গোলান মালভূমি: ইসরাইলের হিংস্র্র থাবার শিকার সিরীয় ভূখণ্ড
সারওয়ার আলম
ইহুদিবাদী ইসরাইলি দখলদারিত্বের কারণে ফিলিস্তিনিরা যেমন নিজ ভূমিতে শরণার্থী হয়ে জীবনযাপন করছে ঠিক তেমনি সিরীয় আরবরা তাদের পৈতৃক স্থান গোলান মালভূমিতে ইসরাইলি দখলদারিত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ।
১৯৬৭ সালে আরবদের সঙ্গে ছয় দিনের যুদ্ধে সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নেয় ইসরাইল। সে সময় ইহুদিবাদী বাহিনী ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকারও নিয়ন্ত্রণ নেয়। পরে ১৯৮১ সালে গোলান মালভূমিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজ ভূখণ্ড বলে ঘোষণা দেয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহল কখনোই ইসরাইলের এই দাবির স্বীকৃতি দেয়নি।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১৬ নভেম্বর শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গোলান মালভূমির মালিকানা সংক্রান্ত এক ভোটাভুটি হয়। সেখানে উপস্থিত ১৫৩টি দেশের মধ্যে ১৫১ দেশ এ ভূখণ্ডের মালিকানা সিরিয়ার বলে স্বীকৃতি দেয়। শুধুমাত্র আমেরিকা ও ইহুদিবাদী ইসরাইল প্রস্তাবটির বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
তা সত্ত্বেও গোলানবাসীদের ওপর ৫২ বছর ধরে ইহুদিবাদী দখলদারিত্ব আর অত্যাচার একটুও কমেনি বরং বেড়েই চলছে।
এরই মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের যুগ যুগ ধরে জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢেলে দেন গত বৃহস্পতিবার। এক টুইটার বার্তায় তিনি গোলানে ইসরাইলি দখলদারিত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
ঘোষণাটি তিনি এমন সময় দিলেন যখন সারা মুসলিমবিশ্ব সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে বর্বরোচিত সন্ত্রাসী হামলার শোকে মুহ্যমান।
শুক্রবার দুপুরে ইস্তানবুলের বসফরাসের তীরে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশান (ওআইসি) নামের আন্তর্জাতিক ইসলামি সংস্থাটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক জরুরি বৈঠকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোগান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কড়া হুশিয়ারি দেন। তিনি ট্রাম্পকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, গোলান মালভূমিতে ইসরাইলের অবৈধ দখলদারিত্বকে স্বীকৃতি দিলে ওই এলাকার সংকট আরও বাড়বে। এরদোগানের মতে মুসলিম বিশ্ব বিষয়টিকে কোনোভাবেই মেনে নেবে না।
ওআইসির বৈঠকটি ছিল মূলত নিউজিল্যান্ডে সম্প্রতি মসজিদে হামলাকে কেন্দ্র করে। কিন্তু দখলকৃত গোলান মালভূমিকে ইসরাইলের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে ট্রাম্পের বৃহস্পতিবারের প্রতিশ্রুতি বৈঠকের মোর ঘুরিয়ে দেয়। নিউজিল্যান্ডকে ছাড়িয়ে সামনে চলে আসে সিরিয়ার এই ভূখণ্ডটি যা ইসরাইল প্রায় অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে জোরপূর্বক দখল করে আছে।
সিরিয়ার এই অঞ্চলটি নিয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে শুধু দামেস্ক না, সারা বিশ্বই সোচ্চার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এই দখলদারিত্বকে কখনোই স্বীকৃতি দেবে না। কিন্তু আমেরিকার একচেটিয়া সমর্থন আর ইসরাইলের গোয়ার্তুমির কাছে বিশ্ববিবেক বারবার পরাজিত হচ্ছে। ট্রাম্পের এ রকম সিদ্ধান্ত ভঙ্গুর এই অঞ্চলে সৃষ্টি করবে আরও বেশি অশান্তির দাবানল।
গোলানবাসীদের ৫২ বছরের পুঞ্জীভূত বেদনা
গোলান মালভূমি এক হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি মালভূমি (Heights) যা সিরিয়ার গোলান পর্বতমালার অংশ। ইসরাইলের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত সিরিয়ার এ অঞ্চলটির প্রায় এক হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ১৯৬৭ সালের আরব ইসরাইলি যুদ্ধে ইসরাইল দখল করে নেয়। তখন থেকেই এ অঞ্চলটিকে অবৈধভাবে এবং জোর করে দখল করে আছে।
দখলের পর থেকেই গোলান মালভূমিতে ইসরাইলে বড় ধরনের সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে। মালভূমিটিতে বর্তমানে প্রায় 30 হাজার লোকের বসবাস। এদের মধ্যে ২০ হাজার হলো অবৈধ দখলদারি ইহুদি যারা ইসরাইলের গড়া ৩০টি বসতি এলাকায় বাস করছে। ইসরাইল প্রতিনিয়ত আরব বা সিরিয়ানদের বসতবাড়ি দখল করে ইহুদিদের জন্য বসতি স্থাপন করছে।
সামরিক এবং কৌশলগত গুরুত্বের বাইরেও গোলান মালভূমি ওই এলাকার মিঠাপানির প্রধান উৎস। ইসরাইলে ব্যবহৃত মিঠাপানির তিন ভাগের প্রায় এক ভাগ জোগান দেয় গোলান। জায়গাটি চাষাবাদের জন্যও বিশেষ উপযোগী। ইসরাইল দখলের পরে এলাকার লোকজনকে উৎপাদিত ফসলাদি সিরিয়াতে বিক্রি করতে বাধা দেয়। আস্তে আস্তে সাধারণ জনগণকে তাদের ইচ্ছামতো ফল-ফলাদি চাষ করার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে ইসরাইল। তারপরে আরব বা সিরিয়ানদের ওপর আরোপ করে অতিরিক্ত ট্যাক্স। তাদের কাছে সেচের পানি, সার ইত্যাদি বিক্রি করা হয় চড়া মূল্যে যা ইহুদিদের কাছে বিক্রি করা হয় প্রায় অর্ধেক দামে।
প্রায় ২ লাখ সিরীয় আরবকে জোরপূর্বক তাদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। সিরীয়রা এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যেতে ইসরাইলি সেনাদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। ২০০৭ সালে সিরীয় আরবদের মধ্যে দেখা করা বা পারিবারিক পুনর্মিলন বন্ধ করে দেয় ইসরাইল। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি হয়তো দূর থেকে চোখে দেখা যায় কিন্তু তাদের ওই বাড়িতে থাকা আত্মীয়র সঙ্গে দেখা করতে পারে না দিনের পর দিন এবং মাসের পর মাস।
ইহুদিবাদী দখলদারিত্বের কারণে গোলানবাসীরা আজ নিজ ভূমিতে শরণার্থী হয়ে জীবনযাপন করছে। হাজার হাজার গোলানবাসী তাদের ঘরবাড়ি ও এলাকা থেকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়েছে। তাদের চোখের সামনে নিজেদের গড়া স্বপ্নের ঠিকানা বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে ইসরাইল সেখানে গড়ে তুলেছে নতুন বসতি।
গোলানে বসবাসরত আরবরা নিজের জন্মভূমি সিরিয়া থেকে সাহায্য সহযোগিতা পেয়ে আসছিল যুগ যুগ ধরে। কিন্তু সেই মাতৃভূমি সিরিয়া গত নয় বছর ধরে গৃহ যুদ্ধে চূর্ণ-বিচূর্ণ। মুসলিম বিশ্ব যে তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলবে সেই মুসলিম বিশ্ব আজ নেতৃত্বহীন। সৌদি আর, তুরস্ক, মিসর নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত। গোলানের ভাগ্যবিড়ম্বিত অসহায় আরবদের দুর্ভোগের কফিনে ট্রাম্প যখন শেষ পেরেকটি মারতে উদ্যত সেই দুর্দিনে আজ তাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই।