মূল : ইবরাহিম সাকরান
অনুবাদ : ইমরান রাইহান
যদি আপনার নোটবুকটির পাতা উল্টে দেখা হয়, কিংবা ড্রয়ার থেকে পুরনো কাগজপত্র বের হয়, তাহলে দেখা যাবে আপনার বহু চমৎকার পরিকল্পনা সেখানে সাজিয়ে লেখা আছে। হতে পারে সময়ের দূরত্ব অনেক কিছুর ওপর বিস্মৃতির আবরণ দিয়েছে, রুচি ও মেজাজও পরিবর্তিত হয়েছে, তবু কিছু পরিকল্পনা আপনাকে বিস্মিত করবেই। আপনি ভাববেন, এত চমৎকার কাজটি কেন করতে পারলাম না? আপনি যদি নিজের সবগুলো পরিকল্পনা স্মরণ করেন, তাহলে একটা দুঃখবোধ আপনাকে ছুঁয়ে যাবে। আপনি আবিষ্কার করবেন, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন উপত্যকায়, আর আপনার স্বপ্ন ও পরিকল্পনাগুলো আছে পাহাড়ের চুড়ায়, হাত বাড়িয়েও যাদের নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়।
কেন আমাদের স্বপ্নগুলো হারিয়ে যায় কালের প্রবাহের সাথে তাল দিয়ে? কেন পরিকল্পনাগুলো আর কখনোই আলোর মুখ দেখে না? কেন সময়ের ভারে চাপা পড়ে যায় ইচ্ছা ও সংকল্পগুলো? আমি বহুবার ভেবেছি, কেন এমনটা হয়? কেন আমরা আমাদের স্বপ্নকে স্পর্শ করার আগেই হারিয়ে যাই ব্যস্ত জীবনের কোলাহলে। আমি জানি—তালিকা করলে এর পেছনে বহু কারণ বের করা যাবে। কিন্তু আমার মনের মাঝে বিশেষ একটি কারণ ঘুরেফিরে আসে। আমার মনে হয়, আমরা পরিকল্পনা করি মজবুত পাথরের ওপর, কিন্তু আমাদের পা এখনো নরম। কোমল। রুক্ষ পাথরে চলাচলের উপযুক্ত হয়ে উঠেনি।
বহু মানুষ ভাবছে—তারা পরিশ্রমের তিক্ত স্বাদ না নিয়ে কিংবা কষ্ট সহ্য না করেই নিজেদের স্বপ্নের দেখা পাবে। সাফল্যের চূড়ায় আরোহণ করবে। কিন্তু আল্লাহ মানুষের জীবনকে কিছু শৃঙ্খলার আওতাভুক্ত করেছেন। মহৎ বিষয়গুলো যেমন—জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় গভীরতা অর্জন, ইলম ও আমলে নিজেকে সজ্জিত করা, সমাজে দীন প্রতিষ্ঠিত করা, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন, ইত্যাদি কখনোই অর্জিত হয় না, যদি কেউ নিজের আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিতে না পারে। নিজের স্বপ্নকে নিজের আয়ত্তে আনতে চাইলে অবশ্যই নিজের অনেক প্রিয় বিষয়কে বিসর্জন দিতে হবে।
যিনি দীর্ঘ সময় ঘুমাতে অভ্যস্ত, কিংবা বহুপদের খাবার না হলে তার চলে না কিংবা বন্ধুবান্ধবের আড্ডাতেই চলে যায় তার দীর্ঘ সময়, তিনি নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার সুযোগ খুব কমই পাবেন। যিনি প্রযুক্তির নেশায় আচ্ছন্ন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা গেইমস না হলে যার চলে না, তিনি কোনো স্বপ্ন দেখা মানে আলাদীনের চেরাগ হাতে পাওয়ার অপেক্ষা করা।
মনে রাখবেন, যে কোনো মহৎ স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য কঠোর পরিশ্রমের বিকল্প নেই। সাফল্য কখনোই আপনার হাতে ধরা দিবে না যদি আপনি নিজের জীবনের আরাম-আয়েশ ও কর্মফোর্ট জোন ত্যাগ করতে না পারেন।
একবার এক সহকর্মী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনটি সবচেয়ে বড় হুমকি? আমি বলেছিলাম, আমাদের জন্য হুমকি হলো, গাম্ভীর্যতার অভাব।
আপনি নিশ্চিত থাকুন যে পরিবেশে হাসি তামাশা ও সস্তা চটুল আচরণ প্রাধান্য পায়, সেখানে কোনো ভালো গবেষণামূলক কাজ করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর বাস্তবতা এটি অনুমোদন করে না। আল্লাহ জ্ঞানকে মূল্যবান করেছেন, সস্তা পণ্যের বাজারে এটি পাওয়া যায় না। আপনি যেকোনো মেধাবী ও জ্ঞানী মানুষকে জিজ্ঞেস করুন কিংবা বিখ্যাত কারো জীবনী পড়ুন, দেখবেন যারা নিজেদের স্বপ্ন ছুঁতে পারেনি, তাদের সবচেয়ে বেশি সময় নষ্ট হয়েছে খাদ্য, পানাহার, ঘুম ও বিনোদনে।
বহু মানুষ পরিকল্পনার পর পরিকল্পনা সাজিয়ে চলেছে, কোন কাজের পর কোন কাজ করবে তা ঠিক করছে, কিন্তু তাদের কোনো কাজই করা হচ্ছে না। কারণ তাদের পা এখনো রুক্ষ পাথুরে জমিতে চলতে রাজি নয়। বহু যুবককে বলতে শুনবেন, কিছুদিনের মধ্যেই একটা ব্যবসা শুরু করবো বা একটা উদ্যোগ নিব। কিন্তু তাদেরকে কখনোই সেই কাজ করতে দেখা যায় না। কারণ তারা তাদের কমফোর্ট জোন থেকে বের হওয়ার সাহস করতে পারেনি। তারা নিজেদের আরাম-আয়েশকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত নয়। তারা চায় সকালে তাদের গাঢ় ঘুম হোক, দুপুরে ভরপেটে খাবার হোক, বিকালের আড্ডাটাও টিকে থাকুক। অপ্রয়োজনীয় সম্পর্ক, অপ্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও অপ্রয়োজনীয় কথোপকথন ঘিরে রেখেছে তাদের যাপিত জীবনকে। এই চক্র বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তাদের প্রতিটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়।
ইমাম মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ রহ. যখন সহীহ মুসলিম সংকলন করছিলেন, তখন তিনি নামাযের সময় সংক্রান্ত অধ্যায়ে পৌঁছে আবদুল্লাহ ইবনে আমর থেকে বর্ণিত এ সম্পর্কিত হাদীসটি পান। হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে একাধিক সূত্রে। ইমাম মুসলিম সবগুলো সনদকে একত্রিত করেন এবং সুন্দরভাবে বিন্যস্ত করেন। কাজটি সহজ ছিল না। এজন্য তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছিল। এই হাদীসগুলো বর্ণনা করার পর তিনি একজন বিখ্যাত আলেম ইয়াহইয়া ইবনু আবি কাসীরের একটি কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেছিলেন, শারীরিক আরামের সাথে ইলম অর্জন করা সম্ভব নয়।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইমাম মুসলিম শর্ত করেছিলেন তার এই গ্রন্থে তিনি শুধু নবীজি ﷺ থেকে বর্ণিত মারফু হাদীসগুলোকেই উল্লেখ করবেন। তাহলে কেন তিনি এমন একটি উক্তি উল্লেখ করলেন যা অধ্যায়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কাযী ইয়াজ রহিমাহুল্লাহ এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে লিখেছেন, অনেকেই প্রশ্ন করেন ইমাম মুসলিম কেন এই বর্ণনাটিকে উল্লেখ করলেন অথচ এটি নবীজির হাদীস নয় এবং এই গ্রন্থের শর্তেরও বাইরে। আমাদের কিছু শায়খ বলতেন, ইমাম মুসলিম এই অধ্যায়ের হাদীসগুলো সংগ্রহের জন্য যে কষ্ট করেছিলেন তা বুঝাতে এটি এখানে বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে ইংগিত আছে তিনি যা অর্জন করেছেন তা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই অর্জন করেছেন। এটা স্পষ্ট ইয়াহইয়া ইবনু আবি কাসিরের এই উক্তি ইমাম মুসলিমের মনোজগতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
যদি আপনি এই উক্তিটি নিয়ে চিন্তা করেন তাহলে বুঝতে পারবেন এটি কোনো কথার কথা নয়। এটি কোনো বুদ্ধিজীবীর বুদ্ধি দেখানোর কসরত নয়। বরং এটি এক বিচক্ষণ ব্যক্তির জীবনে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার সার নির্যাস। এর প্রতিটি শব্দ জীবনের বাস্তবতাকেই মেলে ধরছে। আমি যখনি কোনো তরুণ আলেমকে দেখি যিনি ইলমের জগতে নিজের সমসাময়িকদের চেয়ে এগিয়ে গেছেন কিংবা বিশেষ কোনো শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেছন। তখনই আমার মাথায় আসে এই উক্তি, শারারিক আরামের সাথে ইলম অর্জন করা যায় না।
এই কষ্টকে আলিঙ্গন করার সাহস অর্জন করতে হবে। ইবনুল কাইয়্যিম রহ. লিখেছেন, যেকোনো বিষয়ে পূর্ণতা অর্জিত হয় কষ্ট সহ্য করার মাধ্যমে। অন্যত্র তিনি লিখেছেন, দীর্ঘ যাত্রা অব্যাহত না রেখে কেউ ঘরের আরাম পায়নি। ক্লান্তির সেতু পাড়ি না দিয়ে কেউ বিশ্রামের জায়গায় পৌঁছেনি। ইবনুল কাইয়্যিম পরে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন, কীভাবে আল্লাহর হেকমত ক্লান্তি ও সাফল্যের মাঝে সমন্বয় সাধন করে। তিনি লিখেছেন, আল্লাহর হেকমত হলো ক্লান্তির সেতু পার না হয়ে সুখ ও আনন্দের কাছে পৌঁছা যাবে না। ক্লান্তি ও সাফল্যের এই যে সম্পর্ক তা শুধু ইসলামী শরীয়াহতে স্থির করা হয়েছে এমন নয়, বরং এটিই পৃথিবীর নেজাম। সকল জাতি ও সকল মানুষের জন্য যেকোনো প্রকার সাফল্য অর্জনের শর্ত হলো তাকে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হবে। নিজের জীবনের অনেক স্বাদ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে লক্ষ্যের পেছনে ছুটতে হবে।
ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রহ.-এর একজন প্রথম সারির ছাত্র ছিলেন আবু ইসহাক ইবরাহীম আল হারবী। তিনি একাধারে বড় মুহাদ্দিস ও সুফি ছিলেন। গরীবুল হাদীস তার লিখিত বিখ্যাত গ্রন্থ। তিনি প্রায়ই বলতেন, জ্ঞানীরা এ কথার ওপর একমত হয়েছেন, আরামের মাধ্যমে সুখ অর্জন করা যায় না। খতীবে বাগদাদী তারিখে বাগদাদে ইবরাহীম আল হারবীর একটি কথা উল্লেখ করেছেন যেখানে তিনি নিজের জীবন সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলেন। ইবরাহীম আল হারবী বলতেন, সব জাতির জ্ঞানীরা একমত যে তাকদীরের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না, সে কখনোই জীবনে শান্তি পায় না। আমার জামা ছিল পরিষ্কার কিন্তু লুঙ্গি ছিল সবচেয়ে ময়লা। কখনোই আমার মনে হয়নি দুইটা সমান হওয়া উচিত। আমার এক পায়ে ছেড়া জুতা ছিল, অন্য পায়ে ছিল ভালো জুতা। এ অবস্থাতেই আমি পুরো বাগদাদের এ মাথা থেকে অন্য মাথায় ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু কখনোই মনে হতো না যে এগুলো ঠিক করতে হবে। আমি কখনো স্ত্রী-সন্তান, মা-বোন কারো কাছে নিজের কনও অসুস্থতার অভিযোগ করিনি। প্রকৃত পুরুষ সে ব্যক্তি, যে নিজের কষ্ট নিজেই বহন করে এবং তার পরিবারকে এতে জড়ায় না। ৪৫ বছর ধরে আমার মাথাব্যথা। আমি কখনো কাউকে এটি বলিনি। জীবনের ত্রিশ বছর আমার কেটেছে শুধু দুটি রুটি খেয়ে। তাও সেগুলো খেতাম যখন আমার মা ও বোন আমার সামনে নিয়ে আসতেন। নইলে পরদিন পর্যন্ত না খেয়েই কাটাতাম। সন্দেহ নেই এই বক্তব্য ইবরাহীম আল হারবীর সুউচ্চ মনোবল ও জীবনের প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করার মানসিকতা তুলে ধরে।
তবে পৃথিবীতে এমন মানুষের সংখ্যা কমই হয়, যারা নিজেকে সুউচ্চ কোনো লক্ষ্য অর্জনে নিয়োজিত রাখেন এবং জীবনের কষ্ট ও ক্লান্তি সম্পর্কে বেপরোয়া থাকেন। বেশিরভাগ মানুষ হারিয়ে যায় কষ্ট ও প্রতিকূলতার সামনে। ইবরাহীম আল হারবীর এই বক্তব্য পরবর্তী আলেমদের অনেককেই প্রভাবিত করেছিল। তারা বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন। তাইতো ইবনুল কাইয়্যিমকেও বলতে দেখা যায়, সকল বুদ্ধিমান ব্যক্তি একমত হবেন যে, আত্মার সমৃদ্ধি ও পূর্ণতার জন্য পরিশ্রম করা উত্তম। যিনি বেশি পরিশ্রম করবেন তার অবস্থান উঁচু হবে।
আপনি যদি নিজের লাইব্রেরিতে বসা থাকেন, আপনার সামনে বইপত্র রাখা আছে জ্ঞানার্জনের জন্য, কিন্তু কেউ এসে আপনাকে ঘোরাঘুরির প্রস্তাব দেয়া মাত্রই আপনি তাতে সায় দিচ্ছেন, কিংবা যখন কঠোর পরিশ্রমের সময় তখন আপনি বিশ্রাম বা ঘুমের কথা ভাবছেন, তাহলে আপনি লক্ষ্য অর্জনের পথ থেকে ছিটকে পড়বেন। আমি বলি, যদি কখনো ক্লান্তি আপনাকে ঘিরে ফেলে এবং আপনি ভাবেন যে অনেক হয়েছে একটু থামা যাক, তখন দয়া করে ইবরাহীম আল হারবীর এই বক্তব্য মনে করবেন। জ্ঞানীরা একমত হয়েছেন, আরামের মাধ্যমে সুখ অর্জন করা যায় না। দেখবেন, আপনি আবার নতুন উদ্যমে জেগে উঠেছেন। আপনার ভেতর সতেজতার প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছে। আপনি কাজে মনোযোগ দিয়েছেন আরামের চিন্তাকে পেছনে ফেলে।
আমাদেরকে অবশ্যই কষ্ট ক্লেশ সহ্য করে পরিশ্রম করতে হবে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্থাৎ জান্নাত প্রাপ্তি এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবার জন্য। কিন্তু দুনিয়ার সাধারণ বিষয়গুলোও পরিশ্রম ছাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। ইবনু তাইমিয়্যা রহ. বলেছেন, দুনিয়ার স্বাদ শুধু বিশেষ ধরণের পরিশ্রমের মাধ্যমেই পাওয়া যায়। তাই যদি কেউ পথ চলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠে, তখন তার উচিত হবে ফলাফলের দিকে লক্ষ রাখা। ইবনুল জাওযী রহ. বলেছেন, পুরষ্কারের প্রথম প্রভাত কষ্টের অন্ধকার দুর করে দেয়। আলেমদের মাঝে একটি কথা প্রচলিত আছে। তারা বলতেন, পরিশ্রম অনুস্বারেই ইচ্ছা পূর্ণ হবে।
এবার তাহলে দেখা যাক, পরিশ্রম ও সাফল্যের মাঝে সম্পর্কের বিষয়ে কুরআন ও হাদীস কী বলছে। এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীসে বহু ইশারা বিদ্যমান। এ সম্পর্কে সবচেয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায়, একটি হাদীসে যেখানে নবীজি ﷺ বলেছেন, “জান্নাত বেষ্টিত দুঃখ মুসিবত দ্বারা।” জান্নাতে প্রবেশ করতে হলে এমনসব বিষয় ত্যাগ করতে হয় যা মানুষের প্রবৃত্তি অপছন্দ করে। মানুষের নফসকে চুড়ান্ত কষ্ট দেয়ার মাধ্যমেই জান্নাতের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব। অন্য এক হাদীসে নবীজি ﷺ মুমিনের দুঃখ ও কষ্ট সহ্য করার চিত্র বর্ণনা করেছেন এভাবে, “দুনিয়া হলো মুমিনের জন্য কারাগার।”
যদি আপনি জান্নাতি ও জাহান্নামিদের ব্যাপারে কুরআনের বর্ণনাগুলো সামনে রাখেন তাহলে দেখবেন জান্নাতিরা দুনিয়ায় ক্লান্তির সেতুতে আরোহণ করেছিল, অপরদিকে জাহান্নামিরা আরাম আয়েশ ও প্রবৃত্তির অনুসরণে ব্যস্ত ছিল। দেখুন, কুরআন কীভাবে জান্নাতিদের দুনিয়ার জীবনকে চিত্রিত করেছে,
آخِذِينَ مَا آتَاهُمْ رَبُّهُمْ إِنَّهُمْ كَانُوا قَبْلَ ذَلِكَ مُحْسِنِينَ , كَانُوا قَلِيلًا مِّنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ
“এমতাবস্থায় যে, তারা গ্রহণ করবে যা তাদের পালনকর্তা তাদেরকে দেবেন। নিশ্চয় ইতোপূর্বে তারা ছিল সৎকর্মপরায়ণ। তারা রাত্রির সামান্য অংশেই নিদ্রা যেত।”
অন্য আয়াতে দেখুন, সাহাবিদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে
إِنَّ رَبَّكَ يَعْلَمُ أَنَّكَ تَقُومُ أَدْنَى مِن ثُلُثَيِ اللَّيْلِ وَنِصْفَهُ وَثُلُثَهُ وَطَائِفَةٌ مِّنَ الَّذِينَ مَعَكَ
“আপনার পালনকর্তা জানেন, আপনি ইবাদতের জন্যে দন্ডায়মান হন রাত্রির প্রায় দু’তৃতীয়াংশ, অর্ধাংশ ও তৃতীয়াংশ। আর দণ্ডায়মান হন আপনার সঙ্গীদের একটি জামাতও।”
রবের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে,
قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًا
রাত্রি জাগরণ করুন কিছু অংশ বাদ দিয়ে।
রাত্রি জাগরণ সম্পর্কে কুরআনের এই আয়াতগুলো স্মরণ করুন এবং ভাবুন, আমাদের বালিশগুলোর কথা, যা দিনরাত ঘুমানোর ফলে চিড়েচ্যাপটা হয়ে গেছে। নিশ্চয় উচ্চতর মর্যাদা অর্জন করতে অনেক কষ্ট করা প্রয়োজন। জান্নাতিদের পরিবর্তে এবার জাহান্নামিদের জীবন দেখুন। কুরআন বলছে,
إِنَّهُمْ كَانُوا قَبْلَ ذَلِكَ مُتْرَفِينَ
“ইতোপূর্বে তারা ছিল আরাম আয়েশের ভেতর। ”
জান্নাতিরা যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন তাদেরকে অভিবাদন জানাতে ফেরেশতারা যে বাক্য বলবে তাতেও রয়েছে ইংগিত। যেমন :
جَنَّاتُ عَدْنٍ يَدْخُلُونَهَا وَمَنْ صَلَحَ مِنْ آبَائِهِمْ وَأَزْوَاجِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ وَالمَلاَئِكَةُ يَدْخُلُونَ عَلَيْهِم مِّن كُلِّ بَابٍ , سَلاَمٌ عَلَيْكُم بِمَا صَبَرْتُمْ فَنِعْمَ عُقْبَى الدَّارِ
“স্থায়ীভাবে অবস্থানের সেই উদ্যানসমূহ, যার ভেতর তারা নিজেরাও প্রবেশ করবে এবং তাদের বাপ-দাদাগণ, স্ত্রীগণ ও সন্তানদের মধ্যে যারা নেককার হবে, তারাও। আর (তাদের অভ্যর্থনার জন্য) ফেরেশতাগণ তাদের নিকট প্রত্যেক দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে (আর বলতে থাকবে-) তোমরা (দুনিয়ায়) যে সবর অবলম্বন করেছিলে, তার বদৌলতে এখন তোমাদের প্রতি কেবল শান্তিই বর্ষিত হবে এবং (তোমাদের) প্রকৃত নিবাস এটা কতই না উৎকৃষ্ট পরিণাম।”
দেখুন, ফেরেশতারা বলবে, “তোমরা যে সবর অবলম্বন করেছিলে।” অর্থাৎ জান্নাতিরা দুনিয়ার জীবনে পার্থিব আয়েশকে ত্যাগ করে কষ্ট ও ধৈর্য্যের জীবনকেই বেছে নিয়েছিল। আপনি বিষয়টি আরো গভীরভাবে অনুধাবন করবেন যদি আপনি কুরআনে বর্ণিত নবীদের জীবনী ও ঘটনাবলী অধ্যয়ন করেন। দেখুন, হযরত নূহ আ. কীভাবে তাঁর জাতির মাঝে ৯৫০ বছর ধরে দাওয়াতী কাজ চালিয়ে গেছেন। তিনি বলেছিলেন,
قَالَ رَبِّ إِنِّي دَعَوْتُ قَوْمِي لَيْلًا وَنَهَارًا
সে বললঃ হে আমার পালনকর্তা! আমি আমার সম্প্রদায়কে দিবারাত্রি দাওয়াত দিয়েছি।
তিনি আরো বলেছিলেন,
ثُمَّ إِنِّي دَعَوْتُهُمْ جِهَارًا ثُمَّ إِنِّي أَعْلَنتُ لَهُمْ وَأَسْرَرْتُ لَهُمْ إِسْرَارًا
“অতঃপর আমি তাদেরকে প্রকাশ্যে দাওয়াত দিয়েছি, অতঃপর আমি ঘোষণা সহকারে প্রচার করেছি এবং গোপনে চুপিসারে বলেছি।”
নবীজির জীবনও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ইবনুল কাইয়্যিম রহ. বলছেন, নবীজি ﷺ সম্মানের সাথে প্রবেশ করলেন মক্কায় যেখান থেকে কাফিররা তাকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করেছিল। নবীজি সম্মানজনক বিজয়লাভ করেছিলেন শত্রুদের কাছ থেকে অনেক কষ্ট সহ্য করার পর। সংক্ষেপে বলতে গেলে, উত্তম প্রশংসনীয় পরিণতিগুলো কঠিন ও অপছন্দনীয় কারণের মধ্য দিয়েই আসে।
যারাই জীবনের বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে এবং গভীরভাবে অনুধাবন করেছে জীবনের গতি-প্রকৃতি, তারাই বুঝতে পেরেছে কঠোর পরিশ্রম ছাড়া কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়।আব্বাসী যুগের বিখ্যাত কবি আবু তাম্মাম একটি কবিতা রচনা করেছিলেন আম্মুরিয়া জয়ের পর। সেখানে তিনি জীবনের বাস্তবতা তুলে ধরে লিখেছেন, আমি মহৎ প্রশান্তির সন্ধান পেয়েছি কিন্তু তা অর্জন করতে হয় ক্লান্তির সেতু পার হয়েই। আরেকটি পঙক্তিতে তিনি বলেন, প্রশান্তির ঘুম পাওয়া যায়, ক্লান্তিকর ঘুমের পরেই। অর্থাৎ আরামদায়ক ঘুম পেতে হলেও অনেক ক্লান্তিকর দিন পেরিয়ে আসতে হয়। আবু তাম্মামের পরে আরেক বিখ্যাত কবি মুতানাব্বির কবিতাতেও মেলে এই নির্দেশনা। তিনি লিখেছেন, যদি পরিশ্রম না থাকতো তাহলে সবাইই নেতা হয়ে যেত। মুতানাব্বির মতে মানুষ মৌমাছির কামড় খাওয়ার ঝুঁকি নিয়েও মৌচাক কাটতে যায়। কারণ, এর মাধ্যমে তারা মধু অর্জন করতে পারবে। জীবনের কষ্টগুলোও এমন। কষ্ট স্বীকার করলেই সুমিষ্ট ফল আমাদের হাতে আসবে।
তবে এখানে একটি বিষয় আছে। যে কোনো কাজ করতে গেলে দুধরনের কষ্ট হতে পারে। একটি হলো সরাসরি কাজের সাথে সম্পর্কিত এবং এই কষ্ট এড়িয়ে সেই কাজটি করার সুযোগ নেই। যেমন নবীজি এক হাদীসে হযরত আয়শা রা.-কে বলেছেন, “তোমার প্রতিদান তোমার কষ্ট অনুসারে হবে।” আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,
الَّذِينَ آمَنُواْ وَهَاجَرُواْ وَجَاهَدُواْ فِي سَبِيلِ اللّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِندَ اللّهِ وَأُوْلَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ
“যারা ঈমান এনেছে, দেশ ত্যাগ করেছে এবং আল্লাহর রাহে নিজেদের জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করেছে, তাদের বড় মর্যাদা রয়েছে আল্লাহর কাছে আর তারাই সফলকাম।”
আরেক প্রকার কষ্ট হলো, যা কাজের সাথে সম্পর্কিত নয়; বরং ব্যক্তি নিজের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে, কিংবা তার কৌশলে ভুল আছে। যেমন একবার নবীজি ﷺ দেখলেন এক বৃদ্ধ ব্যক্তি তার দুই ছেলের কাঁধে ভর রেখে হেটে যাচ্ছেন। নবীজি ﷺ জিজ্ঞেস করলেন, তার কী হয়েছে? সাহাবিরা জানালেন, তিনি মানত করেছেন পায়ে হেঁটে হজ্ব করবেন। নবীজি বললেন, লোকোটি নিজেকে কষ্ট দিক আল্লাহর এর কোনো দরকার নেই। এরপর তিনি আদেশ করেন, সে যেন বাহনে আরোহণ করে। এই ধরণের কষ্ট যা ব্যক্তি নিজের ওপর অনর্থক চাপিয়ে দেয় তা ইসলামী শরীয়তে পছন্দনীয় নয়। নবীজির সীরাতপাঠে আমরা জানতে পারি নবীজির সামনে যদি দুটি পদ্ধতি উপস্থিত হতো তাহলে তিনি তুলনামূলক সহজটি অবলম্বন করতেন। ইবনু তাইমিয়্যা রহ. এই বিষয়ে সুন্দর আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন,
অনেক সময় কষ্ট ও পরিশ্রম অনুযায়ী সওয়াব বৃদ্ধি পায়। এর মানে এই নয় যে, কষ্ট ও পরিশ্রম করাই মূল উদ্দেশ্য। বরং কাজ করতে গেলে অনিবার্যভাবেই কষ্ট ও পরিশ্রম চলে আসে। আমাদের শরীয়াহর বৈশিষ্ট্য হলো, এটি আমাদের ওপর সবকিছু সহজ করেছে এবং অনর্থক কিছু চাপিয়ে দেয়নি। দু’ধরনের কষ্টের তফাত আলোচনা করলাম যেন আমরা কোনো প্রান্তিকতা অবলম্বন না করি, যেটা করেছে ভ্রান্ত সুফিদের কেউ কেউ।
আমার মূল আলোচ্য বিষয় হলো, প্রায়ই লক্ষ করি, আমরা অনেকে জ্ঞানচর্চা, দাওয়াহ, সংস্কার ও উম্মাহর পুনরুত্থানের স্বপ্ন দেখি। অনেক জটিল জটিল পরিকল্পনা করি। কিন্তু আমরা যে জীবন যাপন করি তা পূর্ণ হয়ে আছে আরাম আয়েশ, পুর্ণ বিশ্রাম, অতিরিক্ত ঘুম, অতিরিক্ত বিনোদন ও অপ্রয়োজনীয় মেলামেশায়। আমরা যে স্বপ্ন দেখি, তার সাথে এই জীবনাচার কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যদি আমরা পরিশ্রমের পথে অগ্রসর না হই তাহলে দ্রুতই আমাদের জীবনের সময় ফুরিয়ে যাবে, সুস্থতার জায়গা দখল করবে অসুস্থতা। শরীর ও মনের সব উদ্যম হারিয়ে এক খাঁ খাঁ বিষণ্ণতা বিরাজ করবে মন জুড়ে। জীবনের সবকিছুই তখন মনে হবে হতাশাকর, যেখানে টানেলের শেষ প্রান্তেও অপেক্ষা করছে শুধুই অন্ধকার।
আল্লাহ আপনি দয়া করুন, ইয়াহইয়া ইবনু আবি কাসীরের প্রতি, যিনি বলেছিলেন, শারীরিক আরামের সাথে ইলম অর্জন করা সম্ভব নয়। আল্লাহ আপনি দয়া করুন, ইবরাহীম আল হারবীর প্রতিও। তিনি বলেছিলেন, আরামের মধ্যে থেকে কখনো প্রকৃত সুখ অর্জিত হয় না।