ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধে করণীয়?
ডা. অমর বিশ্বাস
ডেঙ্গুজ্বর সাধারণত একটি সংক্রামক রোগ যা ডেঙ্গু ভাইরাসের (A. Aegyti ভাইরাস) কারণে হয়। এডিস নামক এক ধরনের মশার কামড়ে এ রোগ হয়। ভাইরাসটির ৪টি ভিন্ন ভিন্ন প্রকার আছে যার একটি প্রকারের সংক্রমণ সাধারণত সেই প্রকারের বিরুদ্ধে জীবনভর প্রতিরোধ ক্ষমতা দেয়, কিন্তু অন্য প্রকারগুলোতে স্বল্পমেয়াদ প্রতিরোধ ক্ষমতা দেয়। পরবর্তীতে অন্য প্রকারের সংক্রমণ হলে সেটি প্রবল জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোন ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তি ৪ থেকে ৬ দিনের মধ্যে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়। আবার, আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোন জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটিও ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবেই এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণুবাহী এডিস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস, বিশেষ করে গরম ও বর্ষার (বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী) সময় ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ অনেক বেশি থাকে। অপরদিকে শীতকালে সাধারণত এ জ্বর হয় না বললেই চলে।
ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ
ডেঙ্গু প্রধানত দু’ধরনের হয়, যেমন- ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু, ফিভার ও হেমোরেজিক ফিভার:
- ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর এবং সেই সঙ্গে শরীরে প্রচন্ড ব্যথা হয়ে থাকে।
- জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে।
- শরীরের বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে মাথায়, চোখের পেছনে, হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়।
- জ্বর হওয়ার ৪ থেকে ৫ দিন পর সারা শরীরে লালচে দানা দেখা যায়, সঙ্গে বমি বমি ভাব বা বমি, রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তবোধ করে, রুচি কমে যায় ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যেতে পারে।
- কিছু কিছু ক্ষেত্রে, ২ বা ৩ দিন পর আবার জ্বর আসে।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গের পাশাপাশি আরও কিছু সমস্যা দেখা যায়। যেমন-
- শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া,
- পায়খানার সঙ্গে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা,
- মেয়েদের বেলায় অসময়ে ঋতুস্রাব বা রক্তক্ষরণ, বুকে বা পেটে পানি আসা ইত্যাদি।
- আবার, লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস, কিডনিতে আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিতে পারে।
- ডেঙ্গুজ্বরের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের সঙ্গে সার্কুলেটরি ফেলিউর যোগ হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়।
ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ
- এ ছাড়াও মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হতে পারে। জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ৪ থেকে ৫ দিনের মাথায় সারা শরীরে লালচে দানা দেখা যায়, যাকে স্কিনর্যাশ বলে। এটা অনেকটা অ্যালার্জি বা ঘামাচির মতো। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব এমনকি বমিও হতে পারে।
- ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করে এবং খাবারে রুচি কমে যায়। এ অবস্থাটা অত্যন্ত জটিল হতে পারে, যেমন- অন্যান্য সমস্যার পাশাপাশি শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হতে পারে, যেমন- মাড়ি ও দাঁত থেকে, কফের সঙ্গে, রক্ত বমি, চামড়ার নিচে, নাক ও মুখ দিয়ে, পায়খানার সঙ্গে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, চোখের মধ্যে ও চোখের বাইরে রক্ত ক্ষরণ ইত্যাদি।
- মেয়েদের ক্ষেত্রে, অসময়ে ঋতুস্রাব অথবা রক্ত ক্ষরণ শুরু হলে অনেকদিন পর্যন্ত রক্ত পড়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এই রোগে অনেক ক্ষেত্রে বুকে বা পেটে পানি আসা, লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস, কিডনিতে আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর ইত্যাদি জটিলতাও দেখা দিতে পারে।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
যেহেতু ডেঙ্গুজ্বরের নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই এবং এই জ্বর সাধারণত নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়, তাই উপসর্গ অনুযায়ী সাধারণ চিকিৎসাই যথেষ্ট। তবে কিছু কিছু জতিলতার ক্ষেত্রে যেমন- শ্বাসকষ্ট হলে, পেট ফুলে পানি এলে, শরীরের কোন অংশে রক্তপাত হলে, প্লাটিলেটের মাত্রা কমে গেলে, অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা দেখা দিলে, প্রচুর পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব বা বমি হলে, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে, জন্ডিস দেখা দিলে ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া উচিত।
কী কী পরীক্ষা করা উচিত?
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডেঙ্গুজ্বর হলে খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন, এতে অযথা অর্থের অপচয় হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাতে হবে। জ্বরের ৪ থেকে ৫ দিন পর সিবিসি এবং প্লাটিলেট টেস্ট করতে হবে। এর আগে টেস্ট করলে রিপোর্টে ডেঙ্গু রোগের জীবাণু ধরা নাও পরতে পারে। সাধারণত প্লাটিলেট কাউন্ট এক লাখের কম ডেঙ্গু হলে ভাইরাসের কথা মাথায় রেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া উচিত। ডেঙ্গু অ্যান্টিবডির পরীক্ষা ৫ থেকে ৬ দিন পর করা যেতে পারে। এটি রোগ শনাক্তকরণে সাহায্য করে। যেহেতু রোগের চিকিৎসায় এর কোন ভূমিকা নেই, তাই এই পরীক্ষা না করলেও কোন সমস্যা নেই। প্রয়োজনে ব্লাড সুগার, লিভারের পরীক্ষা যেমন- এসজিওটি, এসজিপিটি, এলকালাইন ফসফাটেজ ইত্যাদি করাতে হতে পারে। আবার চিকিৎসক যদি মনে করেন রোগী ডিআইসি জাতীয় জটিল কোন সমস্যায় আক্রান্ত সে ক্ষেত্রে প্রোথ্রোম্বিন টাইম, এপিটিটি, ডি-ডাইমার ইত্যাদি পরীক্ষা করাতে হতে পারে।
ডেঙ্গুজ্বরের চিকিৎসা
ডেঙ্গুজ্বরের চিকিৎসা সাধারণ জ্বরের মতোই। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগীই সাধারণত ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। এমনকি কোন চিকিৎসা না করালেও। তবে রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চলতে হবে যাতে ডেঙ্গুজনিত কোন মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি না হয়। নিম্নে ডেঙ্গুজ্বরের চিকিৎসায় করণীয় কিছু বিষয় উল্লেখ করা হচ্ছে,
- জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল সেবন করতে হবে, দিনে সর্বোচ্চ ৪ বার।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে।
- জ্বর কমানোর জন্য বার বার শরীর মুছে দিতে হবে।
- জ্বরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। তাই প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার, যেমন- ওরাল স্যালাইন, ফলের জুস, শরবত ইত্যাদি পান করতে হবে।
- বমির কারণে যদি কোন রোগী পানি পান করতে না পারেন সেক্ষেত্রে স্যালাইন দিতে হবে।
- অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যাসপিরিন বা অন্য কোন ব্যথানাশক ওষুধ একেবারেই সেবন করা যাবে না।
- ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে আক্রান্ত হলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ধরনের রোগীকে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করাতে হবে।
সাধারণত ডেঙ্গু আক্রান্ত সব রোগীকেই রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। রক্তের প্লাটিলেটের পরিমাণ ১০ হাজারের কম হলে অথবা শরীরে রক্তক্ষরণ হলে প্লাটিলেট কনসেন্ট্রেশন দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। সিরাম এ্যালবুমিন ২ গ্রাম ডেসিলিটারের কম হলে অথবা আক্রান্ত ব্যক্তি শকে গেলে প্লাজমা বা প্লাজমা সাবস্টিটিউ দিতে হয়। যদি রক্তে প্লাটিলেট কাউন্ট ৫০ হাজারের নিচে নেমে যায় তবে জরুরি ভিত্তিতে রক্ত সংগ্রহ করে রাখতে হবে।
ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধে করণীয়
ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধের জন্য এডিস মশা রোধ করা এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সাধারণত স্বচ্ছ ও পরিষ্কার পানিতে এরা ডিম পাড়ে। ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত অথবা ড্রেনের পানিতে এরা ডিম পারে না। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানসমূহকে পরিষ্কার করতে হবে এবং পাশাপাশি মশা নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- বাড়ির আশপাশের জলাশয়, ঝোপঝাড়, জঙ্গল ইত্যাদি থাকলে তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
- ঘরের বাথরুমে বা অন্য কোথাও জমানো পানি যেন ৫ দিনের বেশি না থাকে। আবার ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনার বা এ্যাকুয়ারিয়ামের নিচেও যেন পানি জমে না থাকে।
- যেহেতু এডিস মশা মূলত এমন স্থানে ডিম পাড়ে, যেখানে স্বচ্ছ পানি জমে থাকে। তাই ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোলা, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে।
- দিনের বেলায় ঘুমালে অবশ্যই মশারি টানিয়ে অথবা কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমাবেন।
- এডিস মশা সাধারণত সকালে বা সন্ধ্যায় কামড়ায় যদিও অন্য যে কোন সময়ও কামড়াতে পারে। তাই দিনের বেলা শরীর ভালোভাবে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে, প্রয়োজনে মসকুইটো রিপেলেন্ট ব্যবহার করতে হবে এবং অবশ্যই ঘরের দরজা এবং জানালায় নেট লাগাতে হবে।
- ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই সব সময় মশারির মধ্যে রাখতে হবে, যাতে কোন মশা তাকে কামড়াতে না পারে।
- মশা নিধনের জন্য স্প্রে, কয়েল, ম্যাট ইত্যাদি ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে মশার কামড় থেকে বাঁচতে দিনে ও রাতে মশারি ব্যবহার করতে হবে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়?
ডেঙ্গু অথবা ভাইরাল জ্বরে অ্যান্টিবায়োটিক দরকার নেই বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী সময়ে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ অনেক বেড়ে যায়। কখনও মুষলধারে বৃষ্টি আবার কখনও উজ্জ্বল রোদ কিংবা ভ্যাপসা গরম এরকম অস্বস্তিকর পরিবেশে মূলত আবহাওয়ার তারতম্য এবং বাতাসে আর্দ্রতার পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাল জ্বর হয়ে থাকে। আবার থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে পানি জমে ডেঙ্গু মশার প্রজনন বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় ডেঙ্গু মশার বিস্তার লাভ সহজ হয়। এ সময়ে জ্বর হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং আক্রান্ত রোগীর বিশেষ যত্নের ব্যবস্থা করতে হবে। সাধারণত ডেঙ্গু সংক্রমণের নিরানব্বই শতাংশ সংক্রমণই ঘটে বর্ষাকালে আর বর্ষা পরবর্তী সময়ে যখন পানি জমা অবস্থায় থাকে। জ্বর বা ব্যথা হলেই সাধারণত রোগীরা ব্যথানাশক ওষুধ খায় কিন্তু ডেঙ্গু হলে ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না এমনকি ডেঙ্গু রোগীদের জন্য কোন অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধেরও প্রয়োজন নেই।
সবশেষে
ডেঙ্গুজ্বর সাধারণত এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি শরীরে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। সাধারণভাবে এ জ্বরে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ডাক্তারের পরামর্শ মেনে সঠিকভাবে চললে কয়েক দিনেই ডেঙ্গু রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। যেহেতু এ রোগের কোন ভ্যাকসিন নেই, তাই মশার সংখ্যা বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ নষ্ট করা, মশার সংখ্যাবৃদ্ধি হ্রাস এবং মশার কামড় থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমে ডেঙ্গুজ্বরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
সহযোগী অধ্যাপক, রেসপেরিটরি মেডিসিন বিভাগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল