রোহিঙ্গা ট্রাজেডি ভিকটিম কিন্তু মুসলিম
মাওলানা এরফান শাহ
পৃথিবীতে আজ সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত, নিপড়িত ও নিগৃহীত জাতি হচ্ছে মুসলমান। নিজ জন্মস্থানে তারা আজ পরবাসী। নিজ মাতৃভূমিতে তারা আজ নির্যাতিত। নিজ দেশে তারা আজ পরাধীন। বিশ্ব যেন তাদের জন্য সংকোচিত হয়ে আসছে। মুসলিম নামটা যেন আজ এলার্জি। তারা আজ শরণার্থী তথা রাষ্ট্রবিহীন জাতিতে পরিণত হয়েছে। কোথাও তারা নিরাপদ নয়। মুসলিম নাম শুনলেই কিছু বর্ণবাদী তাদের উপর হামলে পড়ছে। বিভিন্ন অজুহাত, অপবাদ ও নাটক সাজিয়ে তাদের মঙ্গল গ্রহে প্রেরণের পায়তারা চলছে। এ লক্ষ্যে তারা অভিন্ন টার্গেট নিয়ে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার নানামুখী চক্রান্ত শুরু করেছে। শতাব্দীকাল ধরে ফিলিস্তিনী জনগণ পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাইল তাদের মানচিত্র কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। মারণাস্ত্রের ধুয়া তুলে ইরাক ও লিবিয়া ধ্বংস করা হয়েছে! দু’পরাশক্তির যাতাকলে পিষ্ট সিরিয়া ও আফগানিস্তান! ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্র, অন্যায় ও অবিচারের শিকার ফিলিস্তিন, কাশ্মির ও আরাকান। আরাকান, কাশ্মির, ফিলিস্তিন / রক্ত ঝরছে প্রতিদিন! কোথায় মানবতা? কোথায় বিবেক? কোথায় বিশ্বসংঘ / নেই কারো মাথা ব্যথা, কারণ তারা মুসলিম অঙ্গ / আফগান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া আক্রান্ত সব মুসলিম রাষ্ট্র / নানা ফন্দি নানা অজুহাত করেছে সব নষ্ট/ নষ্টের তালিকায় নেই কোনো অমুসলিম রাষ্ট্র / দেখেনা তারা উত্তর কুরিয়ার হুমকি ও মারণাস্ত্র / ইসলামের অগ্রযাত্রা রুখে দিতে তারা এক পায়ে খাঁড়া / আভিজাত্য আরবরা আজ বাড়ি-ঘর ছাড়া / প্রথম জঙ্গি সংগঠন ‘হাগানার’ জন্ম ১৯২০ সালে / ফিলিস্তিনিদের তাড়াতে ইহুদী জঙ্গি সৃষ্টি ইতিহাস বলে / দেশে দেশে জঙ্গি সৃষ্টি ইহুদী ষড়যন্ত্র / আইএস ভাইরাস ইসরাইল মিত্র / স্বাধীন হয়েছে পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদান / বিশ্বমোড়লরা চায় না, ফিলিস্তিন ও আরাকান সমাধান / নৃশংসতা ও বর্বরতায় উন্মত্ত ইসরাইল ও মিয়ানমার / অথচ মুসলিমবিশ্ব ঘুমন্ত আর বিশ্বনেতৃবৃন্দ নির্বিকার!
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন রোহিঙ্গাদের ওপর মগ দস্যুদের নির্যাতনের ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেছে। একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে এক বোনকে বিবস্ত্র করে কিছু মানুষ নামধারী নরপশু ঘিরে ধরেছে। বার্মিজ সৈন্যরা তাকে রাইফেল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে উল্লাস করছে আর কিছু মগ দস্যু নরপিচাশ কুপিয়ে কুপিয়ে জীবন্ত বোনটির হাত-পা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেহ থেকে একে একে বিচ্ছিন্ন করছে। বোনটির আহাজারি, আর্তনাদ ও আর্তচিৎকারে অকাশ বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে। এসব দৃশ্য দেখলে একজন সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যাবে। কোনো বিবেকবান ও হৃদয়বান ব্যক্তি নিজেকে ধরে রাখতে পারবেন না। আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে নাফ নদীর পানিতে ভাসছে একটি বালিকার মৃতদেহ। দু’হাত দু’দিকে ছড়ানো। শ্যামলা মুখটি ফোলে কালো হয়ে গেছে। এ রকম একটি দু’টি শিশু নয়, বরং শত শত লাশ! ভাসছে সব বয়সের নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর শিশুর মরদেহ। ফেসবুক খুললে দেখা যায় মিয়ানমার বাহিনীর নৃশংস উল্লাস নৃত্য। মানুষ এমন বর্বর, নিষ্ঠুর আর পিশাচ হতে পারে, সেসব দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। পুরো নগ্ন করে যুবতীর দেহ নিয়ে উল্লাস করছে। লাথি মারছে, প্রহার করছে, হাত-পা কেটে নিচ্ছে, মাথা কেটে আলাদা করে ফেলছে। তারপর দেহে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিচ্ছে। কর্তিত মুণ্ডু হাতে নিয়ে উল্লাস নৃত্য করছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে এক বোনকে ঘিরে ধরেছে হিং¯্র হায়েনার দল। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে তার চোখ-মুখ দিয়ে। তিনি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। বাঁচার জন্য কাকুতি-মিনতি করছেন। কিন্তু দাঁড়াতে দেয়া হচ্ছে না তাকে। সঙ্গে সঙ্গে লাথি মেরে আবার তাকে মাটিতে ফেলে দেয়া হচ্ছে। চারদিকে তাকে ঘিরে রয়েছে কয়েক শ’মানুষ নামের নরপশু। আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা। না তাকে সেই সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। গায়ে ঢেলে দেয়া হলো পেট্রোল। আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো শরীরে। বোনটি চীৎকার করেন। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। পারেন না। মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পিশাচ বাহিনী তাকে বাঁচতে দেয় না। আবার তার শরীরে ঢেলে দেয় জ্বালানি তেল। আবার দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে তার দেহ। সেটি পরিণত হয় আগুনের কুণ্ডুলিতে। আর নর-পিশাচদের উল্লাস চলতে থাকে। লাশ গুলোকে যেভাবে বিকৃত করা হচ্ছে তা দেখে বনের হিংস্র জানোয়ারাও লজ্জা পাবে।
সীমান্তে প্রবাহিত নাফ নদীর একূলে বাংলাদেশ আর ওকূলে মিয়ানমার। এ কূলে মানবতার আশ্রয় আর ওকূলে মানবতার পরাজয়। একূলে শরণার্থী আর ও কূলে মৃত্যুযাত্রী। এ কূলে সহযোগিতা ও সহমর্মিতা আর ও কূলে ধর্ষিতা ও হত্যা। এ কূলে মানবতার জয়গান বাঁচাও বাঁচাও আর ও কূলে মানবতার পরাজয় আগুন, জ্বালাও, পোড়াও। এ কূলে মানুষ কুরবানির পশুর রশি ধরে টানছে আর ও কূলে আদম সন্তানদের গলায় রশি লাগিয়ে টানছে। মানবতার কী ভয়ংকর অবমাননা! একূলের লোকগুলো আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য গরু-ছাগল জবাই করছে আর ওকূলের মগরা আদম সন্তানদের জবাই করছে অবলীলায়! গৌতম বৌদ্ধের বাণী ‘জীব হত্যা মহাপাপ’। তাহলে কার সন্তুষ্টির জন্য রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে হত্যা করা হচ্ছে? এ কূলের মানুষ মৃত পশুর মস্তক কর্তন করছে আর ও কূলে জীবিত মানুষের মস্তক কর্তন করছে। কুড়াল দিয়ে জীবন্ত মানুষের দেহ থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। এ কূলের মানুষগুলো ঈদ আনন্দ করছে আর ও কূলে ধর্ষিতা রোহিঙ্গা নারীর আর্তচিৎকারে মগের মুল্লুকের আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠছে। গৌতম বৌদ্ধের দর্শন পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখী হোক। খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে কিভাবে সুখ নিশ্চিত হয়? এ কি গৌতম বৌদ্ধের আদর্শ? ‘অহিংসা পরম ধর্ম’ বৌদ্ধের এই বাণীর সঙ্গে পৈশাচিকতা কিভাবে সমান্তরালভাবে চলতে পারে? একূলে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলিম আর ওকূলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মগদস্যু। এ হচ্ছে নাফ নদীর দু’কূলের পার্থক্য।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে প্রায় দেড় কোটি রাষ্ট্রহীন মানুষ বসবাস করে। তারাতো রোহিঙ্গাদের মতো বর্বরতা ও নৃশংসতার শিকার হয় না। তাহলে মিয়ানমারে তাদের ভাষায় রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গাদের ওপর এতো অত্যাচার, নির্যাতন, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ কেনো হচ্ছে? অনেকে মনে করেন, বার্মিজরা ঐতিহাসিকভাবে অসভ্য, বর্বর ও নিষ্ঠুর। মানুষের গলায় দড়ি বাঁধা, হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া রাখাইনদের পুরনো অভ্যাস। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭১৮ সালে বার্মার রাখাইন রাজা দক্ষিণবঙ্গ তছনছ করে অন্তত এক হাজার ৮০০ জন সাধারণ অধিবাসীকে ধরে নিয়ে যায়। বন্দিদের রাজার সামনে হাজির করা হলে রাখাইন রাজা সেখান থেকে বেছে বেছে এক দলকে তাঁর নিজের দাস বানান, আর অবশিষ্টদের গলায় দড়ি বেঁধে ক্রীতদাস হিসেবে বাজারে বিক্রি করে দেন। আগের আরাকান বর্তমান রাখাইন প্রদেশে দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস, দক্ষিণে বার্মিজ বংশোদ্ভূত ‘মগ’ ও উত্তরে মিশ্র বংশোদ্ভূত ‘রোহিঙ্গা’। মগের মুল্লুক বলতে জোর যার মুল্লুক তার, অরাজকতা ও দস্যুপনার যে প্রবাদ দেশে প্রচলিত আছে তা মিয়ানমারের মগদের বর্বরতা ও দস্যুপনা থেকেই উৎপত্তি। মগ দস্যুরা এতটাই নিষ্ঠুর ও বর্বর ছিল যে, হত্যা ও লুণ্ঠন শেষে গ্রামের পর গ্রাম আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিত। মানুষদের ধরে নিয়ে দাস হিসেবে বাজারে বিক্রি করত। পৃথিবীতে নিজ দেশের নাম পরির্বতন করেছে এমন জাতি খুঁজে পাওয়া ভার। যে জাতি নিজ দেশের নাম পরিবর্তন করতে পারে, তা থেকে অনুমেয় তারা করতে পারে না এমন কোনো বর্বর কাজ নেই।
ইতিহাস থেকে জানা যায় স্বাধীন রাজ্য আরাকানে প্রায় ২০০ বছর মুসলমানদের শাসন ছিল। আরাকান বহু শতাব্দী ধরেই রোহিঙ্গা মুসলমান, রোসাঙ্গ হিন্দু, আর বৌদ্ধদের মাতৃভূমি। মধ্যযুগে এ হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা চন্দ্র-রোসাং আর মুসলমানরা রোহাং নামেই পরিচিত ছিল। হিন্দু চন্দ্র রাজারা এবং মুসলিম সুলতানরাই ছিলেন আঠারো শতকের আগ পর্যন্ত আরাকানের শাসক। রাখাইন উপকূল থেকে বর্মি অধ্যুষিত মিয়ানমার আরাকান পাহাড় দিয়ে বিচ্ছিন্ন। বর্মি রাজারা প্রায়ই এ অঞ্চলে হামলা করতেন। প্রাচীন সভ্যতায় সমৃদ্ধ আরাকানের বির্পযয়ের শুরু মূলত ১০৪৪-১০৭৭ খ্রিস্টাব্দে বার্মিজ রাজা আনাওরথার আগ্রাসনের সময় থেকে। তিনি হাজার হাজার স্থানীয় রোসাং, রোহাং এবং রেকং বা রাখাইনদের হত্যা করেন, দেশত্যাগী হয় লাখ লাখ আরাকানী। চট্টগ্রামে বসবাসকারী চাকমা, রাখাইন, মারমাসহ অনেক জনগোষ্ঠী সে সময় দেশত্যাগী হয়ে বাংলাদেশে বসত করে। রাজা আনাওরথাই স্থানীয় বৌদ্ধ মতবাদ হঠিয়ে থেরাভেদা বৌদ্ধ মতবাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেন। গৌড়ের সুলতানদের সহযোগিতায় আরাকানের সম্রাট নারামেখলা ২৪ বছর বাংলায় নির্বাসিত থাকার পরে ১৪৩০ সালে আরাকানের সিংহাসন ফেরত পান। পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে আরাকানী রাজারাও বাঙ্গালী ও মুসলমানদের আরাকানের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্টিত করেন। সুতরাং আরাকানের রোহিঙ্গাদের বাঙ্গালী বা মুসলমান যা-ই বলা হোক না কেনো, তারা কোনো ভাবেই বহিরাগত নয়। বরং ১৭৮৫ সালে আরাকান দখলকারী বর্মিরাই হলো নবাগত। এ সত্য ও সঠিক ইতিহাস আর্ন্তজাতিক মহল ও বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা সকলের নৈতিক দায়িত্ব। আরাকান দখলের পর বর্মি শাসকেরা হিন্দু ও মুসলিম অধিবাসীদের সঙ্গে আবারও শত্রুতা শুরু করে। এ বৈরিতা কমেছিল ব্রিটিশদের হাত থেকে মিয়ানমারের স্বাধীনতার পর গণতন্ত্রপন্থীদের সময়। বার্মার প্রথম প্রেসিডেন্ট উ নু রোহিঙ্গাদের আরাকানের অধিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে বার্মার প্রথম সংবিধান সভার নির্বাচনে তারা ভোট দিয়েছিলেন। ১৯৫১ সালে তারা পায় আরাকানের অধিবাসী হিসেবে পরিচয়পত্র। ১৯৫৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের আরাকানের জাতিগোষ্ঠী বলে অভিহিত করেন। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন মিয়ানমারের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম শাও সোয়ে থাইক বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গারা যদি স্থানীয় আদিবাসী না হয়, তাহলে আমিও তা নই’। কিন্তু ‘ভাগ্যের র্নিমম পরিহাস ১৯৬২ সালে সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার দিন থেকেই শুরু হয় রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগের মহাকাব্য! তাদের নাগরিত্ব কেড়ে নেওয়া হয়, বন্ধ হয়ে যায় রোহিঙ্গা ভাষায় রেড়িও অনুষ্ঠান প্রচার। শুরু হয় অপারেশন ড্রাগন কিং নামে রোহিঙ্গা বিতাড়ন কর্মসূচি। দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধন চলে আসছে। ২০১২ সালে হত্যাকান্ডের সময় সে সময়কার মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, বিতাড়নই এ সমস্যার সমাধান।’ সুতরাং রাখাইন তথা সাবেক আরাকান রোহিঙ্গাশূন্য করা তাদের রাষ্ট্রীয় প্রকল্প। আদমশুমারিতে রোহিঙ্গাদের গণনা করা হয় না। নাগরিকত্বের অধিকার ও ভোটের অধিকার নেই। বাঁচা-মরা, বিবাহ ও সন্তানধারণ, কর্ম, চাকুরী, ভ্রমণ, লেখাপড়া, বাণিজ্য ও চলাফেরা সবই সামরিক শাসকদের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং কৃপার অধীন। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় থেরাভেদা বৌদ্ধ উগ্রপন্থীরা রোহিঙ্গাদের বিনাশ চায়। গৌতম বৌদ্ধের বাণী ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামী’র শরণ তারা পায় না বিধায় তারা আজ আমাদের দুয়ারে শরণার্থী। গণতন্ত্রের মানসকন্যা খ্যাত অং সান সুচিও রোহিঙ্গা বিতাড়নের পরোক্ষ সর্মথক। কবি আবুল হাসানের ভাষায় বলতে হয়, ‘মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না’।
এ পৃথিবীতে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। আজ যিনি উজির-নাজির, হতে পারেন কাল উনি ফকির। এ ক্ষমতা-গৌরব, ধন-সম্পদ ও মাল-দৌলত অল্প কয়েক দিনের আমানতমাত্র। আল্লাহপাক আমাদের দান করেছেন পরীক্ষা করার জন্য। আবার এসব ছেড়ে খালি হাতে একদিন এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে। অপরের দুঃখে আমরা যদি দুঃখিত হতে না পারি, অপরের ব্যথায় আমরা যদি ব্যথিত হতে না পারি, তাহলে পরকালে আমরা নিশ্চিত ক্ষতিগ্রস্ত হব। অনাথ, অসহায়, বিপদগ্রস্ত মানুষগুলোর প্রতি আমরা যদি সহযোগিতা, সহমর্মিতা, দোয়া ও দয়ার হাত প্রসারিত না করি, তাহলে কাল হাশরের ময়দানে মহান আল্লাহর দরবারে আমরা কি জবাব দেব? হাদিসে কুদসিতে এসেছে আল্লাহপাক হাশরের ময়দানে বান্দারদের উদ্দেশ্য করে বলবেন, হে বান্দা! আমি তোমার দুয়ারে শরণার্থী হয়েছিলাম, তুমি কিন্তু আমাকে আশ্রয় দাওনি। আমি বিপদগ্রস্ত ছিলাম, তুমি কিন্তু আমাকে সহযোগিতা করনি। আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, তুমি কিন্তু আমাকে খাদ্য দাওনি। আমি পিপাসিত ছিলাম, তুমি কিন্তু আমাকে পান করাওনি। আমি অসুস্থ ছিলাম, তুমি কিন্তু আমার সেবা করনি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘তুমি মুমিনদের জন্য তোমার বাহুকে অবনমিত করো’ (৮৮:১৫)। সূরা দোহায় আল্লাহপাক বলেন, ‘তুমি পিতৃহীনের প্রতি কঠোর হয়ো না এবং ভিক্ষুককে ধমক দিয়ো না।’ হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ (রাযি.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে মানুষকে দয়া করে না, আল্লাহপাক তাকে দয়া করেন না’ (বুখারী ও মুসলিম)। বনী ইসরাইলের এক মহিলা কুকুরকে পানি পান করিয়ে জান্নাতে গিয়েছেন। আরেক মহিলা বিড়ালকে নির্যাতন করার অপরাধে জাহান্নামে গিয়েছেন। হাদীসে এসেছে রাসূল (সা.) বলেন, ‘যদি অর্ধেক খেজুর দান করে জাহান্নামের আগুন থেকে বাচঁতে পার, তবুও বাঁচ। যদি কারো পক্ষে তাও সম্ভব না হয়, তাহলে সে যেন ভাল কথা বলে বাঁচে (বুখারী ও মুসলিম)। ‘জীবে দয়া করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’। মনে রাখতে হবে ‘সবার উপরে মানুষ, তাহার উপরে নেই’।