বুধবার-২১শে রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি-১৫ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আল-কুরআনের তাফসীর ও তারজুমানী : মূলনীতি ও পাঠদান পদ্ধতি (২য় পর্ব)

সলিমুদ্দীন মাহদি কাসেমী

উচ্চতর তাফসীর গবেষণা বিভাগ: কিছু কথা ও কিছু পরামর্শ:
উচ্চতর তাফসীর গবেষণা বা তাকমীলে তাফসীর। এটিকে দারুল উলূম দেওবন্দে দাওরায়ে তাফসীরও বলা হয়। দারুল উলূম দেওবন্দের পাঠ্যক্রমে দুটি তাফসীর এবং তাফসীরের নীতিমালা সম্পর্কিত একটি কিতাব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
(১) তাফসীরে ইবনে কাসীর থেকে সূরা আস-সাফফাত এবং সাতাশতম পারা সম্পূর্ণরূপে পড়ানো হয়। (২) বায়যাবী শরীফ থেকে সূরা আলে-ইমরান সম্পূর্ণরূপে পড়ানো হয়। সূরা ফাতিহা এবং সূরা বাকারার অর্ধেক পারা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শিক্ষক মহোদয়গণ এই দুটি তাফসীরের দৈনন্দিন কিছু কিছু অংশ পাঠদান করে সমাপ্ত করেন। ছাত্রদেরকে তামরীন ও অনুশীলনমূলক ব্যবহারিক তেমন কোনো কাজ না থাকায় এই বিভাগটি খুব একটা সক্রিয় নয়।
দারুল উলূম হায়দ্রাবাদে তাফসীরের ওপর বিশেষায়িত একটি বিভাগ খোলা হয়েছিল এবং পাঠ্যসূচিতে তাফসীরের নিম্নলিখিত কিতাবগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়: মুখতাসার ইবনে কাসীর, আল্লামা শাওকানীর ফাতহুল কাদীর, তাফসীরাতে আহমাদীয়া, ইবনে কুতায়বা রচিত তাওয়িলু মুশকিলিল কুরআন, আল্লামা কাশ্মীরি (রহ.) রচিত মুশকিলুল-কুরআন এবং মানাহিলুল- ইরফান।

বিভিন্ন তামরীন ও অনুশীলন :
(১) সেখানে লেখার কাজও বিভিন্ন উপায়ে করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে হুকুমের আয়াত বের করা হয়। পবিত্র কুরআন থেকে সরাসরি কতগুলো হুকুম বের হয়, শিক্ষার্থীরা সহায়কগ্রন্থ থেকে এর বিবরণ লিখে।
(২) বায়ানুল-কুরআনের অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক করা হয়।
(৩) শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতে বলা হয়।
বর্তমানে মেধাবী ছাত্ররা হয় ইফতা পড়তে অথবা আরবী ভাষা ও সাহিত্যের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এই কারণে, হযরত মুফতী সাঈদ আহমাদ সাহেব পালনপূরী (রহ.) লিখেছেন: “দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত হওয়ার পর তাকমীলে তাফসীর পড়ানো হয়; তাই, যারা এ বিভাগে পড়াশোনা করতে চায়, তাদের অভিভাবকরা তাদের সুযোগ দেন না। তারা বলেন, ‘তুমি দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেছো, এখন আর পড়াশোনা করার কী দরকার? কাজে লেগে যাও!’ তারপর তারা কাজে এতটাই জড়িয়ে পড়ে যে, নিজেরাও তাফসীর অধ্যয়ন করার সুযোগ পায় না।” (আল-খাইরুল-কাসীর, পৃ. ২০)

তাকমীলে তাফসীরের পথ ও পদ্ধতি:
হযরত মুফতী সাঈদ আহমাদ সাহেব পালনপুরী (রহ.) লিখেছেন: “যে তাফসীর বিভাগে বায়যাবী, ইবনে কাসীর এবং তাফসীরে মাযহারী পড়িয়ে পবিত্র কুরআনের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা শেখানো হয়, এটি মোটেও ফলদায়ক নয়। আর ব্যর্থতার মূল কারণ হল, উপরোক্ত ব্যাখ্যাগুলো এত দীর্ঘ যে, একেকটি ঘণ্টায় (ক্লাসে) পাঁচ পারাও সঠিকভাবে পড়ানো যায় না। তাছাড়া, যোগ্য শিক্ষার্থীরা নিজেরাই এগুলো অধ্যয়ন করতে পারে, তাহলে কেন এক বছর এগুলোর জন্য ব্যয় করার প্রয়োজন? যদি উমদাতুল-ক্বারী, ফাতহুল-মুলহিম, বাযলুল-মাজহূদ এবং মাআরিফুস-সুনানের সাহায্যে দাওরায়ে হাদীস পড়ানো হয়, অর্থাৎ হাদীসের গ্রন্থ পড়ানোর পরিবর্তে এই ব্যাখ্যাগুলো পড়ানো হয়, তাহলে দাওরায়ে হাদীসও সজীবতা হারাবে।”
তিনি আরও লেখেন: “তাফসীরের ক্ষেত্রে, বাস্তবিক প্রয়োজনীয় হলো, পবিত্র কুরআনের (মতন) মূলপাঠকে ভিত্তি হিসেবে সামনে রেখে, তাফসীরের বিশেষজ্ঞরা পবিত্র কুরআন পড়াবেন, যেমন হাদীস বিশেষজ্ঞ শায়খুল হাদীসগণ হাদীসের দারস দিয়ে থাকেন। সমস্ত তাফসীরগ্রন্থ অধ্যয়ন করে সেগুলোর সারসংক্ষেপ তৈরি করে শিক্ষার্থীদের সামনে পেশ করবেন। তাহলে তাফসীর বিভাগের শান ও মর্যাদা রক্ষা করা যেতে পারে।” (আল-খাইরুল-কাসীর, পৃ. ১৯) পাশপাশি কিছু তামরীন ও অনুশীলনের কাজ যোগ করলে অনেক ফলফসূ হবে এ বিভাগ।

পবিত্র কুরআনের প্রতি অমনোযোগীতা:
যদি আমরা লক্ষ করি, আমাদের মাদরাসাগুলোতে কেবল কুরআনের অর্থানুবাদ শেখানো হয়। তিনটি জামাতে (পঞ্জুম, ছাহারুম ও সিউম)। আর (দুয়াম-কামেলাইনে) তাফসীরে জালালাইন পড়ানো হয়। ব্যস, এইটুকুই। কিছু কিছু মাদরাসায় উচ্চতর তাফসীর বিভাগ থাকলেও তাও তেমন ক্রিয়াশীল নয়। পবিত্র কুরআনের অবস্থা একটি নিপীড়িত ধর্মগ্রন্থের মতো হয়ে পড়েছে! আল-ইয়াযু বিল্লাহ। আমরা এই কিতাবটির প্রতি প্রাপ্য মনোযোগ দিচ্ছি না।
মাদরাসার জিম্মাদারগণের দায়িত্ব হলো, কুরআনের তাফসীর বিভাগের জন্য একটি কার্যকর পাঠ্যক্রম এবং ফলফসূ পদ্ধতি গ্রহণ করা। আল-হামদুলিল্লাহ, আজ পবিত্র কুরআন মুখস্থকারীদের অভাব নেই। যদি অভাব থাকে, তাহলে তা হলো—পবিত্র কুরআন সঠিকভাবে বোঝে, তার ওপর আমল করে এবং তা ছড়িয়ে দেয় এমন লোকের অভাব। আমরা যদি পবিত্র কুরআনের ওপর আমল করতে থাকি, তাহলে আমরা অবশ্যই সম্মান ও গৌরব অর্জন করব। আল্লাহ আমাদের অবশ্যই সাফল্য দান করবেন!

তাফসীরের উসূল ও নীতিমালার পাঠদান:
‘উসূলে তাফসীর’ কুরআনের ব্যাখ্যার সাথে সম্পর্কিত নিয়মকানুন বর্ণনা করে। আমাদের পাঠ্যক্রমে এই বিষয়ে দুটি বই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:
(১) আল-ফাওযুল-কাবীর
(২) মানাহিলুল-ইরফান।
আল-ফাওযুল-কাবীর একটি অত্যন্ত কার্যকর কিতাব। এটি কুরআন বোঝার ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় তা খুব ভালোভাবে সমাধান করে। কিতাবটিতে এত নীতি ও নিয়ম রয়েছে যে, অন্য কোনও কিতাব এর প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না। হযরত মাওলানা আবুল-হাসান আলী নদভী (রহ.)-এর ভাষায়: “এটি একটি মূল্যবান এবং বিরল কিতাব, এর মূল্য কেবল তারাই অনুধাবন করতে পারবে, যারা এই সঙ্কটের সম্মুখিন হয়েছেন। শাহ সাহেব তাঁর নিজস্ব রুচি, বিবেক এবং কুরআনের বোধগম্যতার ওপর ভিত্তি করে যে নীতিগুলো লিখেছেন তার কিছু অংশও অন্যান্য কিতাবের শত শত পৃষ্ঠা পড়েও তা অর্জন করা যায় না।” (মাসিক আল-ফুরকান, শাহ ওয়ালিউল্লাহ স্মারক, পৃষ্ঠা নং ৩৪১)
এটা বলা অযৌক্তিক হবে না যে, আমাদের মাদরাসসমূহে এই শাস্ত্রে এটাই একমাত্র কিতাব পড়ানো হয়; এর কারণ হলো—মাত্র কয়েকটি মাদরাসায় তাফসীর বিভাগ থাকলেও সেখানে খুবই কম সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। কিন্তু এই কিতাবটিও যথাযথভাবে পড়ানো হয় না। খারেজি ঘন্টায় ঐচ্ছিকের মতো পড়ানো হয়। শিক্ষার্থীরা ঠিকভাবে বুঝতে পারে না। অতএব, এটি শিক্ষার্থীর জন্য কোনও উপকার বয়ে আনে না। দারুল উলূম দেওবন্দ কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে মনোযোগ দেন এবং ১৪১৭ হিজরি থেকে বছরের শুরুতে ক্লাস শুরু হয় এবং এটিকে পৃথক ঘণ্টায় পড়ানো হয়। দারুল উলূমের এই উদ্যোগটি খুবই কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা গভীরভাবে পড়তে পারছে এবং পবিত্র কুরআনের নীতিমালা সম্পর্কে সুপরিচিত হতে পারছে। (আল-খাইর আল-কাসীর, পৃ. ২৪)।
আনন্দের বিষয় হলো, বর্তমানে আঞ্জুমানে ইত্তিহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ (কাওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড) এই কিতাবটিকে সেন্ট্রাল পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত করছে। আশা করি, তাতে এর প্রতি ছাত্র-শিক্ষকের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে, ইনশা আল্লাহ।
বস্তুতঃ “আল-ফাওযুল-কবীর” কিতাবটি এলোমেলোভাবে পড়া উচিত নয়। নীতিমালার কোনও বই এলোমেলোভাবে পড়া লাভজনক নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো—এই নীতিগুলো বাস্তবায়ন করা। এর মধ্যে সবচেয়ে মৌলিক বিষয় হলো কুরআনের আয়াতগুলোর শ্রেণিবিভাগ। শাহ সাহেব (রহ.) এগুলোকে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন: (১) বিধি-বিধান, (২) যুক্তি ও তর্ক, (৩) নেয়ামতের স্মরণ, (৪) ঘটনার বিবরণ, এবং (৫) মৃত্যু ও পরকালের স্মরণ।
আল-ফাওযুল-কাবীর এবং জালালাইন; উভয় কিতাবের পাঠদান একজন শিক্ষক করলে উপকার বেশি হয়। অন্যথায় কাঙ্ক্ষিত উপকার লাভ করা যায় না। যখন আল-ফাওযুল-কবীর শেষ হয় এবং জালালাইন শুরু হয়, তখন শিক্ষক ইঙ্গিত করবেন যে, এটি অমুক আয়াত এবং এটি অমুক আয়াত। তারপর সেই অনুযায়ী ব্যাখ্যা করবেন। উদাহরণস্বরূপ, বিধানের আয়াতে বলবেন, এই আয়াতে এই বিধান বলা হয়েছে, এর এই অংশটি কুরআনে রয়েছে, অপর অংশটি হাদীস কিংবা ইজমাতে রয়েছে, ইত্যাদি।
যুক্তি ও তর্কের আয়াতগুলোতে এটাও ব্যাখ্যা করবেন যে, মুশরিক, মুনাফিক, ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের এখানে অমুক ত্রুটি রয়েছে এবং সেখানে অমুক ত্রুটি রয়েছে। কুরআন তাদের জন্য যুক্তির ধরণ কী গ্রহণ করেছে? তা ছাত্রদেরকে বুঝিয়ে দেয়া।
আল-ফাওযুল-কাবীরে “শানে নুযূল”-এর আলোচনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি অবশ্যই ধীরে ধীরে, গভীর বোধগম্যতার সাথে পড়াতে হবে। প্রতিটি পাঠের পরে শিক্ষার্থীরা কী শিখেছে? তা তাদের কাছ থেকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা। এতে তারা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে কিনা তা মূল্যায়ন করা যায়।
আল-ফাওযুল-কবীরের পর, “মানাহিলুল- ইরফান” উচ্চতর তাফসীর বিভাগে পড়ানো হয়। এটি আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুল-আযীম যারকানী (রহ.)-এর বক্তৃতা সংকলন—যা তিনি আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করেছিলেন। এটি কোনও পাঠ্যপুস্তকের মতো নয়, এটি খুব দীর্ঘ। কখনও কখনও পড়তে পড়তে বিরক্ত হয়ে যায় ছাত্ররা। কিন্তু এটি খুবই কার্যকর। এর তিনটি অধ্যায় দারুল উলূম দেওবন্দে পড়ানো হয়। যদি শিক্ষকরা এই কিতাবটি ধারাবাহিকভাবে না পড়িয়ে; বরং যদি শিক্ষার্থী নিজে পড়ে প্রতিটি অধ্যায়ের সারাংশ লিখে, তারপর নিজস্ব ভাষায় ব্যাখ্যা করে, তাহলে সুবিধা দ্বিগুণ হতে পারে। যেসব শিক্ষক তাফসীরের নীতিমালা পড়ান, তাদের উচিত আল-ইতাকান, আল-বুরহান, আত-তিবইয়ান ইত্যাদি অধ্যয়নে রাখা।

মূল্যবান পরামর্শ:
হযরত মুফতী সাঈদ আহমাদ সাহেব পালনপুরী (রহ.)-কে “কুরআনের তাফসীরের পাঠদান” বিষয়ে কিছু বলতে বলা হলে তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন : শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষকমণ্ডলির কাছ থেকে যেভাবে শিখেছেন, সেইভাবেই পাঠদান করবেন। যার কাছে যে শিক্ষকের পদ্ধতি পছন্দ হয়, সে ওই শিক্ষকের পদ্ধতি অনুসরণ করে পাঠদার করবেন। তারপর তিনি বললেন, যে ‘মারজূহ’ অপছন্দের উক্তিগুলো ক্লাসে উপস্থাপন করা উচিত নয়। সবচেয়ে পছন্দের উক্তিটি নির্ধারণের জন্য আকাবিরের তাফসীরকে মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করা জরুরি। দক্ষতা বৃদ্ধির সর্বোত্তম উপায় হলো, শিক্ষার্থী নিজেই কিতাবটি সমাধান করবে এবং শিক্ষকের সামনে তা পড়ে শুনাবে। যদি সঠিক হয়, তাহলে শিক্ষক “হ্যাঁ” বলবেন, আর যদি ভুল হয়, তাহলে বলবেন, “উঁ..হোঁ..” এত জোরে বলবেন যে, শ্রেণিকক্ষে পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী থাকা সত্ত্বেও শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এই ভর্ৎসনা যেন পৌঁছে যায়।

মসজিদে মসজিদে দারসে কুরআনের ব্যবস্থা করা:
পবিত্র কুরআন যেমনি তেলাওয়াতের কিতাব, তেমিন এটি পথনির্দেশনারও কিতাব। আজ আমরা এটিকে কেবল তেলাওয়াতের কিতাব করে তুলেছি; যদিও উম্মাহর আলেমরা পবিত্র কুরআন বিশেষভাবে সাধারণ মানুষের জন্য অনুবাদ করেছেন, যখন ভাষা ছিল ফারসি, তখন হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ সাহেবই প্রথমে এটি ফারসি ভাষায় যথাযথভাবে অনুবাদ করেছিলেন, তারপর তাঁর পুত্ররা এটিকে উর্দু ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন।
হযরত শায়খুল-হিন্দ (রহ.) তাঁর সময়ের উর্দু ভাষায় শাহ আব্দুল কাদির সাহেবের অনুবাদকে সুন্দর ও সহজ করেছিলেন এবং হযরত মাওলানা শাব্বির আহমাদ উসমানী (রহ.)-এর ওপর একটি তাফসীর লিখেছিলেন। এই সবকিছুই সাধারণ মানুষের জন্য করা হয়েছিল। বর্তমানে এ সব বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অতএব, জনসাধারণের উচিত পবিত্র কুরআনের এই অনুবাদগুলো পড়া। মুসলমানদের দুঃখ, যন্ত্রণা, লঞ্চনা এবং বঞ্চনার অন্যতম কারণ হল পবিত্র কুরআন থেকে তাদের দূরত্ব। হযরত শায়খুল-হিন্দ (রহ.) যখন মাল্টা থেকে দেওবন্দে আসেন, তখন তিনি আলেমদের উদ্দেশ্যে বলেন:
“আমি মাল্টার কারাগার থেকে এই শিক্ষাটি নিয়ে এসেছি যে, আমার সমস্ত শক্তি দুটি কাজে ব্যয় হবে। একটি হল, গ্রাম থেকে গ্রামে, পাড়া থেকে পাড়ায় এবং ঘরে ঘরে কুরআন ছড়িয়ে দেওয়া, যাতে কোনও পুরুষ, মহিলা, শিশু বা বৃদ্ধ ব্যক্তি এর আক্ষরিক শিক্ষা ছাড়া না থাকে। এবং বড় মসজিদগুলোতে”কুরআনের দারস” অনুষ্ঠিত হতে হবে, যেন যেখানে জনসাধারণকে কুরআনের সহজ ব্যাখ্যা শেখানো যায়। দ্বিতীয়ত, পারস্পরিক লড়াই ও মতবিরোধ কোনভাবেই সহ্য করা যাবে না।” (আল-খাইরুল-কাসীর, পৃ. ১৮)
বর্তমানে “দরসে কুরআন”-এর মাধ্যমে সাধারণ মুসলমানদের কুরআনের বিষয়গুলোর সাথে পরিচিত করা প্রয়োজন, বিশেষ করে সেইসব আয়াতের মাধ্যমে যেগুলোতে আল্লাহর অনুগ্রহের কথা, সৃষ্টিজগত, প্রাণীজগত ও চিন্তাভাবনাকে উৎসাহিত করে। নবীদের গল্প, অবাধ্যদের শাস্তির গল্প, সাধারণ উপদেশ, শিক্ষণীয় আয়াত, সাধারণ মুসলমানদেরকে এই পৃথিবীর ধ্বংস এবং আখেরাতের স্থায়ীত্ব, কবর, পুনরুত্থান, জান্নাত ও জাহান্নাম সম্পর্কিত আয়াতগুলোর অর্থ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য এবং তাদের মৃত্যু এবং পরবর্তী পুরস্কার ও শাস্তির কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য দারসে কুরআনের ব্যবস্থা করা অতি প্রয়োজন। যদি মসজিদে “দরসে কুরআন”-এর মজলিস অনুষ্ঠিত হত, তাহলে জনসাধারণ ও আলেমদের মাঝে আরো ঘনিষ্ঠতা তৈরি হত, শরীয়া অনুযায়ী জীবনযাপনের ইচ্ছা তৈরি হত, কুরআনের ওপর গোটা জাতি ঐক্যমত্য গঠিত হত। এতে সমাজ কুরআনের আলোকসজ্জায় আলোকিত হত।

দরসে কুরআনের ধরণ:
“দরসে কুরআন”-এর ধরণ খুবই সহজ ও সরল রাখতে হবে, যার সাথে সাধারণ মানুষ পরিচিত, শব্দগুলো সম্পূর্ণরূপে জনসাধারণের জন্য ব্যবহার করতে হবে। জটিল জটিল আকিদার কথা, নতুন রীতিনীতির আলোচনা পরিহার করতে হবে। সমাজ সংস্কার, সৎকর্মকে উৎসাহিত করণঃ এবং সততা ও নৈতিকতার প্রতি জোর দিতে হবে, যাতে জনসাধারণের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করা যায়। আজকাল মানুষের ব্যস্ততা অনেক বেড়ে গেছে; অতএব, পনেরো থেকে বিশ মিনিটের বেশি সময় নেওয়া উচিত নয়; পরামর্শক্রমে সবার জন্য সুবিধাজনক হয় এমন একটি সময় নির্ধারণ করা। কুরআনে কারো জন্য নিজস্ব মতামত প্রকাশ করার অধিকার নেই, বরং সঠিক চিন্তাভাবনাসহ আলেমদের কাছ থেকে এমন বিষয়গুলো জেনে নিবেন, যা তাদের বোধগম্য নয়। এইভাবে, সাধারণ মুসলমানরা কুরআনের আরও কাছাকাছি আসতে থাকবে এবং পবিত্র কুরআন তাদের জীবনের জন্য একটি পথনির্দেশক গ্রন্থ হিসেবে প্রমাণিত হবে।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক, উচ্চতর তাফসীর গবেষণা বিভাগ
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ