এ বই পড়া থাকলে সেসব মানুষকে বোঝানো বা সান্ত্বনা দেওয়া সহজ হবে।
ছয়.
من توفي من العلماء وهو ساجد
এটিও একটি চমৎকার গ্রন্থ। পূর্ববর্তী যেসব ওলামায়ে কেরাম সিজদারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন লেখক তাঁদের জীবনেতিবৃত্ত উল্লেখ করার প্রয়াস পেয়েছেন। এ তালিকায় সাহাবি, তাবেয়ি এবং তৎপরবর্তী সময়ের পুণ্যাত্মাদের নাম রয়েছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরও অস্তিত্ব রয়েছে এই তালিকায়। ২০৪ পৃষ্ঠার এই সুখপাঠ্য বইটি প্রথম ছাপা হয় ২০১৫ সালে। লেখক ড. মুহাম্মদ ইবরাহিম সাঈদ আল ফারিসি তার বইটি সাজিয়েছেন একটি ভূমিকা এবং দুটি পরিচ্ছেদে। ভূমিকায় তিনি তার বইয়ের আলোচ্য বিষয়ের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, এ নিয়ে লেখার কারণ ও প্রেক্ষাপট, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে লিখিত অন্যান্য গ্রন্থের পর্যালোচনা, গ্রন্থটি রচনার ক্ষেত্রে তার নিয়ম ও পদ্ধতি ইত্যাদি কতক দিক ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথম পরিচ্ছেদে তিনি হুসনে খাতেমা ও সুয়ে খাতেমা বা শুভ ও অশুভ পরিণতি এর মর্ম ও ব্যাখ্যা, এ দুয়ের প্রকারভেদ ও কারণসমূহ এবং মুমূর্ষু ব্যক্তি সংক্রান্ত কিছু বিধিবিধান নিয়ে আলোচনা করেছেন। আর দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে তিনি সিজদারত অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী পুণ্যবানদের জীবনালেখ্য পেশ করেছেন। বইয়ের শেষে একটি পরিশিষ্ট, গ্রন্থপঞ্জি ও বিষয়সূচি দিয়ে পাঠকদের জন্য উপকৃত হওয়ার পথ সহজ করে দিয়েছেন বিজ্ঞ লেখক।
জানার বিষয় হলো, এই তালিকায় ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহর নামও শুভা পেয়েছে। বইয়ের ৮২-৯০ পৃষ্ঠায় লেখক ইমাম আবু হানিফা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। লেখক তার পুরো বইয়ে প্রতিটি পয়েন্ট নির্ভরযোগ্য আরবি গ্রন্থাদির উদ্ধৃতিতে প্রমাণ করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন; যা সচেতন পাঠকদের জন্য প্রশান্তিদায়ক কিংবা স্বস্তিকর। এই বই সামনে রেখে এরকম আরও নতুন নতুন বিষয়ে গ্রন্থ সংকলন করা যেতে পারে। অভিনব দিকগুলো অনুসন্ধান করে একটি তালিকা প্রস্তুত করতে পারেন। যেমন- কুরআন তেলাওয়াতের অবস্থায় যেসব মনীষীর মৃত্যুবরণ হয়েছে এবং তখন তারা কোন কোন আয়াত তেলাওয়াত করছিলেন ইত্যাকার নানাবিধ প্রসঙ্গ রয়েছে।
সাত.
منهج العلامتين شبلي النعماني وسليمان الندوي في كتابيهما سيرة النبي ﷺ
শায়খ ড. তকী উদ্দিন নদবী হাফিযাহুল্লাহ বর্তমান বিশ্বের একজন স্বনামখ্যাত আলেম। আরবি কিতাব তাহকীকের জগতে তিনি বহু যুগান্তকারী কাজ করে যাচ্ছেন। হিন্দুস্তানি ওলামায়ে কেরাম রচিত আরবি কিতাবগুলো আরব থেকে আধুনিক মানসম্মত ছাপায় প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে দীর্ঘকাল। ইতোমধ্যে আরবি ভাষায় তাঁর জীবন ও কর্মের ওপর বিশদ একটি গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে।
ফরিদ উদ্দিন নদবী তাঁরই সুযোগ্য নাতি। আল্লামা শিবলি নু’মানী এবং আল্লামা সুলায়মান নদবী রাহিমাহুমাল্লাহ রচিত সাড়া জাগানো সিরাত গ্রন্থ নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী একটি চমৎকার অভিসন্দর্ভ প্রস্তুত করেছেন। সিরাত রচনায় মনীষীদ্বয়ের নিয়ম-পদ্ধতি, চিন্তা-চেতনা, নতুনত্ব-অভিনবত্ব ইত্যাকার নানান দিক তুলে ধরেছেন। পশ্চিমা প্রাচ্যবিদদের খণ্ডনে মনীষীদ্বয়ের যে প্রজ্ঞা, পাণ্ডিত্য পরিশ্রম ও সার্থকতা সেটাও এতে ফুটে উঠেছে খুব সুন্দরভাবে। তিন শত পৃষ্ঠার এই বইটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। বইটি ছেপেছে জর্ডানের দারুল ফাতহের সহযোগী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আরওয়িকা (উভয়টির সত্ত্বাধিকারী একজনই: ড. ইয়াদ আহমদ আলগুজ)।
আট.
تقسيم الأخبار ودلالتها عند السادة الحنفية
শাগরেদ এবং উস্তাদের সাহেবযাদার গল্প! নিয়মানুযায়ী গতদিন গিয়েছিলাম লন্ডনের সর্ববৃহৎ আরবি ও ইলমি কিতাবের পরিবেশনা ও বিক্রয়কেন্দ্র আযহার একাডেমিতে। উদ্দেশ্য ছিলো দারসি ও গায়রে দারসি কিছু কিতাব সংগ্রহ করা। সদ্য প্রকাশিত বা নতুন আমদানিকৃত কিতাবগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়া। আল-হামদুলিল্লাহ! ইংলিশ ভাষায় রচিত শামায়েলে তিরমিযীর কয়েকটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ, আরবি ভাষাশিক্ষা বিষয়ক কিছু কিতাব এবং অন্যান্য কতগুলো মূল্যবান গ্রন্থ কেনার সুযোগ হয়। নতুন আসা কিতাবগুলো নাড়াচাড়া করতে গিয়ে শায়খ ড. মুহি উদ্দিন আওয়ামা হাফিযাহুল্লাহর এই রিসালাটি চোখে পড়লো। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ৬০ পৃষ্ঠার এই বইটির দাম ৯ পাউন্ড ২০ পেন্স। তথা বাংলাদেশি মুদ্রার হিসেবে প্রায় ১ হাজার টাকা! আরও মজার বিষয় হলো, ৬০ পৃষ্ঠার এ বইয়ের অর্ধেকই বিভিন্ন আলেমের লেখা ভূমিকা বা অভিমত! মাওলানা সাইয়েদ আরশাদ মাদানী, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানি এবং মাওলানা আবদুল মালেক সাহেব হাফিযাহুমুল্লাহ ছাড়াও আরব-আজমের বেশ কয়েকজন বিজ্ঞ আলেম অভিমত লিখে দিয়েছেন।
বিদগ্ধ হাদীস গবেষক, শায়খ আবদুল মালেক হাফিযাহুল্লাহর অভিমতটি পড়ে বেশ ভালো লাগলো। তিনি স্বীয় উস্তাদ (আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামা হাফিযাহুল্লাহ)-এর সাহেবযাদাকে সম্বোধন করেছেন, أخي الكريم سيدي وابن سيدي الأستاذ الفاضل الشيخ বলে; যা তাঁর বিনয় ও মহানুভবতার পরিচয় বহন করে। এছাড়া তিনি অত্যন্ত জরুরি ও উপকারী কতেক বিষয়ের প্রতি তালিবুল ইলমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আর শায়খ মুহি উদ্দিনও স্বীয় পিতার যোগ্য উত্তরসূরি এই পণ্ডিত আলেমের সঙ্গে শায়খ আল্লামা শব্দদ্বয় ব্যবহার করে যথার্থ মূল্যায়ন দেখিয়েছেন।
নয়.
صفحات مضيئة من حياة سيدي الوالد العلامة محمد عوامة
আমাদের সময়ের জীবন্ত এক কিংবদন্তি হলেন হাদীসশাস্ত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র, জগদ্বিখ্যাত গবেষক, আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামা হাফিযাহুল্লাহ। গোটা বিশ্বে তাঁর ইলমি কারনামা, যশ ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। জীবনের ৭৯টি বসন্ত পার করে দিয়েছেন এই মনীষী।তাঁর সম্পর্কে জানার আগ্রহ ও কৌততহল বহুদিনের। গত ফেব্রুয়ারিতে তুরস্কের সফরে গেলে তাঁর ঘরেও যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। তাঁর সুযোগ্য সন্তান, ড. শায়খ মুহি উদ্দিন আওয়ামা কয়েকটি কিতাব হাদিয়া করলেন। সেগুলোর মাঝে এটিও একটি।
এটি মূলত বিগত বছর তুরস্কের ইবনে খালদুন ইউনিভার্সিটি যখন শায়খ আওয়ামার জীবন ও কর্মের ওপর একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স করেছিলো, সেই সময় ছাপা হয়। এটি লেখার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিলো শায়খ ড. মুহি উদ্দিনের ওপর। তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। চমৎকার ভাষা ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে একটি তথ্যবহুল জীবনীগ্রন্থ উপস্থাপন করেছেন। আজ এক বৈঠকেই বইটি পড়ে শেষ করলাম। বেশ মুগ্ধ হয়েছি ছেলের লেখার ভঙ্গি আর বাপের জীবনের গতি দেখে। অনেক জরুরি ও উপকারী তথ্য জানা হলো। শায়খের শিক্ষাজীবন, শিক্ষকতা ও পারিবারিক জীবন ইত্যাদি সবই বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। সবচেয়ে ভালো লেগেছে, ড. মুহি উদ্দিন শায়খের লেখালেখি ও তাহকিকের মানহাজ বা নিয়ম-পদ্ধতিগুলোর কথা সযত্নে উল্লেখ করে দিয়েছেন। ১৪৪ পৃষ্ঠার এ মূল্যবান বইটি ছেপেছে সাউথ আফ্রিকার দারুল হাদীস আল-আওয়ামিয়া। সুযোগ থাকলে আপনিও কিতাবটি সংগ্রহ করুন। পড়ুন। সমৃদ্ধ হোন। আল্লাহ তায়ালা শায়খ আওয়ামাকে সুস্থতার সহিত দীর্ঘ হায়াত নসিব করুন। আমীন।
দশ.
عقود العقائد في فنون الفرائد
আকীদাবিষয়ক দুটি কাব্যগ্রন্থ। প্রথমটি ইমামযাদা উপনামে পরিচিত হানাফি ফকীহ আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর আল-বুখারী রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু: ৫৭৩ হি.) রচিত উকুদুল আকায়িদ ফি ফুনুনিল ফাওয়াইদ আর দ্বিতীয়টি আল্লামা আহমদ ইবনে আবুল মুয়াইয়াদ আল-মাহমুদী আন-নাসাফী রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু: ৫১৯ হি.) রচিত আল-মানযুমাতুর রায়িয়া। মাতুরীদী মতাদর্শের ব্যাখ্যানুসারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আকীদা এই কাব্যগ্রন্থ দুটোতে ফুটে উঠেছে। আকীদার মৌলিক ও প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো সংক্ষিপ্ত অথচ আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে উল্লিখিত হয়েছে। তুরস্কের তরুণ গবেষক মুহাম্মদ উসমান দুগান ইস্তাম্বুলের বিভিন্ন গ্রন্থাগার থেকে এই দুটি কাব্যগ্রন্থের একাধিক পাণ্ডুলিপি বা হস্তলিখিত কপি উদ্ধার করেন। এরপর তিনি সেগুলোর ওপর তাহকীক বা নিরীক্ষণের কাজ করেন। ২৯৬ পৃষ্ঠার এই সংকলনটি জর্ডানের দারুল ফাতহ থেকে ১৪৩৯/২০১৮ সালে প্রথম ছাপা হয়।
সদ্য প্রকাশিত এই সংস্করণের ভূমিকা লিখেছেন বিদগ্ধ গবেষক ড. হামযা মুহাম্মদ ওয়াসিম আল-বাকরী হাফিযাহুল্লাহ। ড. হামযার জন্ম ফিলিস্তিনে। তবে তাঁর শৈশব ও যৌবন কেটেছে জর্ডানে। লেখাপড়ার জন্য বেশ কয়েকটি আরব দেশ তিনি সফর করেছেন। কিছুদিন কুয়েতে অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বর্তমানে তিনি ইস্তাম্বুলের ইবনে খালদুন ইউনিভার্সিটির আকায়িদ ও হাদীস বিভাগের লেকচারার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। অধমের তুরস্ক সফরে বিদগ্ধ এই গবেষকের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাত হয়। বিবিধ প্রসঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তা হয়। সেসময় তিনি এই সংকলনটি হাদিয়া করেছিলেন। বইয়ের শুরুতে ড. হামযা আল বাকরির ৫ পৃষ্ঠার ভূমিকাটি খুবই তাৎপর্যবহ। তিনি সেখানে মাতুরীদী ও আশআরি মতাদর্শের তুলনামূলক পর্যালোচনা করেছেন চমৎকারভাবে। সুযোগ থাকলে বইটি সংগ্রহ করে শুধু তাঁর ভূমিকা পড়েও অনেক সমৃদ্ধ হতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।
লেখক: আলোচক, ইকরা টিভি লন্ডন