বুধবার-২১শে রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি-১৫ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শরীয়তের দৃষ্টিতে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা

শরীয়তের দৃষ্টিতে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা

[মাওলানা সাদ সম্পর্কিত একটি ইস্তিফতার জবাবে দারুল উলুম দেওবন্দের ফতওয়া]

জুন ২০২৩ খ্রি./যিলকদ ১৪৪৪ হি.

 

 আবদুল্লাহ আল-ফারুক

       অনুবাদক: বিশিষ্ট অনুবাদক, লেখক ও গবেষক

 

(পূর্বপ্রকাশিতের পর)

দীনী খেদমতের জন্য বেতন গ্রহণ এবং বাণিজ্য না করা প্রসঙ্গে হযরত আবু বকর (রযি.) ও হযরত ওমর (রযি.)সহ অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের যে আমল ছিল এবং এ প্রসঙ্গে সম্মানিত ফুকাহায়ে কেরাম যা লিখেছেন, তার আলোকে হাকিমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) তাঁর সংস্কারধর্মী রচনা ইসলাহে ইনকিলাবে উম্মত গ্রন্থে বেশ বিশদাকারে গবেষণামূলক আলোচনা করেছেন। যার সারসংক্ষেপ হচ্ছে,

علماء، طلبہ اور دینی خدمت میں مشغول افراد کی مالی خدمت مسلمانوں پر واجب اور ضروری ہے اور یہ نفقہ واجبہ کی ایک اہم ترین قسم ہے جس کی طرف عمو مًالوگوں کی توجہ نہیں ہوتی ہے، فقہاء نے فرمایا ہے کہ نفقہ جزائے جبس ہوتا ہے، جیسے رزق قاضی، یعنی قاضی کا نفقہ کہ وہ عام مسلمانوں کی خدمت میں محبوس ہوتا ہے، اس لیے اس کی کفالت تمام مسلمانوں کے مال سے بیت المال کے ذریعے کی جاتی ہے، اسی طرح علماء اور طلبہ کا نفقہ بھی مسلمانوں پر واجب ہے؛ کیونکہ یہ حضرات قوم کی دینی خدمت میں محبوس و مشغول ہیں، اس کی عقلی نظیر بھی ہے کہ بالفرض اگر پوری قوم میں کوئی طبیب نہ بنے تو عقل کہتی ہے کہ پوری قوم پر لازم ہے کہ متفق ہو کر چند افراد کو اس فن کی طرف متوجہ کرے اور ان کے خوردونوش کا خود انتظام کرے، ورنہ پوری قوم پریشان ہو جائے ۔ اب جب تک بیت المال کا نظام تھا تب تک اس کے ذریعے مسلمانوں سے یہ نفقہ وصول ہو جاتا تھا ، لیکن اب صرف یہی صورت ہے کہ مسلمان از خود علماء اور طلبہ کی خدمت کریں ، مدرسہ کو دے کر یا براہ راست دے کر ، آیت قرآنی [لِلْفُقَرَآءِ الَّذِيْنَ اُحْصِرُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ۠ ضَرْبًا فِي الْاَرْضِ١ٞ۰۰۲۷۳] {البقرة: 273} ہماری تقریر کی واضح دلیل ہے، کیونکہ لاؔم استحقاق کا ہے، [اُحْصِرُوْا ١ٞ۰۰۲۷۳]احتباس پر دلالت کر رہا ہے، [فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ ١ٞ۰۰۲۷۳] کی تفسیر طالب علم کے ساتھ منقول ہے، [لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ۠ ضَرْبًا ١ٞ۰۰۲۷۳] معاش کے لیے فرصت نہ ملنے کی طرف مشیر ہے، ان تمام چیزوں کے بعد علماء وطلبہ سے یہ پوچھنا کہ معاش کا کا انتظام کر رکھا ہے عجیب بات ہے، پوچھنے کا حق تو انھیں تھا، اس تقریر کے مطابق اس مسئلے میں امام شافعی کے قول پر فتویٰ دینے کی ضرورت ہی نہ رہی؛ کیونکہ یہ تو قوم کے اوپر واجب شدہ نفقہ اور کفالت ہے جو کہ عند الاحناف جزائے جبس ہے اور اس کا متعین ہونا قطع نزاع کے لیے ہوگا، نہ کہ اجرت ہونے کے سبب، اب یہ شبہ کہ کیسے علماء معاش کے لیے فارغ نہیں ہو سکتے نا قابل تسلیم ہے؛ کیونکہ جو معاش میں لگتا ہے، وہ ایسی خدمت میں نہیں کر پاتا جیسی کہ فارغ ہو کر کر لیتا ہے، یہ بات تجربہ سے ثابت ہے اور تجربہ کی باتوں میں بحث نہیں کی جاسکتی ، اسی طرح قرآن دیکھو کہ جو [لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ۠ ١ٞ۰۰۲۷۳] فرمایا ہے، وہ لوگ اپاہچ نہ تھے ؛ بلکہ حد درجہ خدمت دین میں مشغول تھے ۔

‘আলেম, দীনী শিক্ষার্থী ও দীনী খেদমতে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের আর্থিক সেবা করা সকল মুসলমানের ওপর ওয়াজিব ও জরুরি। এ ভরণ-পোষণ হচ্ছে এ যুগের অন্যতম অবহেলিত ওয়াজিব, যার দিকে সাধারণত মানুষের দৃষ্টি নেই। ফুকাহায়ে কেরাম লিখেছেন, কারও সময় আটকে রাখলে তার বিনিময় দিতে হবে। বিচারপতিদের বেতন এ ঘরানার একটি উদাহরণ। তিনি যেহেতু মুসলমানদের সেবায় আটকে আছেন, কাজেই তার ভরণ পোষণ হিসেবে সমস্ত মুসলমানদের সম্পদ বায়তুল মাল থেকে বেতন দেওয়া হয়। তদ্রূপ তালিবুল ইলম ও আলেমদের জীবিকাও মুসলমানদের ওপর ওয়াজিব। কেননা তারাও জাতির দীনী সেবায় নিয়োজিত। তাদের সময় বন্দি। একটি যুক্তির মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট করছি। যদি কোনো জাতির মাঝে একজন চিকিৎসকও না থাকে তখন বিবেক বলে যে, এ মুহূর্তে পুরো জাতির দায়িত্ব হচ্ছে, তারা একমত হয়ে কয়েকজন ব্যক্তিকে এ শাস্ত্রের প্রতি মনোযোগী করবে এবং তাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা তারাই করে দেবে। এ পদক্ষেপ না নেওয়া হলে গোটা জাতি বিপদে পড়বে। যতদিন পর্যন্ত বায়তুল মালের প্রচলন ছিল, ততদিন তার মাধ্যমে মুসলমানদের থেকে এ ভরণ-পোষণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে উসুল হয়ে যেতো। কিন্তু বর্তমানে তার বিকল্প হচ্ছে, মুসলমানরা নিজেরাই ওলামা ও তুলাবাদের সেবা করবে। হয় মাদরাসায় দিয়ে আসবে, বা নিজেরাই সরাসরি দেবে। কুরআন করীমের এ আয়াত لِلْفُقَرَآءِ الَّذِيْنَ اُحْصِرُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ۠ ضَرْبًا فِي الْاَرْضِ١ٞ۰۰۲۷۳ (খয়রাত সেসব গরীব লোকের জন্যে যারা আল্লাহর পথে আবদ্ধ হয়ে গেছে-জীবিকার সন্ধানে অন্যত্র ঘোরাফেরা করতে সক্ষম নয়।[1]) আমাদের এ আলোচনার সুস্পষ্ট দলিল। কেননা এ আয়াতের لام حرف جرটি হকদার হওয়া বোঝায়। আর اُحْصِرُوْا ١ٞ۰۰۲۷۳ শব্দটি ব্যক্তির সময় আটকে রাখা বোঝায়। فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ ١ٞ۰۰۲۷۳-এর তাফসীর হচ্ছে, তালিবুল ইলম—এমনটাই বর্ণিত রয়েছে। لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ۠ ضَرْبًا فِي الْاَرْضِ١ٞ۰۰۲۷۳ দ্বারা ইঙ্গিত করা হচ্ছে যে, তারা জীবিকা উপার্জনের জন্য সময়-সুযোগ পান না। এত কিছু সত্ত্বেও কেউ যদি তালিবুল ইলম বা ওলামায়ে কেরামকে জিজ্ঞাসা করে যে, আপনারা আপনাদের জীবিকার কী বন্দোবস্ত করে রেখেছেন? তাহলে সেটা হবে অবান্তর প্রশ্ন। এমন প্রশ্ন তোলার অধিকার তাদের নেই। উপর্যুক্ত আলোচনা সামনে রাখলে ইমাম শাফিয়ীর মাযহাব অনুসারে ফতওয়া দেওয়ার প্রয়োজন থাকে না। কেননা এ ভরণ-পোষণ ও আর্থিক সংস্থান তো গোটা জাতির ওপর ওয়াজিব দায়িত্ব। হানাফি আলেমদের মতে, এটি হচ্ছে অন্যকে নিজ কাজে আটকে রাখার বিনিময়। অন্তত ঝগড়া থেকে নিরাপদ থাকার জন্য যা নির্ধারিত হওয়া জরুরি। এখন কেউ যদি এ প্রশ্ন তুলে যে, ওলামায়ে কেরাম কীভাবে নিজের জীবিকা নির্বাহের অবসর পান না? তাহলে তার সেই সন্দেহ হবে বাস্তবতা বিবর্জিত। কেননা যে ব্যক্তি জীবিকা উপার্জনের কাজে ব্যস্ত থাকে, তার কাছে একজন অবসর ব্যক্তির সমান সেবা করার সুযোগ থাকে না। অভিজ্ঞতার আলোকে এটাই প্রমাণিত। আর অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয়ে তর্ক করা নিষ্ফল কাজ। আপনি নিজেই লক্ষ করুন, তাদের ব্যাপারে কুরআন বলেছে, لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ۠ ١ٞ۰۰۲۷۳ (তারা জমিনে ঘুরে বেড়াতে সক্ষম নন)। এমন নয় যে, তারা পঙ্গু। বরং তারা হচ্ছে, দীনের খেদমতে সীমাহীন ব্যস্ত।’[2]

হযরত থানভী (রহ.) তাঁর এক ওয়াজে বলেছেন,

اس آیت [لِلْفُقَرَآءِ الَّذِيْنَ اُحْصِرُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ۠ ضَرْبًا فِي الْاَرْضِ١ٞ۰۰۲۷۳] {البقرة: 273} سے معلوم ہوا کہ ایسی جماعت کو ذرائع تحصیل معاش میں بالکل مشغول نہ ہونا چاہیے، [لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ۠ ضَرْبًا فِي الْاَرْضِ١ٞ۰۰۲۷۳] اس پر دلالت کر رہا ہے اور اس سے پیہ شبہ بھی جاتا رہا کہ علماءد نیوی معاش میں اپانچ ہیں اور ثابت ہو گیا کہ بایں معنی آپا نہی ہونا ضروری ہے اور راز اس میں یہ ہے کہ ایک شخص سے دو کام نہیں ہوا کرتے ، خصوصا جب کہ ایک کام ایسا ہو کہ ہر وقت اس میں مشغول ہونے کی ضرورت ہو۔

‘এ আয়াত لِلْفُقَرَآءِ الَّذِيْنَ اُحْصِرُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ۠ ضَرْبًا فِي الْاَرْضِ١ٞ۰۰۲۷۳ (খয়রাত সেসব গরীব লোকের জন্যে যারা আল্লাহর পথে আবদ্ধ হয়ে গেছে-জীবিকার সন্ধানে অন্যত্র ঘোরাফেরা করতে সক্ষম নয়।[3]) থেকে জানা যায় যে, এ জামায়াতটির জীবিকা উপার্জনের কাজে বিলকুল লিপ্ত না হওয়াই সমীচীন। لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ۠ ضَرْبًا فِي الْاَرْضِ١ٞ۰۰۲۷۳ বাক্যটি সে দিকেই ইঙ্গিত করছে। কাজেই যারা সন্দেহ তোলে যে, আলেমগণ কেন পার্থিব জীবিকা উপার্জনের ক্ষেত্রে পঙ্গু-তাদের সেই সন্দেহও প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায়। প্রমাণিত হচ্ছে যে, উপর্যুক্ত অর্থে তাদের পঙ্গু হওয়াই জরুরি। তার কারণ হচ্ছে, এক ব্যক্তির পক্ষে ভিন্ন দুটি কাজ সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। বিশেষত, কাজটি যদি এমন হয় যে, তার মাঝে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকা জরুরি।’[4]

বায়তুল মাল থেকে সুলতান যেই সম্মানী পান, আর জনগণের চাঁদা থেকে মাদরাসার আসাতিযায়ে কেরাম যে সম্মানী পান, সেই দুটোর মাঝে সাদৃশ্যের কারণ সম্পর্কে আলোকপাত করে হযরত থানভী (রহ.) বলেন,

بادشاہ کو جوخزانہ سے تنخواہ ملتی ہے، وہ بھی محض اس لیے کہ وہ رعایا کے کام میں محبوس ہے ؛ کیونکہ بادشاہ وہ ہے جس کو ساری قوم حاکم بناتی ہے اور اس کو بیت المال کے خزانہ سے تنخواہ دیتی ہے، اب یہ دیکھو کہ وہ خزانہ کس چیز کا نام ہے، میں اس کی حقیقت بتلاتا ہوں ، ساری قوم سے جو چندہ جمع کیا جاتا ہے کہ ایک پائی زید کی ایک پائی عمرو کی اور ایک پائی بکر کی جس کو کوٹھری میں جمع کیا جاتا ہے، اس کا نام خزانہ ہے، حقیقت اس کی وہی چندہ ہے، وہ بھی قومی چندہ ہے، اس سے بادشاہ کو تخواہ ملتی ہے، صرف خزانہ لفظ سے اس کی عزت بڑھ گئی ،لوگ کہتے ہیں کہ یہ خزانہ شاہی ہے مگر حقیقت اس کی وہی قومی چندہ ہے، پس یہی حقیقت اس چندہ کی ہے جس سے مولویوں کو تنخواہ ملتی ہے۔

‘রাজকোষ থেকে বাদশাহ সম্মানী পান এ কারণে যে, তিনি জনগণের কাজে ব্যস্ত। আটক। কেননা বাদশাহ তো তিনিই হন, যাকে গোটা জাতি শাসক হিসেবে মেনে নেয়। এমন ব্যক্তি রাজকোষ থেকে সম্মানী পেয়ে থাকেন। আচ্ছা, বলুন তো রাজকোষের এ অর্থ কোত্থেকে আসে? জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ দিয়েই তো রাজকোষ সমৃদ্ধ হয়। যায়দ এক পয়সা দিলো। ওমর এক পয়সা দিলো। বকর এক পয়সা দিলো। তাদের দেওয়া অর্থ যেখানে জমা হয়, সেটাই রাজকোষ। এটাও এক ধরনের চাঁদা। জনগণ থেকে নেওয়া চাঁদা। সেখান থেকে বাদশাহ বেতন পান। রাজকোষ হওয়ার কারণে যার সম্মান বেড়ে যায়। লোকজন সমীহ করে বলে, রাজকোষ। অথচ আদতে সেটা কিন্তু জনগণের চাঁদা। কাজেই বাস্তবতা হচ্ছে, মৌলভীগণ একই ধরনের চাঁদা থেকেই বেতন পেয়ে থাকেন।’[5]

উপরের সুস্পষ্ট লেখাগুলো থেকে পরিষ্কার হচ্ছে যে, যেসব ব্যক্তি দীনী খেদমতে নিয়োজিত তাদের আর্থিক সংস্থানের বন্দোবস্ত করা সাধারণ মুসলমানদের দায়িত্ব। এ ধরনের ভরণ-পোষণ করা শুধু জায়েযই নয়; শরীয়তের অভীষ্ট লক্ষ্যের অনুসরণও বটে। বর্তমান যুগের পরিপ্রেক্ষিতে এটাই উত্তম (মুসতাহসান)। সাহাবায়ে কেরাম ও সালফে সালেহীন (অতীতের আদর্শ মনীষা)-এর জীবনীর আলোকে প্রমাণিত। শুধু তাই নয়; আমাদের আকাবির (রহ.) গণচাঁদার ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি মজবুত, সুদৃঢ় ও উপকারী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। হযরত মাওলানা মুহাম্মদ কাসিম নানুতুভী (রহ.) দারুল উলুম দেওবন্দের জন্য যে উসুলে হাশতগানা (অষ্ট মূলনীতি) প্রণয়ন করেছিলেন, তার প্রথম ও দ্বিতীয় ধারায় তিনি অধিক চাঁদার প্রতি মনোযোগ এবং শিক্ষার্থীদের খাবার ও আবাসনের প্রতি উৎসাহিত করার প্রয়াসের প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন, যেন তারা দীনের হেফাজত ও প্রচারের কাজ পূর্ণ মনোনিবেশ ও অভিনিবেশ সহকারে আঞ্জাম দিতে পারেন।

এখন বয়ানকারী (মাওলানা সাদ সাহেব) দীনী খেদমতে নিয়োজিত ব্যক্তিদেরকে যে এ অজুহাতে ব্যবসা করার দাওয়াত দিচ্ছেন যে, ‘তারা যেন নিজেরাই নিজেদের ভরণ-পোষণের বন্দোবস্ত করার মাধ্যমে মাখলুক থেকে অমুখাপেক্ষী হতে পারে এবং তাদের মুজাহাদা যেন কামিল হয়।’ তার এ বক্তব্য প্রমাণিত করে যে, তিনি নিজেই সীরাত সম্পর্কে অজ্ঞ। দীনের খেদমত করার সময় শতভাগ মনোযোগ নিবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে বেতন-ভাতা মেনে নেওয়া অবশ্যই ব্যবসা করা থেকে উত্তম। কেউ যদি ইখলাস ও সদিচ্ছার সাথে এ খেদমত আঞ্জাম দেন তাহলে আল্লামা শামী ও হযরত থানভী (রহ.)-এর সুস্পষ্ট বক্তব্য অনুসারে তিনি দ্বিগুণ সওয়াবের হকদার হবেন। একটি হচ্ছে, দীনী ইলমের প্রচারের সওয়াব। অন্যটি হচ্ছে, পরিবার-পরিজনের জীবিকা সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করা।[6] বরং বিভিন্ন হেকমতে বেতন গ্রহণ করাকে উত্তম অভিহিত করা হয়েছে। এ কারণেই হিদায়া গ্রন্থের লেখক ধনী বিচারপতির বেতন গ্রহণের বিশেষ উপকার সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।[7]

শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা মুহাম্মদ যাকারিয়া (রহ.) ফাযায়িলে তিজারত গ্রন্থে লিখেছেন,

میں پہلے لکھ چکا کہ میرے نزدیک تجارت افضل ہے وہ بحیثیت پیشہ کے ہے؛ اس لیے کہ تجارت میں آدمی اپنے اوقات کا مالک ہوتا ہے، تعلیم  وتعلّم، تبلیغ اور افتاء وغیرہ کی خدمت بھی کر سکتا ہے؛ لہٰذا اگر اجارہ دینی کاموں کے لیے ہوتو وہ تجارت سے بھی افضل ہے ؛ اس لیے کہ وہ واقعی دین کا کام ہے؛ مگر شرط یہ ہے کہ وہی کام مقصود ہو اور تنخواہ بدرجہ مجبوری ہے، میرے اکابر دیوبند کا زیادہ معاملہ اسی کا رہا اور اس کا مدار اس پر ہے کہ کام کو اصل سمجھے اور تنخواہ کو اللہ تعالیٰ کا عطیہ ؛ اِسی لیے کسی جگہ پر اگر کوئی دینی کام کر رہا ہو تدریس، افتاء کا وغیرہ وغیرہ اور اس سے زیادہ کسی دوسرے مدرسہ میں زیادہ تنخواہ ملے تو پہلی جگہ کو محض کثرت تنخواہ کی وجہ سے نہ چھوڑے۔

‘আমি পূর্বেই লিখেছি যে, আমার মতে পেশা হিসেবে ব্যবসা উত্তম। কারণ হচ্ছে, ব্যবসার মাঝে ব্যক্তি নিজ সময়ের মালিক থাকে। যার ফলে ব্যবসার পাশাপাশি পঠন-পাঠন, দীন প্রচার ও ফতওয়া প্রদান ইত্যকার কাজও করতে পারে। এ কারণে কেউ যদি দীনী কাজের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করে তবে সেটি ব্যবসা থেকেও উত্তম। শর্ত হচ্ছে, দীনের খেদমতই একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে। বেতনকে রাখবে বাধ্যবাধকতার স্তর হিসেবে। আমাদের দেওবন্দি আকাবির (রহ.)-এর এটাই চিরন্তন অভ্যাস ছিল। তবে তার ভিত্তি হচ্ছে, এটাকেই মূল কাজ মনে করবে। বেতনকে মনে করবে আল্লাহর দান। কাজেই কেউ যদি এক জায়গায় দীনী কাজে নিয়োজিত থাকে; পাঠদান, ফতওয়া প্রদান ইত্যকার কোনো পদে নিযুক্ত থাকে, এমন ব্যক্তি যদি অন্য কোনো মাদরাসায় অধিক বেতন পায়, তাহলে যেন স্রেফ বেতনের লোভে পূর্বের খেদমত ত্যাগ না করে।’

দীনী খেদমতে নিয়োজিত থাকার পাশাপাশি ব্যবসা বা অন্য কোনো পেশায় সময় দেওয়াটা মুহাদ্দিস, ফকীহ ও আমাদের আকাবির (রহ.)-এর সুস্পষ্ট বক্তব্য ও অভিজ্ঞতার আলোকে দীনী খেদমতের জন্য ব্যঘাত সৃষ্টিকারী। এ প্রসঙ্গে শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা মুহাম্মদ যাকারিয়া (রহ.) লিখেছেন,

میرا تو کئی سال سے یہ معمول ہے کہ اہل مدارس کو مشورہ دیتا ہوں کہ بغیر تنخواہ کے مدرس نہ رکھا جائے اور اپنا ذاتی تجربہ اپنے مدرسہ کا یہ ہے کہ ابتداء میں میں نے مظاہر علوم میں معین المدرسی کا درجہ شروع کیا تھا جس کو ایک دو سبق مدرسہ کے اور بقیہ اوقات میں اپنا کوئی تجارتی کام کرنے کا مشورہ دیتا تھا، مگر ایک ہی سال بعد ان کی توجہ پڑھانے کی طرف کم ہوگئی اور تجارتی کام میں لگ گئے اور شده شده دینی کام چھوٹ گیا اور بے تنخواہ مدرس جس بے توجہی سے کام کرتے ہیں، تنخواہ دار نہیں کرتا۔اسی واسطے ہمارے اکابر کا یہی دستور رہا ہے؛ چنانچہ حضرت گنگوہیؒ نے ابتداء میں سہارنپور میں دس روپے تنخواہ پر بچوں کو پڑھانے کے لیے ملازمت کی اور حضرت نانوتویؒ کے متعلق بھی گزر چکا کہ کچھ دنوں حدیث پڑھانے پر اور تصحیح کتب پر تنخواہ لی اور حضرت تھانویؒ کا قصہ مشہور ہے ابتداء میں کانپور میں ملازمت کی۔

‘কয়েক বছর যাবত আমার অভ্যাস হচ্ছে, আমি মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে এ পরামর্শ দিয়ে আসছি যে, আপনারা বিনাবেতনের কোনো শিক্ষক রাখবেন না। আমার মাদরাসার ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা আপনাদের জানাচ্ছি। প্রথমদিকে আমি মাযাহিরুল উলুমে সহকারী শিক্ষক পদ শুরু করেছিলাম। তাদেরকে পরামর্শ দিতাম যে, মাদরাসায় দুয়েকটি সবক পড়াবে, আর অবশিষ্ট সময় নিজস্ব কোনো ব্যবসা করবে। কিন্তু এক বছরের মাথায় দেখা গেল, শিক্ষকতার প্রতি তাদের মনোযোগ কমে গেছে। পুরোদস্তুর ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে দীনী কাজ ছুটে যেতে লাগলো। সাধারণত একজন বিনাবেতনের শিক্ষক যতটা মনোযোগ ছাড়া কাজ করে, বেতনপ্রাপ্ত শিক্ষক ততটা করে না।… এ কারণেই আমাদের আকাবির এ নীতি মেনে চলতেন। হযরত গঙ্গুহী (রহ.) কর্মজীবনের শুরুতে সাহারানপুরে দশ রুপি বেতনে শিশুদের পড়ানোর চাকরি করতেন। হযরত নানুতুবি (রহ.) সম্পর্কেও বলেছি যে, তিনি কিছু দিন হাদীস পড়ানো ও কিতাবের প্রুফ সংশোধনের চাকরিতে বেতন নিয়েছেন। হযরত থানভী (রহ.)-এর ঘটনা তো সর্ববিদিত যে, তিনি প্রথম জীবনে কানপুরে শিক্ষকতা করেছেন।’[8]

বয়ানকারী (মাওলানা সাদ সাহেব) তালিবুল ইলম ও ওলামায়ে কেরামকে টার্গেট করে তাদের জীবিকার সংস্থান হিসেবে যে প্রস্তাবনা দিয়েছেন এবং নিজপ্রস্তাবনার জন্য যেসব বিষয়কে ভিত্তি বানিয়েছেন, আফসোসের বিষয় হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে আধুনিকতাবাদীরা একই রকম অভিমত দিয়ে আসছে। হযরত মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ তকি উসমানী (দা. বা.) লিখেছেন,

بعض حضرات دینی مدارس کی خیرخواہی اور ہمدردی میں یہ تجویز بھی پیش فرماتے رہے ہیں کہ ان درسگاہوں میں دست کاری کے ہنر سکھانے اور دوسری ٹیکنیکی تربیت کا بھی انتظام ہونا چاہیے تا کہ جو علماء یہاں سے فارغ التحصیل ہوں، وہ معاشی اعتبار سے معاشرے پر بوجھ بننے اور دوسروں کے دست نگر ہونے کے بجائے اپنے معاش کا انتظام اپنے ہاتھ کے ہنر سے کر سکیں اور دین کی خدمت کسی معاوضہ کے بغیر انجام دیں، یہ تجویز خواہ کتنی نیک نیتی سے پیش کی گئی ہو اور بظاہر کتنی خوشنما معلوم ہوتی ہو، حقیقت پسندی سے بہت دور اور نا قابل عمل ہے، پہلی بات تو وہی ہے کہ اگر دینی مدارس کا مقصد قرآن وسنت کے علوم میں بصیرت رکھنے والے علماء پیدا کرنا ہے تو یہ علوم اپنی تحسین اور اپنی خدمت کے لیے پورا وقت چاہتے ہیں اور آج کی زندگی اس قدر پیچیدہ ہوگئی ہے، اس میں تجربہ یہی ہے کہ ٹیکنیکی کاموں میں لگ جانے کے بعد ان علوم کی خدمت محض ایک آرزو ہو کر رہ جاتی ہے جو ساری عمر پوری نہیں ہوتی، بعض طلبہ نے علم دین کے ساتھ یہ ٹیکنیکی ہنر سیکھے؛ لیکن اس عملی تجربہ میں شاید کوئی استثناء نہ ہو کہ فارغ التحصیل ہونے کے بعد اگر طالب علم دینی علوم کی خدمت میں لگا تو اپنے ہنر کی طرف توجہ نہ دے سکا اور اس ہنر کے ذریعے کسب معاش میں مصروف ہوا تو علم دین سے تعلق باقی نہ رکھ سکا، لہذا جو مدارس اعلی ٰقابلیت کے علماء تیار کرنے کے لیے قائم ہوئے ہیں، ان کے لیے یہ نہ ممکن ہے اور نہ مناسب کہ وہ اپنے طلبہ کو علوم دین کے ساتھ ٹکنیکی تربیت دینے کا بھی انتظام کریں، دوسرے یہ عجیب تصور ہے کہ اگر کوئی شخص معاشرے کے دینی ضروریات پوری کر کے کوئی اجرت یا تنخواہ وصول کر رہاہے تو وہ معاشرے پر بوجھ یا دوسروں کا دست نگر بن گیا ہے، علم وفن کے ہر شعبے کا قاعدہ یہ ہے کہ جو شخص علم وفن میں مہارت حاصل کر کے اس شعبے میں معاشرے کی خدمت انجام دیتا ہے، اس کا معاش بھی اسی شعبے سے وابستہ ہوتا ہے اور اگر وہ اس شعبے میں معاشرے کی خدمت انجام دینے کی بناء پر کوئی اجرت یا تنخواہ وصول کرتا ہے تو اس میں معاشرے پر بوجھ بننے یا کسی کا دست نگر ہونے کا کوئی سوال نہیں ؛ بلکہ یہ اس معاشرتی نظام کا ایک لازمی حصہ ہے جس پر پوری انسانیت کی بنیاد قائم ہے، اگر کوئی طیب ، انجینئر ، ماہر معاشیات یا سائنس داں اپنے شعبے میں معاشرے کی خدمت کرتا ہے اور اس کے صلے میں معاشرہ اسے معاشی فوائد بہم پہنچاتا ہے تو یہ نہ اس پر کسی کا احسان ہے اور اس کی بناء پر یہ سمجھنا درست ہے کہ وہ معاشرے پر بوجھ بن رہا ہے یا دوسروں کا دست نگر ہے، سوال یہ ہے کہ کیا علوم دین کی خدمت معاشرے کی کوئی ضرورت نہیں ؟ کیا ایک مسلمان معاشرے کو ایسے اہل علم کی حاجت نہیں جو ان کی دینی ضروریات پوری کر سکیں ؟ ان کونت نئے مسائل میں دین کی رہنمائی فراہم کرسکیں؟ ان کے بچوں کو دینی تعلیم دے سکیں؟ ان کے دینی مستقبل کے تحفظ کے لیے اپنی زندگیاں وقف کر سکیں؟ دین پر حملہ آور فتنوں کا موثر تعاقب کر سکیں ؟ اگر یہ ایک مسلمان معاشرے کی اولین ضرورت ہے اور کون ہے جو اس حقیقت کا انکار کر سکے تو اگر معاشرہ ان خدمات کے صلہ میں ایسے اہل علم کو اپنے معاش سے بے فکر کرنے کے لیے اپنا فریضہ اداء کرتا ہے تو کونسا احسان ہے جوان اہل علم پر کیا جارہا ہے اور اس کی بناء پر یہ خیال آخر کیوں پیدا ہوتا ہے کہ وہ معاشرے پر بوجھ اور دوسروں کے دست نگر ہیں ؟ اس لیے انہیں اپنی معاشی کفالت کے لیے کوئی اور ہنر سیکھنا چاہیے۔

‘কিছুলোক দীনী মাদরাসার প্রতি কল্যাণকামিতা ও সহমর্মিতা দেখিয়ে এ প্রস্তাব পেশ করে যে, এসব বিদ্যাপীঠে হস্তশিল্পসহ অপরাপর কারিগরি বিদ্যার বন্দোবস্ত থাকা উচিত, যেন এখান থেকে শিক্ষাসম্পন্নকারী আলেমগণ জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে সমাজের বোঝা না হয়। যেন অন্যের কাছে হাত পাতার পরিবর্তে নিজ জীবিকার সংস্থান নিজ হস্তবিদ্যার মাধ্যমে করতে পারে এবং কোনো বিনিময় না নিয়ে দীনের খেদমত করতে পারে। তাদের এ প্রস্তাবনা বাহ্যত যত সুন্দরই মনে হোক; এবং তাদের মনে যত সদিচ্ছাই থাকুক; বাস্তবতার দৃষ্টিতে অবশ্যই অদূরদর্শী ও অগ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ। প্রথম কথা হচ্ছে, যদি দীনী মাদরাসার উদ্দেশ্য হয় কুরআন ও সুন্নাহর গভীর জ্ঞানের অধিকারী আলেম সৃষ্টি করা তাহলে অবশ্যই এ জ্ঞানের ক্ষেত্রে উৎকর্ষ সাধনের জন্য ব্যক্তিকে ষোলোআনা সময় দিতে হবে। বর্তমানে আমাদের জীবন বেশ জটিল হয়ে পড়েছে। অভিজ্ঞতার আলোকে প্রমাণিত যে, কোনো ব্যক্তি যদি কারিগরি বিদ্যায় জড়িয়ে পড়ে তাহলে তার পক্ষে দীনের খেদমত করাটা স্রেফ স্বপ্নে পরিণত হয়। বাকি জীবনে সেই স্বপ্ন আর কখনই পূরণ হবে না। অনেক শিক্ষার্থীকে দীনী ইলমের পাশাপাশি হস্তশিল্প শিখতে দেখা যায়। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতায় এমনটাই দেখা যায় যে, পরবর্তীকালে কোনো তালিবুল ইলম দীনী ইলমের খেদমতে জড়িয়ে পড়লে তার পক্ষে হস্তশিল্পে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না। আবার কেউ জীবিকার প্রয়োজনে হস্তশিল্পে মনোনিবেশ করলে পরবর্তীকালে দীনী ইলমের সাথে তার সম্পর্ক থাকে না। অতএব যেসব মাদরাসা উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন ওলামা তৈরি করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাদের জন্য এ প্রস্তাব অসম্ভব। নিজ শিক্ষার্থীদেরকে তারা ইলমে দীনের পাশাপাশি কারিগরি বিদ্যা শেখাবে—এটা শোভা পায় না। কোনো ব্যক্তি যদি সমাজের দীনী প্রয়োজন পূরণ করার বিনিময়ে বেতন বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করে, তাহলে সেটাকে সমাজের বোঝা সাব্যস্ত করা মারাত্মক ভুল চিন্তা। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখার নীতি হচ্ছে, যে ব্যক্তি সেই শাখায় দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে সমাজের সেবা করছে, তার জীবিকা অবশ্যই সেই শাখার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে। যদি সে ওই শাখায় সমাজের সেবা দেওয়ার ওপর ভিত্তি করে কোনো বেতন বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করে, তাহলে কোনোভাবেই তাকে সমাজের বোঝা ঠাওরানো যাবে না। বরং এটাই তো সামাজিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর ওপর ভর করেই গোটা মানবতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। যেমন ধরুন, প্রত্যেক ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা অর্থবিশেষজ্ঞ বা বিজ্ঞানী নিজ শাখায় গোটা সমাজের সেবা করছেন। তার বিনিময়ে সমাজ যদি তাকে আর্থিকভাবে উপকৃত করে তাহলে তাকে কিছুতেই তার ওপর করুণা বলা যাবে না। এটাকে সমাজের ওপর বোঝা তকমা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে যে, সমাজের কি দীনী ইলমের কোনো প্রয়োজন নেই? কোনো মুসলিম সমাজে কি এমন একজন আলেমের প্রয়োজন নেই, যিনি তাদের সকল দীনী প্রয়োজন পূরণ করবেন? যিনি তাদেরকে নিত্যনৈমিত্তিক মাসআলার ক্ষেত্রে প্রদর্শন করবেন? তাদের বাচ্চাদের দীন শেখাবেন? জনগণের ধর্মীয় ভবিষ্যত হেফাজতের স্বার্থে যিনি নিজ জীবন ওয়াকফ করে দেবেন? যিনি দীনের ওপর নেমে আসা প্রতিটি ফিতনাকে সমূলে উপড়ে ফেলবেন? এগুলো যদি কোনো মুসলিম সমাজের সর্বাধিক জরুরত হয়ে থাকে, তাহলে যিনি নিজের জীবিকার সংস্থানের ফিকির বিসর্জন দিয়ে মুসলিম সমাজের সেবা করে যাচ্ছেন, সমাজ কর্তৃক তার বিনিময় হিসেবে ভরণ-পোষণের জোগান দেওয়াটা এমন কী ইহসান! এটাকে কেউ যদি সমাজের বোঝা বা অন্যের কাছে হাত পাতা বলে, এবং তাকে নিজ জীবিকা প্রতিপালনের স্বার্থে হস্তবিদ্যা শেখার পরামর্শ দেয়, তাহলে তা হবে অত্যন্ত বাজে ভাবনা।’[9]

মোটকথা উপর্যুক্ত আলোচনার মাধ্যমে একথা পরিষ্কার হচ্ছে যে, বয়ানকারী (মাওলানা সাদ সাহেব) সাইয়েদুনা আবু বকর (রযি.)-এর ঘটনা থেকে যে অবাস্তব ইজতিহাদ ও মতবাদ আবিষ্কার করেছেন, তা শতভাগ ভুল। হায়াতুস সাহাবা গ্রন্থের শিরোনাম ও মূল ঘটনার সাথে তার দাবির মোটেও মিল নেই। তার এ দাবিকে আমরা প্রচণ্ড দুঃসাহসের প্রকাশ বলতে পারি। তিনি দাবি করেছেন, শতশত বছর ধরে প্রায় সকল পূর্ববর্তী মনীষী সাহাবায়ে কেরামের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন এবং নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে অপব্যাখ্যা দিয়ে শরীয়ত পরিপন্থী কাজকে শরীয়তের অংশ বানানোর অপরাধে অভিযুক্ত। গোটা উম্মত বিগত ১৪ শতাব্দী ধরে অপব্যাখ্যাপ্রেমী আলেমদের আগ্রাসনের শিকার। এর বিপরীতে যারা আযীমত (উত্তম)-প্রেমী, তাদের পরম্পরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং এখনও বিচ্ছিন্ন আছে। মাওলানার এ অপবাদ নিঃসন্দেহে আমাদের আকাবির ও আসলাফ (সুমহান পূর্বসূরি)-দের ওপর নির্জলা অপবাদ। সকল আলেম ‘রুখসত’ (শরীয়তের বিকল্প ছাড় বিধান)-এ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন—এটা কত বড় কঠিন আক্রমণ! উপরন্তু তিনি বলছেন যে, সেই আকাবির ওলামা এতটাই অপব্যাখ্যাপ্রেমী অলস হয়ে পড়েছেন যে, এখন তার হক কথা শুনলে তারা সবাই তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন। এজন্যই তারা তার বিরোধিতায় উঠে-পড়ে লেগেছেন। বয়ানকারীর উপর্যুক্ত বয়ানের পরিণতি বিচার করুন। সমাজের যে লোকগুলো তার কথাকেই চূড়ান্ত মনে করে, তারা স্রেফ সেসব আলেমকেই শ্রদ্ধার চোখে দেখবে, যাঁরা ব্যবসায় জড়িত। এর বাইরে যাঁরা তাদের মনগড়া মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হবে না, তাঁদের সবাই তাদের দৃষ্টিতে মূল্যহীন হয়ে পড়বে। ‘দীনী খেদমতের জন্য বেতন গ্রহণ করলে মুজাহাদা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়’ বয়ানকারীর এমন বক্তব্যের কারণে হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর (রযি.)-এর মতো সুমহান মনীষীও আক্রান্ত হবেন। কেননা বায়তুল মাল থেকে বেতন গ্রহণের কারণে তাদের মুজাহাদাও ত্রুটিপূর্ণ হয়ে গেছে। নাউযুবিল্লাহ। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, পূর্বের ব্যবসা-বাণিজ্যের পাট গুটিয়ে মামুলি বেতন নিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে মুসলমানদের জাতীয় সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করার মাধ্যমে তাঁরা উঁচু স্তরের আজিমতের পরিচয় দিয়েছেন। বর্তমান যুগেও যেসকল তালিবুল ইলম, ওলামায়ে কেরাম, মুহাদ্দিসীনে কেরাম ও খাদেমগণ মহান পূর্বসূরিদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে পার্থিব জীবিকা বিসর্জন দিয়ে মামুলি বেতনের বিনিময়ে ইলমে দীনের প্রচার ও হেফাজতের কাজে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করছেন, নিঃসন্দেহে তারা আজিমতের নিখাদ উদাহরণ। (চলবে)

[1] আল-কুরআনুল করীম, ২ (সূরা আল-বাকারা): ২৭৩

[2] আশরফ আলী থানভী, ইনকিলাবে ইসলাহে উম্মত, ইরাদারাতুল মাআরিফ, করাচি, পাকিস্তান, খ. ২, পৃ. ১৯০-১৯৩

[3] আল-কুরআনুল করীম, ২ (সূরা আল-বাকারা): ২৭৩

[4] (ক) আশরফ আলী থানভী, আল-ইলমু ওয়াল উলামা, পৃ. ১৬১; (খ) আশরফ আলী থানভী, হুকূকুল ইলম, ইদারায়ে ইসলামিয়াত, করাচি-লাহোর, পাকিস্তান, পৃ. ২০-২১

[5] (ক) আশরফ আলী থানভী, আল-ইলমু ওয়াল উলামা, পৃ. ১৬৯-১৭০; (খ) আশরফ আলী থানভী, আত-তাবলীগ, ইদারায়ে ইফাদাতে আশরাফিয়া লখনউ, ইউপি, ভারত, খ. ২, পৃ. ৭২

[6] দেখুন: আশরফ আলী থানভী, আখতরী বেহেশতী যেওর, কুতুবখানায়ে আখতরী সাহারনপুর, ইউপি, ভারত, খ. ১১, পৃ. ১৩৫

[7] (ক) আশরফ আলী থানভী, আল-ইলমু ওয়াল উলামা, পৃ. ১৭২; (খ) মুহাম্মদ হাসান অমৃতসরী, আল-কালামুল হাসান = মলফুযাতে হাকীমুল উম্মত হযরত মওলানা শাহ আশরফ আলী থানভী, আল-মাকতাবাতুল আশরফিয়া, লাহোর, পাকিস্তান, খ. ১, পৃ. ২৭; (গ) আল-মারগীনানী, আল-হিদায়া ফী শরহি বিদায়াতুল মুবতাদী, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরাবী, বয়রুত, লেবনান, খ. ৪, পৃ. ৩৮২

[8] যাকারিয়া কান্ধলভী, ফাযায়িলে তিজারত, মাকতাবাতুশ শায়খ বাহাদুরাবাদ, করাচি, পাকিস্তান, পৃ. ৫২-৬২

[9] বিচারপতি তকী উসমানী, হামারা নিযামে তালীম, যমযম বুক ডিপো দেওবন্দ, ইউপি, ভারত (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৬ হি. = ১৯৯৫ খ্রি.), পৃ. ৮৮-৯০

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ