আল্লামা মুফতী আবু তাহের কাসেমী নদভী
নাহমদুহু ও নুসল্লি ‘আলা রাসূলিহিল কারীম। আম্মা বাদ-
قال رسول الله ﷺ: إذا ماتَ الإنسانُ انقطع عنه عملُه إلَّا من ثلاثٍ: صدقةٌ جاريةٌ، أو علمٌ يُنتفَعُ به، أو ولدٌ صالحٌ يدعو له
-সহীহ মুসলিম
উপস্থিত সম্মানিত ওলামায়ে কেরাম, প্রিয় অতিথিবৃন্দ এবং আমার শ্রদ্ধেয় ছাত্রভাইয়েরা-
আজ আমরা স্মরণ করছি সেই মহান মনীষাকে, যাঁর নাম উচ্চারণমাত্রই হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বন্যা বয়ে যায়। তিনি হলেন আমার উস্তয-হযরত আল্লামা সুলতান যওক (রহ.)। তাঁর জীবন, তাঁর কর্ম, তাঁর সাধনা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে এবং ইনশাআল্লাহ আরও হবে। আমি নিজেও তাঁর সাহচর্যে পুষ্ট এক নগণ্য খিদমতগার। কিছু স্মৃতির আবেশ হৃদয়ে ধারণ করে আজ এখানে হাজির হয়েছি।
যখন আমি জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার ছাত্র, তখন একদিন হযরতের কক্ষে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম। হযরত স্নেহভরে বললেন, “কিছু কলা নিয়ে এসো।” আমি তখন দোকান থেকে কলা এনে দিলাম, কিন্তু সেগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের। হযরত সেগুলো হাতে নিয়ে আবার আমাকে পাঠালেন। আমি তখন সচেতনভাবে ভালোমানের, পাকা ও আকর্ষণীয় কলা নিয়ে এলাম। হযরতের মুখমণ্ডলে তখন যে স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠেছিল, তা আজও চোখে ভাসে। আমি অনুভব করলাম—হয়তো হযরতের অন্তরে এ বোধ জাগলো, “এই ছেলে সজ্ঞান, বুদ্ধিদীপ্ত।” সেদিন থেকেই হযরতের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা, স্নেহভাজনতার এক অটুট বন্ধন গড়ে ওঠে।
হযরতের সাহিত্যিক রুচি ছিল অসাধারণ। তিনি আরবী সাহিত্যের এক নবধারার সূচনা করেছিলেন পটিয়ার প্রাঙ্গণে। আমি, আদীব সাহেব আবু তাহের মিসবাহ দা.বা.—এই সাহিত্যপিপাসু ছাত্রদের নিয়ে তিনি শুরু করলেন এক নতুন অভিযাত্রা। ‘সাদেক’ নামে একটি আরবী পত্রিকা প্রকাশ করলেন, যেখানে জাতির উদ্দেশ্যে আরবী সাহিত্যের মাধ্যমে দীনের আহ্বান পেশ করতেন। আমরা সেই কাগজে লিখতাম, তাঁর নির্দেশনায় নিজেদের কলমকে শাণিত করতাম।
এই সম্পর্কের ধারাবাহিকতায়, যখন আমি দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে দাওরায়ে হাদীস শেষ করে হযরতের কাছে চিঠি লিখলাম, হযরত আমার তো দাওরায়ে হাদীস শেষ হল আমি এখ নদওয়ায় যেতে চাই। হযরত উত্তরে লিখলেন বেশ ভালো এখনই চলে যাও।
আমি যাওয়ার পর দেখলাম নদওয়াতুল ওলামায় ভর্তি হওয়ার তখন কোনো সুযোগই নাই। ভর্তি হওয়ার সাধারণ পদ্ধতিগুলোতে চেষ্ট করে আমি বিফল হই। যওক সাহেব নিজ হাতে একটি সুপারিশপত্র রচনা করে নদওয়ায় বিশ্ববরেণ্য আলেমে দীন মাওলানা আবুল হাসান আলি নদভী রহ. এর নিকট পাঠিয়ে দেন। যা ছিল অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ও দায়িত্বপূর্ণ। তিনি লিখলেন, “এই ছেলেটি আমার নিজস্ব ছেলে। আমার নিজ হাতে গড়া ছাত্র। এই ছাত্র আমার মশাওয়ারা মোতাবেক নদওয়াতুল ওলামায় ভর্তি হওয়ার জন্য গিয়েছে। আমি চাই, সে নদওয়াতে ভর্তি হোক। আপনি তার দাখেলার ব্যবস্থা করে দেন।”
তখন রমযান মাস আমি এই চিঠি বিশ্ববরণ্য মনীষী, আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)-এর অবস্থান স্থল রায়বেরলীতে যাই। তার মসজিদে শত শত মানুষ ইতিকাফরত। আমিও সেখানে ইতেকাফ নিলাম। আমি হযরতের খেদমতে হাজির হলাম। এই দরখাস্ত পেশ করলাম। এই দরখাস্ত পেশ করার পর হযরত সেই পত্র হাতে নিয়ে নদওয়াতুল ওলামার নায়েবে মুহতামিম রাবে’ হাসান নদভীকে বললেন, “তুমি ছেলেটিকে দেখো। যাবতীয় বিষয়ের দেখভাল করো।”
আলহামদুলিল্লাহ সেখানে পুরা রমযান শেষ করার পরে ৭ শাওয়াল নদওয়াতুল ওলামা খোলার পর আল্লামা নদভী সাহেব রহ. এর সাথে সাক্ষাত করে আরজ করি, “হযরত আমার তো দাখেলা হয় নাই কী করা যায়”?
এরপর হযরত নিজ হাতে এক অপ্রথাগত অথচ দায়িত্বপূর্ণ সুপারিশ লিখে দিলেন-
“اس طالب علم کو استثنائی طور پر ادب عربی کے لیے داخلہ دیا جائے”
সমস্ত প্রচলিত নীতিমালার উর্ধ্বে উঠে হযরত যওক সাহেব হুজুর রহ. এর চিঠির বরকতে সেখানে আমার দাখেলা হয়ে গেল। বাংলাদেশের ইতিহাসে নদওয়ায় আমার এই দাখিলা ছিল এক নবদিগন্তের সূচনা। হযরত যওক সাহেব (রহ.) বলতেন- এই ছেলে মাজমাউল বাহারাইন! এই সেই ছাত্র, যিনি একসাথে দেওবন্দেরও, আবার নদওয়ারও গর্ব। এই পথ ধরেই পরবর্তীতে বাংলাদেশি ছাত্রদের জন্য পথ খুলে গেল। বাংলাদেশী ছাত্রদের আরবী সাহিত্য শিখার নবদিগন্তের সুচনা হল।
নদওয়ার পড়া-লেখা শেষে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে আমি হযরত নদভী (রহ.)-এর খেদমতে আরজ করলাম-“আমি তো বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছি, কী করব সেখানে?” হযরত বললেন, “সুলতান যওক সাহেবের সঙ্গে কাজ করো।” যওক সাহেব হুজুর তখন পটিয়া থেকে চলে এসে মুরাদপুর বাসা ভাড়া নিয়ে মাদরাসার কাজ শুরু করেছিলেন। আমি সরাসরি মুরাদপুর তাঁর কাছে চলে যাই। সৌভাগ্যক্রমে আমার জন্য সেখানে কিতাব তাকসিম হয়। এর পরে রিজিকের মালিক রাজ্জাক। যার যেখানে রিজিক সেখানে চলে যেতে হয়। পটিয়ার মুরুব্বিদের অনুরোধে আমি আবার পটিয়ায় ফিরে যাই, তবে হযরতের পূর্ণ অনুমতি নিয়ে, তাঁকে সন্তুষ্ট রেখেই।
সর্ব শেষ দুনিয়া কী বলে আমি বুঝি না। উলাামা কী বলে আমি বুঝি না। মানুষ কী মন্তব্য করে আমি জানতে চাই না। আমি হযরত যওক সাহেব হুজুর রহ. এর কাছে বারবার এসেছি।হযরতের পায়ে ধরেছি। চোখের পানি ফেলেছি। শতকিছুর পরেও হযরত ছিলেন আমার ওস্তাদ, আমার রূহানী অভিভাবক। আমি তাকে কষ্ট দিতে পারি না। তাঁর দুঃখ আমি কখনো চাইনি। তাঁর বিরুদ্ধাচরণ আমার পক্ষে ছিল অসম্ভব।
ইন্তেকালের মাত্র এক সপ্তাহ আগে পটিয়া মাদরাসার বড়বড় আসাতিযায়ে কিরামকে নিয়ে আমি হযরতের সাথে সাক্ষাতে এসেছি । তারও কিছুদিন আগে হযরত নিজেই ফোন করেছিলেন-মুফতী শামসুদ্দিন সাহেবের ফোন থেকে। বলেছিলেন, “আমি পটিয়া আসবো।” আমি বলেছিলাম, “আপনার হাজার হাজার ছাত্র আপনার জন্য অপেক্ষা করছে, হযরত!” কিন্তু আল্লাহর হুকুম চূড়ান্ত। হযরত আর আসতে পারলেন না।
হযরতের ইন্তেকালের দিন আমি ঢাকায় ছিলাম। পরদিন ছুটে এসে হযরতের কবর জিয়ারত করলাম, সুন্নত অনুযায়ী কিছু খাবার নিয়ে এলাম। হযরতের কন্যাদের তাজিয়াত করলাম এবং মুহতামিম হযরত মাওলানা ফুরকানুল্লাহ খলিল সাহেব (দা.বা.)-এর সান্নিধ্যে কিছু সময় কাটালাম।
আজ আমি শুধু এই দুআই করতে পারি-
“হে আল্লাহ! আমাদের এই মুরুব্বীকে জান্নাতুল ফেরদাউসের উচ্চতম মর্যাদা দান করুন। তাঁর রেখে যাওয়া শিক্ষা ও আদর্শ যেন যুগে যুগে আমাদের হৃদয়ে অনুরণিত হয়।”