হাফেজ মুহাম্মদ জাফর সাদেক
عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ قَالَ: مَا عَمِلَ ابْنُ آدَمَ يَوْمَ النَّحْرِ عَمَلًا أَحَبَّ إِلَى اللَّهِ، مِنْ هِرَاقَةِ دَمٍ، وَإِنَّهُ لَيَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ، بِقُرُونِهَا، وَأَظْلَافِهَا، وَأَشْعَارِهَا، وَإِنَّ الدَّمَ لَيَقَعُ مِنَ اللَّهِ، بِمَكَانٍ قَبْلَ أَنْ يَقَعَ عَلَى الْأَرْضِ، فَطِيبُوا بِهَا نَفْسًا
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেন, কুরবানীর দিন আদম সন্তান এমন কোনো কাজ করতে পারে না, যা মহামহিম আল্লাহর নিকট রক্ত প্রবাহিত করার (কুরবানী) তুলনায় অধিক পছন্দনীয় হতে পারে। কুরবানীর পশুগুলো কিয়ামতের দিন এদের শিং, খুর ও পশমসহ উপ¯ি’ত হবে। কুরবানীর পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই মহান আল্লাহর নিকট সম্মানের ¯’ানে পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা আনন্দ সহকারে কুরবানী করো। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং: ৩১২৬)
শাব্দিক বিশ্লেষণ:
هِرَاقَة শব্দে তিনটি ভাষাগত রূপ রয়েছে: (১) أهراقَ – إهراقة (২) هراقَ – هراقة (৩) أراقَ – إراقة
যারা প্রথম রূপের প্রবক্তা তাদের বক্তব্য হলো—এটি মূলত أروقَ ছিল। (و) এর হরকত পূর্বের হরফ (ر) তে ¯’ানান্তর করে (و) কে (ا) দ্বারা পরিবর্তন করে দিয়েছে। উক্ত পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণস্বরূপ (ر) এর পূর্বে একটি (ه) বৃদ্ধি করা হয়েছে।
যারা দ্বিতীয় রূপের প্রবক্তা তাদের বক্তব্য হলো—এটি মূলত (أراقَ) ছিল। কেবল (ء) কে (ه) দ্বারা পরিবর্তন করা হয়েছে। যেমন, আরবরা (إياك) এর পরিবর্তে (هياك) বলে। (أما والله) এর পরিবর্তে (هما والله) বলে।
যারা তৃতীয় রূপের প্রবক্তা তাদের বক্তব্য হলো—এটি (أراقَ)ই ছিল أقام এর মতো।
অর্থ হলো—বহানো, ঝরানো ও প্রবাহিত করা। (বিস্তারিত জানতে দ্রষ্টব্য: “শরহু কিতাবি সিবওয়াহ লিস সাইরাফি: ১/১৮৪”)
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা:
হজ ও ঈদুল আযহার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো—আল্লাহর সš‘ষ্টির জন্য কুরবানী বা পশু জবেহ। এটি এমন একটি ইবাদত যাতে হজ পালনকারী এবং যিনি হজে যাননি—উভয়েই অংশ নিতে পারেন।
হজ পালনকারী মক্কায় “হাদি” নামক পশু জবেহ করেন, আর অন্যরা দেশে কুরবানী দিয়ে হজযাত্রীদের অনুসরণ করেন। এই কুরবানী মূলত আল্লাহর আদেশ মানার প্রতীক এবং একান্তভাবে তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যম।
এর পাশাপাশি এই ইবাদতের একটি বড় দিক হলো—এটি সমাজে সহমর্মিতা, সামাজিক সাম্য ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাছাড়া কুরবানী হ”েছ সমাজের গরিব ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ, দয়া, সহানুভূতি ও আনন্দ ছড়িয়ে দেয় সবার মাঝে।
কুরবানীর ঈদ আসলেই একদল লোক বুঝে কিংবা না বুঝে বলতে চায়, এত টাকা গরু ও খাওয়া-দাওয়ার পেছনে ব্যয় করার চেয়ে তা সাদাকা করে দেওয়াই মানবিক দাবি। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের মুসলমানরা আজ না খেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। তাই মানবতার দাবি হলো—যে টাকা দিয়ে কুরবানী করে মজা-মস্তি করবে সে টাকা সাদাকা করে দেওয়া ফিলিস্তিন, অসহায় কিংবা দুর্যোগ কবলিত মানুষের জন্য দান করে দেওয়া জরুরি।
যেমন, এক লক্ষ টাকা দিয়ে কুরবানীর জš‘ ক্রয় করলে কয়জন দু¯’-অসহায় মানুষের উপকার হবে? পক্ষান্তরে এক লক্ষ টাকা দিয়ে একশজন মানুষকে এক হাজার করে দান করে দিলে অনেক বেশি উপকার হবে।
এ ধরণের কথা দুই শ্রেণির ব্যক্তিদের মূখ থেকে বের হয়। এক শ্রেণির ব্যক্তি হলো—সুশীল শ্রেণি যাদের ইসলাম নিয়ে অ্যালার্জি আছে। তারা প্রতি বছর এ সময়ে নৈতিকতা, দয়াশীলতা এসবের ধুয়া তুলে আল্লাহর নির্ধারিত এই ইবাদাত কুরবানীকে আক্রমণ করে। তারা যেসব যুক্তি ও চেতনার কারণে পশু কুরবানীর বিরোধিতা করছেন বলে দাবি করেন আশ্চর্যজনকভাবে সেগুলো শুধু ঈদ উল আযহার সময় মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। অন্যান্য সময় এই চেতনা এবং যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের উত্থাপিত যুক্তি এবং তাদের কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালেই এই হিপোক্রেসির ধরণটা বোঝা যায়। তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের জবাব হলো—বাংলাদেশে যখন পহেলা বৈশাখের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ হয় তখন আপনাদের এ বুলি কোথায় থাকে? মুজিববর্ষের নামে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় তখন আপনাদের নৈতিকতা বন্ধক রেখে আসেন?
আর দ্বিতীয় শ্রেণী হলো—সেসব ব্যক্তি যারা প্রথম শ্রেণীর কথায় ধোঁকা খেয়ে এ ধরণের বুলি আওড়ায়, তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের জবাব হলো—আজকের দারসে হাদীসে আলোচিত হাদীসটি।
তাছাড়া আরও কয়েকটি হাদীস পেশ করতে চাই—
عَنْ سَلَمَةَ بْنِ الأَكْوَعِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ، قَالَ : قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” مَنْ ضَحَّى مِنْكُمْ فَلا يُصْبِحَنَّ بَعْدَ ثَالِثَةٍ وَفِي بَيْتِهِ مِنْهُ شَيْءٌ ” ، فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ ، قَالُوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ ، نَفْعَلُ كَمَا فَعَلْنَا الْعَامَ الْمَاضِي ؟ قَالَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” كُلُوا وَأَطْعِمُوا وَادَّخِرُوا ، فَإِنَّ ذَلِكَ الْعَامَ كَانَ بِالنَّاسِ جَهْدٌ ، فَأَرَدْتُ أَنْ تُعِينُوا فِيهَا
হযরত সালামা ইবনু আকওয়া’ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম ﷺ এরশাদ করেন, তোমাদের যে লোক কুরবানী করেছে, সে যেন তৃতীয় দিনে এমন অব¯’ায় সকাল অতিবাহিত না করে যে, তার ঘরে কুরবানীর গোশ্ত কিছু থেকে যায়। পরবর্তী বছর আসলে সাহাবীগণ আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি তেমন করব, যেমন গত বছর করেছিলাম? তখন তিনি এরশাদ করলেন, তোমরা নিজেরা খাও, অন্যকে খাওয়াও এবং সঞ্চয় করে রাখো, কারণ গত বছর মানুষের মধ্যে ছিল অভাব-অনটন। তাই আমি চেয়েছিলাম, তোমরা তাতে সহযোগিতা করো। (বুখারী, হাদীস নং: ৫২৪৯, মুসলিম, হাদীস নং: ৫০৫৮)
যদি কুরবানীর টাকা দিয়ে দু¯’দের সাহায্যের বিধান থাকতো তাহলে রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবীগণ তাই করতেন, কিš‘ করেননি বরং দূর্ভিক্ষ ও অভাব-অনটনের সময়ও কুরবানী করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং কুরবানীর গোশ্ত তিন দিনের বেশি সংরক্ষণ না করে দু¯’ ও অভাবীদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কুরবানীর অর্থ দান করার নির্দেশ দেননি। জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত,
قَالَ شَهِدْتُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الأَضْحَى بِالْمُصَلَّى فَلَمَّا قَضَى خُطْبَتَهُ نَزَلَ مِنْ مِنْبَرِهِ وَأُتِيَ بِكَبْشٍ فَذَبَحَهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِيَدِهِ وَقَالَ ” بِسْمِ اللَّهِ وَاللَّهُ أَكْبَرُ هَذَا عَنِّي وَعَمَّنْ لَمْ يُضَحِّ مِنْ أُمَّتِي ” .
আমি ঈদুল আযহার দিন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সঙ্গে ঈদগাহে উপ¯ি’ত হই। তিনি খুতবা শেষ করার পর যখন মিম্বর হতে অবতরণ করেন, তখন তাঁর নিকট একটি বকরি আনা হয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজ হাতে সেটি যবেহ করেন এবং বলেন, বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার। এটি আমার তরফ হতে এবং আমার উম্মতের ওই ব্যক্তিদের পক্ষ হতে, যারা কুরবানী করেনি। (আবু দাউদ, হাদীস নং: ২৮১০)
নামায বা রোযা নির্দিষ্ট আমলের সঙ্গে যুক্ত, তেমনি কুরবানী নির্দিষ্টভাবে পশু জবাইয়ের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। অন্য কিছু দিয়ে তা পূরণ হয় না। তাই রাসূল ﷺ নিজের উম্মতের যারা কুরবানী করতে সক্ষম নয় তাদের পক্ষ থেকেও কুরবানী করে দিয়েছেন।
আর যারা কুরবানী করতে সক্ষম, কিš‘ কুরবানী করল না তাদের ব্যাপারে কঠোর ধমকি উ”চারিত হয়েছে হাদীসে। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল ﷺ এরশাদ করেন,
مَن كان له سَعَةٌ ولم يُضَحِّ، فلا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانا
“যার সামর্থ্য রয়েছে, অথচ কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে না আসে।” (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং: ৮২৭৩, ইবনে মাজাহ, হাদীস নং: ৩১২৩)
সমস্ত ওলামায়ে কেরাম একমত যে, ঈদুল আযহার দিনে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজগুলোর মধ্যে একটি হলো কুরবানী করা। কুরবানীর জায়গায় শুধু দান-সদকা করে দায় শেষ করা বৈধ নয়। কারণ সাধারণ দান কখনোই কুরবানীর বিকল্প হতে পারে না এবং তা দিয়ে এই ইবাদতের প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ হয় না।
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম।