হাফেজ মুহাম্মদ জাফর সাদেক
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
لَعَنَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم الْمُخَنَّثِينَ مِنَ الرِّجَالِ، وَالْمُتَرَجِّلَاتِ مِنَ النِّسَاءِ، وَقَالَ: أَخْرِجُوهُمْ مِنْ بُيُوتِكُمْ، قَالَ: فَأَخْرَجَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فُلَانًا، وَأَخْرَجَ عُمَرُ فُلَانًا.
রাসূলুল্লাহ ﷺ নারীরূপ ধারণকারী পুরুষদের ওপর এবং পুরুষরূপ ধারণকারী নারীদের ওপর লানত করে বলেছেন, তাদেরকে তোমাদের ঘর থেকে বের করে দাও। বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম অমুককে (তাঁর ঘরে আসলে) বের করে দিয়েছেন এবং অমুককে উমর রা. বের করে দিয়েছেন।
প্রেক্ষাপট: ট্রান্সজেন্ডারবাদ (Transgendarism) বা রূপান্তরকামিতা। অনেকে এটাকে ‘জেন্ডারআইডেন্টিটি’ বা লিঙ্গ পরিচয় মতবাদও বলে থাকেন। সম্প্রতি পশ্চিমাবিশ্বের ওপর রাজত্ব করেছে অদ্ভূত ও অভিশপ্ত এ মতবাদ। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ২০১৫ এর পর থেকে পশ্চিমা দাতারা ক্রমেই ট্রান্সজেন্ডার প্রসারে তৎপরতা শুরু করে। এবং ওই বছরই সামাজিকীকরণের অংশ হিসেবে মোট চৌদ্দজন হিজড়াকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে চাকরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। প্রাথমিক বাছাইয়ের পর মেডিক্যাল টেস্টে দেখা যায় ১২ জনের মধ্যে ১১ জনেরই লিঙ্গ ইত্যাদি আছে। তারা সুস্থ স্বাভাবিক পুুরুষ। বাকি একজনও জন্মগতভাবে সুস্থ ও স্বাভাবিক পুরুষ ছিল। এই পরীক্ষার দুই বছর আগে স্বেচ্ছায় সার্জারি করে নিজের লিঙ্গ আর অন্ডকোষ অপসারণ করেছে সে…
শুধু তাই নয়, ২০২৩ সালে আইন করে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষার নামে আইনের খসড়াও প্রণয়ন হয়ে গিয়েছে। ২০২৪ সালে মার্কিন সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে বিরোধী দলীয় নেতা এবং ফ্লোরিডা রাজ্যের গভর্ণর রনডি স্যান্টিস বলেছেন, বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডারবাদ প্রসারের জন্য লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ করেছে। এটা আমেরিকান জনগণের দেওয়ার ট্যাক্সের অপচয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়ও পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে ট্রান্সজেন্ডারবাদ ও অবাধ যৌনতার বিষয়টি নরমালাইজ করা হয়েছে। এ নিয়ে তখন বেশ আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছিল। এমনকি মিডিয়া জগতেও ট্রান্সজেন্ডারবাদকে তুলে ধরা হচ্ছে ইতিবাচকভাবে। নিউজ মিডিয়াতে আসছে নানা প্রতিবেদন।
৫ আগষ্টের পরের যে সরকার এসেছে তা অনেকটা এনজিওকেন্দ্রিক। এ সরকারের টপ টু বাটম ট্রান্সজেন্ডারবাদের প্রচারক কিংবা নরমালাইজ করার অ্যাজেন্ডা হাতে নিয়েই যেন মাঠে নেমেছে। শব্দের মারপ্যাচে নারী-পুরুষ শব্দ ব্যবহার না করে জেন্ডার বলা বা ইন্ক্লুসিভ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার হয়ে আসছে। সম্প্রতি ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ট্রান্সজেন্ডার মো. মুহিন ওরফে মোহনার মতো একজন বায়োলজিকাল মেইলকে ‘অদম্য নারী’ হিসেবে উপস্থাপন করে পুরো নারী জাতিকে কলঙ্কিত করেছে এবং প্রধান উপদেষ্টাসহ রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের হাতে তাকে ‘অদম্য নারী’ পুরস্কার দিয়ে ট্রান্সজেন্ডারবাদকে স্বীকৃতি দেওয়ার কার্যক্রম অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে।
এরপর বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গঠিত ১২ টি সংস্কার কমিশনের অন্যতম একটি সংস্কার কমিশন হলো ‘নারী সংস্কার কমিশন’। গত ১৯ এপ্রিল ২০২৫ খ্রি. তারিখে তারা অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে ৩১৮ পৃষ্ঠাব্যাপী এক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। বিশাল এই সংস্কার প্রতিবেদনের প্রায় পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে সরাসরি কুরআন-হাদীস বিরোধীতা ও পশ্চিমা এলজিবিটি প্রতিষ্ঠার অ্যাজেন্ডা।
শাব্দিক বিশ্লেষণ:
الْمُخَنَّثِينَ (আল-মুখান্নাসিন) অর্থ: নারীর মতো আচরণকারী পুরুষরা। এই শব্দটি এমন পুরুষদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয় যারা নারীর পোশাক, আচরণ, কণ্ঠস্বর বা চলাফেরা অনুকরণ করে। ইসলামে পুরুষের এমন আচরণকে নিষেধ করা হয়েছে এবং রাসূল (সা.) এদের লানত ও অভিসম্পাত করেছেন।
الْمُتَرَجِّلَاتِ (আল-মুতারাজ্জিলাত) অর্থ: পুরুষের মতো আচরণকারী নারীরা। এই শব্দটি এমন নারীদের বোঝায় যারা পুরুষের মতো পোশাক পরে, তাদের মতো আচরণ করে বা নিজেদেরকে পুরুষ হিসেবে প্রকাশ করে। ইসলামী শরীয়তে এ বিষয়ক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) এ ধরনের নারীদেরও নিন্দা ও লানত করেছেন।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা:
বর্তমান ট্রান্সজেন্ডারবাদের বিরুদ্ধে আলোচিত হাদীসটি কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। বর্তমান ট্রান্সজেন্ডারবাদের দাবি হলো, “জন্মগত দেহ যা-ই হোক না কেন, নিজেকে যে নারী দাবি করবে তাকে নারী বলে মেনে নিতে হবে, নিজেকে যে পুরুষ দাবি করবে তাকে মেনে নিতে হবে পুরুষ বলে, আইনী ও সামাজিকভাবে। মানুষ ইচ্ছেমতো পোশাক পরবে, ইচ্ছেমতো ওষুধ আর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বদলে নেবে নিজের দেহকে। আর কেউ যদি অস্ত্রোপচার না করেই নিজেকে বিপরীত লিঙ্গের বলে দাবি করে, তাও মেনে নিতে হবে মুখ বুজে। রাষ্ট্র ও সমাজ কোনো বাধা দিতে পারবে না, বরং ‘সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী’ হিসেবে এ ধরনের মানুষকে দিতে হবে বিশেষ সুবিধা। সেই সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একদম ছোটবেলা থেকে সবাইকে শেখাতে হবে যে, মানুষের মনটাই গুরুত্বপূর্ণ; দেহ না।”
যারা এধরণের লিঙ্গ পরিবর্তনের দাবি করে তথা পুরুষ নিজেকে নারী দাবি করে এবং নারী নিজেকে পুরুষ দাবি করে, এমন লোকদের সম্পর্কে কুরআন-হাদীসে ভয়াবহ পরিনতি ও ধমকি রয়েছে। অপর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে—
لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الْمُتَشَبِّهِينَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ، وَالْمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ.
“রাসূলুল্লাহ ﷺ ওইসব পুরুষকে লানত করেছেন, যারা নারীর বেশ ধারণ করে এবং ওইসব নারীকে লানত করেছেন, যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে।”
আরেক হাদীসে এসেছে, আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَعَنَ الرَّجُلَ يَلْبَسُ لِبْسَةَ الْمَرْأَةِ، وَالْمَرْأَةَ تَلْبَسُ لِبْسَةَ الرَّجُلِ.
“রাসূলুল্লাহ ﷺ লানত করেছেন এমন পুরুষের ওপর, যে নারীর মতো পোশাক পরিধান করে এবং এমন নারীর ওপর, যে পুরুষের মতো পোশাক পরিধান করে।”
ইসলামী শরীয়াতে যেখানে পুরুষকে নারীর পোশাক পরতে নিষেধ করা হয়েছে, নারীকে পুরুষের বেশ-ভূষা গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে, সেখানে ট্রান্সজেন্ডারবাদ তো এর চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ। এ মতবাদ শুধু পোশাক আর বেশভূষা পরিবর্তন নয়, গোটা পরিচয়ই পাল্টে দিতে বলছে। আপাদমস্তক পুরুষকে বলা হচ্ছে নারী! আপাদমস্তক নারীকে বলা হচ্ছে পুরুষ! কত মারাত্মক বিকৃতি!!
এ ছাড়া পরিবার ও সংসারেও দেখা দিবে চরম বিশৃঙ্খলা। কে পিতা, কে মাতা, কে ভাই, কে বোন—তা নিয়েই তৈরি হবে অনিঃশেষ জটিলতা। এতদিন ধরে যিনি পিতা ছিলেন, হঠাৎ তিনি নারী হয়ে গেলে, তেমনিভাবে এতদিন ধরে যিনি মা ছিলেন, হঠাৎ তিনি পুরুষ হয়ে গেলে পরিবার ও সংসারের কী হবে!!
এ মতবাদ সমাজে স্থান পেলে শুধু যিনা-ব্যভিচারই নয়, যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণও অতি সহজে সমাজে ছড়িয়ে পড়বে। কোনো নারী নিজের সমলিঙ্গের মনে করে নারীরূপী কোনো পুরুষের সাথে থাকলে তার কাছ থেকে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া একেবারেই স্বাভাবিক। অসৎ লোকেরা ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের উদ্দেশ্যে সহজে নারীদের কাছে পৌঁছার জন্য এই পথ বেছে নেবে। ফলে সমাজে নারীদের জন্য নিরাপদ স্থান পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
ট্রান্সজেন্ডারবাদে আল্লাহর দেওয়া শরীয়ত ও কুরআন-সুন্নাহর অসংখ্য বিধানের স্পষ্ট বিরুদ্ধাচরণ রয়েছে। এর মাধ্যমে ইসলামের নামায, হজ্ব, বিয়ে, তালাক, ইদ্দত, বংশপরিচয়, পর্দা-সতর, শাহাদাহ (সাক্ষ্যদান), কাযা, ইমামাত (নামাযের ইমামতি) ও মীরাস-উত্তরাধিকারসহ নারী-পুরুষ সংক্রান্ত কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামের বহু বিধান সরাসরি লঙ্ঘিত হয়।
এর দ্বারা কুরআন কারীমের এক-দুটি আয়াত নয়; বরং দু’শরও অধিক আয়াতের বিরুদ্ধাচরণ করা হবে। এমনিভাবে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ ﷺ-এর শত শত হাদীসেরও বিরুদ্ধাাচরণ হবে। তাছাড়া এটি হবে সকল নবী, রাসূল, সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীসহ সকল মুমিন-মুসলিমের পথ তথা জান্নাতের পথ ছেড়ে অভিশপ্ত শয়তানের পথ তথা জাহান্নামের পথ অবলম্বন।
ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী বিবাহ হবে নারী ও পুরুষের মাঝে। কিন্তু এ মতবাদ মেনে নিলে একজন ট্রান্সনারী (বাস্তবে পুরুষ) অপর পুরুষকে বিবাহ করার সুযোগ পাবে। অনুরূপভাবে একজন ট্রান্সপুরুষ (বাস্তবে নারী) অপর নারীকে বিবাহ করার সুযোগ পাবে। পুরুষে পুরুষে বিয়ে বা নারীতে নারীতে বিয়ে তো স্পষ্ট সমকামিতা।
শরীয়ত মোতাবেক একজন নারীর জন্য একসঙ্গে একাধিক স্বামী রাখার অনুমতি নেই। অথচ এ মতবাদ মেনে নেয়া হলে একজন ট্রান্সপুরুষের (বাস্তবে নারী) একাধিক ট্রান্সনারীকে (বাস্তবে পুরুষ) বিয়ে করার সুযোগ তৈরি হবে।
তাছাড়া এটি আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির সাথে সরাসরি বিদ্রোহ ও চরম পর্যায়ের সীমালঙ্ঘন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿وَلَأُضِلَّنَّهُمْ وَلَأُمَنِّيَنَّهُمْ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُبَتِّكُنَّ آذَانَ الْأَنْعَامِ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللَّهِ ۚ وَمَن يَتَّخِذِ الشَّيْطَانَ وَلِيًّا مِّن دُونِ اللَّهِ فَقَدْ خَسِرَ خُسْرَانًا مُّبِينًا﴾
“আমি তাদেরকে সরল পথ হতে নিশ্চিতভাবে বিচ্যুত করব, তাদেরকে (অনেক) আশা-ভরসা দেব এবং তাদেরকে আদেশ করব, ফলে তারা চতুষ্পদ জন্তুর কান চিরে ফেলবে এবং তাদেরকে আদেশ করব, ফলে তারা আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবর্তে শয়তানকে বন্ধু বানায়, সে সুস্পষ্ট লোকসানের মধ্যে পড়ে যায়।”
আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাজত করুন। আমীন।
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।