সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী
আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভী (রহ.)। একটি নাম। এ নাম দীপ্যমান ছিলো পূর্ব-পশ্চিমে—তাঁর কর্মগুণে। বর্ষীয়ান আলেমে দীন ও বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একটি সজীব আন্দোলন। বহু যোগ্য আলেমের ওস্তাদ। জামিয়া দারুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া চট্টগ্রাম-এর প্রতিষ্ঠাতা। আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্থা-রাবেতায়ে আদবে আলমে ইসলামীর বাংলাদেশ ব্যুরো প্রধান। আরব বিশ্বে সমাদরের সঙ্গে পরিচিত এক বরেণ্য বাংলাদেশী মনীষী-আলেম। সারাটি জীবন তিনি দীনের, ইলমের আলো ছড়িয়ে গেছেন। গোটা বাংলাদেশের পাশাপাশি বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছিলো তাঁর জ্ঞান-গবেষণার দ্যুতি।
আকাবির-আসলাফের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন তিনি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই। মানুষকে কাছে টানার এক অদ্ভুত যোগ্যতা ছিলো তাঁর। নানা মত-পথের মানুষ তাঁর সামনে অবনতমস্তক হয়ে পড়তেন। এ মহা মনীষী আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ায় প্রায় সতের বছর খেদমত করেছেন। তিনি জামিয়ার ফতওয়া বিভাগেও দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন। তাঁর জ্ঞান-গবেষণালব্দ অনেক ফতওয়া এখনো জামিয়ার গবেষণাগারে সংরক্ষিত আছে। জামিয়া পটিয়ার পক্ষ থেকে ‘ফতওয়ায়ে জামিয়া পটিয়া’ সংকলনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিলো কয়েক বছর পূর্বেই। আল্লামা মুফতী আব্দুল হালীম বোখারী রহ. এর সরাসরি তত্ত্বাবধান করেছিলেন। ২টি খণ্ড প্রস্তুত। কর্তৃপক্ষের সানুগ্রহে প্রকাশিতব্য।
ফতওয়ার কিতাবটির জন্য একটি ভূমিকা লেখা হয়েছিলো। সেখানে মুফতী সাহেবানদের জীবনী সংকলন করা হয়েছে। সেই দায়িত্ব ছিলো অধমের ওপর। তখন দারুল মাআরিফের শিক্ষক মাওলানা মাহমূদ মুজিবের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে লেখাটি তৈরি করা হয়েছিলো। বিগত ২রা মে, ২০২৫ ইংরেজি, জুমাবার দিবাগত রাতে হযরত যওক সাহবে (রহ.) আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেলেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। নিম্নে হযরতের সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম আলোচনা করা হলো
শুভ জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়:
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের কোনো এক সোনালী মুহূর্তে কক্সবাজারের মহেশখালীতে রূহ আফজা বেগমের কোল আলোকিত করে পৃথিবীতে আগমন ঘটে এক নতুন জীবনের। রাজপুত্রের মতো অপূর্ব মুখাবয়ব, যেন আকাশের চাঁদও তার রূপের কাছে ম্লান! সূফী আবুল খায়ের সাহেব—যিনি নিজে ছিলেন এক দরবেশ সুলভ মানুষ, মুমিন হৃদয়ের অধিকারী, তাঁরই কোল আলোকিত করে পৃথিবীতে এ শিশুর জন্ম হয়। তিনি নিজের ঔরসজাত শিশুটির নাম রাখেন মুহাম্মদ সুলতান। পরবর্তীতে নিজ প্রচেষ্টা, মেহনত ও মুরব্বীদের বিশেষ নযরের মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেন ‘আল্লামা সুলতান যওক নদবী রহ.’।
তাঁর পিতা, সূফী আবুল খায়ের রহ., ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপনকারী এক ব্যবসায়ী। স্বর্ণ ও রৌপ্যের ব্যবসা তাঁর ছিল, কিন্তু তাতে কখনোই অহংকারের ছাপ পড়েনি। তাঁর জীবনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল নামায। আযান হলে তিনি নির্দ্বিধায় মসজিদে চলে যেতেন। বর্ষাকালে যখন আকাশে বিজলি চমকাতো, রাস্তাগুলো ভরে যেত কাদায়, তখনো তিনি লুঙ্গি ও কুর্তা গুটিয়ে, হারিকেন হাতে নিয়ে মসজিদে চলে যেতেন নামায আদায় করতে। এমন এক নিবেদিত মনের মানুষ ছিলেন তিনি, যে দৃষ্টান্ত সুলতান যওক রহ.-এর জীবনেও গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিল।
সুলতান যওক রহ. ছোটবেলা থেকেই এই নামাযের প্রতি নিবেদন এবং পিতার আদর্শ নিজের জীবনাচরণে একত্রিত করেছেন। বড় হওয়ার পর, যখন জীবনের নানা ব্যস্ততা তাঁকে চারপাশে ঘিরে রাখত, তবুও তিনি কখনো নামাযের নিয়ম থেকে বিচ্যুত হননি। পৃথিবীর যেখানেই গিয়েছেন, আযান হলেই তিনি নামাযে রত হয়েছেন—সবকিছু ছেড়ে রেখে।
দারুল মা’আরিফের ওস্তাদগণ বলেন, “হুযুরকে দেখেই আমরা সময়ের হিসাব বুঝতে পেতাম। যতই ব্যস্ততা থাকুক, নামাযের সময় হলেই তিনি চলে আসতেন মসজিদে। আমরা হুযুরকে দেখে বুঝতাম – সময় হয়ে গেছে নামাযের।ছাত্রজীবনে শেষরাতে হুযুরের গম্ভীর গলার আওয়াজ শুনে আমরা বিছানা ছেড়ে ওঠতাম তাহাজ্জুদরে জন্য। তিনি জামিয়ার আঙিনায় পায়চারি করতেন।কোনো ছাত্র যদি ফজর নামাযে মাসবুক হতো, তবে তার জন্য প্রশ্ন ওঠত, কেন সে যথাসময়ে নামাযে পৌঁছাতে পারেনি।”
এছাড়াও, তাঁর মাতার দিক থেকেও তিনি পেয়েছিলেন অসামান্য রূহানী ফয়েজ। তাঁর নানাজী হযরত মাওলানা মকবুল আহমদ রহ. ছিলেন থানভী সিলসিলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ খলীফা এবং হযরত জাফর আহমদ উসমানী রহ.-এর বিশেষ খলীফা। পিতামাতা দুজনেরই রূহানী প্রশান্তি ও পূর্ণতা তাঁকে এমন এক পরিবেশে লালন-পালন করেছে, যেখানে সুলতান যওক রহ. নূর মেখে মেখে বড় হয়েছেন। সেই আধ্যাত্মিক পরিবেশই ছিল তাঁর জীবনের মূল শক্তি, যা তাঁকে আধ্যাত্মিকতার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছতে সাহায্য করেছিল।
শিক্ষা-দীক্ষা :
একদিন বের হলেন এই শিশু, ঘর ছেড়ে দু’পা। ভর্তি হলেন বাড়ির পাশে প্রাথমিক স্কুলটিতে। তারপর নতুন বাজার জামে মসজিদের ফোরকানিয়ায় কিছুদিন থেকে ৫ম শেণীতে গিয়ে ভর্তি হলেন গোরকঘাটার মাদরাসায়ে ইসলামিয়ায়। সেখান থেকে তারপর চলে যান মাদরাসা আশরাফুল উলূম ঝাপুয়ায়। সেখানে হেদায়তুন্নাহু জামাতে ভর্তি হয়ে কিছুকাল অতিবাহিত করেন। তারপর পাড়ি জমান জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায়।
পটিয়া মাদরাসার মুহতামিম, আল্লামা আযীযুল হক সাহেব (রহ.) একদিন বালক মুহাম্মদ সুলতান যওককে দেখিয়ে সূফী আবুল খায়েরকে বলেন, ‘তোমার এ ছেলেটাকে পটিয়ায় পাঠিয়ে দাও।’ এভাবে তার পটিয়া আসা হয়। পটিয়ায় এসে, প্রস্ফুটিত হতে থাকে ধীরে-ধীরে সুলতান যওকের প্রতিভা। সবার নজর কাড়তে থাকেন তিনি। পদে পদে ফেলে যান দাগ—মেধার, প্রতিভার। জামাতে ছুয়াম থেকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত জামিয়া পটিয়ায় সমাপ্ত করে ১৯৫৯ ইংরেজিতে ফারেগ হন। পরবর্তীতে ১৯৮৪ ইংরেজিতে উচ্চতর নদবিয়্যত ডিগ্রী (সম্মানসূচক) লাভ করেন দারুল উলূম নদওয়াতুল ওলামা, লৌখনো, ভারত থেকে। এভাবে, কৃতিত্বের সঙ্গে সমাপ্ত করেন শিক্ষাজীবন।
কর্মজীবন :
আল্লামা সুলতান যওক নদভী রহ. বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের গুরু দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন। তন্মধ্যে অন্যতম হলো;
বসরত নগর রশিদিয়া মাদরাসা, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম-এ সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন।
জামিয়া এমদাদিয়া কিশোরগঞ্জে প্রায় দুইবছর হাদীস ও আরবী প্রভাষকের খেদমত আঞ্জাম দেয়া।
জামিয়া আযীযুল উলূম বাবুনগর, ফটিকছড়িতে হাদীস, ফিকহ ও আরবী সাহিত্যর পাঠদান।
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম-এ মুহাদ্দিস ও আরবী বিভাগীয় প্রধান এবং সহকারী মুফতী হিসেবে প্রায় সতের বছর খেদমত আঞ্জাম দেয়া।
ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দারুল উলূম নদওয়াতুল ওলামা লৌখনো, ভারত-এ ২ মাস যাবত দরস প্রদান করেন।
জামিয়া দারুল মা’আরিফ আল-ইসলামিয়া, ঢট্টগ্রাম-এ ১৯৮৫ থেকে মৃত্যুঅবধি প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও আরবী সাহিত্যের উচ্চতর শিক্ষক এবং প্রধান মুফতী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জামিয়া পটিয়ার দৃষ্টি নন্দিত শিক্ষকতা :
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা মুফতী আযীযুল হক রহ. -এর পরম আদরের শাগরিদ আল্লামা সুলতান যওক নদভী (রহ.) জামিয়া পটিয়ায় ১৩৯২ হিজরী সনে দ্বিতীয়বার শিক্ষক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এরপর তিনি একজন আদর্শ শিক্ষকের আসনে সমাসীন হলেন। রাতদিন এক করে ভাবতেন-কীভাবে ছাত্রদের গড়ে তোলা যায়। যোগ্য করা যায়। আরবীতে যেন লিখতে-বলতে পারে সবাই, অণর্গল—সেই ফিকর-চিন্তা করতে থাকেন। তারপর হাতে নেন কর্মসূচি। শুরু হয় পরিশ্রম। মেহনত আর মেহনত। প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। ছাত্রদের প্রতি দরদী এ মনীষী, দৃষ্টি কাড়ে সবার। খতীবে আজম আল্লামা সিদ্দীক আহমদ সাহেব (রহ.) তখন জামিয়া পটিয়ায় নাজেমে তালীমাত ও শায়খুল হাদীস। তিনি আল্লামা সুলতান যওক সাহেবের ছাত্র গড়ার নানাবিধ প্রচেষ্টা দেখে, ছাত্রদের বলতেন,
‘আমার মন চায়, এ বুড়ো বয়সেও আবার তালীবে ইলম হয়ে যওক সাহেবের কাছে পড়া শুরু করে দিই।’
কবিতা ও সাহিত্য চর্চা :
তিনি স্বভাবজাত একজন কবিও ছিলেন। উরদু এবং আরবীতে রয়েছে তার অসংখ্য কবিতা। তার উরদুর দক্ষতা দেখে হযরত রাবে হাসান নদভী (রহ.) বিস্ময়প্রকাশ করে বলেছিলেনㅡ‘মাওলানা যওক সাহেব, বলুন তো, আপনার উরদু এতো চমৎকার ও বিশুদ্ধ কী করে হলো!?’আর তাঁর আরবীর দক্ষতা তো সর্বজনবিদিত। শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানী সাহেবের ভাষায়, ‘তিনি বাংলাদেশের একজন মহান আলেমে দীন। আরবদের চাইতেও ভালো আরবী লিখতে পারেন। যাকে দেখলে আমাদের জামাতের ঘাটতির অনুভূতি হ্রাস পায়।’
জামিয়া দারুল মা’আরিফের প্রতিষ্ঠা :
জামিয়া পটিয়ায় দীর্ঘকাল শিক্ষকতা শেষে স্বেচ্ছায় দায়িত্ব ত্যাগ করেন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভী (রহ.)। অতঃপর, মুফাক্কিরে ইসলাম আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)-এর পরামর্শ ও নির্দেশনায় ১৯৮৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জামিয়া দারুল মা‘আরিফ আল-ইসলামিয়া। মূলত, ১৯৮৪ সালের এক মাহেন্দ্রক্ষণে আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) বাংলাদেশ সফরে এলে তাঁর সঙ্গে আল্লামা সুলতান যওক নদভী (রহ.)-এর বিশেষ আলোচনার ভিত্তিতে দেশের বরেণ্য আলেম-ওলামা ও ইসলামী ব্যক্তিত্বদের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয় এই বহুমুখী গবেষণাধর্মী ও যুগোপযোগী আদর্শ শিক্ষাকেন্দ্র—‘জামিয়া দারুল মা‘আরিফ আল-ইসলামিয়া’। এটি একটি ইসলামী শিক্ষা ও দাওয়াতভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে, নতুন প্রজন্মকে যুগোপযোগী যোগ্য শিক্ষক, বিচক্ষণ মুবাল্লিগ এবং মুসলিম সমাজের আদর্শ পথনির্দেশক হিসেবে গড়ে তোলা। শিক্ষার্থীদের কুরআন-হাদীস ও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি আরবী ভাষায় দক্ষতা এবং দাওয়াতি কর্মকাণ্ডে পারদর্শিতা অর্জনের দিকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটি দারুল উলুম দেওবন্দ এবং নদওয়াতুল ওলামা-এর চিন্তা-চেতনা ও আদর্শের সমন্বয়ে পরিচালিত একটি শিক্ষানিকেতন, যার ফলে এর শিক্ষা-ব্যবস্থা ও কার্যক্রমে রয়েছে একটি বৈশ্বিক আবেদন ও সার্বজনীনতা।
তাঁর উল্লেখযোগ্য শিষ্যগণ ;
তিনি দারুল উলূম নদওয়াতুল ওলামা, লৌখনোতে খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন এবং জামিয়া পটিয়া, কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়া, জামিয়া আযীযুল উলূম বাবুনগরেও পাঠদান করেছেন দীর্ঘদিন। সে হিসেবে তাঁর সৃজন-বাগান অনেক প্রশস্ত। যোগ্য ও দেশবরেণ্য ছাত্র অগণিত। তাঁর শাগরেদদের অন্যতম হলেন;
১। মাওলানা আতাউর রহমান খান (কিশোরগঞ্জ)
২। মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ (ঢাকা)
৩। মাওলানা আনওয়ার শাহ সাহেব (কিশোরগঞ্জ)
৪। মাওলানা আশরাফ আলী (কিশোরগঞ্জ)
৫। মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ (ঢাকা।)
৬। মাওলানা মুহাম্মদ আইয়ুব রহ. (জামিয়া পটিয়া)
৭। মাওলানা মুফতী শামছুদ্দিন জিয়া (জামিয়া পটিয়া)
৮। মাওলানা হাফেজ মুহাম্মদ জুনাইদ বাবুনগরী (জামিয়া আহলিয়া হাটহাজারী)
৯। মাওলানা ফজলুল্লাহ (বোয়ালখালী)
১০। প্রফেসর ড. মাওলানা আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভী (এমপি)
১১। মাওলানা ওবাইদুর রহমান খান নদভী (ঢাকা)
১২। ড. মাহফুজুর রহমান (কুষ্টিয়া)
১৩। প্রফেসর ড. রশীদ রাশেদ (অষ্ট্রেলিয়া)
১৪। ড. মুজাফফর আহমদ নদভী (আইআইইউসি)
১৫। মাওলানা ইকবাল নদভী (ভারত)
১৬। মাওলানা জসিমুদ্দীন নদভী (দারুল মা’আরিফ)
১৭। মাওলানা মুহাম্মদ তাহের কাউছার (পাকিস্তান)
১৮। প্রফেসর ড. মাওলানা মুহাম্মদ রশীদ জাহেদ (আইআইইউসি)
১৯। মাওলানা হেফাজতুল্লাহ নদভী
২০। মাওলানা ফজলুর রহমান
২১। মাওলানা শাকের আলম শওক (আইআইইউসি)
২২। মাওলানা হাফেজ ওবাইদুল্লাহ (কাতার)
২৩। মাওলানা হাফেজ নুরুল হক (কাতার)
বর্হিবিশ্বে তাঁর পদচারণা :
আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভী (রহ.)। তিনি যে শুধু তার সুদর্শন চেহারায়-ই অনুপম, তা-নয়; বরং ইলমে-আমলে আরও বেশি দীপ্যমান। এই উজ্জ্বল্যতার কারণে কাছে-দূরের অজস্র মানুষ, তাদের মধ্যে কত লিখিয়ে কত দার্শনিক, তাকে অনবরত প্রীতি আর ভক্তির তাপ জুগিয়েছেনㅡতা হিসেব ছাড়া। বিশ্বের নানাপ্রান্তে তিনি আমন্ত্রিত হয়েছেন। কথা বলেছেন। প্রবন্ধ পড়েছেন।
১৯৯০ সালে উপসাগরীয় সমস্যার পর্যালোচনার জন্য ‘রাবেতাতুল-আলম আল-ইসলামী’র আহ্বানে মক্কা মোকাররমায়া অনুষ্ঠিত এক কনফারেন্সে যোগদান করেন। এ সফরে সৌদি সরকারের ব্যবস্থাপনায় বায়তুল্লাহ শরীফের অভ্যন্তরে প্রবেশের বিরল সুযোগ লাভ করেন। আবার লিবিয়ায় অনুষ্ঠিত ১৮৮২ সনে, গবেষণামূলক একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ২য় স্থান অধিকার করেনㅡবিশ্বের ৩৬ টি দেশের ৭৪ জন স্কলারের মধ্যে। তাছাড়া তিনি আমন্ত্রিত হয়েছেনㅡমিশর, তুরস্ক, শ্রীলংকা, মরক্কো, কুয়েত, আফগানিস্তান, কাতার, ওমান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, পাকিস্থান ছাড়াও বিশ্বের আরও বহু রাষ্ট্রে।
যে সকল বুযুর্গানে দীনের খেলাফত লাভে ধন্য হয়েছেন :
আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রাহিমাহুল্লাহর একান্ত সুহবতধন্য হয়ে ইজাযাতপ্রাপ্তির পাশাপাশি তিনি পেয়েছেন আরও কয়েকজন বরেণ্য মনীষীর শিষ্যত্ব গ্রহণের সৌভাগ্য। যাদের থেকে তিনি হাদীসের ইজাযত নিয়েছেন। তাদের অন্যতমㅡশায়খুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া রহ., হাকীমুল ইসলাম কারী মুহাম্মদ তৈয়ব রহ., আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ., আল্লামা ইউসুফ বানুরী রহ., মাওলানা মনজুর নোমানী রহ., শায়খ আব্দুল্লাহ দরখাস্তী রহ. প্রমুখ। এ ছাড়াও বাংলাদেশের অনেক মনীষীর কাছ থেকেও খেলাফতপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাঁরা হলেন; ১- মাওলানা হারুন বাবুনগরী রহ. ২- মাওলানা শাহ মেহেরুজ্জামান রহ. ৩- মাওলানা শাহ আলী আহমদ বোয়ালভী রহ. ৪- মাওলানা ইহসানুল হক সন্দীপি রহ.।
রচনা ও গ্রন্থাবলি :
১। আত-তারিক ইলাল-ইনশা (আবরী রচনার শৈল্পিক পদ্ধতি)
২। কাসানুন নাবীয়্যীন, টিকা-টিপ্পনী ও অনুশীলনী সংযোজন (৩খণ্ড)।
৩। যাদুত তালেবীন, নির্বাচিত হাদীস গ্রন্থের উরদু অনুবাদ।
৪। নুখবাতুল আহাদীস, নির্বাচিত হাদীস সম্ভার।
৫। শিক্ষা সংস্করের ডাক, আরবী ও বাংলায় প্রকাশিত।
৬-৯। শিশুদের আরবী শিক্ষা সিরিজ (চারটি কিতাব)
(ক) ইশরুনা দরসান, (খ) আল-কিরাআতু লির রাশিদীন, (গ) আল-কিরাআতুল আরাবিয়া (২য় খণ্ড)
১০। মু-আল্লিমুল ফার্সি
১১। রাহবারে উরদু
১২। আসান কাওয়ায়েদে উরদু
১৩। তাযকেরায়ে আযীয, মুফতী আযিযুল হক (রহ)-এর জীবন ও কর্ম। (উরদু)
১৪। তাছলিয়াতুল কুলুব, হযরত মাওলানা হারুন বাবুনগরী রহ, এর জীবনী। (উরদু)
১৫। আল্লামা আবুল হাসান আলা নদভী (রহ)-এর জীবন ও দর্শন (আরবী)
১৬। আল্লামা কারী তৈয়ব সাহেব (রহ.)-এর জীবন ও শিক্ষা (আরবী)
১৭। সাজারাত মিনান-নুসুসিল আদাবিয়া, আরবী সাহিত্য সংকলন (দুই খণ্ড, যন্ত্রস্থ)
১৮। কনদেখামা শরহে পান্দনামা (উরদু)।
১৯। কুল্লিয়াতে যওক স্বরচিত আরবী, ফার্সি, উরদু কবিতা।
২০। আল আযকার ওয়াল আওরাদুল মাসনূনাহ (আরবী/বাংলা)।
২১। সহজ হজ ও ওমরা (বাংলা)
২২। দাওয়াতুল ইসলাহ ওয়াত তাতভীর (আরবী)।
২৩। মাদরাসা শিক্ষা সংস্কারের ডাক (বাংলা)।
২৪। তুরুকুত তাসীর ওয়াল ইকনা ফীদ-দাওয়াত ইলাল্লাহ (আরবী)।
ব্যক্তিগত কিছু স্মৃতি
হযরতের সাথে আমার পরিচয় সেই শৈশবেই, যখন আমরা হিফয বিভাগে অধ্যয়ন করছিলাম। তিনি তখন বোয়ালিয়া হোসাইনিয়া নতুন মাদরাসার মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। মাঝে মাঝে মাদরাসায় এসে ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে মূল্যবান নসীহত পেশ করতেন। তাঁর প্রাণস্পর্শী কথা, অনুপম আচরণ ও দীপ্ত ব্যক্তিত্ব আমাকে গভীরভাবে বিমুগ্ধ করত। তখন থেকেই মনের গহীনে তাঁর প্রতি অজানা এক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ গড়ে ওঠে।
পরবর্তীকালে তাঁর রচনাগুলো যখন দরসে পাঠ করবার সুযোগ হলো, তখন তাঁর ভাবনার গভীরতা ও বিশুদ্ধতা আমাকে আরও মুগ্ধ করে। তবে দুঃখের বিষয়, সরাসরি তাঁর দরসে বসে শিক্ষা গ্রহণের সৌভাগ্য আর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তাঁর কিতাবাদি যখন নিজে পড়ানোর সুযোগ এলো, তখন অন্তরে এক প্রগাঢ় আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠল—এই মহামনীষীর নিকট থেকে ইজাযত গ্রহণ করতে হবে।
এই আগ্রহ থেকেই একদিন ছুটে গেলাম তাঁর সান্নিধ্যে। পরিচয় জেনে তিনি অত্যন্ত স্নেহভরে আমাকে কাছে টেনে নিলেন। অতঃপর তাঁর হাতে থাকা যতগুলো সনদ ছিল, সবই একে একে পাঠ করে আমাকে ইজাযত প্রদান করলেন। নিজের হাতে কষ্ট করে লিখে একটি সনদপত্রও দান করেন। সে মুহূর্তে তাঁর হৃদয়ের যে উষ্ণতা, ভালোবাসা ও আত্মিক ঔদার্য পেয়েছিলাম, তা আজীবনের সম্পদ হয়ে রইল। এভাবেই তাঁর সঙ্গে গড়ে উঠেছিল এক অন্তরঙ্গ আধ্যাত্মিক সম্পর্ক।
আজ তিনি আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন। তবুও তাঁর স্মৃতি, শিক্ষা ও ভালোবাসা হৃদয়ের আকাশে নক্ষত্রের মতো দীপ্ত হয়ে থাকবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন তাঁর কবরকে জান্নাতুল ফিরদাউসের সুবাসে ভরে দেন—আমীন।
মৃত্যু ও দাফন: বিদায়ের শোকাবহ মুহূর্ত
সময় চলে যায়, স্মৃতি রয়ে যায়। কিন্তু কিছু বিদায় হৃদয়ে এমন এক শূন্যতার রেখা টেনে যায়, যা সহজে পূরণ হয় না। আমাদের প্রিয় হযরত আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভী (রহ.)-এর ইন্তেকাল ছিল তেমনই এক অশ্রুসিক্ত বিদায়—যা রেখে গেছে গভীর বেদনাবোধ, রেখে গেছে এক বিশাল শূন্যতা।
শুক্রবার রাত ১২টায়, চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন এই প্রাজ্ঞ আলেমে দীন।إنالله وإناإليه راجعون—নিঃসন্দেহে আমরা আল্লাহরই এবং তাঁর দিকেই আমাদের প্রত্যাবর্তন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। তিনি পেছনে রেখে গেছেন দুই পুত্র, পাঁচ কন্যা, হাজার হাজার রূহানী সন্তান এবং অগণিত শুভানুধ্যায়ী ও গুণগ্রাহী, যারা আজো তাঁর বিদায়ের শোক বুকে ধারণ করে পথ চলে।
৩রা মে, শনিবার বিকেল ৪টায় চট্টগ্রামস্থ তাঁর প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া দারুল মা‘আরিফআল-ইসলামিয়া-র প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় তাঁর নামাযে জানাযা। যেন আকাশ-বাতাসও সে মুহূর্তে ভারী হয়ে এসেছিল। জানাযায় ইমামতি করেন মরহুমের সুযোগ্য পুত্র মাওলানা এমদাদ উল্লাহ। দেশবরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ, শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম, বিভিন্ন মাদরাসার মুহতামিম ও শিক্ষকবৃন্দ এবং লাখো মুসল্লির উপস্থিতে সেই প্রিয় মুখটিকে শেষ বিদায় জানানো হয়।
নামাযে জানাযা শেষে তাঁকে দাফন করা হয় জামিয়ার সন্নিকটে অবস্থিত কবরস্থানে—তাঁরই হাতেগড়া প্রতিষ্ঠানটির পবিত্র প্রাঙ্গণে, যেখানে তাঁর জীবনের নিঃস্বার্থ শ্রম, দাওয়াতি ঘাম এবং শিক্ষার আলো একাত্ম হয়ে রয়েছে। মাটি চাপা পড়েছে এক দেহ, কিন্তু ইতিহাসে অমলিন হয়ে রইল এক মহত ব্যক্তিত্ব, এক দীপ্ত আদর্শ, এক অবিচল চিন্তাধারা।
আমরা প্রার্থনা করি—আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন, তাঁর কবরকে নূরের উদ্যান বানিয়ে দিন এবং আমাদেরকেও তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শে অনুপ্রাণিত জীবন যাপনের তাওফিক দিন—আমীন।
তথ্যসূত্র :
১। আমার জীবন কথা।
২। হিলফুল ফুজূল সংগঠন কর্তৃক প্রকাশিত তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী।
৩। মাসিক মানারুশ-শরক।
৪। মাসিক আস-সুবহুল জাদীদ।