এহতেশাম আনাস
গ্রীষ্মের দুপুরে হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড় নেমেছে। আকাশে ভীষণ ধোঁয়াটে মেঘ। চারিপাশ অন্ধকারে নিমজ্জিত। প্রবল বাতাসে গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ছে। বাসাবাড়ির টিনে ভারি বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ। বজ্রপাতের বিকট শব্দে আমরা ভাইবোন সবাই ভয়ে আঁতকে উঠেছি। গা শিউরে উঠেছে ঠাণ্ডা বাতাসে। বাড়ির চৌকিতে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বসেছে আড্ডা।
আমাদের ভয় কাটিয়ে দিতে আম্মা গল্প শুরু করেছেন। গল্প করতে করতে একটা সময় গল্পের চরিত্র হয়েছি আমি। কাঁদো কাঁদো গলায় আম্মু বলেছেন, জানিস? তোকে অনেক কষ্ট আর ত্যাগ দিয়ে রবের কাছে চেয়ে রেখেছি। তুই তখন ছোট। একদম ছোট। সাত নাকি আট মাসের শিশু। হঠাৎ তুই ভয়ানক শব্দে কান্না শুরু করলি। এ কান্না কেবল কান্নাই ছিল না। সেই কান্না শরীরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা যন্ত্রণার অব্যক্ত আর্তনাদ। কান্না হয়ে উঠেছে ভেতরের অসহনীয় যন্ত্রণার প্রতিশব্দ। তোর কচি গলার এমন অস্বাভাবিক কান্নায় ভেতরটা মুচড় দিয়ে উঠেছে। আকাশ কেঁদেছে। কেঁদেছে পাড়াপ্রতিবেশি। সেদিন তো আশপাশের মানুষজনের ভিড় লেগে গেছিল তোকে ঘিরে। তোর এমন যন্ত্রণা দেখে পরিস্থিতি বুঝতে হিমসিম খেয়ে গেছি।
গ্রামের বাড়ি। আশপাশে ছিল না কোনো ডাক্তার। কোনোমতে চলে তেমন ডাক্তার মেলাতেও অনেক দৌড়ঝাঁপ সইতে হতো। গাড়ি পাওয়া তো স্বপ্ন, চলাচলের ভালো রাস্তাটাই মিলে নি। মাইলের পর মাইল হেঁটেই চলতে হয়েছে। তোর আব্বুও বাড়িতে ছিলেন না। তোর আপুরাও এমন ছোট যে, আমার কাজে হাত লাগানোর শক্তি ছিল না। একা সেদিন তোকে কাঁধে নিয়ে দৌড়িয়েছি। দীর্ঘ পথ হেঁটে গেছি ডাক্তারের কাছে।
ডাক্তার দেখেই বলে ফেলেছেন এ শিশু বেঁচে উঠবে না। ভীষণ মারাত্মক রোগে ধরেছে। ডাক্তার বলেছিল ‘নিউমোনিয়া’ রোগ। নিউমোনিয়া খুবই ক্রিটিকাল অসুখ। তাতে মৃত্যুর শঙ্কা থাকে ঢের। বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা খুব কমই। এ রোগের পর্যাপ্ত ট্রিটমেন্ট তখনকার সময়ের জন্য দুর্লভ ছিল। নিউমোনিয়ার কারণে যে ফুসফুস যথাক্রমে শ্বাস নিতে পারে না, তার জন্য শ্বাসযন্ত্রও নাই। শহরে ছিল কি-না জানতাম না।
গ্রামে বসতবাড়ি। গ্রামের মানুষদের জন্য এসবের ভাবনা, নুনভাতের জিন্দেগীতে আকাশ ধরার স্বপ্ন। গ্রামের ‘হাতুড়ে চিকিৎসক’-এর যতটুকু সেবা, তাতেই আমাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা। গ্রামে অতো কিসিমের রোগ দেখা যায় নি। শহর থেকে কী-ই সব নতুন নতুন রোগের খবর আসতো, সে-সব গ্রামের লোকদের আজগুবিই লাগতো। তোর মরণব্যাধি—কিন্তু ভালো ট্রিটমেন্ট না থাকায় ভয় হচ্ছিল প্রচুর।
ডাক্তার বলেছে, অতিরিক্ত নিউমোনিয়ার কারণে শিশুর প্রাণ বাঁচতে দেয়া ভীষণ চ্যালেঞ্জিং বিষয়। উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। তখনকার শিশুদের জন্য নিউমোনিয়া প্রাণনাশক ব্যাধি। তোর এমন মারাত্মক অসুস্থতা দেখে আমরা সকলেই ভীতসন্ত্রস্ত। ভালো ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা তো ছিলই না। তারমধ্যে প্রাণ যাওয়ার পরিস্থিতি।
এতো বিপদজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেও ভেঙে পড়ি নি। রবের দরবারে প্রার্থনায় মগ্ন থেকেছি। রবের নিকট তাঁর একান্ত করুণাই বেঁচে থাকার মাধ্যম। খুউব করে তোর জন্য সুস্থতা খুঁজেছি। মহান প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা জারি রেখেছি। দুআর সাথে যা পেরেছি ট্রিটমেন্ট চালিয়ে গেছি। উন্নত চিকিৎসা না থাকায় ইন্ট্রাভেনাস থেরাপিই দিতে পেরেছি। ক্যানোলা লাগিয়ে স্যালাইন চলেছে দিনের পর দিন। তোর কোনো নড়চড় নেই। কান্নাটাও ভুলে গেছিস। যেন মৃত্যুর কোলে সামান্য প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকলি। আমাদের অবস্থাটা যাচ্ছিল ভয়ে ভয়ে। না জানি তোকে হারিয়ে বসতে হবে কি-না; সে ভয়ে অন্তর কম্পিত।
মোটা একটা শরীর ছিল তোর। চেহারায় উজ্জ্বল লাবণ্যতা। খুুবই চঞ্চলতা দেখা যেতো তোর মায়ামুখে। এক অসুখে সব শেষ। এখন সে-সবকিছু অল্পতেই আছে। সে অসুস্থতা তোকে অনেকদিন জ্বালিয়েছে। দীর্ঘ সময়ের পর মহান প্রতিপালকের অফুরন্ত দয়া ও অনুগ্রহে তুই অসুখ থেকে বেঁচে ফিরেছিস।
মহীয়সী মায়ের মুখে সন্তানের স্মৃতিচারণ খুব আবেগঘন হয়েই শুনছি। শুনতে শুনতে কখন যে অশ্রু জমেছে চোখে, টেরই পাই নি। সন্তানের প্রতি মায়ের এমন অতুলনীয় ভালোবাসা ও আবেগ যারপরনাই বিস্মিত করেছে। এটা কোনো সাধারণ স্মৃতি না। এ একটা স্মৃতিজুড়ে জড়িয়ে আছে, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া। মায়ের আত্মত্যাগ ও প্রচেষ্টায় সুস্থ হয়ে ফিরে আসা। সন্তানের অসুস্থতায় মায়ের দৌড়ঝাঁপ ও অস্থিরতা। যন্ত্রণার জগত থেকে প্রশান্তি নিয়ে ফেরার মুহূর্ত। সবকিছু মিলালে এ একটা স্মৃতি অবিস্মরণীয় ও বেদনাদায়ক। স্মৃতির পাতায় সেই ভয়াবহ দিন আজও গেঁথে আছে গভীরভাবে। মা’য়ের ভালোবাসা, ত্যাগ ও প্রার্থনার জোরেই আজ বেঁচে আছি। এই সত্যটাই আমার জীবনের শিক্ষা ও আশ্রয়। রবের নিকট প্রার্থনা, তিনি আমার ওপর মায়ের ছায়া দীর্ঘায়িত করুক এবং নেক হায়াত দান করুক। আমীন।