জামেয়া ওয়েবসাইট

মঙ্গলবার-১০ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-১৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইসলামি অর্থব্যবস্থা

ইসলামি অর্থব্যবস্থা

রকিবুল ইসলাম

মানবজীবনকে ঘিরে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। সুতরাং মানবজীবনে অর্থ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অর্থের প্রয়োজনীয়তা থেকেই পরবর্তীতে অর্থব্যবস্থাপনার বিষয়টি চলে আসে। বিভিন্ন উৎস থেকে উপার্জিত আয় এবং বিভিন্ন খাতে ব্যয়িত অর্থের হিসাবরক্ষণ ও ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণের জন্য অর্থ সঞ্চয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। মূলত সেখান থেকেই অর্থব্যবস্থাপনার উৎপত্তি।

আল্লাহর দেয়া ধন সম্পত্তি তাঁর অনুমোদিত পথে অর্জন ও ব্যয় করার যে ব্যবস্থা, তাই ইসলামি অর্থব্যবস্থা। ইসলামি অর্থব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আল্লাহর দেয়া মাল আল্লাহর দেখানো পথে খরচ করতে হবে। জীবন যাপনের জন্য অর্থের প্রয়োজন আছে, তাই বলে যত্রতত্র পথে যেমন অর্জন করা যাবে না তেমনি তা ব্যবহারেও রয়েছে সুনির্দিষ্ট বিধান। হালাল পথে উপার্জিত অর্থ হালাল পথেই ব্যয় করতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য অর্থের মজুদদারি ইসলাম কখনও সাপোর্ট করে না। তেমনি ভবিষ্যতে মূল্য বৃদ্ধির প্রত্যাশায় আর্থিক কোন ফসলের মজুদ রাখাও ইসলামি আইনে দণ্ডনীয়।

ইসলামি অর্থব্যবস্থায় পরিশ্রমের মাধ্যমে সম্পত্তি উপার্জন ও তা সঠিক পথে ব্যয় করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। ধন সম্পত্তি সঞ্চয় করে রাখা এবং তা অধিক জনকল্যাণকর কাজে বিনিয়োগ না করা ইসলামি অর্থনীতির দৃষ্টিতে মারাত্মক অপরাধ। এজন্য ইসলামি সমাজে অতিরিক্ত অর্থ সঞ্চয়কারীকে কঠোর ভাষায় তিরোস্কার করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেন, ‘পরিতাপ! প্রত্যেক দোষারোপকারী ও পশ্চাতে নিন্দুকের জন্য, যে সম্পত্তি জমা করে এবং বারবার তা গণনা করে। সে ধারণা করে তার সম্পত্তি তাকে চিরস্থায়ী করে রাখবে।’

উপার্জিত অর্থ যেমন অলসভাবে সঞ্চয় করে রাখা যাবে না, আবার তা যথাতথা খরচও করা যাবে না। খরচের খাতও ইসলামের দৃষ্টিতে সুনির্দিষ্ট রয়েছে। অর্জিত সম্পত্তিতে এতিমের অংশ থাকলে তা ব্যবসায় বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং অধিক সংখ্যক মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা হয়।

অর্থব্যবস্থার সাথে সুদ বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। মূলধন ব্যবহারের জন্য মূলধনের মালিককে নির্দিষ্ট সময় অন্তর যে অর্থ প্রদান করা হয়, তাই-ই সুদ। ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ গ্রহণ এবং প্রদান দুটোই মারাত্মক গর্হিত কাজ। সুদখোর, সুদ প্রদানকারী, সুদি কারবারের সাক্ষী এবং সুদের চুক্তি লেখককে রাসুলুল্লাহ (সা.) অভিশাপ দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জেনে শুনে সুদের একটি টাকা খায়, তার এ অপরাধ ছত্রিশবার ব্যাভিচারের চেয়েও অনেক কঠিন।’ সুতরাং ইসলাম ব্যবসায়কে যেমন হালাল করেছে, সুদকে তেমন হারাম করেছে। কেননা সুদব্যবস্থার কারণে সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি যেমন হয়, তেমনি আল্লাহর পক্ষ থেকে নেমে আসে মর্মন্তুদ শাস্তি।

অর্থনৈতিক উন্নতি এবং এর দ্বারা অর্জিত উপকরণাদি মানবজীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নয়। কুরআন সুন্নাহ পরিপূর্ণভাবে যে কথার প্রতি জোর দিয়েছে, তা হচ্ছে পৃথিবীর জীবন সীমিত। মৃত্যুর পরে এমন চিরস্থায়ী জীবন আসবে, যার কোন শেষ নেই। দুনিয়ার জীবন আখিরাতের জন্য উৎসর্গ করার চিন্তাই মানুষের মূল ভাবনা। এতে এক অপরের চেয়ে অধিক অর্থ উপার্জনের চেয়ে পরকালের জন্য পাথেয় সঞ্চয় করার প্রতি মানুষ বেশি গুরুত্ব দেবে। মানুষের মধ্যে এমন মন মানসিকতা সৃষ্টি হবে, যেখানে হালাল পথ ছেড়ে কেউ কখনও অবৈধ পথে উপার্জনের চিন্তাও করবে না।

ইসলামি অর্থব্যবস্থায় যাকাত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পবিত্র কুরআনে নামাযের পাশাপাশি যাকাতের কথাও অধিক গুরুত্বের সাথে বলা হয়েছে। যাকাত দিলে ধন সম্পত্তি কমে না বরং তা বৃদ্ধি পায়। এই ধারণা মানুষের মধ্যে অধিক সঞ্চয়ের প্রবণতা হ্রাস করে। ব্যক্তির ওপর যাকাত ফরয হলে তাকে তা অবশ্যই আদায় করতে হবে। সঠিক মাত্রায় যাকাত আদায় করা হলে সমাজে অর্থের ভারসাম্য বজায় থাকে। অন্যদিকে যাকাত না আদায়ের ফলে সমাজে উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ তৈরি হয়। এক শ্রেণির মানুষ পর্যায়ক্রমে ধনি থেকে ধনি এবং অন্য শ্রেণি গরিব থেকে গরিব অবস্থানে পৌঁছে যায়। এতে ক্রমান্বয়ে মানুষের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়, যা ইসলামি মূল্যবোধবহির্ভূত। যাকাত ফরয হওয়া সত্ত্বেও তা আদায় করা না হলে পরকালে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। পরকালের শাস্তির ভয়ে সমাজে ব্যাপক হারে যাকাতের প্রচলন করা হলে ধনি-নির্ধনের কোন বৈষম্য থাকে না। পারস্পরিক সৌহার্দ ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায়ও যাকাতের ভূমিকা রয়েছে। যাকাত আদায়ের ফলে নিম্নশ্রেণির মানুষ যেমন সচ্ছলতা ফিরে পায়, তেমনি যাকাত প্রদানকারীর নিকটও অলস অর্থ পড়ে থাকে না। কেননা অলস অর্থ মানুষকে খারাপ কাজে উৎসাহিত করে। এতে একদিকে মানুষ যেমন খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে তেমনি অর্থেরও একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা হয়ে যায়। যাকাত প্রাপ্ত ব্যক্তি তার যাকাতের অর্থ প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করার পাশাপাশি অনেক সময় তা বিনিয়োগও করে থাকে। এভাবে সমাজে মূলধন গড়ে উঠে এবং পর্যায়ক্রমে তা শিল্প গড়ে তুলতে সহায়তা করে।

বিভিন্ন উৎস থেকে অর্জিত ও রাষ্ট্রের কোষাগারে জমাকৃত অর্থ সম্পত্তি বায়তুল মাল হিসেবে অভিহিত হয়ে থাকে। ইসলামি অর্থব্যবস্থায় বায়তুল গঠনের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এতে ইসলামি রাষ্ট্রের সকল নাগরিকেরই সম্মিলিত মালিকানা স্বীকৃত। বায়তুলমালের অর্থ সম্পত্তির ওপর ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-লিঙ্গ-ভাষা নির্বিশেষে সকলের ন্যায্য অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্রের সীমার মধ্যে কোন ব্যক্তি যেন তার মৌলিক মানবিক প্রয়োজন থেকে বঞ্চিত না হয়, সেজন্য বায়তুলমাল থেকেই পদক্ষেপ নেয়া হয়ে থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে বায়তুলমালও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বায়তুলমাল থেকে গরিব ও বঞ্চিতদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানো হয়ে থাকে। এ অর্থ সম্পত্তি থেকে ব্যক্তি বা শাসকের ভোগ বিলাসের জন্য ব্যয় করার কোন বিধান নেই।

বর্তমানকালে অর্থব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ব্যাংক ও বিমাব্যবস্থা। বিশেষ করে ব্যাংকিংব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বিরাট একটা অংশ সম্পন্ন হচ্ছে। তাই ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ব্যতিরেকে ইসলামি অর্থব্যবস্থার বাস্তবায়ন অসম্ভব। ব্যবসায় ও বিনিয়োগে ইসলামি শরীয়তের আলোকে হালাল হারামের পার্থক্য অনুসরণ, অংশীদারিত্ব শরীয়া বোর্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া, যাকাত আদায় করা, লাভ লোকসানের অংশীদারিত্বের শর্তে বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করা, ইসলামি ব্যাংকব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইসলামি অর্থব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই ইসলামি বিমাব্যবস্থা চালু করতে হবে। মানুষ তার ব্যবসায়ে নিজের জীবন ও পণ্যের নিরাপত্তা চায়। নিরাপত্তার এ প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সুদ ভিত্তিক বিমাব্যবস্থা। এ অবস্থার অবসানকল্পে শরীয়তসম্মত বিমাব্যবস্থার উৎপত্তি হয়। যেখানে অংশীদারগণ স্ব স্ব ইচ্ছানুযায়ী ফান্ডে টাকা জমা করে। সারা বৎসরে যাদের দুর্ঘটনা ঘটে, তাদের এ ফান্ড থেকে সাহায্য করা হয়। বৎসর শেষে যে টাকা অবশিষ্ট থাকে, তা অংশীদারদের মধ্যে যোগান অনুপাতে বণ্টন করা হয়। অথবা আগামি বৎসরের জন্য ফান্ডে জমা হিসেবে রেখে দেয়া হয়। এছাড়াও ইসলামি বিশ্বের কয়েকটি দেশে ইসলামি বিমার পরিবর্তে তাকাফুল প্রকল্পের নামে বিভিন্ন কোম্পানি চালু হয়েছে।

ইসলামি অর্থব্যবস্থায় সুদকে জঘন্যভাবে হারাম করা হয়েছে। তাই এই ব্যবস্থায় সুদকে কখনই প্রশ্রয় দেওয়ার অবকাশ নেই। আল্লাহর দেয়া নিয়ামত উপার্জন, বণ্টন, বাজারজাতকরণ এবং ভোগ এ সবই যেন শরীয়তসম্মত নিয়মেই সংঘটিত হয়, সেদিকে সচেতন দৃষ্টি রাখা প্রত্যেক মুসলমানের নৈতিক কর্তব্য। তবেই ইসলামি অর্থব্যবস্থার বাস্তবায়ন সম্ভব।

সুদের ভয়াবহতা বর্তমান প্রেক্ষাপট

হাফিজুর রহমান

সমস্ত প্রসংসা ও কৃতজ্ঞতা সেই করুণাময় আল্লাহ তাআলার, যার অশেষ কৃপায় আমাদের এ সুন্দর সুশৃংখল জীবনধারা। যার অফুরন্ত মহামূল্যবান। নি’মাতরাজি সুগম ও সহজতর করেছে মানব জাতিসহ সমস্ত সৃষ্টিকুলের জীবনপ্রণালী আল-হামদু লিল্লাহ। অগণিত দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক সেই মহা মানবের প্রতি, যার দেখানো পথে চললেই কেবলমাত্র পরকালীন জীবনে মুক্তি অর্জন সম্ভব। আমরা সকলেই বিশেষভাবে অবগত আছি যে, প্রত্যেক জীবের জীবন ধারণের জন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বের দাবিদার, সেটি হলো- পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ। এর সাথে জড়িয়ে আছে সুখ, দুঃখ ও গৌরবের বিষয়। আবার জীবনের অন্যান্য প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য প্রয়োজন অর্থের। আজ অর্থের চাহিদা ব্যাপক। তবে সে অর্থ উপার্জন করতে হবে সমস্ত প্রকার অবৈধ পন্থা। এড়িয়ে হালাল বা বৈধ পন্থায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা সুদকে হারাম বা নিষিদ্ধ করেছেন আর ব্যবসাকে হালাল করেছেন।’ (সূরা আল-বাকারা, ২:২৭৫)

বর্তমান বিশ্বে বিরাজমান্য অবৈধ উপার্জনের অন্যতম একটি উপার্জন হলো সুদ যা আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করেছেন। সমাজে প্রচলিত এ সুদ এমন এক জঘন্যতম ও ভয়ংকর ব্যাধি, যার মাধ্যমে প্রদানকারী ও গ্রহণকারী সমানভাবে ধ্বংস হয়।

সুদের পরিচয়

আরবি ভাষায় সুদকে বলা হয় ‘রিবা’ যার শাব্দিক অর্থ বৃদ্ধি, অতিরিক্ত প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি।

অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, ইসলামে সব ধরনের বৃদ্ধিকে হারাম বা নিষিদ্ধ গণ্য করা হয়েছে। প্রখ্যাত ইসলামি অর্থনিতিবিদ ও দার্শনিক ওমর চাপড়ার মতে, শরীআতে রিবা বলতে সেই অর্থকেই বোঝায় যা ঋণের শর্ত হিসেবে মেয়াদ শেষে ঋণ গ্রহীতা অতিঅবশ্যই মূল অর্থসহ ঋণদাতাকে অতিরিক্ত পরিশোধ করতে বাধ্য।

ইমাম ফকরুদ্দীন আর-রাযী (রহ.) বলেন, জাহিলিয়াতের যুগে আরববাসীর সকলেরই রিবা বা সুদ সমন্ধে জানা ছিল। সে যুগেও তারা প্রথা সিদ্ধভাবে ঋণ দিত শর্ত অনুসারে মাসে মাসে তার ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আদায় করত কিন্তু আসলের পরিমাণ থাকত অপরিবর্তিত।

বিশ্ব বরেণ্য মুহাদ্দিস হাফিয ইবনু হাজার আল-আসকালানী (রহ.) বলেন, পণ্য বা অর্থের বিনিময়ে প্রদেয় অতিরিক্ত পণ্য বা অর্থই হলো রিবা বা সুদ।

প্রখ্যাত তাফসীরবিদ ইবনু জারীর আত-তাবারী (রহ.) বলেন, জাহেলী যুগে প্রচলিত ও কুরআনে নিষিদ্ধ রিবা হলো কাউকে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ঋণ দিয়ে মূলধনের সাথে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করা।

সুদের সূচনা প্রকারভেদ

আরব আমিরাতে ইসলামি অনুশাসন বাস্তবায়নের অনেক আগে থেকেই অর্থাৎ জাহেলী যুগে আরব বিশ্বে সুদের প্রচলন ছিল ব্যাপকভাবে। যা পুরো পৃথিবীতে অদ্যবধি প্রচলিত। বিশেষ করে আহলে কিতাব অর্থাৎ ইহুদি-নাসারাদের মাঝে সুদের ব্যাপকতা ছিল অপরিসীম। যা নির্মূলের জন্য তাদের বিদ্যানগণ সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। সামনের আলোচনায় তা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে।

সুদের প্রকারভেদ

ইসলামি শরী’আহ অনুসারে সুদ বা রিবা দু’প্রকার। যথা- ১. রিবা আন-নাসিয়া। ২. রিবা আল-ফাযল।

রিবা আন-নাসিয়া হচ্ছে বাকিতে ঋণের সুদ, বা ঋণের সেই মেয়াদকাল, যা ঋণদাতা মূলধনের ওপর নির্ধারিত পরিমাণ অতিরিক্ত প্রদানের শর্তে ঋণ গ্রহীতাকে ঋণ দেন।

রিবা আল-ফাযল হচ্ছে পণ্য সামগ্রী হাতে হাতে বিনিময়ের সময় একই জাতীয় পণ্যের পরিমাণের সাথে কম পরিমাণের সাথে বেশি পরিমাণ পণ্য হাতে হাতে বিনিময় করা হলে পণ্যটির অতিরিক্ত পরিমাণকে বলা হয় সুদ বা রিবা।

সুদ নিষেধাজ্ঞায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদীস: প্রখ্যাত সাহাবী আবু সাঈদ আল-খুদরী (রাযি.) হতে বর্ণিত। একদা বিলাল (রাযি.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট কিছু উন্নতমানের খেজুর নিয়ে আসলেন। অতঃপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথা থেকে এ খেজুর আনলে? বিলাল (রাযি.) উত্তর দিলেন আমাদের খেজুর নিম্নমানের ছিল, আমি এর দুই ‘সা’-এর বিনিময়ে এক সা নিয়েছি। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, এটা নির্ভেজাল সুদ; কখনও এরূপ করো না। তোমরা যদি উত্তম খেজুর পেতে চাও, তাহলে নিজের খেজুর বাজারে বিক্রি করতে তারপর উন্নতমানের খেজুর কিনতে। (সহীহুল বুখারী, সহীহ মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ: ২৮১৪)

আবু সাঈদ আল-খুদরী (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সোনার বিনিময়ে সোনা, রূপার বিনিময়ে রূপা, গমের বিনিময়ে গম, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর, যবের বিনিময়ে যব, লবণের বিনিময়ে লবণ সমান সমান এবং উপস্থিতক্ষেত্রে হাতে হাতে পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি বেশি দিয়েছে বা নিয়েছে সে সুদের কারবার করেছে। এ ক্ষেত্রে দাতা ও গ্রহীতা উভয়ে সমান।’ (সহীহ মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ: ২০৮৯)

অন্যান্য ধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যে সুদের অবস্থান: কুরআন নাযিলের পূর্বে যে সকল আসমানী গ্রন্থ। নাযিল হয়েছে, সেসব কিতাবেও সুদ নিষিদ্ধ ছিল। যুগের আবর্তনে ও সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের কবলে ফেলে সে সকল কিতাবের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে যা সুপ্রসিদ্ধভাবে বিশ্ববাসী জেনে আসছে। তারপরেও ওল্ড ইনজিল বা, বাইবেলের ওল্ড টেষ্টামেন্ট ও আদি পুস্তক তাওরাতের অংশ বিশেষ বলে ইউরোপিয় বিশেষজ্ঞগণ দাবি করেন। সেই আদি পুস্তকেই সুদ সম্বন্ধে যে ঘোষণা ও নির্দেশনা রয়েছে তা এ যুগের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। যেমন-

দলীল: ১, যাত্রা পুস্তক ২২:২৫-এ বলা হয়েছে। প্রজাদের মধ্যে তোমার স্বজাতীয় দীন দুঃখিকে অর্থ ধার দাও, তবে তার কাছে সুদ গ্রহীতার ন্যায় হয়ো না। তোমরা তার ওপর সুদ চাপাবে না। লেবিয় পুস্তক ৩৬-৩৭-এ বলা হয়েছে, তুমি তা হতে সুদ বা বৃদ্ধি নিবে না, কিন্তু আপন ঈশ্বরকে ভয় করবে। খ্রিস্টধর্মের শুরু হতে সংস্কার আন্দোলনের সূচনা এবং রোমে পোপের নিয়ন্ত্রিত চার্চ হতে অন্যান্য চার্চের বিচ্ছিন্ন হওয়া পর্যন্ত সুদ নিষিদ্ধ ছিল।

বিভিন্ন দার্শনিকের অভিমত

  1. প্রাচীন মধ্যযুগের প্রখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটল তার Politics গ্রন্থে বলেছেন, অন্যান্য পণ্যের ন্যায় অর্থের ক্রয়-বিক্রয় এক ধরনের জালিয়াতি। সুতরাং সুদের কোন বৈধতা থাকতে পারে না।
  2. প্লেটো তার Laws নামক গ্রন্থে সুদের তীব্র নিন্দা করেছেন।
  3. শুধু এখানেই সিমাবদ্ধ নয় বরং হিন্দু ধর্মেও সুদ গ্রহণ সমর্থন করা হয়নি। মনুসংহিতা ১ম অধ্যায় শ্লোক নং ১০২ সুদের নিন্দা করা হয়েছে।

সুদ ইসলাম

সুদ যে এক ধ্বংসাত্বক বিষয় তা আমাদের সমাজের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বুঝা যায়। সুদ প্রদানকারী বাহ্যিকভাবে কিছু সময়ের জন্য লাভবান হলেও ধ্বংসাত্বক এ পাপের কালো ছোবল থেকে রক্ষা পায়নি। এক সময়ে সে নিঃস্ব হয়েই যায়। অপরদিকে দরিদ্র গ্রহণকারী সে আরো দরিদ্র হয়ে যায়।

সুদের বিষয়ে ইসলামের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর ভয়াবহ

আল্লাহ তাআলা নিজেই সুদের বিরুদ্ধে নিন্দা করে বলেন, ‘আল্লাহ সুদকে বিলুপ্ত করেন এবং সাদাকাহ/দানকে বৃদ্ধি করেন, আল্লাহ অকৃতজ্ঞ পাপীদেরকে ভালবাসেন না।’ (সূরা আল-বাকারা, ২:২৭৬)

একজন সত্যিকারের মুসলমান কখনও পারে না যে, সে সুদ প্রদান ও গ্রহণ করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যে সব বকেয়া আছে তা পরিত্যাগ করো যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো। (সূরা আল-বাকারা, ২:২৭৮)

সুদের ভয়াবহতা

সুদের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যার নিকট তার প্রতিপালকের উপদেশ এসেছে এবং যে বিরত হয়েছে, তবে অতীতে যা হয়েছে তা তারই; এবং তার ব্যাপার আল্লাহর ইখতিয়ারে। আর যারা পুনরায় আরম্ভ করবে তারাই অগ্নি-অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।’ (সূরা আল-বাকারা, ২:২৭৫)

অতএব আমাদের সকলেরই উচিত জীবনের দারিদ্রতাকে ধৈর্যসহকারে মোকাবেলা করা ও মহান আল্লাহর কাছে স্বচ্ছলতা কামনা করার সাথে সাথে এও কামনা করা আল্লাহ তাআলা আমাদের সুদ বর্জনের তাওফীক দিন তার একান্ত ভালবাসার পাত্র হওয়ার মাধ্যমে। আমিন।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ