তারেকুল ইসলাম
(সংখ্যা: নভেম্বর ২০১৭)
সম্প্রতি আমেরিকার পর্যটন শহর লাস ভেগাসে একটি কনসার্টে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। আইএস দায় স্বীকার করলেও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই তা নাকচ করে দিয়েছে। এই হামলায় প্রায় ৬০ জন নিহত হয় এবং আহত হয় পাঁচ শতাধিক। হামলার উদ্দেশ্য এখনো জানা যায়নি। নাইন-ইলেভেনের পর এটাকেই যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত সবচেয়েয়ে ভয়াবহ হামলা বলে অভিহিত করা হয়েছে। পাশ্চাত্য মিডিয়া এই হামলাকে ‘মাস শুটিং’ (গণহারে গুলি) বলে আখ্যা দিয়েছে। স্টিফেন প্যাডক নামের ঐ হামলাকারী ছিল একজন খ্রিস্টান। তাকে ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত’ বলেও তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এই ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সন্ত্রাসবাদের জিগির তোলেনি পশ্চিমা মিডিয়া। কিন্তু হামলাকারী যদি মুসলিম নামধারী হতো, তাহলে সন্দেহ নেই, পুরো পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া অন্যরকম হতো। বলা বাহুল্য, পাশ্চাত্য মিডিয়ায় মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তখন শুরু হয়ে যেতো টেররিজম-প্রপাগান্ডা। ইউরোপজুড়ে ইসলামবিদ্বেষ ও ইসলামভীতিকে উসকে দেওয়া হতো। অথচ লাস ভেগাসের হামলায় যেহেতু হামলাকারী মুসলিম নয়, সেহেতু এখন এটা শুধু আমেরিকার অভ্যন্তরীণ ‘নিরাপত্তাবিষয়ক ইস্যু’ হিসেবেই গৃহীত হচ্ছে। এই ইস্যুতে পাশ্চাত্যের ‘ওয়ার অন টেরর’ বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের প্রচারণা আর হচ্ছে না। পাশ্চাত্য নেতৃবৃন্দ ও তাদের মিডিয়ার এহেন দ্বিচারিতা ও ভন্ডামির উদাহরণ আজকে নতুন নয়। এই ধরনের কয়েকটি কেইস স্টাডি বিশ্লেষণ করেই আজকের এই লেখা।
বিগত ২০১৫ সালের ২০ মার্চ শুক্রবার, আমেরিকার নিউ অর্লেন্স এয়ারপোর্টে প্রবেশ করে প্রাক-চেকপয়েন্টে রিচার্ড হোয়াইট নামের যাত্রীবেশী একজন উগ্র খ্রিস্টান সন্ত্রাসী সেখানকার দায়িত্বরত ট্রান্সপোর্টেশন সিকিউরিটির (টিএসএ) দুজন এজেন্টকে প্রথমে বিষাক্ত স্প্রে ছুঁড়ে মারে, তারপর আরেকজন এজেন্ট ক্যারল রিচেলকে বিষাক্ত স্প্রে ছুঁড়ে মেরে একটি চাপাতি দিয়ে আক্রমণ করে বসে। এক পর্যায়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত একজন পুলিশ অফিসার আক্রমণকারী রিচার্ডকে তিন তিনবার গুলি করে (যথাক্রমে পায়ে, বুকে ও মুখে) আক্রমণ থেকে নিবৃত্ত করতে এবং নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ঐ টিএসএ’র এজেন্টকে রক্ষা করতে সক্ষম হন। যদিও এজেন্ট ক্যারল রিচেলের ডান হাত গুরুতর জখম হয়। গুলিবিদ্ধ রিচার্ডকে হাসপাতালে নেয়া হয় এবং সে হাসপাতালেই পরে মারা যায়। হাফিংটন পোস্টের রিপোর্টে পুলিশের জবানিতে বলা হয়েছে, Sheriff Newell Normand said suspect Richard White, who was shot three times by a security agent late Friday after approaching a security checkpoint spraying insecticide and brandishing a machete, was also carrying a bag loaded with six Molotov cocktails – six Mason jars with cloth wicks soaked in gasoline. He had a history of mental illness, officials said. …White, who lived near the airport and had worked as a taxi driver, refused some types of medical attention because of religious beliefs, officials said (21 March, 2015).
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, পুলিশের বরাতে হাফিংটন পোস্ট তার রিপোর্টে বলছে যে, রিচার্ডের মানসিক সমস্যা ছিল। তার কিছু মেডিকেল অ্যাটানশন তথা স্বাস্থ্যপরীক্ষার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে(!) সেগুলো সে উপেক্ষা করেছিল। এ এক অদ্ভূত প্রমাণহীন যুক্তি! ঘটনার তদন্ত ঠিকভাবে শেষ না হতেই প্রেস কনফারেন্সে পুলিশ কর্তৃক রিচার্ডকে ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। অথচ দেখুন, এয়ারপোর্টে থাকা আক্রমণকারী রিচার্ডের গাড়িতে বর্ণহীন হাউড্রোকার্বন গ্যাস, ফেরন গ্যাস ও অক্সিজেন পাওয়া যায়। এমনকি আক্রমণস্থলে পতিত ও গুলিবিদ্ধ রিচার্ডের ব্যাগ থেকে ছয়টি হোমমেইড বিস্ফোরক বা ককটেল, বিষাক্ত স্প্রে এবং আক্রমণে ব্যবহৃত চাপাতি পুলিশ কর্তৃক জব্দ করা হয়। এতদসত্ত্বেও রিচার্ডকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলা কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল? এ প্রসঙ্গে Dean Obeidallah ডেইলি বিস্টে তাঁর সাম্প্রতিক কলাম Surprise! Another Christian Terrorist- এ লিখেছেন, Perhaps Mr. White truly was mentally ill. Interviews with his neighbors, however, don’t even give us a hint that he had mental problems. Rather they described White as meek and kind man who a few had spoken to just days before the incident and everything seemed fine. You would think these neighbors would at least note that White had a history of mental illness if it was so apparent.
হাফিংটনের উক্ত রিপোর্টে আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার যে, পুলিশ রিচার্ডকে সাসপেক্ট (সন্দেহভাজন) বলে সম্বোধন করেছিল, কিন্তু ‘সন্ত্রাসী’ বলেনি(!), যদিও তাকে সন্ত্রাসী বলার মতো যথেষ্ট ও উপযুক্ত কার্যকারণ রয়েছে। তথাপি ওয়েস্টার্ন মিডিয়া এবং পুলিশ রিচার্ডকে ‘সন্ত্রাসী’ না বলে ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ হিসেবেই সাব্যস্ত করেছিল। ঠিক এর আগে যেভাবে ওয়েস্টার্ন মিডিয়া আত্মস্বীকৃত খুনি উগ্র খ্রিস্টান মৌলবাদী জঙ্গি আন্ডারস বেহরিং ব্রেইভিককে অপকৌশলে ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ অভিহিত করে ‘সন্ত্রাসবাদে’র কালিমা থেকে রক্ষা করার প্রয়াস নিয়েছিল। ২০১১ সালের ২২ জুলাই নরওয়ের রাজধানী অসলোতে একটি সরকারি ভবনে গাড়িবোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এবং উটোইয়া দ্বীপে হামলা চালিয়ে আন্ডারস ব্রেইভিক পরিষ্কার দিনের আলোতে একাই ৭৭ জন নিরীহ সাধারণ মানুষকে ব্রাশফায়ার করে গণহত্যা চালিয়েছিল। এই ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধ চরম দাম্ভিকতার সাথে স্বীকার করে তার দেওয়া জবানবন্দিতে ব্রেইভিক উল্লেখ করেছিল যে, এটাকে সে তার প্রতিবাদের উপায় হিসেবে নিয়েছিল। প্রতিবাদ এই কারণেই যে, নরওয়েতে মুসলিমদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ইসলামী সংস্কৃতির প্রসার ঘটেই চলছে; কিন্তু নরওয়ে সরকার ও রাষ্টযন্ত্র এটা ঠেকাচ্ছে না বলেই সে প্রতিবাদস্বরূপ আর কোনো উপায় না দেখে এই গণহামলার পরিকল্পনা করেছিল। এমনকি এই হামলার পরিকল্পনার আগে সে হাজার পৃষ্ঠার একটা ডকুমেন্টও লিখেছিল, যেটা পুরোটাই ছিল তীব্র মুসলিমবিদ্বেষে ভরপুর। আন্ডারস বেহরিং ব্রেইভিকের এই হামলা ও একক গণহত্যাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নরওয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হামলা বলে ধারণা করা হয়। উগ্র খ্রিস্টান জঙ্গি ব্রেইভিকের হামলার ইস্যুতে ওয়েস্টার্ন মিডিয়ার তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে’র ন্যূনতম প্রচারণাও দেখা যায়নি। এছাড়া বেশ কিছুদিন আগে অর্থাৎ শার্লি হেবদো পত্রিকার অফিসে ফলস ফ্ল্যাগ অ্যাটাকের রেশ ধরে ইউরোপ ও পশ্চিমা দুনিয়াজুড়ে নতুন করে উস্কে দেওয়া মুসলিমবিদ্বেষী ঘৃণা ও প্রপাগান্ডার ধারাবাহিকতায় এক উগ্র মুসলিমবিদ্বেষীর নৃশংস সন্ত্রাসী হামলায় আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটির নিরীহ মুসলিম তিন শিক্ষার্থী খুন হওয়ার ঘটনায় পশ্চিমা বিশ্বের নির্মম নিরবতা বিশ্ববাসী সেদিন দেখেছে। পশ্চিমা মিডিয়া ও নেতৃবৃন্দের এহেন নিষ্ঠুর নিরবতা ও বৈষম্যমূলক বর্ণবাদী আচরণের তীব্র নিন্দা ও সমালোচনা দেখা যায় বিশ্বজুড়ে। সাধারণত পশ্চিমাবাসী সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে অনেক চেঁচামেচি করে থাকে, অথচ শুধু মুসলিম বলেই সংখ্যালঘু ভিকটিম ঐ তিন শিক্ষার্থীর প্রতি তারা চরম বর্ণবাদী আচরণ ও অবিচার করেছে বলে প্রতীয়মান হয়েছিল। নিরপরাধ মুসলমান যখন আক্রান্ত ও হামলার শিকার হয়, তখন সেটা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড নয়; আর যখন কোনো পথভ্রষ্ট মুসলিম ব্যক্তি কর্তৃক ন্যূনতম অপরাধ বা হামলার ঘটনা ঘটে, তখনই ‘সন্ত্রাসবাদ’ নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ার সমস্ত খিস্তিখেউর শুরু হয়ে যায়। ‘সব মুসলমান সন্ত্রাসী নয়, তবে সব সন্ত্রাসীই মুসলমান’—এই ধারণাকে পশ্চিমা মিডিয়া সবসময় ছড়িয়ে দেওয়ার কসরত চালায়।
টিএসএ’র এজেন্টদের ওপর হামলার ক্ষেত্রে রিচার্ডের মূল উদ্দেশ্য এবং তাদের ওপর তার এহেন ক্ষোভের নেপথ্য কারণ এখন পর্যন্ত আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থাগুলো উদ্ঘাটন করতে পারেনি। এর আগে আরো একবার হামলা হয়েছিল টিএসএ’র এজেন্টদের ওপর। ২০১৩ সালের নভেম্বরে লম্বা একজন বন্দুকধারী ব্যক্তি একটি সেমি-অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে লস এঞ্জেলেস এয়ারপোর্টে যাত্রীবেশে প্রবেশ করে প্রকাশ্যে গুলি করে একজন টিএসএ’র এজেন্টকে হত্যাসহ আরো তিনজনকে আহত করে। উল্লেখ্য যে, ৯/১১-র ‘সন্ত্রাসী হামলা’র পরই বিশেষভাবে Transportation Security Agency (TSA) গঠিত হয়। রিচার্ডের হামলাটি এই এজেন্সির এজেন্টেদের ওপর এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো হামলা। এরকম বিশেষ একটা সিকিউরিটি এজেন্সির এজেন্টদের ওপর পরপর দু’বার সশস্ত্র হামলার বিষয়টি মোটেও বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। নানা দিক বিবেচনায় এসব সন্ত্রাসী হামলার সাথে মার্কিনিদের সামাজিক-নাগরিক হতাশা ও ক্ষোভের সঙ্গতি লক্ষ করা যায়। রাষ্ট্র যখন চতুরতার সাথে নানাভাবে তার নাগরিকদেরকে ক্রমশ হতাশ ও বিভ্রান্ত করতে থাকে, তখন সমাজে এর প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল অত্যন্ত মারাত্মক হয়ে ওঠে। নাইন ইলেভেনের নাটক সাজিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রযন্ত্র প্রচ্ছন্নভাবে তার উগ্র সামরিক জাতীয়তা ও সা¤্রাজ্যবাদী উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে যেয়ে তার নাগরিকদের ভীতির কবলে রেখে দিনের পর দিন তাদেরকে বিভ্রান্ত করে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র প্রকল্প সাজিয়ে অপ্রমাণিত ‘শত্রু’র বিরুদ্ধে অনৈতিক যুদ্ধে জড়িয়ে অযথা ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, যা একসময় মার্কিন নাগরিকসমাজ প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করে। নাইন ইলেভেনের রহস্য ও বিতর্ক যত তীব্র হয়েছে, ততই রাষ্ট্রের সাথে মার্কিন নাগরিকসমাজের সম্পর্ক, সন্দেহ ও আস্থার টানাপড়েন প্রবল হয়ে উঠেছে।
২০০৮ সালে স্মরণকালের অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে আমেরিকা অনেকটাই কাবু হয়ে পড়েছিল। এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রস্ত দেশ হিসেবে আমেরিকার পরিচয়ও এখন আর কারো অজানা নয়। একপর্যায়ে মন্দার কুপ্রভাবে আমেরিকায় বেকারত্বের হার বেড়ে যায়। সরকারিভাবে কৃচ্ছ্রসাধননীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। ফলত নাগরিক হতাশা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এর রেশ ধরে পুঁজিবাদবিরোধী ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনও গড়ে উঠেছিল। এমন ধারাবাহিক ক্রান্তিকাল ও নাজুক পরিস্থিতিতে উইকিলিক্স প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ যেভাবে যুদ্ধবাজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামরিকনীতির অত্যন্ত স্পর্শকাতর গোপন তথ্যাবলী ফাঁস করছিলেন এবং এর ফলস্বরূপ ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া বিশ্বজুড়ে তো বটেই খোদ মার্কিন নাগরিকদের ওপরও লক্ষ করা গেছে। ইরাক-আফগানিস্তান যুদ্ধে আমেরিকান সরকারের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয়ের বোঝা মার্কিন নাগরিকরা আর বহন করতে রাজি হচ্ছিল না। উগ্র যুদ্ধংদেহী রাষ্ট্রীয় সামরিক নীতিমালার প্রতি এক ধরনের বিরক্তি ও বীতশ্রদ্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে। ওবামা তাঁর প্রথম নির্বাচনে ইরাক-আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ থেকেই বুঝা যায়, মার্কিন নাগরিকরা অনেক আগে থেকেই আমেরিকার সামরিক যুদ্ধনীতির প্রতি চরমভাবে বিমুখ হয়ে উঠেছিল। ২০১৩ সালে মার্কিন কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের সাথে ওবামা-প্রশাসনের তীব্র মতদ্বৈধতার দরুন যথাসময়ে বাজেট পাস না হওয়ায় উক্ত বছরের ১-১৬ অক্টোবর পর্যন্ত আমেরিকার প্রায় সমস্ত সরকারি কার্যক্রম ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত দপ্তর নজিরবিহীনভাবে বন্ধ থাকে। এছাড়া সম্প্রতি আমেরিকার রাষ্ট্রীয় সিক্রেসি এবং তার নাগরিকদের ওপর গোপন নজরদারির গুমরগুলো একে একে ফাঁস করে দিচ্ছেন রাশিয়ায় বর্তমানে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রাপ্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা এডওয়ার্ড স্নোডেন। প্রকল্পিত ‘ওয়ার অন টেররে’র জিগির তুলে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ‘নিরাপত্তা’র নামে তার নিজের নাগরিকদের ওপর গভীর গুপ্ত নজরদারির কারণে সম্ভবত মার্কিন সমাজে এর বেশ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র যখনই নাগরিক স্বাধীনতা, অধিকার ও প্রাইভেসিকে নিয়ন্ত্রণ ও সঙ্কুচিত করার চেষ্টা করবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেটা নাগরিকদের জন্য সুখকর হবেনা। এই অবস্থায় নাগরিক ক্ষোভ, হতাশা ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দানা বাঁধবেই এবং তা রাষ্ট্রের জন্য বুমেরাং হতে বাধ্য। অন্যদিকে ইতোমধ্যে আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বর্ণবাদী আচরণ ও পুলিশি নির্যাতন-হত্যাকান্ড তীব্রতর হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ফার্গুসনে এক মার্কিন পুলিশকে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। নাইন ইলেভেনের পর গঠিত বিশেষ সিকিউরিটি এজেন্সির (টিএসএ) এজেন্টদের ওপর দ্বিতীয়বারের মতো হামলা এবং অতিসম্প্রতি বর্ণবাদ ও শ্রেণিবিদ্বেষের প্রতিক্রিয়ায় এক মার্কিন পুলিশের হত্যাÑ সব মিলিয়ে মার্কিন সমাজে নাগরিক হতাশা, ক্ষোভ ও অস্থিরতা যে ক্রমবর্ধনশীল, তার প্রমাণ বহন করে।
সর্বশেষ ফ্রান্সে শার্লি হেবদো পত্রিকার অফিসে ফলস ফ্ল্যাগ অ্যাটাকের পর পশ্চিমা বিশ্বে মুসলিমবিদ্বেষের ক্রমবর্ধমান স্ফুলিঙ্গের নিদারুণ প্রেক্ষাপটে ইউরোপ ও আমেরিকাজুড়ে সংখ্যালঘু মুসলমানরা এখন বর্ণবাদী আচরণ ও সাম্প্রদায়িক হামলার মূল শিকারে পরিণত হয়েছে। উগ্র খ্রিস্টান মৌলবাদী জঙ্গিদের হামলা ও অপতৎপরতাকে সন্ত্রাসবাদ বলা হয়না, বিপরীতে শুধু মুসলমানদের বেলায় সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের যত প্রসঙ্গ আসে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যখন এহেন চরম বৈষম্যমূলক অবস্থা, তখন এর প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়ার নেতিবাচক বিস্ফোরণোন§ুখ কুফল হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান বহুমুখী রণক্ষেত্র। আল কায়েদা, তালেবান, আইএস, নুসরা ফ্রন্ট, হিজবুল্লাহ ও আফ্রিকার বোকো হারাম ইত্যাদি নানা ধরনের সশস্ত্র গোষ্ঠী অনিয়ন্ত্রিত যুদ্ধ ও সঙ্ঘাতে লিপ্ত। এখানে একটি অপ্রিয় সত্য হচ্ছে, এসব গোষ্ঠীকে আমরা সন্ত্রাসী, মধ্যযুগীয়, মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী বলছি ঠিকই; কিন্তু সোভিয়েতের পরে বর্তমান বিশ্বে এরাই একমাত্র যে, পশ্চিমা ধনতন্ত্র ও যুদ্ধবাজ তেলখেকো মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একাই সশস্ত্র লড়াই করে যাচ্ছে।
বিশ্ববাসীকে সন্ত্রাসবাদের আতঙ্ক ও জুজু দেখিয়ে আমেরিকা তেলের লোভে এবং বিশ্বব্যাপী একক কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করার স্বার্থে মুসলিম দেশগুলোতে একের পর এক সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে। নাইন ইলেভেনের কথিত ‘সন্ত্রাসী হামলা’র ঘটনা একবিংশ শতকের প্রারম্ভেই এক-মেরুকেন্দ্রিক মার্কিন বিশ্বব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও সংগঠনের নিয়ামকের ভূমিকায় পরিণত হয়। তবে নাইন ইলেভেন ছিল একবিংশ শতকের নব্য সংস্করণ। তার মানে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের নাইন ইলেভেনের মতো সন্ত্রাসী হামলা কি এর আগেও দেখা গিয়েছিল, একই উদ্দেশ্যে? হ্যাঁ, অবশ্যই। দুর্বল মুসলিম দেশের ওপর হামলা ও যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার অপকৌশল হিসেবে নাইন ইলেভেনের মতো বিতর্কিত সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাও লক্ষণীয়ভাবে নিকট-অতীতে ঘটেছিল। সোভিয়েতের পতনের পর বিশ্বজুড়ে একক কর্তৃত্ব স্থাপনকারী মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ ভূতপূর্ব রাশিয়ার একটি গোয়েন্দা সংস্থা (এফএসবি) কর্তৃক ঘটানো ফলস ফ্ল্যাগ বোম্বিংস তথা ‘রাশিয়ান অ্যাপার্টমেন্ট বোম্বিংস’-এর নতুন সংস্করণ ঘটায় নাইন ইলেভেনের ‘সন্ত্রাসী হামলা’র ঘটনার মধ্য দিয়ে।
১৯৯৯ সালে ৪-১৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাশিয়ার তিনটি শহরে মোট চার দফায় সিরিজ অ্যাপার্টম্যান্ট বোম্বিংস-এর ঘটনা ঘটে। এই সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় ২৯৩ জন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু ঘটে এবং এক হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়। এই সিরিজ বোমাহামলার ঘটনায় পুরো রাশিয়াজুড়ে আতঙ্ক ও ভীতি শুরু হয়ে যায়, যেভাবে নাইন ইলেভেনের ‘সন্ত্রাসী হামলা’র পর পুরো আমেরিকাজুড়ে ভয় ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। উইকিপিডিয়ার সংরক্ষিত বর্ণনায়, The blasts hit Buynaksk on 4 September, Moscow on 9 September and 13 September and Volgodonsk on 16 September. A similar explosive device was found and defused in an apartment block in the Russian city of Ryazan on September 22. The next day then Prime Minister of Russia Vladimir Putin praised the vigilance of the inhabitants of Ryazan and ordered the air bombing of Grozny, which marked the beginning of the Second Chechen War.
স্বাধীনতাকামী মুসলিম চেচেনদের সশস্ত্র মুক্তি-আন্দোলন দমাতে চেচেনদের ওপর হামলার সুযোগ খুঁজছিল তৎকালীন রাশিয়া। ‘রাশিয়ান অ্যাপার্টম্যান্ট বোম্বিংস’ নামে খ্যাত বোমা হামলার দায় চেচেন মুজাহিদদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে রাশিয়া দ্বিতীয় চেচেন-যুদ্ধ শুরু করেছিল। ঠিক একইভাবে আমেরিকাও নাইন ইলেভেনের ‘সন্ত্রাসী হামলা’র দায় প্রমাণহীনভাবে ওসামা বিন লাদেনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সুদীর্ঘ আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। রাশিয়ান সিরিজ বোমা হামলা যে ফলস ফ্ল্যাগ বোম্বিংস ছিল তা বলাই বাহুল্য। উইকিপিডিয়ার বর্ণনামতে, A few hours later (after ordering air bombing of Grozny, a city of Chechen), three FSB agents who had planted this device (with a view to bombing) were arrested by the local police. The incident was declared to be a training exercise. These events led to allegations that the bombings were a false flag attack perpetrated by the FSB in order to legitimize the resumption of military activities in Chechnya and bring Vladimir Putin to power.’
অ্যাপার্টম্যান্ট বোম্বিংস নিয়ে ২০০২ সালে Assassination of Russia নামে একটি ডকুমেন্টারি প্রচারিত হয়। সেই ডকুমেন্টারিতেও অ্যাপার্টম্যান্ট বোম্বিংস Federal Security Service of the Russian Federation (FSB) কর্তৃক গোপনে সংগঠিত ও সংঘটিত হয়েছিল বলে যুক্তিতর্কসহ দাবি করা হয়। ডকুমেন্টারিটি নাইন ইলেভেনের ‘সন্ত্রাসী হামলা’কে অ্যাপার্টম্যান্ট বোম্বিংস-এর সাথে তুলনা করে এবং নাইন ইলেভেন ও অ্যাপার্টম্যান্ট বোম্বিংস যে ফলস ফ্ল্যাগ অ্যাটাকÑতাও দাবি করেছিল। মোদ্দা কথায়, অ্যাপার্টম্যান্ট বোম্বিংস ছিল নাইন ইলেভেনের গডফাদার। এসব ফলস ফ্ল্যাগ অ্যাটাকের মাধ্যমে মুসলমানদের ওপর দোষ চাপিয়ে সন্ত্রাসবাদের হুক্কহুয়া রব তুলে তাদের দেশে হামলা ও আগ্রাসনের পথ সুগম করেছে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলো।
লেখক: পলিটিক্যাল এনালিস্ট, দ্যা ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস