বৃহস্পতিবার-১৫ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি-১৫ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সফর মাস: কিছু প্রসঙ্গ কথা

মুহাম্মদ আবদুল্লাহ

সফর হিজরি সালের দ্বিতীয় মাস। এ মাসে বিশেষ আমল হিসেবে প্রচলিত আমলসমূহ নিয়ে সমাজে নানা বিভ্রান্তি রয়েছে। এ মাসের শেষ বুধবারে আখেরি চাহার শোম্বা পালিত হয়।

ফারসি শব্দ আখেরি চাহার শোম্বা অর্থ শেষ চতুর্থ বুধবার। সফর মাসের শেষ বুধবারকে ‘আখেরি চাহার শোম্বা’ বলা হয়। বলা হয় হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সফর মাসের শেষের দিকে অসুস্থ হন। তিনি সফর মাসের শেষদিকে কিছুটা সুস্থ হন এবং গোসল করেন। এর পর তিনি পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এই অসুস্থতাতেই তিনি পরের মাসে ইন্তেকাল করেন। এ জন্য অনেকে এই দিনে রাসূলের সর্বশেষ সুস্থতা ও গোসলের স্মৃতি উদযাপন করেন। এ কারণে দিনটি কতিপয় মুসলমান ‘শুকরিয়া দিবস’ হিসেবে পালন করেন।

এ দিনকে ঘিরে এমন আরও অনেক কথা প্রচলিত রয়েছে। তবে ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো, উপর্যুক্ত  বিষয়ে যা কিছু বলা হয়, তার সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। এমন কোনো বর্ণনা হাদীসে নেই। আরও মজার বিষয় হলো, ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া অন্য কোনো মুসলিম সমাজে সফর মাসের শেষ বুধবার পালনের রেওয়াজ নেই। তারা জানেও না আখেরি চাহার শোম্বা কী!

বিশুদ্ধ হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অসুস্থতা, অসুস্থকালীন অবস্থা, কর্ম ও ইন্তেকাল ইত্যাদির ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত আছে। কিন্তু কোথাও কোনোভাবে, কোনোদিন, তারিখ বা সময় উল্লেখ করা হয়নি। এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। অসুস্থ হওয়ার পরে মাঝে কোন দিন তিনি সুস্থ হয়েছিলেন এটা কেউ উল্লেখ করেননি। তবে কয়েকদিন অসুস্থ থাকার পর তিনি গোসল করেছিলেন বলে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন আমার ঘরে প্রবেশ করলেন এবং তার অসুস্থতা বৃদ্ধি পেল, তখন তিনি বললেন, তোমরা আমার ওপরে ৭ মশক পানি ঢাল, যেন আরামবোধ করে লোকদের নির্দেশনা দিতে পারি। তখন আমরা এভাবে তার দেহে পানি ঢাললাম। এরপর তিনি মানুষের নিকট যেয়ে তাদের নিয়ে নামাজ আদায় করলেন এবং তাদেরকে ওয়ায করলেন। [সহীহ আল-বুখারী]

এখানে স্পষ্ট যে, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তার অসুস্থতার সময় অসুস্থতা ও জ্বরের প্রকোপ কমানোর জন্য এভাবে গোসল করেন। যেন কিছুটা আরামবোধ করেন এবং মসজিদে যেয়ে সবাইকে নসিহত করতে পারেন। এই গোসল করার ঘটনা কত তারিখে বা কী বারে ঘটেছিল তা হাদীসের কোনো বর্ণনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। তবে আল্লামা ইবনে হাজার আল-আসকালানী (রহ.) সহীহ আল-বুখারী ও সহীহ মুসলিমসহ অন্যান্য হাদীসের সঙ্গে এই হাদীসের সমন্বয় করে উল্লেখ করেছেন যে, এ গোসলের ঘটনাটি ঘটেছিল ইন্তেকালের আগের বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ইন্তিকালের ৫ দিন আগে [ফতহুল বারী: ৮/১৪২]।

সে হিসেবে ১২ রবিউল আউয়াল হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইন্তেকাল করলে তা ঘটেছিল ৮ রবিউল আউয়াল।

উপরের আলোচনা থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, সফর মাসের শেষ বুধবার হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুস্থ হওয়া, গোসল করা এবং এ জন্য সাহাবীদের আনন্দিত হওয়া ও দান-সদকা করার কাহিনির কোনো ভিত্তি নেই। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে অনেক আনন্দের দিন এসেছে। যখন তিনি আনন্দিত হযেছেন শোকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য আল্লাহর দরবারে সিজদাবনত হয়েছেন। কিন্তু পরের বছর বা পরবর্তী কোনো সময় সেই দিনকে তারা বাৎসরিক আনন্দ দিবস হিসেবে উদ্যাপন করেননি। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশ বা সাহাবীদের কর্ম ছাড়া এরূপ কোনো দিন পালন করা কিংবা এ দিনগুলোতে বিশেষ ইবাদতকে বিশেষ সওয়াবের কারণ বলে মনে করার কোনো সুযোগ নেই।

উপর্যুক্ত বিষয় ছাড়াও অনেকেই সফর মাসকে অশুভ মনে করে থাকেন। ইসলামি শরীয়তে এরও কোনো ভিত্তি নেই। কোনো স্থান, সময়, বস্তু কিংবা কর্মকে অশুভ অথবা অমঙ্গলময় বলে মনে করা ইসলামি বিশ্বাসের ঘোর পরিপন্থী। এটা একটি কুসংস্কার। প্রাচীন আরবের মানুষেরা জাহেলি যুগ থেকেই সফর মাসকে অশুভ ও বিপদাপদের মাস বলে বিশ্বাস করতো। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের এই বিশ্বাসের প্রতিবাদ করে বলেন, ‘ইসলামে কোনো অশুভ-অযাত্রা নেই’ [সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম]।

এর পরও মানুষের মনে স্থান পায়, এই মাস বালা-মুসিবতের মাস হিসেবে। তবে মুহাদ্দিসগণ এ বিষয়ে একমত যে, সফর মাসের সকল কথা ভিত্তিহীন মিথ্যা। বিভিন্ন জাল হাদীসে বলা হয়েছে, বুধবার অশুভ এবং যে কোনো মাসের শেষ বুধবার সবচেয়ে অশুভ। আর সফর মাস যেহেতু অশুভ; সেহেতু সফর মাসের শেষ বুধবার বছরের সবচেয়ে বেশি অশুভ দিন। এগুলো সবই ভিত্তিহীন।

(মাসিক আত তাওহীদ, নভেম্বর ২০১৭)

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ