ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ ও চিকিৎসা
ডা. আলীয়া শাহনাজ
দৃশ্যপট-১ মিসেস সোহানা। বয়স ৪৩ বছর। ৪ বছর আগে ডান breast-এ ছোট একটা চাকা অনুভব করলেন। তিনি সচেতন, গেলেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বায়োপসি করলেন। ব্রেস্ট ক্যান্সার। তিনি ভয় পেলেন, অপারেশন হল।
এরপর কেমোথেরাপি। ফলোআপের জন্য নির্ধারিত তারিখে ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করেন। আর কোনো চিকিৎসা প্রয়োজন হয়নি তার।
দৃশ্যপট-২ কাজলী। বয়স ৩৫। তার বুকের ভেতর চাকা দেখা দেয় ৫ মাস আগে। প্রথমে পাত্তা দেননি। ডাক্তারও দেখাননি। গরীবের সংসার। খাবারই জোটেনা আবার ডাক্তার। হঠাৎ প্রচণ্ড ব্যথা, লাল হয়ে গেল বুকের চামড়া, কমলালেবুর মতো শক্ত চামড়া। শক্ত চাকার মতো চাপটা যেন বুকের ওপর চেপে বসেছে।
চলল কবিরাজি আর টোটকা চিকিৎসা। অল্প পয়সায় যদি উদ্ধার হয়। না হল না। চাকা থেকে বড় গর্ত হল বুকে, সঙ্গে পুঁজ আর রক্ত ঝরা শুরু হল। ব্যথায় অজ্ঞান হয়ে গেলেন একদিন।
তখন সবাই ধরাধরি করে নিয়ে গেল ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে। এরপর অনেক চড়াই-উৎরাই। ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়েছে। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে। সাহায্য পাওয়া গেছে অনেক টাকা। আদৌও কি ভালো হবে কাজলী? এত টাকা পেয়ে কী লাভ হল?
ব্রেস্ট ক্যান্সার এক ঘাতক ব্যাধি। ওপরের দৃশ্যপটই তার প্রমাণ। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে রোগী ভালো হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই বেড়ে যায়। আসুন আমরা জানি ব্রেস্ট বা স্তন ক্যান্সার কাদের হয়? এর উপসর্গগুলো কী কী? আর প্রকোপ-ই বা কতটুকু, চিকিৎসাই ইত্যাদি।
ব্রেস্ট ক্যান্সার এখন সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও মহিলাদের ক্যান্সারের মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করে আছে। যদিও মাত্র দুয়েক বছর আগে জরায়ুর ক্যান্সার শীর্ষস্থানে অবস্থান করছিল। তাহলে ইদনিং কেন এত প্রকোপ?
কী কারণে breast Cancer–Gi প্রকোপ বেড়ে গেছে?
- প্রথমত এর জন্য দায়ী আমাদের জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন। যেমন আজকাল আমরা প্রচুর fast food খাই, সবুজ শাকসবজি খুবই কম খাই, কম শারীরিক পরিশ্রম করি যার ফলে আমরা অতিরিক্ত স্থূলতায় ভুগছি। অতিরিক্ত স্থূলতা breast Cancer এক অন্যতম প্রধান কারণ।
- দেরিতে বাচ্চা নেওয়া।
- বাচ্চাকে বুকের দুধ দিতে অনীহা বা অপারগতা (যেমন চাকরিজীবী মহিলারা এ সমস্যায় ভোগেন বেশি)
- বেশি বয়স, গড় আয়ু বেড়ে যাওয়াতে এ রোগের প্রকোপ বাড়ছে।
- Early screening অর্থাৎ মানুষ সচেতন বলে আগেই ডাক্তারের শরণাপন্ন হচ্ছে রোগ আছে কিনা জানার জন্য। ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ ধরা পড়ছে।
বগলে চাকা দেখা দেওয়া
যদি Cancer ছড়িয়ে পড়ে তাহলে যেখানে ছড়িয়ে পড়েছে তার উপসর্গ দেখা দেওয়া যেমন-
- খরাবৎ বা যকৃতে ছড়ালে পেটে ব্যথা বা জন্ডিস দেখা দেয়।
- ফুসফুসে ছড়ালে কাশি হওয়া এমনকি কাশির সঙ্গে রক্তও যেতে পারে।
- Bone বা হাড়ে ছড়ালে সেখানে তীব্র ব্যথা হওয়া।
উপসর্গ
- breast-এ চাকা দেখা দেওয়া।
- breast-এর চামড়ার রং পরিবর্তন হওয়া বা চামড়া মোটা হওয়া। (কমলালেবুর খোসার মতো)
- Nipple বা স্তনের বোঁটা ভেতরে দেবে যাওয়া।
- Nipple দিয়ে রক্ত বা পুঁজ পড়া।
ডায়াগনোসিস বা শনাক্তকরণ পরীক্ষা
প্রথমেই বিশেষজ্ঞরা রোগীর রোগের history নিয়ে থাকেন। শারীরিক পরীক্ষা করেন। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে ব্রেস্ট ক্যান্সার শনাক্ত করা হয়। রোগীর বয়সের সঙ্গে সামাঞ্জস্য রেখেই বিশেষজ্ঞরা তা দিয়ে থাকেন। যেমন-
- ম্যামোগ্রাফি,
- আলট্রাসনোগ্রাফি,
- এমআরআই,
- FNAC-চাকা থেকে,
- বায়োপসি/মাংস পরীক্ষা।
চিকিৎসা
প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে শতকরা ৯০-৯৫ ভাগ রোগী সুস্থ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারেন। এ ক্যান্সারের চিকিৎসা প্রধানত কয়েকভাগে বিভক্ত:
- সার্জারি,
- কেমোথেরাপি,
- রেডিওথেরাপি,
- হরমোন থেরাপি,
- টার্গেটেড থেরাপি।
সার্জারি: স্তন ক্যান্সরের যে কোনো পর্যায়েই রোগীর সার্জারি করা প্রয়োজন হতে পারে। সার্জারি করা যাবে কিনা বা কী ধরনের সার্জারি হবে তাই প্রাথমিক বিবেচ্য বিষয়। সিদ্ধান্ত নেবেন সার্জন এবং ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ দু’জনে মিলে। অনেক সময় শুধু টিউমার কেটে ফেলা হয়। অনেক সময় পুরো বেস্টই ফেলে দেয়া হয়।
কেমোথেরাপি: প্রায় সব রোগীকেই কেমোথেরাপি নিতে হয়। সার্জারির আগে বা পরে এমনকি রোগ শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়লেও কেমোথেরাপি কাজ করে। যদিও কেমোথেরাপিতে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে তবুও রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্য কেমোথেরাপির বিকল্প নেই। রোগীর শারীরিক অবস্থা, কেমোথেরাপির কার্যকারিতা, রোগীর আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়েই ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা উপযুক্ত পরামর্শ দেন। কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যাতে কম হয় তারও ব্যবস্থাপত্র দেন চিকিৎসকরা।
রেডিওথেরাপি: বিশেষ ধরনের মেশিনের মাধ্যমে রোগীদের রেডিওথেরাপি চিকিৎসা দেয়া হয়।
এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে অনেক কম। সাধারণ কেমোথেরাপির পরই রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়। শুধু breast-এ নয়, যদি Cancer হাড়েও ছড়িয়ে পড়ে তাহলেও সেখানে রেডিও থেরাপি দিয়ে হাড়ের ভাঙন বা ফ্র্যাকচার রোধ করা যায়।
হরমোন থেরাপি: সব ব্রেস্ট ক্যান্সারের রোগীর জন্য হরমোনের দরকার নেই। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই হরমোনের চিকিৎসা কাদের লাগবে তা শনাক্ত করেন।
টার্গেটেড থেরাপি: এ থেরাপি রোগীদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। যেমন- Transtyuumab, Lapatinib, Bevacizumab ইত্যাদি।
ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য Breast Cancer Screening জরুরি। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ ব্যাপারে সবারই জানা উচিত এবং এই program-এর আওতায় আসা উচিত। তাহলে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ ধরা পড়বে এবং রোগী দ্রুত সুস্থ হবে। আমাদের সুশৃঙ্খল জীবনযাত্রা এবং জীবনযাত্রার কিছু পরিবর্তন হলে (যা ক্যান্সার রোগের কারণ) এ রোগের প্রকোপ অনেকাংশেই কমে আসবে এবং আমাদের সমাজে সুস্থ-সুন্দর জীবনের অধিকারী মানুষের অবস্থান সুদৃঢ় হবে।
কারা স্তন ক্যান্সার হওয়ার
ঝুঁকির মধ্যে আছেন
- বয়স্ক মহিলা,
- যাদের স্তন ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস আছে,
- যেসব মহিলারা বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করাননি,
- BRCA-1, BRCA-2 নামক জিনের মিউটেশনের কারণে,
- অল্প বয়সে মাসিক শুরু হওয়া,
- দেরিতে মাসিক বন্ধ হওয়া,
- মদ্যপান করলে,
- ব্রেস্টের কিছু অসুখ যেমন atypical ductal বা lobular hyperplasia থাকলে,
- অন্য কোনো ক্যান্সার যেমন- কোলন, ডিম্বাশয়ে ক্যান্সার হলে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, রেডিওথেরাপি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল