সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের উত্তরে অবস্থিত সাইদনায়া কারাগার দীর্ঘদিন ধরে স্বৈরশাসনের এক নির্মম প্রতীক। বিশেষত ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধের পর এই কারাগার রূপ নেয় এক ভয়াল মৃত্যুক্যাম্পে, যেখানে রাজনৈতিক বন্দিদের ওপর চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন, ধর্ষণ ও গণহত্যা। তুরস্কভিত্তিক সংস্থা ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ডিটেনিজ অ্যান্ড মিসিং পারসনস অব সাইদনায়া (এডিএমএসপি)’ এই নির্যাতনের বিস্তৃত দলিল ও সাক্ষ্য সংগ্রহ করেছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে দামেস্ক মুক্ত হওয়ার পর মুজাহিদদের হাতে কারাগারটি উন্মুক্ত হলে বেরিয়ে আসে ইতিহাসের এক বিভীষিকাময় অধ্যায়।
বন্দীদের অধিকাংশই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে, বহু নারী যৌন সহিংসতার শিকার হয়ে জন্ম দিয়েছেন পরিচয়হীন সন্তানের। অজস্র লাশ পাওয়া গেছে ফ্রিজার ও এসিডে গলানো অবস্থায়। কারো হাড়গোড়ই কেবল বাকি, কারো অঙ্গহানি হয়েছে চিরতরে। সাইদনায়া কারাগার কেবল একটি কারাগার নয়, এটি এক জাতিগত ও মানবিক বিপর্যয়ের জীবন্ত স্মারক। এই অনুবাদ-রচনাটি সেই ভয়াবহ নির্যাতনের নীরব সাক্ষ্য—যা ভুলে গেলে আবারও এমন ইতিহাস ফিরে আসতে পারে।
মুহাম্মাদের জবানবন্দী
আমার বন্দীত্বের স্মৃতিগুলো যখন লেখার চেষ্টা করি, তখন একটি গল্পের কাছে এসে থমকে যাই। এটি এমন একটি ঘটনা, যা আমার মুক্তির চার কিংবা পাঁচ মাস আগে ঘটেছিল। সেদিন আমার নাম ধরে ডাকা হলো। ভাবলাম, এটি হয়তো আরেকটি নির্যাতনের দিন। “সোয়েটারটা মাথায় চাপিয়ে নাও!” তাদের নির্দেশে মাথার ওপর টেনে দিলাম সেই সোয়েটার। এরপর শুরু হলো সেই অবমাননাকর বাক্যবাণ :
“চল, হারামজাদার বাচ্চা! মায়ের জন্য বাঁচার শখ তো? আজ বুঝবি মায়ের দুআর দাম। তোমার বউ কি এসেছে দেখা করতে? মনে রেখ, গতকাল রাতেই হয়তো সে তোমার ভাইয়ের সঙ্গে ছিল!”
এই অশ্রাব্য ভাষার সঙ্গে চলতে থাকে বেধড়ক মার আর লাথি। গন্তব্য সেই নাপিতের ঘর। সেখানে পৌঁছে হাঁটু মুড়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে বসতে বাধ্য করে। মাথার ওপর তখনও সোয়েটার ঢাকা। তারপর শুরু হয় রক্ষীদের নির্মম খেলা। “মাটিতে লুটিয়ে পড়ো! হাঁটু গেঁড়ে বসো!”—এইসব হুকুমের মধ্যেই চলতে থাকে লাথি, পায়ের তলায় পিষে ফেলা, আর লোহার নল দিয়ে পেটানো। সেই নলকে তারা ডাকে “গ্রিন ব্রাহিমি।”
নাপিতও কোনো দয়া দেখায় না। তার কাজ কেবল চুল কাটা নয়। মুখের ওপর আঘাত করা তার শেভিং মেশিন দিয়ে। এমন নির্যাতনে দেহ ক্ষত-বিক্ষত, আত্মা যেন প্রতিনিয়ত টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সেই মুহূর্তগুলো মনে পড়লে বুকের ভেতর এক ধরনের ভারি বোঝা নেমে আসে। মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে সেই অপমান আর অত্যাচারের স্মৃতি। সেদিন যেন কেবল দেহ নয়, ভেঙে দেওয়া হয়েছিল আত্মসম্মান, মনুষ্যত্ব আর সব ধরনের অনুভূতির শেষ অবশিষ্টটুকু।
সেদিন সোয়েটারের ভেতর দিয়ে কিছুটা দেখতে পাচ্ছিলাম। নাপিতের ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ল মাঝখানে একজন পড়ে আছে। ভীষণ রুগ্ন। যেন কেবল হাড় আর চামড়ার এক অবয়ব। প্রথমে বুঝতে পারিনি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে দুঃস্বপ্নের মতো ধারণা এলো—এ কি আমার ছোট ভাই আহমাদ? পরিবারের প্রিয়তম। আদরের ছোট্ট ভাই। শরীরের গড়ন চেনা মনে হলেও, তার এই দুরাবস্থা দেখে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে মনে দুআ করলাম—হে আল্লাহ, এটা যেন সে না হয়।
কিন্তু হঠাৎ, যখন তাকে কষ্টে গোঙ্গাতে শুনলাম, তখন নিশ্চিত হলাম। আমার ভাই। আমার আদরের আহমাদ।
আমার মুখ তখন দেয়ালের দিকে। নাপিত-সাজা সেই রক্ষী ডাক দিল। কিছু চুল কেটে কিছু রেখে দিল, গোঁফের এক পাশ ছেঁটে আরেক পাশে হাত দিল না। যেন নিছক বিনোদনের খেলা। চোখ খুলতে পারছিলাম না। জানতাম, চোখ খুললেই শেভিং মেশিন দিয়ে চোখে আঘাত করবে। কাজ শেষ হলে আমাকে লাথি মেরে আবার জায়গায় পাঠাল। ততক্ষণে তাদের একজন আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করল, “এই জানোয়ারটাকে মাঝখানে শুইয়ে রেখেছ কেন? ওকে নিয়ে গিয়ে আবর্জনায় ফেলে দাও!”
এরপর নাম ডাকার পালা শুরু হলো। পরিবারের সঙ্গে দেখা করার জন্য বন্দীদের নাম ধরে ডাকা হচ্ছিল। একজন এসে আমার ভাইয়ের নাম বললো, কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। তখন আরেকজন বললো, “ওই মাঝখানে শুয়ে থাকা জানোয়ারটা কি ওই মাগীর বাচ্চা?” ওরা বিষয়টা হেসে উড়িয়ে দিল। এরপর যখন আমার নাম ডাকা হলো, তখন তারা খেয়াল করল নামের মিল। একজন এসে জিজ্ঞেস করল, “এই মাগীর বাচ্চা তোমার ভাই? চল, জানোয়ার! নিজের ভাইকে টেনে নিয়ে যাও।”
তড়িঘড়ি ছুটে গেলাম। ভয়ে, উত্তেজনায় কাঁপতে থাকা হাত বাড়ালাম তাকে ধরতে। জড়িয়ে ধরতে চাইলাম। তাকে আড়াল করতে চাইলাম নিজের শরীর দিয়ে। ততক্ষণে তার হালকা ওজন বোঝা সহজ হলো। আমি নিজেও তখন দুর্বল। ক্ষুধায় কঙ্কালসার। কিন্তু আমার ভাই—তার ওজন যেন বাতাসের মতো হালকা।
সে ফিসফিস করে বললো, “ভাই, আমি আর পারছি না।” আমি কী বলবো জানতাম না। কেবল বললাম, “ধৈর্য ধরো… আল্লাহ সহায় হবেন।”
রক্ষীরা হাসতে হাসতে আমাদের দেখে মজা নিল। একের পর এক লাথি মেরে, আঘাত করে তারা আমাদের নিয়ে চলল। একসময় নির্দেশ দিল, “এখানেই ফেলে দাও!” আমি তাকে মেঝেতে শুইয়ে দিলাম। এটিই ছিল তার সঙ্গে আমার শেষ স্পর্শ।
আমাকে সরিয়ে তাকে নিয়ে গেল কক্ষের ভেতর। এরপরের গল্পটি শুনেছি আমার মা আর বোনের কাছ থেকে।
দুই রক্ষী মিলে তাকে টেনে নিয়ে যায়। কারণ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছিল না সে। দেয়ালের জালের সঙ্গে তাকে ঠেস দিয়ে রাখা হয়। এক রক্ষী তার পেছন থেকে ধরে। বোন তাকে দেখে চমকে উঠে বলে, “এ কেমন চেহারা! এর পরিবার তাকে কীভাবে চিনবে?” মা তাকে দেখে শিউরে ওঠেন। বলেন, “হায় আল্লাহ! কোনো মা কি এ দৃশ্য সহ্য করতে পারবে?”
তখনই রক্ষীরা নাম ডেকে বলে, “এই তোমার ছেলে!”
মা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। “অসম্ভব!”—বলে চিৎকার করেন। কথা বলতে পারেনি আমার ভাই। তাকে টেনে বের করে রক্ষীরা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে বলে, “পরেরজনের পালা!”
আমাকে দেখা করতে ডাকা হলো। মনে শক্তি জোগাড় করার চেষ্টা করলাম। সামনে রক্ষী, পেছনে রক্ষী। ডানে-বামে ঘিরে আছে। জালের ওপারে আমার পরিবার। কেবল সংক্ষিপ্ত কথা বলা সম্ভব: “তোমরা কেমন আছ? আমার জন্য কিছু কাপড় আনবে?”
দেখা শেষে বের হয়ে আসতেই একজন আমাকে বললো, “ওই হারামজাদা! নেমে সেজদা দাও।”
আমার দিকে এগিয়ে এলো আরেকজন। দলপতির মতো দেখতে। তার সঙ্গে আরও দশজন। সে জিজ্ঞেস করল, “এই জানোয়ারটা কে?” আরেকজন উত্তর দিল, “ও আপন অভিনয় করছে, যেন অসুস্থ!”
“ওকে কেমন করে শাস্তি দেওয়া যায়? নাহ, কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস দিই।”
তারপর শুরু হলো সেই নিষ্ঠুর খেলা, যেখানে আর কোনো আশা অবশিষ্ট ছিল না। আমার ভাইকে চিৎ করে শুইয়ে দিল। একজন রক্ষী তার শরীরের ওপর উঠল। তারপর শুরু করল লাফিয়ে তার ঘাড়ে পড়া। সেই মুহূর্তের প্রতিটি শব্দ যেন আজও আমার মনে দগদগে। প্রত্যেক লাফের পর তার শ্বাস নেওয়ার কষ্টমাখা শব্দ, সেই তীব্র গোঙানি—সব যেন কানে বাজে।
রক্ষীরা লাফানোর ফাঁকে জিজ্ঞাসা করল, “শ্বাস নিচ্ছিস?” আহমাদ উত্তর দিল, “না।” রক্ষী হেসে বললো, “ওরে! এর বুকে হয়তো হাড়গুলো ফেটে গেছে। ফুসফুসে হয়তো সমস্যা আছে।” তারপর তারা লাফিয়ে চলল একের পর এক। মাঝে মাঝে লাথি। আহমাদ তখন আর কিছু বলতে পারছিল না। কেবল অস্পষ্ট গোঙানি আর কষ্টমাখা শ্বাস।
যখন তার শরীর থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করল, একজন রক্ষী বললো, “ওই হারামজাদা আমাকে রক্তে ভাসিয়ে দিচ্ছে!” আমি তখনও সেজদায়। একজন রক্ষীর বুটের পায়ের নিচে আমার মাথা। তাদের প্রতিটি বাক্যে পায়ের চাপে আরও গভীর হয় সেই অপমান। একসময় বললো, “তৈরি থাক! তোর পালা আসছে।”
এমন মুহূর্তে মানুষ কী করতে পারে? আমি আমার ভেতরে বলতে থাকলাম, “হে আল্লাহ! এ তোমার বিচার! আমি এটা মেনে নিয়েছি।”
একসময় একজন রক্ষী এলো। তার পদমর্যাদা যেন বাকিদের চেয়ে বেশি। সে জিজ্ঞাসা করল, “কী ব্যাপার?” কেউ একজন উত্তর দিল, “মরে গেছে।” সে আদেশ দিল, “নিয়ে যা।”
তারা কিছুক্ষণ ফিসফিস করল। তারপর বললো, “আর এইটাকে (আমাকে) ফেরত নিয়ে যা।” এরপর তারা আমাকে আমার কক্ষে ফিরিয়ে নিয়ে গেল।
সেটা ছিল এমন এক দিন, যা আমার অস্তিত্বের প্রতিটি অংশকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। যা আজও আমার স্মৃতিতে রয়ে গেছে কেবল অপমান আর অসহায়তার এক অধ্যায় হয়ে।
অনুবাদ : কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক