জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শরণার্থী নাকি অনুপ্রবেশকারী

মাওলানা এরফান শাহ

পৃথিবী দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আকাশ-মহাকাশ, সাগর-মহাসাগর জয় করে মানুষ এখন চাঁদে। মঙ্গলগ্রহে বসবাসের আয়োজন চলছে। বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। অথচ বিশ্বায়নের এ যুগে কিছু মানুষের কোনো দেশ নেই। রাষ্ট্র নেই। নাগরিকত্ব নেই। মানুষের জন্য এর চেয়ে অপমানের, দুঃখের, পরাজয়ের আর কী থাকতে পারে যে, তারই মতো আর একজন মানুষ এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য কোনো ভূখ- পায় না! জান-মালের নিরাপত্তা পায় না! মৌলিক অধিকার পায় না! আমরা কী তবে এখনো মানুষ হতে পারিনি? এই পৃথিবী কী তাহলে মানুষের পৃথিবী নয়? এত আয়োজন শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির কার জন্য? বাস্তবে আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মুখোশ পরা এক অমানবিক হিংস্র সভ্যতার মধ্যে বসবাস করছি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এ যুগে, একবিংশ শতাব্দীতে এসে মানবতা ও সভ্যতায় মানুষ এখনো কত পিছিয়ে তার নজির সাম্প্রতিক মগের মুল্লুক আরাকান ও ভিকটিম রোহিঙ্গা মুসলমান।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সত্যিই এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। চাহিদা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যে যার মতো করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। জাতি, দল, ধর্ম, বর্ণ, শহর, গ্রাম সব একাকার হয়ে গেছে। ‘প্রয়োজনে রোহিঙ্গাদের সাথে খাবার ভাগ করে খাব’ সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য মুসলিমকে উম্মাহ আশান্বিত করেছে। জাতিসংঘে রোহিঙ্গাদের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা ও জোরালো অবস্থান বিশ^ দরবারে প্রসংশিত হয়েছে। প্রতিবেশি রাষ্ট্রের মানবিক বির্পযয়ে দেশের মানুষ ও গণমাধ্যম যেভাবে এগিয়ে এসেছে তা সত্যিই নজিরবিহীন।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা বিষয়ে একটি উন্মুক্ত আলোচনার আয়োজন করে। সেখানে সংস্থাটির মহাসচিব রোহিঙ্গা পরিস্থিতিকে ‘পৃথিবীর দ্রুততম অবনতিশীল জরুরি শরণার্থী সমস্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে একে ‘মানবতা ও মানবাধিকারের জন্য একটি দুঃস্বপ্ন’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। একই সঙ্গে মহাসচিব শরণার্থীদের দেখভাল করার জন্য বাংলাদেশের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান করতে গিয়ে বাংলাদেশ এক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায় থেকে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘভুক্ত প্রতিষ্ঠানকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে বেশ কিছু সেক্টর চিহ্নিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে এই চাপ মোকাবিলায় দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছে, যার সাড়া ইতিমধ্যে মিলছে।

রোহিঙ্গা সমস্যার সুদূরপ্রসারী সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে, একই সময়ে ৯-১০ লাখ শরণার্থীর জন্য ত্রাণ এবং সুরক্ষা প্রদান করার গুরুদায়িত্ব বাংলাদেশের ওপর বর্তেছে। অদূর ভবিষ্যতে নিজ দেশে এই শরণার্থীদের মর্যাদার সঙ্গে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই পরিস্থিতিতে এই সম্ভাব্য প্রলম্বিত শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। সে ক্ষেত্রে শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের যথেষ্ট বিচক্ষণতা ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। মানবিকতার সঙ্গে প্রয়োজন বিরাজমান বাস্তবতার সঠিক মূল্যায়ন।

১৯৫১ সালের জাতিসংঘের শরণার্থীসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এই দলিলে ১ (ক) ধারায় শরণার্থীর সংজ্ঞা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, শরণার্থী ‘এমন একজন ব্যক্তি যিনি নৃগোষ্ঠী, ধর্ম, লিঙ্গ, জাতীয়তা বা জাতিতাত্ত্বিক পরিচয়ের কারণে নিগৃহীত হওয়ার দৃঢ়ভিত্তিক ভয়ের কারণে তার উৎস রাষ্ট্রের বাইরে অবস্থান করছেন এবং সে দেশ কর্তৃক প্রদত্ত রক্ষণাবেক্ষণ সুযোগ গ্রহণে অপারগ বা সেই রূপ ভয়ের কারণে অনিচ্ছুক।’ সুতরাং সনদের মাপকাঠিতে বাংলাদেশে অবস্থানরত সব রোহিঙ্গা এই সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞার মাপকাঠিতে শরণার্থী।

গত ১২ সেপ্টেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্যদের তিনি অবহিত করেন যে তিনি নিজে ১৯৭১ সালে একজন শরণার্থী ছিলেন এবং সে কারণে তিনি তাদের বেদনা অনুভব করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য সত্ত্বেও সরকারিভাবে শরণার্থীদের ‘অনুপ্রবেশকারী’, ‘মিয়ানমার থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী’, অথবা ‘মিয়ানমারের স্থানচ্যুত নাগরিক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, যা মন্ত্রী ও সচিব পর্যায়ের ব্যক্তিদের বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে।

বিরাজমান রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত রয়েছে রাষ্ট্রহীনতার সমস্যা। এই রোহিঙ্গাদের অবৈধ অভিবাসী, অনুপ্রবেশকারী বা স্থানচ্যুত হিসেবে চিহ্নিত করা একটি ভ্রান্ত পদক্ষেপ। শরণার্থী শব্দের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অধিকারের স্বীকৃতি। একই সঙ্গে তাদের সমস্যার সমাধান এবং চাপ বহনের দায়িত্ব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপরও বর্তায়। সেদিক থেকে অনুপ্রবেশকারী অথবা স্থানচ্যুত হিসেবে চিহ্নিত করলে তারা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও তাদের দায়বদ্ধতা থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হবে।

(মাসিক আত তাওহীদ, নভেম্বর ২০১৭)

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ