বুধবার-২১শে রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি-১৫ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

হজের বিধান ও আল্লাহ তাআলার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ

আল্লামা মুফতী আবু তাহের কাসেমী নদবী

আমরা আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করছি। দুরুদ পাঠ করছি তার দয়ালু রাসূল ﷺ-এর প্রতি। হামদ ও সালাতের পর…
হে মুসলিম উম্মাহ!
হজ ও তার প্রতিটি বিধান—হোক তা ফরয, ওয়াজিব কিংবা সুন্নাত, মুস্তাহাব যেমন, এহরাম, তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ার সায়ি, আরাফাহ-মুযদালিফায় অবস্থান, পাথর নিক্ষেপ, হাজারে আসওয়াদ চুমু, কোরবানি ও যমযমের পানি পান করাসহ সবগুলো ইবাদতই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বান্দা কর্তৃক আল্লাহ তাআলার প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হযরত ইবরাহীম আ. ও ইসমাইল আ.-এর আত্মোৎসর্গ ও বিলীনতার স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক নিদর্শন।
ইবরাহীম আ. থেকে আল্লাহ তাআলা নানা ধরনের পরীক্ষা নিয়েছেন। সবগুলো পরীক্ষায় তিনি বিশেষভাবে কৃতকার্যও হয়েছেন। প্রথম পরীক্ষা ছিল, পিতা ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকরণ ও ভ্রান্ত ধর্ম, ভ্রান্ত উপাস্য এমনকি তার সমসাময়িক মুশরিক বাদশা নমরুদের সাথে মোকাবেলা। এটি সম্ভব হয়েছে আল্লাহর ভালোবাসা ও সরল-সঠিক দীনের প্রতি প্রগাড় মহব্বতের কারণে। আল্লাহর ভালোবাসার সামনে তিনি আগুনে নিক্ষেপিত হতেও ভয় পাননি। তাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এবং আল্লাহর নির্দেশে সে আগুন আরামদায়ক শীতলরূপ ধারণ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আমি বললাম, হে আগুন! ইবরাহীমের জন্য তুমি আরামদায়ক ঠাণ্ডা হয়ে যাও।”
দ্বিতীয় পরীক্ষা ছিল, আল্লাহর মহব্বতে শাম দেশে হিজরত করা। তিনি ইরাক ছেড়ে স্ত্রী সারা ও ভ্রাতুষ্পুত্র লুত আ.-কে নিয়ে শামে হিজরত করেন। মাঝপথে মিসরের অত্যাচারী বাদশার মুখোমুখি হন । এবং শামকে নিজের আবাসভূমি বানিয়ে নেন।
তৃতীয় পরীক্ষা ছিল বিবি হাজেরা ও হযরত ইসমাইল আ.-এর ব্যাপারে। (হাজেরা ইবরাহীম আ. এর দ্বিতীয় স্ত্রী। মিসরের অত্যাচারী বাদশার পক্ষ থেকে তাকে উপঢৌকনস্বরূপ দেওয়া হয়েছিল। হযরত ইসমাইল আ. তারই গর্ভজাত।) আল্লাহ তাআলার নির্দেশ ছিল, তিনি যেন তাদের নিয়ে এক অজানা দেশে হিজরত করেন। এই সন্তান ছিল তাঁর প্রার্থনার ফসল। তিনি তখন শেষ বয়সে পৌঁছে গেছেন । আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করলেন, “হে আল্লাহ! আমাকে একটি নেককার সন্তান দান করুন।” (আল্লাহ তাআলা সেই সন্তান দান করলেন।) তিনি সেই সন্তান ও তার মাকে নিয়ে সফর করলেন পাহাড়ি বিরান মরু-ময়দানে। সঙ্গে জিবরাইল আ.। বাইতুল্লহার পাশে যেই স্থান—যেখানে কোনো ক্ষেত-খামার নেই। তাদেরকে রেখে এলেন সেখানে। কোনো পানি নেই। মানুষ নেই। জীবনোপকরণ নেই । এবং সাথে-সাথেই তিনি শামে ফিরে এলেন । সন্তান ও স্ত্রীর ব্যাপারে কোনো চিন্তা করলেন না। আল্লাহর ভালোবাসার সামনে তাদের জীবন-মৃত্যু নিয়ে একটুও ভাবলেন না। এরপর হাজেরা আ. ও ইসমাইল আ.-এর সাথে যা ঘটার তাই ঘটল । হাজেরা আ. সাফা-মারওয়ায় দৌড়ালেন। ইসমাইল আ. এর পায়ের কাছে আল্লাহ তাআলা জমজম কূপ দান করলেন।
চতুর্থ পরীক্ষা ছিল, আল্লাহর ভালোবাসা ও পুত্রের ভালোবাসার মাঝে তুলনার। ইতিহাসে এক নজিরবিহীন পরীক্ষা। মানুষ মানবতা ও পৃথিবীর ইতিহাসে যার দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। পিতার হাতে পুত্রকে জবাই করার পরীক্ষা। এমন সময়, যখন পিতার হৃদয়ে সন্তানের ভালোবাসা গভীরতা লাভ করে। যখন বৃদ্ধ বয়সে পিতা সন্তানের মুখোপেক্ষী হতে শুরু করে। এমন সন্তান যে ছিল শেষ বয়সের প্রার্থনার ফসল। আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعۡیَ قَالَ یٰبُنَیَّ اِنِّیۡۤ اَرٰی فِی الۡمَنَامِ اَنِّیۡۤ اَذۡبَحُكَ فَانۡظُرۡ مَاذَا تَرٰی ؕ قَالَ یٰۤاَبَتِ افۡعَلۡ مَا تُؤۡمَرُ ۫ سَتَجِدُنِیۡۤ اِنۡ شَآءَ اللّٰهُ مِنَ الصّٰبِرِیۡنَ ﴿﴾ فَلَمَّاۤ اَسۡلَمَا وَ تَلَّهٗ لِلۡجَبِیۡنِ ﴿﴾ۚ وَ نَادَیۡنٰهُ اَنۡ یّٰۤاِبۡرٰهِیۡمُ ﴿﴾ۙ قَدۡ صَدَّقۡتَ الرُّءۡیَا ۚ اِنَّا كَذٰلِكَ نَجۡزِی الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿﴾
‘অতঃপর সে পুত্র যখন ইবরাহীমের সাথে চলাফেরা করার উপযুক্ত হল, তখন সে বলল, বাছা! আমি স্বপ্নে দেখছি যে, তোমাকে যবেহ করছি। এবার চিন্তা করে বল, তোমার অভিমত কী। পুত্র বললো, আব্বাজী! আপনাকে যার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে আপনি সেটাই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে সবরকারীদের একজন পাবেন। সুতরাং (সেটা ছিল এক বিস্ময়কর দৃশ্য) যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং পিতা-পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিল। আর আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। নিশ্চয়ই আমি সৎকর্মশীলদেরকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি।’ [সাফ্ফাত: ১০২-১০৫] এভাবেই আল্লাহ তাআলা তাঁকে সুন্দর সূচারুরূপে সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করেছেন ।
আমি অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। ‘এবং (সেই সময়কে) স্মরণ করো, যখন ইবরহিমকে তাঁর প্রতিপালক কয়েকটি বিষয় দ্বারা পরীক্ষা করলেন এবং সে তা সব পূরণ করল। আল্লাহ (তাকে) বললেন, আমি তোমাকে সমস্ত মানুষের নেতা বানাতে চাই। ইবরাহীম আ. বললো, আমার সন্তানদের মধ্য হতে? আল্লাহ বললেন, আমার (এ) প্রতিশ্রুতি জালিমদের জন্য প্রযোজ্য নয়।’ [বাকারা: ১২৪]
আল্লাহ তাআলা আমাকে এবং আপনাদেরকে কুরআনে কারীমের মাধ্যমে বরকত দান করুন, বর্ষণ করুন কল্যাণের ফল্গুধারা। কুরআনের প্রজ্ঞাপূর্ণ আয়াত দ্বারা আমাকে এবং আপনাদেরকে উপকৃত করুন। কারণ তিনিই দাতা, মহানুভব, অধিপতি, পরম দানশীল, দয়ালু ও করুণাময়।

লেখক : মহাপরিচালক, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম।
সূত্র : লেখকের খুতবা সংকলন ‘মিম্বরের আহ্বান’ : পৃ. ১৯৬-১৯৭ অবলম্বনে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ