বুধবার-২১শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি-২১শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

প্রসঙ্গ হযরত মুআবিয়া (রাযি.) ইতিহাসের ইতিহাস পর্যালোচনা

প্রসঙ্গ হযরত মুআবিয়া (রাযি.) ইতিহাসের ইতিহাস পর্যালোচনা

প্রসঙ্গ হযরত মুআবিয়া (রাযি.) ইতিহাসের ইতিহাস পর্যালোচনা

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

 

আশারায়ে মুবাশশরার পর শ্রেষ্ঠ সাহাবাগণের একজন হলেন আমীরুল মুমিনীন হযরত মুআবিয়া (রাযি.)। হযরত আলী (রাযি.) ও হযরত হাসান (রাযি.)-এর সাথে সন্ধিচুক্তির পর তাঁর খিলাফতের জমানায় ইসলামের উন্নতি সমৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হয়েছে। সাম্রাজ্যের পর সাম্রাজ্য মুসলমানদের পদানত হয়।

হযরত উসমান (রাযি.)-এর শাহাদতের পর থেকে নিয়ে হযরত হাসান (রাযি.)-এর সাথে সন্ধি পর্যন্ত ইসলামের যে বিজয় যাত্রা থমকে ছিল তা হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর জমানায় নবউদ্যমে আবার শুরু হয়। পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পরে ইসলামের বিজয় নিশান। তিউনিশিয়ার কায়রাওয়ান থেকে উজবেকিস্তানের বুখারা পর্যন্ত এবং ইয়ামান ও ইথিউপিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ইসলামি হুকুমত। হিজায, শাম, মিসর, ইরাক, জাযীরাতুল আরব, আরমানিয়া, পারস্য, খুরাসান এবং আমু দরিয়ার উপারের রাজ্যগুলো ছিল ইসলামি সালতানাতের অধীন।[1]

হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর সময়কালে অসংখ্য জল ও স্থলভাগের বিজয় অর্জিত হয়। তার শাসনামলেই পৃথিবীর প্রান্ত পর্যন্ত ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়।

হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর নেতৃত্বে সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) এবং তাবেয়ীগণের উত্তম আখলাক ও চরিত্র মাধুরিমা ইসলামের বিস্তৃতি এবং স্থায়িত্বের জন্য অনেক অবদান রাখে।

খিলাফতে রাশিদার জমানার পর হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর শাসনামলই ছিল ইসলামের ইতিহাসের সর্বোত্তম সময়। এ সময়ই পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে। ‘সমস্ত দীনের ওপর ইসলামকে বিজয়ী করার’ কুরআনী নির্দেশের বাস্তব ফসল প্রতিফলিত হয় এ স্বর্ণালী যুগেই।

 

হযরত মুআবিয়া (রাযি.) উমাইয়াদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ কেন?

হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর মৃত্যুর পর একের পর উমাইয়া বংশের শাসক আসতে থাকে। অবশেষে ১৩২ হিজরী মুতাবিক ৭৪৯ ঈসাব্দে বনি আব্বাসের আবুল আব্বাস সাফফাহ নামক একজন ব্যক্তি বনি উমাইয়ার শাসনব্যবস্থা খতম করে আব্বাসী খিলাফতের গোড়াপত্তন করেন।

একথা বলাই বাহুল্য যে, বনি আব্বাসীরা বনি উমাইয়াদের শক্তি-সামর্থ্যকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। বংশীয় গোঁড়ামি হেতু বনি আব্বাসীয়রা বনি উমাইয়াদের কঠোর বিরোধী ছিল। যেমন পরবর্তী শাসকের পূর্ববর্তী শাসকদের সাধারণত বিরোধী হয়ে থাকে।

বিশেষ করে যখন আগের কোন শাসনব্যবস্থা ধ্বংস করে নতুন শাসনব্যবস্থা চালু হয়, তখন স্বাভাবিকভাবে পূর্ববর্তী শাসকের ভালো কাজগুলোকেও খারাপভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়। উত্তম কাজগুলোকে মন্দ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে সকল ধরণের অভিযোগ-অপবাদ আরোপ করা হয়। সেই সাথে পূর্ববর্তী শাসকদের চরিত্র-আখলাক নিয়ে সত্যমিথ্যা সংবাদ ছড়ানো হয়। যার ফলে পূর্ববর্তী শাসকের প্রতি মানুষের মনে ঘৃণা জন্মায়। আর বর্তমান শাসকের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি পায়। পুরো দুনিয়াব্যাপী রাজনৈতিক রাষ্ট্রগুলোর শাসকগণ যার প্রকিষ্ঠ প্রমাণ। যা দিবালোকের ন্যায় সকলের কাছেই পরিস্কার।

 

নির্মম বাস্তবতা

আগের শাসকের প্রতি বর্তমান শাসকের বিরূপ ভাবাপন্ন হওয়ার এ স্বাভাবিক ও বাস্তবতাই প্রতিফলিত হয়েছে বনি আব্বাসীয়দের শাসনামলে।

আব্বাসী খিলাফত শুরু হয়েছিল হিজরী দ্বিতীয় শতকে। আর সেই সময়কালেই সাধারণত ইতিহাস সংকলন শুরু হয়েছে।

আর ইতিহাসবিদগণও উপর্যুক্ত মানসিকতার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন স্বাভাবিকভাবেই। এ কারণে পূর্ববর্তীদের ইতিকথাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর সময়কালের উত্তম কাজগুলোও খারাপ করে দেওয়া হয়। তাঁর কীর্তিমান কর্মকাণ্ডগুলোও কলংকযুক্ত করা হয়। তার ইসলামি এবং সামাজিক পদক্ষেপগুলোকে মন্দভাবে পেশ করা হয়। তার সময়কালের শ্রেষ্ঠ ও ঐতিহাসিক কাজগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে এর মাঝে দোষ ও দুর্বলতা খোঁজে বের করা হয়।

শুধু তাই নয়, হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর উত্তম ও শ্রেষ্ঠ কাজগুলোকে এমনভাবে পাল্টিয়ে দেওয়া হয় যে, তার আখলাক চরিত্র সম্পর্কে জনমনে বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয়।

এমন সব ঘটনাবলি দিয়ে ইতিহাস ভরপুর করা হয়, যা দেখে হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর ওপর অভিযোগের পাহাড় দাঁড় করানো যায়।

কতিপয় ইতিহাস রচয়িতা তাঁর জমানার শাসকের সন্তুষ্টি লাভের আশায় তাদের পা চাটার পথকে বেছে নেন। শাসকের দৃষ্টিতে ভালো হয়ে পুরস্কার লাভের নিমিত্তে ইতিহাস রচনায় উপর্যুক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করে তারা রুটি-রুজির ব্যবস্থা করে নেয়।

যেহেতু আব্বাসী খিলাফতের সময়কালে সাধারণত ইতিহাস রচনা শুরু হয়। আর আব্বাসী শাসকেরা ভয়ানকভাবে উমাইয়া শাসকদের বিরোধী ছিল। তাই এ সময়কার ইতিহাস রচয়িতারা শাসককে খুশি করতে হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর অপবাদ ও অভিযোগের রসদ সরবরাহ করে। যার দ্বারা তারা শাসকদের সন্তুষ্টি ও পুরস্কার অর্জন করে দুনিয়া কামাই করে।

এর উল্টো সত্য ইতিহাস লিখে শাসকের রোষানলে পতিত হওয়ার মত সৎসাহস অনেকেই প্রদর্শন করতে পারেননি।

বনি আব্বাসীয়রা ক্ষমতা দখলের পর কি পরিমাণ বর্বরতা ও হিংস্রতা প্রদর্শন করেছিল। যার বিপরীতে তাদের বিরুদ্ধে কলম ধরা ও উমাইয়া শাসকদের প্রশংসনীয় কাজগুলো ইতিহাস হিসেবে উপস্থাপন করা একজন লেখকের জন্য কতটা কঠিন ছিল তা দুয়েকটি ঘটনা দেখলেই আমরা আন্দাজ করতে পারবো।

॥১॥

وَذَكَرَ فِيْ تَرْجَمَةِ مُحَمَّدِ بْنِ سُلَيْمَانَ بْنِ عَبْدِ اللهِ النَّوْفَلِيِّ، قَالَ: كُنْتُ مَعَ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَلِيٍّ أَوَّلَ مَا دَخَلَ دِمَشْقَ، دَخَلَهَا بِالسَّيْفِ ثَلَاثَ سَاعَاتٍ مِنَ النَّهَارِ، وَجَعَلَ مَسْجِدَ جَامِعِهَا سَبْعِيْنَ يَوْمًا إِصْطَبْلًا لِدَوَابِّهِ وَجِمَالِهِ، ثُمَّ نَبَشَ قُبُوْرَ بَنِي أُمَيَّةَ فَلْمْ يَجِدْ فِيْ قَبْرِ مُعَاوِيَةَ إِلَّا خَيْطًا أَسْوَدَ مِثْلَ الْـهَبَاءِ، وَنَبَشَ قَبْرَ عَبْدِ الْـمَلِكِ بْنِ مَرْوَانَ فَوَجَدَ جُمْجُمَةً، وَكَانَ يُوْجَدُ فِي الْقَبْرِ الْعُضْوُ بَعْدَ الْعُضْوِ، غَيْرَ هِشَامِ بْنِ عَبْدِ الْـمَلِكِ، فَإِنَّهُ وَجَدَهُ صَحِيْحًا لَـمْ يَبْلَ مِنْهُ غَيْرُ أَرْنَبَةِ أَنْفِهِ، فَضَرَبَهُ بِالسِّيَاطِ وَهُوَ مَيِّتٌ، وَصَلَبَهُ أَيَّامًا، ثُمَّ أَحْرَقَهُ بِالنَّارِ، وَدَقَّ رَمَادَهُ، ثُمَّ ذَرَاهُ فِي الرِّيْحِ.

ইবনে আসাকির মুহাম্মদ ইবনে সুলাইমান ইবনে আবদুল্লাহ আন-নাওফালীর জীবনীগ্রন্থে লিখেছেন যে, তিনি বলেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে আলী (আবুল আব্বাসের সেনাপতি) প্রথম যখন দিমাশকে প্রবেশ করেন তখন আমি তাঁর সাথে ছিলাম। তিনি তরবারি হাতে সেখানে প্রবেশ করেন এবং তিন ঘণ্টার জন্য খুন-খারাবি গণহত্যা বৈধ করে দেন। সেখানকার জামে মসজিদ ৭০ দিন যাবৎ তাঁর উট-ঘোড়া অন্যান্য চতুষ্পদ জন্তুর আস্তাবল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এরপর তিনি উমাইয়াদের কবরগুলো খনন করেন। হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর কবরে একটি কালো সুতা ব্যতীত কিছুই পাননি। আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের কবর খনন করা হয়। সেখানে একটি মাথার খুলি পাওয়া যায়। কোন কোন কবরে এক বা একাধিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাওয়া যায়। তবে হিশাম ইবনে আবদুল মালিকের লাশ পাওয়া যায় সম্পূর্ণ অক্ষত। নাকের অগ্রভাগ ছাড়া তাঁর শরীরের অন্য কোন স্থানে কোন দাগ কিংবা জীর্ণতার চিহ্নও পড়েনি। সেনাপতি আবদুল্লাহ মৃত হিশামের লাশ পেয়ে ওই মৃত লাশকে চাবুক দিয়ে পিটিয়েছে। কয়েকদিন সেটিকে শূলিতে চড়িয়ে রাখে। তারপর আগুনে পুড়িয়ে ছাইগুলো বাতাসে উড়িয়ে দেয়।[2]

শুধু তাই নয়, আরও কী করেছে?

قَالَ: ثُمَّ تَتَبَّعَ عَبْدُ اللهِ بْنُ عَلِيٍّ بَنِيْ أُمَيَّةَ مِنْ أَوْلَادِ الْـخُلَفَاءِ وَغَيْرِهِمْ، فَقَتَلَ مِنْهُمْ فِيْ يَوْمٍ وَاحِدٍ اثْنَيْنِ وَتِسْعِيْنَ نَفْسًا عِنْدَ نَهْرٍ بِالرَّمْلَةِ وَبَسَطَ عَلَيْهِمُ الْأَنْطَاعَ، وَمَدَّ عَلَيْهِمْ سِمَاطًا، فَأَكَلَ وَهُمْ يَخْتَلِجُوْنَ تَحْتَهُ.

বর্ণনাকারী বলেন, এরপর আবদুল্লাহ ইবনে আলী উমাইয়া বংশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সন্তান-সন্ততিদের তথা পরবর্তী প্রজন্মের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। সে তাদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করে এবং হত্যা করতে থাকে। একদিনে সে রামাল্লা নদীর তীরে তাদের ৯২ হাজার লোককে হত্যা করে। তাদের মৃত অর্ধমৃত দেহের ওপর সে ন্যাকড়া বিছিয়ে দেয়। তার ওপর পশমী দস্তরখান রেখে সে অনায়াসে খাওয়া-দাওয়া করে। নীচে আহত, ক্ষত-বিক্ষত দেহগুলো কাতরাচ্ছিল, গড়াগড়ি খাচ্ছিল।[3]

এ ছিল বনি আব্বাসীয়দের অবস্থা। বনি উমাইয়াদের প্রতি ছিল তাদের ভয়ানক বিদ্বেষ ও প্রতিশোধপরায়ণতা। যারাই উমাইয়াদের আত্মীয় ছিল বা তাদের পছন্দ করতো তাদের খুঁজে খুঁজে বের করে হত্যা করা হতো। শুধু হত্যা নয় চালানো হতো বর্বরতম নির্যাতনও।

এমন সময়ে কোন লেখক উমাইয়া শাসক হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর কীর্তিগাঁথা লিখবে তার সাফল্য তুলে ধরে সত্য ইতিহাস উপস্থাপন করার সাহস দেখানো কি সম্ভব ছিল? শুধু তাই নয়!

॥২॥

আব্বাসী খলীফা মামুনুর রশীদ বিষয়ে ইমাম শামসুদ্দীন আয-যাহাবী (রহ.) লিখেছেন,

سنة أحدى عشرة ومئتين

فيها أظهر المأمون التشيُّع وأمر بأن يقال خير الخلق بعد النبي ﷺ علي h، وأمر بالنداء أن بَرِئَت الذمة ممن ذكر مُعاوية بخير.

২১১ হিজরীতে আব্বাসী খলীফা বাদশা মামুনুর রশীদ শিয়া হওয়ার কথা প্রকাশ করেন। সেই সাথে সরকারিভাবে ঘোষণা করেন যে, নবী করীম (সা.)-এর পর সর্বোত্তম ব্যক্তি হলেন হযরত আলী (রাযি.)। ঘোষণাও দেন যে, যে ব্যক্তি হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর ব্যাপারে ভালো কথা বলবে তার ব্যাপারে রাষ্ট্রের কোন যিম্মাদারী নেই।[4]

 

শিয়াদের স্বীকৃতি

এসব ঘটনার সত্যতা প্রসিদ্ধ শিয়া ঐতিহাসিক মাসউদী তার কিতাব মুরাওয়াজুয যাহাব গ্রন্থে বাদশা মামুনুর রশীদের আলোচনায় এভাবে উদ্ধৃত করে,

وفي سنة اثنتي عشرة ومائتين نادىٰ منادي المأمون: برئت الذمة من أحد من الناس ذكر معاوية بخير أو قدمه علىٰ أحد من أصحاب رسول الله ^.

২১২ হিজরীতে বাদশা মামুনুর রশীদ ঘোষণা করায় যে, যে ব্যক্তি হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর কোন ভালো বিষয় উল্লেখ করবে, বা তাকে কোন সাহাবীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিবে তার ব্যাপারে রাষ্ট্র দায়িত্বমুক্ত। অর্থাৎ তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের নয়।[5]

উপমহাদেশের প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ আল্লামা শিবলী নুমানী (রহ.) তাঁর কিতাব আল-ইনতিকাদ আলা তামাদ্দুনিল ইসলামির মাঝে ইসলামি ইতিহাস সংকললের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন,

ثم أن هناك أمر آخر، وهو أن المؤرخين بأمرهم كانوا في عصر بني العباس ومن المعلوم أنه لم يكن يستطيع أحد أن يذكر محاسن بني أمية فى دولة العباسيين، فإذا صدر من أحد شيء من ذلك فلتة كان يقاسي قائلها أنواعا من الهتك والإيذاء وخامة العاقبة وكم لنا من أمثال هذه في أسفار التاريخ الخ.

স্মর্তব্য যে, ইসলামি ইতিহাসের ঐতিহাসিকগণ সাধারণত আব্বাসী শাসনামলের। আর এতো জানা কথাই যে, আব্বাসী আমলে বনি উমাইয়াদের ভালো বিষয়গুলো বর্ণনা করার সাহস কারো ছিল না। কেননা বনি উমাইয়াদের ভালো কিছু যদি কারো মাধ্যমে কদাচিৎও প্রকাশ পেতো তাহলে তাকে নানাবিধ নির্যাতনের শিকার হতে হতো। সম্মানহানি ছাড়াও নানা ধরণের শাস্তি পেতে হতো। ইতিহাসের পাতায় এর অনেক নজির পাওয়া যায়।[6]

পরিস্কার কথা যে, সরকারিভাবে এমন প্রকাশ্য ঘোষণা ও কঠোর হুমকির পর ঐতিহাসিকগণ যে ইতিহাস রচনা করেছেন তাতে হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর দোষ-ত্রুটিই বর্ণিত হবে। তাদের কাছে মুআবিয়া (রাযি.)-এর আখলাকী গুণাবলি এবং ইসলাম ও জাতীয় খেদমতের বর্ণনা পাওয়ার আশা রাখা অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কী হতে পারে?

ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। সুবিধাবাদী-ভীতসন্ত্রস্ত লেখকেরা কলমের খোঁচায় ধামাচাপা দিয়েছেন হযরতে হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর কীর্তিমান জীবন। ইতিহাসের নামে অসত্য আর অপবাদের জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে এ মহান সাহাবীর উজ্জ্বল দ্বিগ্বিজয়ী খেদমত।

তবে খুবই অল্পসংখ্যক ঐতিহাসিক যারা রাষ্ট্রীয় এ জুলুমের পরোয়া না করে সত্য প্রকাশ করেছেন। তাদের সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোনা কয়েকজন। তাই ইসলামি ইতিহাস পাঠকগণ এ বাস্তব অবস্থা মাথায় রেখে ইতিহাস পড়া খুবই জরুরি। নতুবা বাস্তবতা বিবর্জিত ইতিহাস নামক এক ভাগাড়েই ঘুরপাক খেতে হবে।

মোটকথা হল উপর্যুক্ত কারণে ইতিহাসের পাতায় হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর বিষয়ে অধিক পরিমাণ অভিযোগ পাওয়া যায়। আর বিদ্বেষীরা এ বিষয়গুলো যাচাই-ছাড়াই খুব প্রচার করেছে। এসব ছড়িয়ে এ মহান সাহাবী ও ইসলামের একনিষ্ট খাদিমের চরিত্রে কালিমা লেপন করে জাতির সামনে নোংরাভাবে পেশ করেছে।


 

[1] আয-যাহাবী, দুওয়ালুল ইসলাম, দারু সাদির, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২০ হি. = ১৯৯৯ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ২৮

[2] (ক) ইবনে কসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, দারু হিজর, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৮ হি. = ১৯৯৭ খ্রি.), খ. ১৩, পৃ. ২৫৯; (খ) ইবনে আসাকির, তারীখু দামিশক, দারুল ফিকর, দিমাশক, সিরিয়া (১৪১৫ হি. = ১৯৯৫ খ্রি.), খ. ৫৩, পৃ. ১২৬-১২৭

[3] (ক) ইবনে কসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ. ১৩, পৃ. ২৫৯-২৬০; (খ) ইবনে আসাকির, তারীখু দামিশক, খ. ৫৩, পৃ. ১২৭

[4] আয-যাহাবী, দুওয়ালুল ইসলাম, খ. ১, পৃ. ১৮৩

[5] আল-মাসউদী, মুরাওয়াজুয যাহাব ওয়া মাআদিনুল জাওহর, দারুল হিজরা, কুম, ইরান (১৪০৯ হি. = ১৯৮৯ খ্রি.), খ. ৩, পৃ. ২৮৫

[6] শিবলী নু’মানী, আল-ইনতিকাদ আলা কিতাবি তামাদ্দুনিল ইসলামী, আসি প্রেস, লাখনৌ, ব্রিটিশ ভারত (১৩২৯ হি. = ১৯১২ খ্রি.), পৃ. ২৪

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ