মাওলানা মাহফুয আহমদ
[বিগত ২৭ নভেম্বর’১৬ রোববার মাতৃভূমি বাংলাদেশ থেকে লন্ডন ফেরার পথে মধ্য এশিয়ার তুর্কমেনিস্তানে যাত্রাবিরতির ইতিবৃত্ত নিয়ে এ লেখা।]
কখন যে ঘুম আসলো বুঝতেই পারি নি। একদিকে সারারাত বিনিদ্র কেটেছে। অন্যদিকে ৪৮০ জন বহন উপযোগী বিমানে যাত্রীসংখ্যা মাত্র ১৫০। সুতরাং ঘুমের যেমন খুবই প্রয়োজন, তেমনি এখানে রয়েছে এর উত্তম আয়োজন। আমার নির্ধারিত সিট ছিল ৩৮ এর সি। বসে পড়লাম। কিন্তু এআরবিতেও প্যাসেঞ্জার আছেন। একজন ক্রু এগিয়ে এলেন। সালাম করে অপর একজন ক্রুকে বলে দিলেন, হুজুরকে উপযুক্ত একটা সিটে নিয়ে যাও, যেন রিলাক্সে বসতে পারেন, চাইলে ঘুমাতেও পারেন। ওই ক্রু তাই করলো। ৪০-এর এ, বি ও সি তিনটে সিটই আমাকে সমঝিয়ে দিলো। বসে পড়লাম। বিমান উড্ডয়নের আগে যে দুআগুলো জানি, পড়তে শুরু করলাম। সম্ভবত বিমান তখন ওমানের উপরে। লাউড স্পিকারের আওয়াজে ঘুম ভাঙলো। সিটের সামনে রাখা স্ক্রিন দেখে বুঝতে পারলাম, বিমান তার গন্তব্যপথ পরিবর্তন করে ফেলেছে। ডান দিকে মোড় নিয়ে অন্য কোথাও যেতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে শুনতে পেলাম, অনিবার্য কারণে আমরা তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশগাবাতের ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে অবতরণ করতে যাচ্ছি। বিমান ধীরে ধীরে তার গতি কমালো। নিচে নামতে শুরু করলো। যতই ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি যাচ্ছে, পাশের জানালা দিয়ে তুর্কমেনিস্তানের ছোটছোট পাহাড়ি টিলাগুলো এবং আধুনিক নির্মাণশৈলীর উৎকৃষ্ট নমুনাস্বরূপ দালান-বাড়ি ও সড়ক-মহাসড়কগুলো চোখ দিয়ে অনুমান করা যাচ্ছিল এবং একসময় দেখা যেতে লাগলো।
পথিমধ্যে হঠাৎ করে বিমানের অবতরণ অবশ্যই বিরক্তিকর। কিন্তু কেন জানি, তুর্কমেনিস্তানে অবতরণ করতে যাচ্ছে শুনে এতটা বিরক্তি লাগেনি। বরং মনে এক ধরনের কৌতূহল জাগলো, দেশটি দেখার। হোক না তা কিছু সময়ের জন্যে এবং নির্ধারিত সীমানার মধ্যে! বিমানের যাত্রী যারা, বলতে গেলে সবাই ছিল বেখবর। ককপিটের ঘোষণা শুনে, তারপর বিমানের অচেনা জায়গায় অবতরণ দেখে সবাই নড়েচড়ে বসল এবং জিজ্ঞেস করতে শুরু করল। এ কেন? এখানে কেন? কী আছে এখানে? কী এর পেছনে?!
বিমানবালারা কিছুই বলতে চাচ্ছে না, কিংবা বলুন, ওরা বলতেই পারছে না। মূল ঘটনা কী? ওরা তাও জানে না। কেউ জানে না। জানে শুধু ক্যাপ্টেন এবং হয়তো তার সহযোগীরা। তবে যাত্রীদের মাঝে কেউ কিছু ভয় করছে বলে মনে হলো না। সবাই ছিল নিশ্চিন্ত, নিরুদ্বিগ্ন। যা শুধু একটু বিরক্ত। তো এবার কেউ কেউ কারণ কী তা নিয়ে রীতিমত গবেষণা শুরু করলেন। কেউ এটা, কেউ ওটা বলেই চললেন। ইতোমধ্যে বিমান ৩৮ হাজার ফিট উচ্চতা থেকে ধীরে ধীরে নেমে একেবারে হাজারের উচ্চতায়, তারপর আস্তে আস্তে নামতে নামতে বিমানের চাকা সচল হলো রানওয়েতে। এবার দ্রুতগতিতে এগিয়ে চললো আশগাবাত ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের দিকে। এয়ারপোর্টের রানওয়ে, আশপাশের বিল্ডিং, উত্তরদিকের পাহাড়ি টিলা, উন্মুক্ত এরিয়া, এসব দেখে মনে হলো, দেশটা বড় ধনী দেশ না হোক খুব পরিকল্পিতভাবে সাজানো হয়েছে। সবকিছু অত্যন্ত সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন। দেখে যে কেউ মুগ্ধ হবে। আমিও মুগ্ধ হলাম। তাদের এমন ব্যবস্থাপনা দেখে অভিভূত হলাম। এরই মধ্যে বিমান এয়ারপোর্টের ১০২ গেইটে থামলো।
এখানে আমি আশ্চর্য হলাম যে, পাশেই ১০৩ গেইটে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের আরেকটি বিমান দেখতে পেলাম। এবার লোকজন পূর্ণ নিশ্চিন্ত হলো যে, বিমান হাইজ্যাক হয়নি এবং যাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে আর কোনো আশঙ্কা নেই। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জাগলো, বাইরের একটা দেশে একই সঙ্গে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দুটি বিমান একসাথে কেন? দেশের কি এতো বিমান আছে যে, একই এয়ারপোর্টে একাধিক বিমান পড়ে থাকবে? তা ছাড়া তুর্কমেনিস্তানের সাথে তো বিমানের কোনো রুট নেই, এখানে তো বিমান আসেই না, তবে আজ একইসঙ্গে দুটো বিমান কেন এখানে দাঁড়িয়ে আছে? ইত্যাকার নানা প্রশ্ন। প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই চোখে পড়লো, তুর্কমেন ভাষায় ইংরেজি অক্ষরে এয়ারপোর্টের নাম, আশগাবাত হালকারা হাওয়া মানযিলি। পাশে ইংরেজিতে লেখা আছে, আশগাবাত ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। আশগাবাত বর্তমান তুর্কমেনিস্তানের রাজধানীর নাম। এটা মূলত ‘এশক আবাদ’ শব্দের বিকৃতরূপ। এশকআবাদ শব্দের মাঝে যে মাহাত্ম্য, মহব্বত ও তাৎপর্য নিহিত আছে, আশগাবাতের মাঝে তার সিকি পরিমাণও নেই। আজকাল এভাবে ইসলামি ইতিহাসের এবং মুসলিম ঐতিহ্যের অর্থবহ কত শব্দ বিকৃতির কবলে পড়ছে তার হিসাব কে রাখে! এগুলো হচ্ছে অত্যন্ত কৌশলে। উদ্দেশ্য একটাই, মুসলমানরা যেন তাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলে বসে, এসব থেকে বেখবর হয়ে পড়ে! আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন।
এখন আমরা যে এয়ারপোর্টে আছি তা আধুনিক বিশ্বমানচিত্রের তুর্কমেনিস্তান রাজ্যের রাজধানী আশগাবাত (এশকাবাদ)-এর অত্যাধুনিক বিমানবন্দর। যেটি দেখতে ঠিক ডানা মেলা বাজপাখির মতো। দেশটির জাতীয় বিমান সংস্থার প্রতীকের সাথে মিল রেখে এই ডিজাইন করা হয়েছে। সম্প্রতি এর আধুনিকায়নের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। নতুন এ এয়ারপোর্ট ভবনটি তৈরিতে কর্তৃপক্ষের খরচ হয়েছে প্রায় ২৫০ কোটি ডলার। যদিও বলা হচ্ছে, প্রতি ঘণ্টায় ১৬০০-এর বেশি যাত্রীর আসা-যাওয়া প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ক্ষমতা রয়েছে এ এয়ারপোর্টের। কিন্তু স্বৈরতান্ত্রিক শাসন আর বিপুল প্রাকৃতিক শক্তির মজুদের জন্য বিখ্যাত দেশটিতে খুব কম বিদেশিই বেড়াতে যান। ২০১৫ সালের সরকারি হিসেবে ১ লাখ ৫ হাজার বিদেশি পর্যটক তুর্কমেনিস্তান ভ্রমণ করেছেন। দেশটিতে ভিসা পাওয়াও বেশ কঠিন। তবে দেশটির প্রেসিডেন্ট গুরবাঙ্গলি বারদি মুহাম্মদভ নিজের দেশের ট্রানজিট দেশ হওয়ার খুব সম্ভাবনা আছে বলে দাবি করেন। বিভিন্ন শৈল্পিক স্থাপনা বা ভবনের জন্য খ্যাতি আছে আশগাবাতের। শুনেছি, শহরে একটি পাবলিশিং হাউজ আছে যার আকৃতি একটি খোলা বইয়ের মতো। বিমানের সিটে বসে ছোট জানালা দিয়ে শুধু তাকাচ্ছি, এদিক-ওদিক এবং সৌন্দর্য অবলোকন করছি। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। আসরের সময় কাছাকাছি।
যদিও আমার চোখের সামনে আধুনিক পৃথিবীর একটি ছোট রাষ্ট্র তুর্কমেনিস্তান। কিন্তু আমার মন চলে গেছে সেই দূর অতীতে। এ ভূখ-ের সঙ্গে তো ইসলামি ইতিহাসের বহু জিনিস জড়িত আছে। বিশেষত ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষণজন্মা বহু ঐতিহাসিক মনীষী তো এ ভূখ-ের বিভিন্ন অঞ্চলের গর্ব এবং প্রধান পরিচয়। সেদিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের পূর্বে বোঝার স্বার্থে বর্তমান তুর্কমেনিস্তানের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা সমীচীন মনে করছি।
তুর্কমেনিস্তান (তুর্কমেন ভাষায়: ঞহৃৎশসবহরংঃধহ ত্যুর্ক্মেনিস্তান্) মধ্য এশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এর উত্তরে কাজাকিস্তান ও উজবেকিস্তান, পূর্বে উজবেকিস্তান ও আফগানিস্তান, দক্ষিণে আফগানিস্তান ও ইরান এবং পশ্চিমে কাস্পিয়ান সাগর। তুর্কমেনিস্তানের অধিকাংশ এলাকা সমতল বা ঢেউখেলানো বালুময় মরুভূমি, যার মধ্যে স্থলে স্থলে বালিয়াড়ি দেখতে পাওয়া যায়। দক্ষিণে ইরানের সাথে সীমান্তে রয়েছে পর্বতমালা। কারাকুম মরুভূমির কাছে অবনমিত ভূমি দেখতে পাওয়া যায়।
তুর্কমেনিস্তানের সরকারি ভাষা তুর্কমেন। তুর্কমেনরা এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি। পূর্বে দেশটি তুর্কমেন সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র নামে পরিচিত ছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। ১৯৯১ সালে এটি স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ১৯৯২ সালে নতুন সংবিধান কার্যকর করে।
তুর্কমেন ভাষা ও রুশ ভাষা তুর্কমেনিস্তানের সরকারি ভাষা। তুর্কমেন ভাষাতে এখানকার জনগণের প্রায় ৮০% এবং রুশ ভাষাতে প্রায় ৮% কথা বলেন। এখানে প্রচলিত অন্যান্য ভাষার মধ্যে আছে বেলুচি ও উজবেক ভাষা।
তুর্কমেনিস্তানের রাজনীতি একটি রাষ্ট্রপতিশাসিত প্রজাতন্ত্র কাঠামোয় সংঘটিত হয়। রাষ্ট্রপতি হলেন একাধারে রাষ্ট্রের প্রধান ও সরকারপ্রধান। তুর্কমেনিস্তানে বর্তমানে একটি একদলীয় শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান, কিন্তু সম্প্রতি দেশটি বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ২০০৭ সালে গুরবাঙ্গলি বারদি মুহাম্মদভ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, তবে নির্বাচনটি বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা ভুয়া আখ্যা দেন। তুর্কমেনিস্তান পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে ১৯৯১ সাল থেকে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সেবা বিনামূল্যে প্রদান করা হয়।
সিটে বসে আছি। চোখ বিমানের বাইরে। বিমানবন্দরের নান্দনিকতা উপভোগ করছি। আরো বাইরে। বিমানবন্দরের অদূরস্থ সড়ক-মহাসড়কে কতরকমের গাড়ি চলাচল করছে। সবকিছুই দেখা যাচ্ছে এবং ভালো লাগছে। কিন্তু চোখ যখন বাইরে চলে গেল এবং আরো দূর পর্যন্ত দেখতে শুরু করল তখন আমার হৃদয়চক্ষুও সতেজ হলো এবং দূর অতীতের দিকে তাকাতে শুরু করল। এ যে এশকাবাদে আমি এখন আছি, নাসা এখান থেকে কত দূর হবে? ১৪ কিলোমিটার, ১৫ কিলোমিটার বা কিছুটা কমবেশ হবে! পশ্চিম দিকে। হ্যাঁ, ওই তো নাসা! ওখানেই তো হাদীসশাস্ত্রের জগদ্বিখ্যাত প-িত, ইমাম নাসায়ী (মৃত ৩০৩ হি./৯১৫ খ্রি.) জন্মগ্রহণ করেছেন। জীবনের প্রথম ক’টি বছর এখানে কাটিয়েছেন। হাদীস শিক্ষার জন্যে কত জায়গা সফর করেছেন। বিমানে? তখন তো বিমান ছিলই না। তবে কীভাবে? অনেকভাবে। বেশিরভাগ পায়ে হেঁটে! হতে পারে আমি এখন যেখানে আছি, আশগাবাতে, বলি এশকাবাদে, কখনও তিনি এ দিকেও এসেছেন, কোথাও যেতে রাস্তা হিসেবে এটাকে ব্যবহার করেছেন! ভাবতেই ভালো লাগলো। ইতিহাসবিদ ইয়াকুত আল-হামাওয়ী (রহ.) নাসার কত চমৎকার ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন,
أن الـمسلمين لـما وردوا خراسان قصدوها، فبلغ أهلها، فهربوا، ولـم يتخلف بها غير النساء، فلما أتاها المسلمون لـم يروا بها رجلا، فقالوا: هؤلاء نساء، والنساء لا يقاتلن، فننسأ أمرها الآن إلى أن يعود رجالـهن، فتركوها ومضوا، فسمّوا بذلك نساء، والنسبة الصحيحة إليها نسائيّ، وقيل نسويّ أيضا.
‘মুসলমানগণ যখন খুরাসানে পৌঁছলেন তখন তারা ওই নাসা অভিমুখে রওয়ানা দিলেন। সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে ওই এলাকার লোকজন পলায়ন করতে লাগল এবং মহিলাগণ ব্যতীত কেউ অবশিষ্ট থাকল না। মুসলমানগণ এখানে এসে কোনো পুরুষ দেখতে পেলেন না। তাই তারা বলে দিলেন, এসব তো নারীজাতি, তাদের সঙ্গে কোনো যুদ্ধ হতে পারে না। সুতরাং এলাকার পুরুষগণ ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা যুদ্ধ প্রসঙ্গ বিলম্ব করব। এ বলে মুসলমানগণ মহিলাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এ থেকে তাদের নাম দেওয়া হলো نساء। এ এলাকার দিকে সম্পৃক্তকরণের বিশুদ্ধ পদ্ধতি হলো نسائيّ, কেউ কেউ অবশ্য نسويّ ও বলেন।’ [মু’জামুল বুলদান, ৫/২৮২]
তুর্কমেনিস্তানে কি শুধু নাসা? এই এক এলাকা! না, এখানে আরো কত শহর আছে, কত গ্রাম আছে এবং ঐতিহ্যময় কত এলাকা আছে।
অতীত ইতিহাস রোমন্থন করতে করতে এবার একটা বুদ্ধি মাথায় এলো। বিমানের প্যাসেঞ্জার যারা, সবাই যার যার মতো বসে আছে। গল্প করছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কিছু খাচ্ছে, পান করছে, এই যা। কেউ বের হওয়ার চিন্তাও করছে না। বিমানের পাইলট কিংবা ক্রু কেউ তা বলছেও না। কিন্তু আমার মনে এলো, আমি কেন সিট থেকে উঠছি না এবং একটু চেষ্টা-তদবির করছি না? সামনে গেলাম। দেখলাম, বিমানের বাম দিককার দ্বিতীয় দরজাটি খোলা আছে এবং একজন কেবিন ক্রু দাঁড়িয়ে আছেন। এগিয়ে গেলে তার সঙ্গে সালাম বিনিময় হলো। তাঁকে একটু বিনয়ের স্বরেই বললাম, আমি ধর্মীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের একজন নগণ্য ছাত্র। আর এই যে তুর্কমেনিস্তান! এ তো আমাদের জ্ঞান-ইতিহাসের একটি অংশ। তো আপনি যদি অনুমতি দেন তবে আমি কিছু সময়ের জন্যে নিচে নামতে চাই। এ জমিন স্পর্শ করতে চাই এবং চাই… থাক! সে কথা নিজের দিলেই লুকায়িত থাক! তিনি বললেন, হুযুর! দেখেন, আমরা এখানে আসলে ইমার্জেন্সি ল্যান্ড করেছি, এখানে নামার তো কোনো পারমিশন আমাদের নেই। সে জন্যে আমি দুঃখিত! তবে আমি আপনাকে এতটুকু সহযোগিতা করতে পারি যে, আপনি আসুন এবং দু’মিনিটের জন্যে শুধু এখানে দাঁড়িয়ে ফ্রেশ এয়ার গ্রহণ করুন।
আমি উপায় না দেখে এতটুকুতেই সন্তুষ্টি প্রকাশ করলাম এবং দু’পা বের করলাম। আহ… আহ! শীতল হাওয়া! শরীরে হাওয়া লাগতেই হৃদয়ে ভিন্নরকম এক স্বাদ অনুভব করলাম। মজা করে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে থাকলাম। বিমানের সিড়িতে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাবলাম, এ হাওয়া থেকে তো এখানকার অতীতের কতো ওলামা, মাশায়েখ, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফকীহ ও আল্লাহর ওলী বাতাস গ্রহণ করেছেন। শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়েছেন। আমিও আজ সে হাওয়া উপভোগ করছি! ভাবতে খুব ভালো লাগলো। তবে আমার শ্বাস-প্রশ্বাস তাঁদের নেওয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের হাওয়ার সঙ্গে একাকার হচ্ছে! তবে তো এ শ্বাস-প্রশ্বাসগুলো বরকতময় হচ্ছে! আজকাল বিজ্ঞানীরাও বলেন যে, মানুষ যে এয়ার থেকে শ্বাস গ্রহণ করে এবং মুখ থেকে যে কথা বের করে তা হাওয়ায় চিরকাল সংরক্ষিত থাকে। তবে তো আমি খুব সৌভাগ্যবান! আল-হামদু লিল্লাহ! সকল প্রশংসা আমার রবের। এখানে অবতরণ করাটা হোক না তা অনিবার্য কারণে আমার রবের ইশারায়! দুর্বল এক বান্দার বিরাট এক সাআদাত ও সৌভাগ্য অর্জনের জন্যে! আমি ওসব ভাবছি। দুচোখ দিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। নাক ও মুখ ভরে শ্বাস গ্রহণ করছি। এরই মধ্যে দরজায় নিয়োজিত কেবিন ক্রুর ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়ালাম। হুযুর! আপনি তো বুঝতেই পারছেন, এখানে কাউকে বাইরে যেতে দেওয়ার পারমিশন আমার নেই। তারপরও আপনার আগ্রহ দেখে সুযোগ দিয়েছিলাম। প্লিজ, এখন ভেতরে চলে আসুন! নতুবা অন্যরা…. আমি অবস্থা উপলব্ধি করে পুনর্বার রিকুয়েস্ট করতে পারলাম না। ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে কিছুসময়ে অনেককিছু নিয়ে সিটে এসে বসে পড়লাম।
বসে এবার মোবাইল হাতে নিলাম। আম্মা-আব্বা এবং আত্মীয়-স্বজনকে বিষয়টি জানাতে। কেননা এখানে তো বিমান অবতরণের কোনো কথা ছিল না। ফলে বিমান বাংলাদেশ সময় রাত ১২টা এবং লন্ডনের স্থানীয় সময় রাত ৬টায় হিথ্রো এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করার কথা। এখন তো দেরি হবে। দেশে আম্মা-আব্বা এবং ভাই-বোন দুশ্চিন্তা করবেন সময়মত ফোন না পেয়ে। এখানকার আত্মীয়-স্বজনও অপেক্ষায় থাকবেন অজানা আশঙ্কা নিয়ে। তাই প্রথমে বাংলাদেশি গ্রামীণ সিম থেকে ট্রাই করলাম মা-বাবাকে জানাতে। কিন্তু কল যাচ্ছে না। দেশের, বিদেশের, কোনো নাম্বারেই যাচ্ছে না। তাই ব্রিটেনি ই-ই সিম থেকে ট্রাই করলাম। এবারও সমস্যা রয়ে গেল। দেশে কল যাচ্ছে না। কিন্তু লন্ডনে যাচ্ছে। ওদেরকে বিষয়টি জানালাম। জানালাম, এ ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিংয়ের কারণ কী তা আমরা জানি না। এও বললাম, দেশে আম্মা-আব্বাকে ফোন করতে। দেশে ফোন করা হলো ঠিকই। কিন্তু দেশে বুঝতে কিংবা বুঝাতে বিপত্তি ঘটলো। তারা মনে করেছেন, বিমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আছেন। আর এখন বিমান আকস্মিক অবতরণ করেছে আফগানিস্তানে! (আমি লন্ডনে বলেছিলাম, আফগানিস্তানের পরে তুর্কমেনিস্তান নামক দেশে আছি।) তার মানে, শেখ হাসিনাকে কিডন্যাপের জন্যে বিমান হাইজ্যাক করা হয়েছে! এখন কী হবে মাহফুযের অবস্থা?! পরে শুনেছি, ওই সংবাদ পাওয়ার পর নাকি কান্নার রোল পড়েছিল। কেউ তিলাওয়াত করেছেন। কেউ নামায পড়েছেন। কেউ মান্নত করেছেন। সবাই দুআ করেছেন। কিন্তু আসলে প্রশ্ন থেকে যায়, লন্ডনগামী বিমানের ওই ফ্লাইটটি কেন জরুরি অবতরণ করেছিল? ওই আশগাবাতে? প্রিয় এশকাবাদে! অনেক পাঠকেরই ওইদিনের ঘটনা কী ছিল জানা থাকার কথা। তারপরও ২৮ নভেম্বর মানবজমিনে প্রকাশিত রিপোর্টটি এখানে পেশ করছি:
‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের উড়োজাহাজ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তুর্কমেনিস্তানে জরুরি অবতরণ করেছে। গতকাল বাংলাদেশ সময় বেলা আড়াইটায় এ ঘটনা ঘটে। এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর বহর তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশগাবাতে ৪ ঘণ্টা অনির্ধারিত যাত্রাবিরতি করে। যাত্রাবিরতি শেষে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ছয়টা ৩৭ মিনিটে আবার হাঙ্গেরির উদ্দেশে তুর্কমেনিস্তান ছাড়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ‘রাঙ্গা প্রভাত’। বিষয়টি নিশ্চিত করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক শাকিল মেরাজ। রাতে মানবজমিনকে বলেন, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বাংলাদেশ সময় বেলা আড়াইটায় বিমানটি তুর্কমেনিস্তানের রাজধানীতে জরুরি অবতরণ করে। ত্রুটি সারিয়ে টেস্ট রান দেখে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টা ৩৭ মিনিটে বিমানটি প্রধানমন্ত্রীসহ সবাইকে নিয়ে হাঙ্গেরির উদ্দেশে রওনা হয়। এর আগে বিকালে শাকিল মেরাজ মানবজমিনকে বলেন, যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং-৭৭৭ ফ্লাইটটি বুদাপেস্ট যাওয়ার পথে ডাইভার্ট হয়ে ল্যান্ডিং করে তুর্কমেনিস্তানের আশগাবাত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ওই বিমানবন্দরে বাংলাদেশ সময় বেলা আড়াইটায় উড়োজাহাজটি অবতরণ করে। একই দিন সকাল সোয়া নটায় বোয়িং-৭৭৭-৩০০ উড়োজাহাজটি হাঙ্গেরির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আকস্মিক ইঞ্জিনে তেলের চাপ কমে গেলে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমান বাংলাদেশ সময় আড়াইটায় তুর্কমেনিস্তানে জরুরি অবতরণ করে। এরপর লন্ডনের উদ্দেশে বেলা ১১টায় শাহজালাল থেকে ছেড়ে যাওয়া একটি বিমানকে উড্ডয়নরত অবস্থায় যাত্রাপথ বদলে তুর্কমেনিস্তানে যাওয়ার জন্য রাডারে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এই বিমানটি বিকাল ৪টা ১০ মিনিটে তুর্কমেনিস্তানে পৌঁছায়। তবে এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী উড়োজাহাজের ত্রুটি সেরে যায়। তখন প্রধানমন্ত্রী ওই বিমানে করেই হাঙ্গেরির উদ্দেশে রওনা হন। এছাড়া ব্যাকআপ বিমানটি তার যাত্রীদের নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা করে।’