বুধবার-২১শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি-২১শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মধ্য শাবানের পুণ্যময় রজনী

মধ্য শাবানের পুণ্যময় রজনী

ধ্য শাবানের পুণ্যময় রজনী

. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান


আরবি চান্দ্রমাসের মধ্যে বিশেষ ফযীলতপূর্ণ শাবান মাসের মধ্যভাগে রয়েছে এক পুণ্যময় রজনী। হিজরী সালের শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত হাদীসের পরিভাষায় লাইলাতুন নিসফ মিন শাবান অর্থাৎ শাবানের মধ্যবর্তী রজনীকে উপমহাদেশে শবে বরাত বলা হয়। প্রতিবছরের মতো শবে বরাত মুসলমানদের কাছে রমজান মাসের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে। আসন্ন মাহে রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য শাবান একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফজিলতময় মাস। রাসুলুল্লাহ (সা.) অধিক হারে এ সময় দুআ করতেন,

«اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِيْ رَجَبٍ وَشَعْبَانَ، وَبَلِّغْنَا رَمَضَانَ».

‚হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাসে আমাদের ওপর বরকত নাজিল করুন এবং আমাদের রমযান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন!“[1]

ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে শাবানের মধ্য রজনীটি আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে পুণ্যময় ও মহিমান্বিত বলে বিবেচিত। আল্লাহ তাআলা মানবজাতির জন্য তাঁর অশেষ রহমতের দরজা এ রাতে অবারিত করে দেন। রাত জেগে নফল ইবাদত করে গুনাহখাতা মাফ ও অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ তা কবুল করেন এবং অনুতপ্ত বান্দাদের পাপমুক্ত করে দেন। নবী করীম (সা.) বলেছেন,

«يَطَّلِعُ اللهُ عَلَىٰ خَلْقِهِ فِيْ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، فَيَغْفِرُ لِـجَمِيْعِ خَلْقِهِ، إِلَّا لِـمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ».

‚মধ্য শাবানের রাতে আল্লাহ তাআলা রহমতের ভাণ্ডার নিয়ে তাঁর সব সৃষ্টির প্রতি এক বিশেষ ভূমিকায় আবির্ভূত হন এবং মুশরিক অথবা হিংসুক ব্যক্তি ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।“[2]

অন্য হাদীসে আছে,

«يَنْزِلُ اللهُ تَعَالىٰ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، فَيَغْفِرُ لِكُلِّ شَيْءٍ إِلَّا رَجُلٍ مُّشْرِكٍ أَوْ فِيْ قَلْبِهِ شَحْنَاءُ».

‚আল্লাহ তাআলা ১৫ শাবানের রাতে প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং এ রজনীতে কেবল মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়।“[3]

আল্লাহ তাআলা মানবসমাজ তথা বিশ্বের সব সৃষ্টির পরবর্তী বছরের ভাগ্য এই রাতে পুনর্নির্ধারণ করেন। তিনি মুমিন বান্দাদের আকুতি ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেন, ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিদের উত্তরণের পথ দেখান। এ দিন সূর্যাস্তের পর থেকে তিনি মানুষের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এ জন্য মুসলমানদের কাছে শবে বরাতের নফল ইবাদত বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

وَعَنْ عَلِيٍّ، عَنِ النَّبِيِّ ^: «إِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، فَقُوْمُوْا لَيْلَهَا، وَصُوْمُوْا نَهَارَهَا، فَإِنَّ اللهَ يَنْزِلُ فِيْهَا لِغُرُوْبِ الشَّمْسِ إِلَىٰ السَّمَاءِ الدُّنْيَا، فَيَقُوْلُ: أَلَا مِنْ مُّسْتَغْفِرٍ لِّيْ فَأَغْفِرَ لَهُ! أَلَا مِنْ مُّسْتَرْزِقٍ فَأَرْزُقَهُ! أَلَا مِنْ مُّبْتَل فَأُعَافِيْهِ! أَلَا كَذَا! أَلَا كَذَا! حَتَّىٰ يَطْلُعَ الْفَجْرُ».

—হযরত আলী (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, —যখন মধ্য শাবানের রজনী আসে তখন তোমরা রাত জেগে ইবাদত করো এবং পরের দিন রোয রাখো। কেননা প্রতিটি রাত্রিতে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে মহান আল্লাহ পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোনো রিজিকপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক প্রদান করব। কোনো বিপদগ্রস্ত আছে কি? আমি তাকে বিপদমুক্ত করব। সুবহে সাদেক পর্যন্ত এ আহ্বান অব্যাহত থাকে।“[4]

নবী করীম (সা.) শাবান মাসে বেশি নফল রোযা রাখতেন এবং সাহাবিদের রোজা পালন করতে বলতেন।

عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ، قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنِّيْ أَرَاكَ تَصُومُ فِيْ شَهْرٍ مَا لَا أَرَاكَ تَصُوْمُ فِيْ شَهْرٍ مثل مَا تَصُومُ فِيهِ، قَالَ: «أَيُّ شَهْرٍ»؟ قُلْتُ: شَعْبَانُ، قَالَ: «شَعْبَانُ بَيْنَ رَجَبٍ وَشُهِرِ رَمَضَانَ، يَغْفُلُ النَّاسُ عَنْهُ، يَرْفَعُ فِيهِ أَعْمَالَ الْعِبَادِ، فَأُحِبُّ أَنْ لَا يُرْفَعَ عَمَلِي إِلَّا وَأَنَا صَائِمٌ».

—হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রাযি.) বলেন, একদিন নবী করীম (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আমি তো আপনাকে শাবান মাসের মতো অন্য কোনো মাসে এত অধিক রোযা রাখতে দেখি না। উত্তরে তিনি বললেন, —শাবান মাসটি রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী মাস। অনেক মানুষ এ মাসের ফযীলত সম্পর্কে উদাসীন থাকে। অথচ বান্দার আমলসমূহ এ মাসে আল্লাহর সমীপে পেশ করা হয়। এ জন্য আমি চাই যে আমার আমলসমূহ আল্লাহর দরবারে এমতাবস্থায় পেশ করা হোক যে আমি রোযাদার।“[5]

তাই মাহে রমযানের প্রস্তুতি হিসেবে শাবান মাসের অন্যতম ঐচ্ছিক ইবাদত রোজা পালন হিসেবে নিসফে শাবান তথা শবে বরাতের আগে সোমবার ও বৃহস্পতিবার মিলিয়ে কমপক্ষে দুটি নফল রোযা পালন করা উচিত। তা ছাড়া, প্রতি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে আইয়ামে বিজের তিনটি নফল রোযা পালনের জন্য নবী করীম (সা.) অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন,

«إِذَا صُمْتَ مِنَ الشَّهْرِ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ فَصُمْ ثَلَاثَ عَشْرَةَ، وَأَرْبَعَ عَشْرَةَ، وَخَمْسَ عَشْرَةَ».

‚যখন তুমি মাসে তিনটি রোযা রাখতে চাও তখন ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখো।“[6]

পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর কবর জিয়ারত এবং ইসালে সওয়াব শবে বরাতের নেকআমল। একদা মধ্য শাবানের রজনীতে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাযি.)-এর ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে রাসুলে করীম (সা.) নীরবে জান্নাতুল বাকির সমাধিস্থলে গিয়ে মৃত ব্যক্তিদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করছিলেন।[7]

নবী করীম (সা.) কবর যিয়ারতে গিয়ে মানুষকে এ দোয়া করতে শিক্ষা দিয়েছেন,

«السَّلَامُ عَلَيْكُمْ دَارَ قَوْمٍ مُؤْمِنِيْنَ، وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللهُ بِكُمْ لَاحِقُوْنَ، وَدِدْتُ أَنَّا قَدْ رَأَيْنَا إِخْوَانَنَا».

‚হে কবরবাসী মুমিন ও মুসলিমগণ! তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক! আমরাও ইন শা আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব! আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের এবং তোমাদের জন্য ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি!“[8]

যুগ যুগ ধরে শবে বরাতে মুসলিম সম্প্রদায় যথাসাধ্য রাত্রি জাগরণ করে বাসায় ও মসজিদে ঐচ্ছিক ইবাদত তথা নফল নামাজ, তাহাজ্জুদ, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, মিলাদ মাহফিল, যিকির-আযকার, তাসবিহ-তাহলিল, তওবা-ইস্তেগফার ও দোয়া-দরুদে মশগুল থাকেন এবং পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের কল্যাণ, দেশ-জাতি তথা মুসলিম উম্মাহর শান্তি, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি ও আন্তধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য আল্লাহর রহমত কামনায় এবং সবার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা ও কল্যাণ কামনায় বিশেষ মুনাজাত করেন। এতে মুমিন বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সক্ষম হন এবং ব্যক্তিজীবনে এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটে।

রোযাদার মুসল্লীরা সাধ্যমতো দান-সাদকা, গরিব-দুস্থদের মধ্যে হালুয়া-রুটি বিতরণ এবং পরলোকগত ব্যক্তিদের রুহের মাগফিরাত কামনায় কবর যিয়ারত করে ফাতিহা পাঠ করেন। এভাবে শবে বরাতের তাৎপর্য অনুধাবন করে ধর্মপ্রাণ মানুষ সর্বক্ষেত্রে অন্যায় পরিহার ও সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হন। তবে সারা বছর ফরয ইবাদত না করে শুধু শবে বরাতে রাত জেগে নফল ইবাদত করে সব ধরনের গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, এমন চিন্তার কোনো সুযোগ নেই। আতশবাজি বা এ ধরনের কিছুর মাধ্যমে যাতে নফল ইবাদতরত ধর্মপ্রাণ মানুষের আল্লাহর ধ্যানে বিঘ্ন না ঘটে, সেদিকে সবার দৃষ্টি রাখা উচিত।

[1] আত-তাবারানী, আল-মু’জামুল আওসাত, দারুল হারামইন, কায়রো, মিসর, খ. 4, পৃ. 189, হাদীস: 3939

[2] আত-তাবারানী, আল-মু’জামুল আওসাত, খ. 7, পৃ. 36, হাদীস: 6776

[3] আল-বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, মাকতাবাতুর রাশাদ, রিয়াদ, সউদী আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪২৩ হি. = ২০০৩ খ্রি.), খ. ৫, পৃ. ৩৫৭, হাদীস: ৩৫৪৬

[4] ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, দারু ইয়াহইয়ায়িল কুতুব আল-আরাবিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ১, পৃ. ৪৪৪, হাদীস: ১৩৮৮

[5] আল-বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, খ. ৫, পৃ. ৩৫2, হাদীস: ৩৫40

[6] আত-তিরমিযী, আল-জামিউল কবীর = আস-সুনান, মুস্তফা আলবাবী অ্যান্ড সন্স পাবলিশিং অ্যান্ড প্রিন্টিং গ্রুপ, কায়রো, মিসর, খ. ৩, পৃ. 125, হাদীস: 761

[7] আল-বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, খ. ৫, পৃ. ৩৫৫-৩৫৬, হাদীস: ৩৫৪৪ ও ৩৫৪৬

[8] মুসলমি, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়তি তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান, খ. ১, পৃ. ২১৮, হাদীস: ২৪৯

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ