আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসেম্মলন ২০১৭
আল্লামা শাহ মুফতী আবদুল হালীম বোখারী (দা. বা.)
সেক্রেটারি জেনারেল, ইত্তেহাদুল মাদারিসিল আহলিয়া বাংলাদেশ
মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
الْـحَمْدُ للهِ نَحْمَدُهُ، وَنَسْتَعِيْنُهُ، وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنُؤْمِنُ بِهِ وَنَتَوَكًّلُ عَلَيْهِ، وَنَعُوذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا، وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مَنْ يَّهْدِهِ اللهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ، وَمَنْ يُّضْلِلْهُ فَلَا هَادِيَ لَهُ، ونَشْهَدُ أَنْ لَّا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ، وَنَشْهَدُ أَنَّ سَيِّدَنَا وَمَوْلَانَا مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَعَلَىٰ آلِهِ وَأَصْحَابِهِ، وَبَارِكْ وَسَلِّمْ تَسْلِيْمًا كَثِيْرًا كَثِيْرًا.
أَمَّا بَعْدُ! فَأَعُوْذُ بِاللهِ مِنْ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ، بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ، [بَلْ تُؤْثِرُوْنَ الْحَيٰوةَ الدُّنْيَاٞۖ۰۰۱۶وَالْاٰخِرَةُ خَيْرٌ وَّاَبْقٰى ؕ۰۰۱۷] {الأعلىٰ: ১৬ – ১৭} صَدَقَ اللهُ الْعَظِيْمِ.
মুহতরম সদরে জলসা! উপস্থিত হযরাতে ওলামায়ে কেরাম ও সম্মানিত বেরাদরানে ইসলাম, বরকতের জন্য পবিত্র কুরআনের কিছু অংশ তেলাওয়াত করেছি, সে আয়াতে আল্লাহ পাক আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ইরশাদ করেন, ‘তোমাদেরকে দেখা যায় যে, তোমরা দুনিয়ার স্বার্থকে প্রাধান্য দাও অথচ আখেরাত দুনিয়া থেকে উত্তম এবং স্থায়ী, দুনিয়া নিরস (অনুত্তম) ও অস্থায়ী।’ আল্লাহ পাক অভিযোগ করেন যে, নিরস ও অস্থায়ীটাকে উপরে রাখলে আর সরস ও স্থায়ীটাকে নিচে রাখলে, এটা তো উচিত নয়। দুনিয়া শব্দের এক অর্থ হলো কাছে, আখেরাতের তুলনায় দুনিয়াটা কাছে। দুনিয়ার আরেক অর্থ হলো নিরস, আখেরাতের তুলনায় দুনিয়াটা অত্যন্ত নিরস, আর আখেরাত হলো সরস। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে আখেরাত হল সরস, আর দুনিয়া নিরস। আমরা যে যুগটিতে আছি সে যুগে আমাদের হায়াত ৫০-৬০-৭০ বছর, আর বেশ হলে ১০০ বছর আমাদের হায়াত। আখেরাতের হায়াতের শুরু আছে শেষ নেই। خٰلِدِيْنَ فِيْهَاۤ اَبَدًاؕ ۰۰۵۷। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘তোমাদেরকে জান্নাতে চিরদিন রাখব, যদি তোমরা আমার হুকুম মান্য কর।’ মুরব্বিরা অফুরন্ত হায়াতের উদাহরণ এভাবে দিয়েছেন যে, সারা পৃথিবীটা যদি আসমান পর্যন্ত গম দিয়ে পূর্ণ করে রাখা হয় এবং একটি পাখিকে বলা হয়, এখান থেকে একটা গম সাত আসমানে নিয়ে যাবে এবং ৭০ হাজার বছর পর আরেকটা গম নিয়ে যাবে, ওই পাখির গম নেওয়া একদিন শেষ হয়ে যাবে কিন্তু আখেরাতের অফুরন্ত হায়াত শেষ হবে না। দুনিয়াতে আমরা আছি সাড়ে তিন হাত, প্রত্যেকের হাতে প্রত্যেকে সাড়ে তিন হাত, আর আখেরাতে ৬০ গজ, যত মানুষ আছে জান্নাতে যাওয়ার পরে সব মানুষের দৈর্ঘ্য ৬০ গজ হয়ে যাবে, প্রস্থ ৭ গজ। আর দুনিয়াতে পেশাব-পায়খানার কারণে দুর্গন্ধ হয়, আর বেহেশতে পেশাব-পায়খানা হবে না। (হুযুর একটা ঘটনাস্বরূপ বলেন) আমরা কোথাও মেহমান হিসেবে গেলে বিশেষ করে রোগী মানুষ বাড়িঅলাকে জিজ্ঞেস করে বাথরুম কোথায়? পরিস্কার আছে তো? তারপর সে ওখানে গিয়ে পানি ঢেলে দেয়, এসব দেখে ফেরেশতা হাসবে, আর এখানেতো যা খায় কিছু হজম হয়ে ভিটামিন হয় আর বাকিগুলো বের হয়ে যায়, আর বেহেশতে যা খাব সব ভিটামিন হয়ে যাবে, সেখানে দুর্গন্ধের কোনো অবকাশ নেই। জনৈক কবি খুবই চমৎকার বলেছেন,
بہشت آں جا کہ آزار نباشد
کسے را با کسے کار نباشد
দুনিয়ার বিবি যতই সুন্দর হোক না কেন আখেরাতের বিবির তুলনায় কিছুই নয়, আখেরাতের বিবি সম্পর্কে বলেছেন যে, বেহেশতের বিবি এতই সুন্দর যে, যদি একজন বিবি আসমান ফেটে একটা আঙ্গুল দেখায় তবে এমন আলো হবে যে, পুরো দুনিয়ায় আর সূর্যের আলো দেখা যাবে না। আর যদি প্রশান্ত মহাসাগরে একবার থুথু নিক্ষেপ করে তাহলে এত বড় প্রশান্ত মহাসাগরের লবনাক্ত সব পানি মিঠায় মিষ্টান্ন হয়ে যাবে, আর তার মাথায় যে ওড়না আছে সে ওড়নার দাম এত বেশি যে, পুরো দুনিয়া বিক্রয় করা হলেও ওই ওড়নার মূল্য দেওয়া যাবে না। আর সেগুলো এমন বিবি যেগুলোকে কেউ টাচ (স্পর্শ) করতে পারেনি। আল্লাহ সেসব রমণীকে রেখেছেন এমন আবরণে ঢেকে যাতে করে কোনো মানুষ বা জিন স্পর্শ করতে না পারে। আমাদের দেশে তো স্কুল-কলেজ ও ভার্সিটিতে পড়েছে এমন কোনো মেয়েকে বিয়ে-শাদি দেওয়ার সময় কেউ গ্যরান্টি দিয়ে বলতে পারবে না যে, কেউ তাকে স্পর্শ করেনি, আল্লাহ পাক বলেন,
حُوْرٌ مَّقْصُوْرٰتٌ فِي الْخِيَامِۚ۰۰۷۲ فَبِاَيِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِۚ۰۰۷۳ لَمْ يَطْمِثْهُنَّ اِنْسٌ قَبْلَهُمْ وَ لَا جَآنٌّۚ۰۰۷۴
অর্থাৎ ‘সেই রমণীগণকে রেখেছি এমন বেষ্টনীতে যাতে কোনো মানুষ স্পর্শ করতে না পারে।’ দুনিয়াতে আমাদের যে সব বিবিরা আছে তারাও আপনার সাথে থাকবে, তারা এখানে সাড়ে তিন হাত, আর তারা যখন বেহেশতে যাবে তখন ৬০ গজ এবং আপনাকে সেখানে যেসব রমণী দেওয়া হবে সে সকল বিবির ডাইরেক্টর হয়ে যাবে এবং ডাইরেক্টর হিসেবে সে সকল বিবিকে পরিচালনা করবে, কারণ সে আপনার কাছে পুরো জীবন ব্যয় করায় আপনার মেজায বুঝবে, সেজন্য দুনিয়ার বিবিকে বেহেশতি বিবির ওপর পরিচালিকা এবং ডাইরেক্টর বানিয়ে দিবে। দুনিয়ার বরই মুরগীর ডিমের সমান, আর আখেরাতের বরই মটকার সমান, আবার মটকাতো দুনিয়ার মটকা নয় সেটা আখেরাতের মটকা হবে, সেটা আবার আখেরাতের মটকার চেয়ে ছোট হবে না; বরং বড়ই হবে, যার পরিমাপ باب الـحضر নামক একটি দরজা আছে তার সমান হবে, যে দরজা দিয়ে ৬০ গজ বিশিষ্ট জান্নাতীরা প্রবেশ করবে, দুনিয়াতে যে চড়–ই পাখি আছে জান্নাতে সেই চড়–ই পাখি দেয়া হবে তা এক একটা উটের সমান, আল্লাহ বলেন,
وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَشْتَهِيْۤ اَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَدَّعُوْنَؕ۰۰۳۱
অর্থাৎ ‘তোমরা মনে যা কামনা করবে, মুখে বলনি মনে মনে কামনা করবে, পৌঁছিয়ে দেওয়া হবে।’ গোস্ত আর ভাত এক সেকেন্ডের ভেতর, আর যদি মুখে বলে তখনও পৌঁছিয়ে দেওয়া হবে।
খতীবে আযম হযরত মাওলানা সিদ্দীক আহমদ (রহ.)-এর এক সঙ্গী ছিল, তার সাথে একদিন দেখা হয়ে ছিল, সে সময় সে সিগারেট টানছে, খতীবে আযম (রহ.) বললেন, তুই বৃদ্ধ হয়ে গেছিস এখনো সিগারেট টানিস? তখন সে উত্তরে বলে আমি বেহেশতে গিয়েও সিগারেট খাব, কোথায় পাবে? তখন সে সঙ্গী উপরের আয়াত তেলাওয়াত করলেন, যার অর্থ হলো- সেখানে তোমাদের যা মনে চায় তা সব কিছুর ব্যবস্থা করা হবে, আমি সেখানে আল্লাহর কাছ থেকে সিগারেট চাইবো এবং আল্লাহ সিগারেট দিবেন, তখন খতীবে আযম (রহ.) বললেন জান্নাতে তো আগুন নেই কোথায় পাবে? لَا يَرَوْنَ فِيْهَا شَمْسًا وَّلَا زَمْهَرِيْرًاۚ۰۰۱۳ তাতে তোমার সিগারেট খেতে যদি ইচ্ছা হয় তাহলে আগুনের জন্য তোমাকে জাহান্নামে যেতে হবে, তখন সে আর যাবে বলে না। দুনিয়াতে একজন মানুষ উন্নতি করতে করতে পুরা বিশ্বের একজন প্রেসিডেন্ট হবে, যেমন সুলাইমান (আ.) পুরা বিশ্বের একজন প্রেসিডেন্ট। তা ছাড়া আর কোন গভর্নর নেই, বেহেশতে দশটা পৃথিবীর রাজত্ব দান করা হবে একজন জান্নাতিকে, এজন্য হযরত বেলাল উদ্দীন গাঙ্গুহী (রহ.) আফসোস করে বলছেন, তুমি বাহন হারিয়ে ফেললে, চেরাগ হারিয়ে ফেললে, মাল হারিয়ে ফেললে সফর করতে পার না। বেহেশতে এরকম অফুরন্ত নেয়ামত ওখানে হাত ছাড়া হয়ে যাবে তুমি তখন কিভাবে সফর করবে? দু’জাহানের বাদশাহ রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন,
مَا مَثَلُ الدُّنْيَا فِي الْآخِرَةِ، إِلَّا مَثَلُ مَا يَجْعَلُ أَحَدُكُمْ إِصْبَعَهُ فِي الْيَمِّ، فَلْيَنْظُرْ بِمَ يَرْجِعُ
অর্থাৎ, দুনিয়া-আখেরাতের দৃষ্টান্ত হলো প্রশান্ত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগরে যদি একটি আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেওয়া হয় আবার আঙুলটি উঠানোর পর যে পানি উঠবে তা হল দুনিয়ার হায়াত, আর প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহা সাগরের অবশিষ্ট পানি হলো আখেরাতের হায়াত।
হাদীস শরীফে আছে,
مَا أَنَا فِي الدُّنْيَا إِلَّا كَرَاكِبٍ اسْتَظَلَّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمَّ رَاحَ وَتَرَكَهَا
অর্থাৎ,দুনিয়া তো ওই রকম যে, কোনো সফরকারী ভারি বাহন নিয়ে ভ্রমণ করছিল পথিমধ্যে বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে একটি গাছের ছায়ায় একটু বসে আবার ওঠে চলে গেল।’ ওই যে গাছের ছায়ায় একটু করে বসেছে এটাই হলো দুনিয়ার হায়াত। হাদীসে আছে, রাসূল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে মশা-মাছির ডানা পরিমাণও যদি দুনিয়ার কোনো মূল্য থাকতো তাহলে আল্লাহ তায়ালা কোনো কাফেরকে এক লোকমা খাবার খেতে দিতেন না।’
জনৈক বুযুর্গ বলেন,
وَالدُّنْيَا فَانِيَةٌ وَالْآخِرَةُ بَاقِيَةٌ.
অর্থাৎ,দুনিয়া ধ্বংসশীল, এটা ধ্বংস হয়ে যাবে।’ বেশি দিন থাকবে না এবং দুনিয়া ও তার ভেতর যা আছে তার দৃষ্টান্ত হল মাকড়সার বাসার ন্যায়, বুযুর্র্গ বলেন, দুনিয়া অস্থায়ী, হায়াত দেরী নেই, দেরী নেই, তুমি আজকে ৫ তলায় কাল নিচ তলায়। তোমার জন্ম হয়েছে মৃত্যুর জন্য, তুমি অনাবাদ জায়গার জন্য ফল চাষ করছ।
হাদীসে আছে, হযরত আলী (রাযি.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের ঈমানের নৌকাকে নিজে তৈরি কর, কারণ সফর খুব লম্বা। ঈমানকে তোমরা নতুনভাবে তৈরি কর, বেশি বেশি لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا اللّٰهُ বল।’ রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন,
جَدِّدُوْا إِيْمَانَكُمْ
‘তোমার লাইসেন্স যেমন বছর অন্তর অন্তর নবায়ন কর, لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا اللّٰهُ তেমনিভাবে ঈমানকে বেশি বেশি পড়ে পড়ে নবায়ন কর।’ হাদীস শরীফে আছে,
اذْكُرُوا اللهَ حَتَّىٰ يَقُوْلُوْا: مَجْنُوْنٌ
‘তোমরা যিকর কর, যিকর করতে করতে মানুষ যাতে তোমাকে পাগল বলে।’
শায়খ আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) বড় পীর সাহেব তাঁর দরবারে শত শত মানুষ থাকত এবং পীর সাহেব সবাইকে মেহমানদারি করতেন, সানজর নামক দেশের বাদশাহ পীর সাহেবের ভক্ত ছিলেন, তিনি দেখলেন হুযুরের লোকজন বেশি, তাই তিনি বললেন, তার বহু রাজ্য ছিল, একটা রাজ্যের নাম ছিল নিমরুজ যার এমনে অর্থ হল আধা দিন। সে একদিন বললেন, পীর সাহেব হুযুরের তো মেহমান বেশি তো নিমরুজ নামক স্থানটি খালি আছে, যদি হুযুর চান সেখানে মেহমানসহ বসবাস করবেন, এ বলে জিলানী (রহ.)-এর কাছে খবর পাঠালেন। তা শুনে জিলানী (রহ.) বললেন, তুমি যে আমাকে নিমরুজ যেতে বলছ আমি যদি সেখানে যাই তাহলে আমার এ চেহারার নূরটা সানজর দেশের ছাতার মতো কালো হয়ে যাবে। তখন আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে দিলেন, আমার রাজ্যের প্রয়োজন নেই, এ ছিলো আমাদের বুযুর্গদের অবস্থা।
আল্লাহ তায়ালা বলেন এবং হাদীসেও একথা বুঝিয়েছেন যে, দুনিয়ার পেছনে দৌড়াদৌড়ি কর না। দুনিয়া তোমার পেছনে দৌড়বে। এ প্রসঙ্গে হযরত কাসেম নানুতবী (রহ.)-এর একটা ঘটনা আছে যে, একদা তিনি মসজিদে বসা ছিলেন, এ অবস্থায় এক ব্যক্তি বেশ কিছু টাকা নিয়ে আসলেন এবং হুযুরকে দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। কিন্তু নানুতবী (রহ.) নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন, আমার তো এখন টাকার প্রয়োজন নেই। আমার টাকা লাগবে না, টাকাগুলো নিয়ে আপনি চলে যান। সে চলে যাওয়ার পর হুযুর মসজিদ থেকে বের হয়ে দেখেন যে, হুযুরের জুতা বাইরে এবং ওই লোকটি সব টাকা জুতার ভেতর রেখে চলে গেছে। তারপর হুযুর তা দেখে সব সাথীদেরকে ডেকে বললেন, দেখেন হুযুর (সা.) যে বললেন, যে ব্যক্তি দুনিয়ার পেছনে দৌড়বে না, দুনিয়া তার পেছনে দৌড়বে। দেখেন লোকটিকে আমি বের করে দিলাম, কিন্তু সে টাকাগুলো আমার জুতায় ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেল। এখন একটা প্রশ্ন আসে যে, তা হল, হুযুর দুনিয়া যদি এমন হারাম হয়, তাহলে আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারব না, সংসারের জন্যে টাকা-পয়সা অর্জন করতে পারব না, গাড়ি ক্রয় করতে পারব না এবং দুনিয়া কী জিনিস বুঝতে পারব না। বেলাল উদ্দিন গাঙ্গুহী (রহ.) বলেন, তোমাকে দুনিয়া থেকে নিষেধ করি না, কিন্তু বলি যে, তুমি যা কিছু কর না কেন আল্লাহকে যাতে ভুলে না যাও। জনৈক কবি খুবই চমৎকার বলেছেন,
نمی گويم کہ از دنيا جدا باش
بہر کارے کہ باشی با خدا باش
অর্থাৎ দুনিয়া অর্জন করা, ব্যবসা-বাণিজ্য করা, বড় বড় বিল্ডিং করা হারাম নয়। যদি এসব তোমাকে আল্লাহর স¥রণ থেকে বিরত না রাখে। সবকিছু থাকা সত্ত্বেও যদি আল্লাহ থেকে গাফেল না হও তবে দুনিয়া অর্জন কর। আখেরাত হল দুনিয়া অপেক্ষা উত্তম এবং স্থায়ী। শায়খ ওবাইদুল্লাহ আহরার নামক এক বহু বড় মাপের বুুযুর্গ ছিলেন, তার ছিল বহু বড় প্রাচুর্য এবং ধনভাণ্ডার। এর ঘর ছিল বহু চাকচিক্যময়। সবসময় শাহী পোশাক পরিধান করতেন। সে সময়ের আরেকজন বুযুর্গ ছিল আল্লামা আবদুর রহমান জামী (রহ.) যিনি শরহে জামী নামক কিতাব লিখেছেন। সে এক সময় ইচ্ছে করলেন ওবাইদুল্লাহ আহরার নামক বুযুর্গের সাথে সাক্ষাৎ করার। সাক্ষাত করতে গিয়ে দেখেন, ওই বুযুর্গের বাড়ির সামনে বহু বড় শাহী গেইট, বহু বড় বিল্ডিং। তা দেখে জামী (রহ.) আশ্চর্য হয়ে বললেন, সেই আবার বুযুর্গ হয কেমনে? যে দুনিয়া নিয়ে এত সময় লিপ্ত থাকে, তখন জামী (রহ.) চক দিয়ে একটি কবিতা এর এক পঙ্ক্তি লিখে দিলেন। গেইট দিয়ে ঢুকে
نہ مرد است کہ دنيا دوست دارد
লিখে দিয়ে আসলেন এবং বললেন, যার মধ্যে দুনিয়ার মহব্বত আছে সে বুযুর্গ হতে পারে না। জামী (রহ.) দূর থেকে সফর করে আসার কারণে একটু ক্লান্ত হয়ে গেছেন বিধায় পাশে এক মসজিদ ছিল সেখানে ঢুকে বিশ্রাম নিলেন এবং ঘুম চলে আসছে, তিনি স্বপ্নে দেখছেন যে, কিয়ামত কায়েম হয়ে গেছে এবং একজন আরেকজন থেকে যে যা টাকা পেত তা আদায় করে নিচ্ছে, এ অবস্থায় জামী (রহ.)-এর থেকে এক ব্যক্তি কিছু টাকা পেত সে এসে বললেন, জামী সাহেব! আমার টাকা দাও, এখনই দিতে হবে, জামী (রহ.)-এর পকেটে তখন টাকা নেই, এখন তো কিয়ামতের মাঠ কায়েম হয়ে গেছে টাকা কোথায় পাবে?
এসব মিলিয়ে জামী (রহ.) খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং মনে মনে ভাবতে লাগলেন, হায় হায় এখন কি হবে? আমি তো আটকে গেলাম। এখন কি হবে? ঠিক সে সময় দেখছেন, ওই ওবাইদুল্লাহ আহরার (রহ.) ঘর থেকে বের হয়ে আসলেন এবং জামীর কাছে এসে ওই ব্যক্তিকে বলছেন, তুমি জামীর কাছ থেকে কত টাকা পাবে? পাওনাদার বলল, এত টাকা, তখন শায়খ ওবাইদুল্লাহ আহরার টাকা বের করে বললেন, নাও তোমার টাকা, সব পাওনা টাকা আদায় করে জামী (রহ.)-কে মুক্ত করলেন। তারপর জামী (রহ.) এর ঘুম ভেঙে গেল, তখন ওই বুযুর্গ জামী (রহ.)-কে ডেকে বললেন, যাও কবিতা আর অর্ধেকটা লিখে দাও, তখন জামী (রহ.) গিয়ে ওই কবিতার সাথে মিলিয়ে লিখে দিলেন,
اگر دارد برائے دوست دارد
তখন পুরো কবিতা হলো এরকম:
مرد آن ست کہ دنيا دوست دارد
اگر دارد برائے دوست دارد
অর্থাৎ যার কাছে দুনিয়া আছে সে বুযুর্গ নয়, তবে যারা খেদমতের জন্যে রাখে, বন্ধু-বান্ধবের খেদমতের জন্যে রাখে, দুঃস্থ-গরীবের খেদমতের জন্য রাখে তাহলে তাকে দুনিয়ার পাগল বলা যাবে না, তাকে বুযুর্গ বলা হবে। আপনি একটি ফ্যাক্টরি দিলেন, ওই ফ্যাক্টরি দিয়ে দীনী খেদমত করলেন, বিবি-বাচ্চার জন্য খরচ করলেন, আপনার জন্য এর সাওয়াব রয়েছে। আবার এমনও আছে মাথায় গোল টুপি, বড় পাগড়ি এবং গায়ে জুব্বা আবার যিকরও করে কিন্তু সে আলমগীর বাদশাহ।
এক বুযুর্গকে জিজ্ঞেস করা হল দুনিয়া এটা কি? তিনি বললেন, এ দুনিয়া একটা টর্নেডোর মত। এই আছে এই নেই বা একটি স্বপ্নমাত্র। অথবা একটা বানানো গল্প। অতঃপর বলল, যারা এই দুনিয়াকে নিয়ে মত্ত হয়ে গেছে, পাগল হয়ে গেছে, তারা হল ভুত বা দুষ্ট জিন।
বাস্তবে এই দুনিয়া এবং এতে যা কিছু আছে সব মাটি হয়ে যাবে। এক বুযুর্গ বলছেন, আমার নফস বলছে রাশিয়া সফর করার জন্য, কেননা এটা খুব সুন্দর জায়গা এবং রাশিয়ার রাজধানী আরও সুন্দর, তারপর আমি আমার নফসকে কবরস্থানে নিয়ে গেলাম, বললাম, হে নফস! দেখ এটা সিকান্দর বাদশাহের কবর, আর এটা হল বাদশাহ সুলাইমানের কবর। তারা ছিল কয়েকটি রাশিয়ার বাদশাহ, তারা সব মাটি হয়ে কী অবস্থা তাদের আজ? হে আমার নফস! তুমি কি রাশিয়া দেখতে চাও? রাসূল (সা.) বললেন,
الدُّنْيَا سِجْنُ الْـمُؤْمِنِ وَجَنَّةُ الْكَافِرِ
‘দুনিয়া হল মুসলমানদের জন্য জেলখানা আর কাফেরদের জন্য বেহেশত।’ জেলখানায় থাকলে জেল কর্তৃপক্ষের সব শর্ত, হুকুম মেনে চলতে হয়, অপরদিকে বেহেশতে কোন শর্ত নেয়, যেমন ইচ্ছে তেমন করতে পারবে।
বাবারা! তোমরা আখেরাতের সন্তান হও দুনিয়ার সন্তান হয়োনা। আর আখেরাতের সন্তান হওয়ার জন্য সে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আর এসবের আলোচনা স্কুল-কলেজ কিংব্ াভার্সিটিতে আছে? না, স্কুল-কলেজ বা ভার্সিটির কোথাও নেই। এসবের আলোচনা রয়েছে আমাদের পটিয়া মাদরাসার মত মাদরাসাসমূহে। এসব মাদরাসা থেকে বড় আল্লাহর ওলী বের হয়েছে। হযরত বড় পীর শাহ আবদুল কাদের জীলানী (রহ.) বের হয়েছে, হাজী ইমদাদুল্লাহ (রহ.) বের হয়েছে, আল্লাহ পাক আমাদেরকে বুঝার ও আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
وَآخِرُ دَعْوَانَا أَنِ الْـحَمْدُ للهِ رَبِّ الْعَالَـمِيْنَ.
অনুলিখন: মুহাম্মদ যাকারিয়া
আদব বিভাগ ২০১৭