কওমী মাদরাসার অঙ্গনে বাংলা ভাষার চর্চা ব্যাপকতা লাভ করছে
জাতিসংঘ কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভাষা দিবস ঘোষিত হয়েছে। বাংলা ভাষার প্রতি এটা আন্তর্জাতিক সম্মান। প্রতি বছর এ দিনে গোটা দুনিয়াব্যাপী বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাস নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে-চলবে। বাংলা ভাষার বাহক ও ধারক হিসেবে এটা আমাদের জন্য কম গৌরবের কথা নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের কওমী মাদরাসাসমূহে বাংলা ভাষার অনুশীলন ও চর্চা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পটিয়া আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া, হাটহাজারী দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম, ঢাকার মিরপুরস্থ দারুর রাশাদসহ বেশ কিছু মাদরাসায় দারুল হাদীস সম্পন্ন করার পর আগ্রহী ছাত্রদের জন্য এক বছর বা দু’বছরব্যাপী বাংলা সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও ইসলামী গবেষণা বিভাগ খোলা হয়েছে অনেক আগে থেকে। চট্টগ্রামের দারুল মাআরিফ, কক্সবাজারের পোকখালী মাদরাসা সহ বহু কাওমী মাদরাসায় মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বাংলা ভাষার র্চ্চা হয়। মাতৃভাষার প্রতি এটা গভীর মমত্ববোধের পরিচয় বহন করে। সাম্প্রতিক সময়ে নিম্ন পর্যায় থেকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত ‘শিক্ষার মাধ্যম’ হিসেবে বাংলা চর্চার প্রচলন শুরু হয়েছে যদিও এখনো তা সর্বজনীনতা লাভ করেনি। যে সব মাদরাসায় শিক্ষার মাধ্যম এখনো উর্দু প্রচলিত-তাকে কিন্তু উন্নত ও মানোত্তীর্ণ উর্দু বলা চলে না। বাংলার পাশাপাশি উর্দু ভাষায়ও মাদরাসার ছাত্রদের দক্ষতা অপরিহার্য। উর্দু ভাষা ও সাহিত্যকে অবহেলা ও অবজ্ঞা করলে ইলমের বিপুল ভান্ডার হতে আমরা বঞ্চিত থেকে যাবো। উর্দু শ্রুতিমধুর একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। ভারত ও পাকিস্তানের আলিমগণ কুরআন, হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, ইতিহাস, দর্শনকে উর্দূতে ভাষান্তর করে বিস্ময়কর খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন ফলে কৃষণচন্দ্র, পংকজ উদাস ও সাদাত হাসান মান্টুর উর্দু হয়েছে ইলমে দ্বীনের ভাষা। এটা উর্দুভাষী আলিমদের নিজ মাতৃভাষার প্রতি সুগভীর অনুরাগের স্বীকৃতি।
আল-হামদু লিল্লাহ। বাংলাভাষী দেওবন্দী বহু আলিম বিগত ৬ দশক ধরে বাংলার চর্চা, অনুশীলন ও প্রচলনের জন্য ব্যাপক মেহনত করে আসছেন। এক্ষেত্রে হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.), পটিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা কুতবে যামান হযরত মুফতী আযিযুল হক (রহ.), হযরত মাওলানা আলহাজ্ব মুহাম্মদ ইউনুছ (রহ.), খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক (রহ.), শায়খুল হাদীস মাওলানা আযিযুল হক (রহ.), মাওলানা নুর মোহাম্মদ আযমী (রহ.), মাওলানা আমিনুল ইসলাম (রহ.), মাওলানা রিযাউল করীম ইসলামাবাদী (রহ.)-এর নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। হযরত ফরিদপুরী (রহ.) বেহেশতী জেওরের বঙ্গানুবাদসহ বহু দীনী গ্রন্থ বাংলা ভাষায় রচনা করে পথিকৃতের ভূমিকা রাখেন। পটিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা কুতবে যামান হযরত মুফতী আযিযুল হক (রহ.) আজ থেকে ষাট বছর আগে ‘বাংলা সাহিত্য ও ইসলামী গবেষণা’ নামে একটি বিভাগ চালু করেন যখন অন্যান্য কাওমী মাদরাসার সর্বস্তরে বাংলা চর্চা ব্যাপকতা লাভ করেনি। তারই ধারাবাহিকতায় পটিয়া মাদরাসার অন্যতম প্রধান পরিচালক হযরত মাওলানা আলহাজ মোহাম্মদ ইউনুছ (রহ.) ইসলামী সাহিত্য ও গবেষণা জার্নাল হিসেবে মাসিক আত-তাওহীদ চালু করেন সেই ১৯৭১ সালে, আজ থেকে ৩৮ বছর আগে। এটা হাজী সাহেব মরহুমের দূরদৃষ্টির বহিঃপ্রকাশ। চরমোনাইয়ের মরহুম পীর সাহেব সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাক (রহ.)-এর ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে ২৭টি কিতাব, মাওলানা নুর মোহাম্মদ আযমী (রহ.)-এর মিশকাত শরীফের বঙ্গানুবাদ, শায়খুল হাদীস মাওলানা আযিযুল হক (রহ.)-এর বুখারী শরীফের বাংলা অনুবাদ ও মরহুম মাওলানা আমিনুল ইসলাম কর্তৃক বাংলায় রচিত ৩০ খণ্ডে সমাপ্ত তাফসীর গ্রন্থ নুরুল কুরআন, মাওলানা রিযাউল করীম ইসলামাবাদী (রহ.)-এর মুওয়াত্তা মালিকের অনুবাদ, মাওলানা মুহীউদ্দীন খান (রহ.)-এর বিপুল অনুবাদ সাহিত্য, মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ (দা. বা.)-এর মৌলিক বাংলা সাহিত্য কর্ম, দৈনিক নয়া দিগন্তে মাওলানা লিয়াকত আলী (দা. বা.) ও দৈনিক ইনকিলাবে মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী (দা. বা.)-এর বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতার চর্চা, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তাঁদের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এ প্রজন্মের বহু আলিম বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চায় এগিয়ে এসেছেন-যা কাওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে রীতিমত আশার সঞ্চার করে। দেওবন্দী চিন্তাধারার যে সব আলিম বাংলাভাষার ব্যাপক চর্চায় জীবন অতিবাহিত করেছেন এবং করে আসছেন আমরা তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। বাংলাদেশের বড় বড় মাদরাসা থেকে যে সব নিয়মিত বাংলা মাসিক জার্নাল বের হয়; বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা ও ইসলামের দাওয়াতী কার্যক্রমে রয়েছে তাদের তাৎপর্যপূর্ণ অবদান।
এখনো যে সব কাওমী মাদরাসা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় পিছনের সারিতে রয়েছে, আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে সময়ের দাবী ও যুগ চাহিদার প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসবেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পারঙ্গম একদল আলিম কলম সৈনিকের আজ বড্ড প্রয়োজন। বাংলা ভাষার হাল যদি আলিমরা ছেড়ে দেন, তাহলে বেদ্বীনদের হাতে তার কর্তৃত্ব চলে যাবে, যা আমাদের জন্য সমূহ ক্ষতির কারণ হতে পারে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষতা অর্জন মানে ৩০ কোটি মানুষের সামনে ইসলামের শাশ্বত সৌন্দর্য তুলে ধরার সুযোগ লাভ করা। ভাষার রয়েছে প্রচণ্ড শক্তি; মনের ভাব প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম ভাষা। জনমতকে সুসংগঠিত করার জোরালো মাধ্যম হচ্ছে ভাষার ওজস্বিতা। সংষ্কৃৃতির বিকাশ ও সভ্যতার অগ্রগতিতে ভাষার অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন