মুহাম্মাদ আলী রেজা
খুবই সহজ কিন্তু সবচেয়ে কার্যকর একটি ইবাদত অনায়াসেই করা যায়। অথচ না জানার কারণে প্রায় সবাই আমরা উপেক্ষা করি। এর বা যার গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা বেশির ভাগই গভীরভাবে অসচেতন। এই ইবাদতটি হচ্ছে জিকরুল্লাহ (আল্লাহকে স্মরণ)। এ জন্য অজু, গোসল বা পবিত্রতার জন্য নেই কোনো বাধ্যবাধকতা। বসে, দাঁড়িয়ে, শুয়ে, ভ্রমণে যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায়, যেকোনো পরিস্থিতিতে অনায়াসে এই জিকির করা যায় প্রকৃতিতে আল্লাহর অগণিত সৃষ্টির নিদর্শন দেখে। শুধু শর্ত একটি—সব জায়গায়, সব পরিস্থিতিতে এবং সব কিছুতে আল্লাহ পাকের আয়াত নিদর্শন খুঁজতে হবে। সে জন্য গভীর মনোযোগসহকারে জ্ঞান ও চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহর জিকির করে এবং চিন্তা-গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে, তারা বলে—হে আমাদের প্রতিপালক! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করোনি। সব পবিত্রতা তোমারই, আমাদিগকে তুমি আগুনের শাস্তি থেকে বাঁচাও’ (সূরা আলে ইমরান : ১৯১)। এখানে আল্লাহ তাআলার জিকির করার অর্থ হলো পৃথিবী ও পৃথিবীর বাইরের জগৎ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করা।
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক বিক্রীত একটি বই হচ্ছে, ক্যারেন আর্মস্ট্রংয়ের ‘অ্যা হিস্ট্রি অব গড’। এতে বর্ণিত হয়েছে, ‘কুরআন পাকে সবসময়ই বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে আল্লাহ পাকের নিদর্শন বা আয়াতের রহস্য উদঘাটনের বিষয়কে। আর এ কারণে ইসলামের অনুসারীরা যুক্তি ও কারণকে এড়িয়ে না গিয়ে গভীর মনোযোগ এবং বিশেষ কৌতূহলের সাথে পৃথিবীর সব কিছুকে পর্যবেক্ষণ করছে। এই মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির ফলে পরে দেখা যায়, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে (ন্যাচারাল সায়েন্স) মুসলমানদের এক উৎকৃষ্ট ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে, যা কখনো বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের বিরোধ বা সংঘর্ষ ঘটায়নি। অথচ খ্রিষ্টান ধর্মে সেটা দেখা গেছে।
‘মুহাম্মাদ দ্য প্রফেট অব ইসলাম’ গ্রন্থে প্রফেসর রাও লিখেছেন, ‘কুরআন পাকে যতগুলো আয়াত মৌলিক ইবাদত সম্পর্কিত, তার চেয়ে অনেক বেশি সেই সম্পর্কিত আয়াত যেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে প্রকৃতি বা সৃষ্টিরহস্য নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা, পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানের। আরবের মুসলমানেরা এই প্রেরণায় প্রকৃতির রহস্য নিয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ শুরু করে দিয়েছিলেন, যেটা বর্তমান সময়ের বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা ও গবেষণার মূলনীতির ভিত্তি নির্মাণ করে—যা অজ্ঞাত ছিল গ্রিকদের কাছে।
শুরুতে দেখে নিই—জিকিরের সাথে আয়াতের সেতুবন্ধ ও নিবিড় সম্পর্কটা গড়ে উঠল কিভাবে? প্রচলিত অর্থে কুরআনের বাক্য হচ্ছে আয়াত। আরবী ভাষায় জুমলাহ মানে বাক্য, তার পরও কুরআনের বাক্যকে জুমলাহ না বলে আয়াত বা নিদর্শন বলা হয় কেন? কুরআনের বাক্য ও আল্লাহ পাকের আরেক নিদর্শন (আয়াত বা sign)। কুরআনের বাক্যের সমতুল্য কোনো বাক্য মানবজাতি রচনা করতে পারে না, যেমনটি পারে না প্রকৃতিতে অগণিত দ্রব্য যেমন—পানি, বাতাস, বৃক্ষ, প্রাণী ইত্যাদি যেগুলো একান্তই আল্লাহ পাকের আয়াত।
আর এ কারণে দুনিয়ার মুসলমানেরা বাক্য না বলে কুরআনের বাক্যকে আয়াত বা নিদর্শন বলে। কেবল জিকির করার মানসেই মুসলিম জাতি প্রকৃতিতে আল্লাহর নিদর্শন বোঝার চেষ্টা চালিয়ে আজকে বিজ্ঞান বলতে বিশ্ববাসী যেটাকে বুঝে থাকে, সেই আদি বিজ্ঞানের বা পদার্থবিজ্ঞানের সূচনা করেছে। এমনটিই তথ্য রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাঠাগার ‘লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে’। সূত্র : লেখকের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস পরিদর্শন।
আসুন প্রথমে আমরা নিজেরই দেহে আল্লাহর আয়াত কী আছে তা পরখ করার মাধ্যমে শুরু করি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিনিয়ত জিকির করার অভ্যাস। বাস্তবে জীবনের সব কিছুতে এমনটি (আল্লাহ পাকের অপার নিদর্শন) খুঁজে পাওয়া যাবে।
- মানব মস্তিষ্ক তিন থেকে এক হাজার টেরাবাইট তথ্য ধারণ করতে সক্ষম, যেখানে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল আর্কাইভের পরিমাণ হচ্ছে ৭০ টেরাবাইট তথ্য (যেখানে যুক্তরাজ্যের ৯০০ বছরের ইতিহাস সংরক্ষিত রয়েছে)।
শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোর জন্য দেহের অনেক জায়গা দরকার হয়। ফুসফুসের ভেতরে যে জায়গা রয়েছে তার পরিমাণ একটি টেনিস কোর্টের প্রায় সমান হবে।
গড়ে একজন মানুষ ৩০ মিনিটে যে তাপ তৈরি করতে পারে, তা দিয়ে আধা গ্যালন পানি ফুটানো যায়।
মানুষ না খেয়ে ২০ দিন বাঁচতে পারে, কিন্তু পানি পান না করে মাত্র দুই দিন।
কেবল বেঁচে থাকার জন্য (শ্বাস-প্রশ্বাস, ঘুম ও খাওয়া) আমাদের দেহের দরকার হয় এক থেকে দেড় হাজার ক্যালরি।
দৈনিক আমাদের হার্ট ১০০ বার করে আমাদের দেহে রক্ত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রবাহিত করে।
আমাদের কিডনি গড়ে প্রতি মিনিটে ১.৩ লিটার রক্ত পরিশুদ্ধ করে।
আমাদের পরিপাকতন্ত্রের এসিড এত শক্তিশালী যে, এটা রেজর ব্লেডকে গলিয়ে ফেলে।
আমরা যখন হাঁচি দিই সেই বাতাস ঘণ্টায় ১০০ মাইলেরও বেশি গতি পায়। হাঁচির সময় আমাদের শরীরের ভেতরকার সব ধরনের কাজ বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি হৃদস্পন্দন থেমে যায়।
আমাদের চোখের একটি পাপড়ি ১৫০ দিন বেঁচে থাকে। এরপর নিজে থেকেই ঝরে পড়ে।
আমাদের দেহের রক্তের শিরা ৬০ হাজার মাইলের মতো হবে।
৬০ বছর বয়সে বেশির ভাগ মানুষ স্বাদ গ্রন্থির ক্ষমতা অর্ধেক হারায়।
দেহে প্রতিদিন ৩০০ বিলিয়ন নতুন কোষ তৈরি হয় এবং প্রতি মিনিটে ৩০০ মিলিয়ন পুরাতন কোষ মারা যায়।
একজন পুরুষ প্রত্যেক দিনে ১০ মিলিয়নের মতো শুক্র তৈরি করে।
একজন মহিলা অর্ধমিলিয়ন এগ (ডিম্ব) তৈরি করে।
দেহের সবচেয়ে বড় কোষ মহিলাদের এগ আর সবচেয়ে ছোট হচ্ছে পুরুষের শুক্র।
পাথর থেকে মানুষের দেহের হাড় চার গুণ বেশি শক্তিশালী।
৪৬ মাইলের মতো স্নায়ু আছে প্রাপ্তবয়স্কদের। ১০০ বিলিয়নের অধিক নার্ভ সেল নিয়ে আমাদের দেহ গঠিত।
ব্রেইন দেহের দুই ভাগ মাত্র কিন্তু রক্তের ভেতর দিয়ে দেহে যে অক্সিজেন প্রবেশ করে তার ২০ ভাগ সে কাজে লাগায়।
ব্রেইন থেকে সঙ্কেত স্নায়ুর মাধ্যমে ঘণ্টায় ১৭০ মাইল বেগে ভ্রমণ করে।
ব্রেইনের ১০০ বিলিয়ন স্নায়ুকোষ রয়েছে যারা দেহের ভেতর সংবাদ গ্রহণ করে ও পাঠায়।
প্রতিদিন দেহ হারায় ৪০ থেকে ১০০ চুল। মানুষের চুল তিন থেকে সাত বছর বাঁচে।
মহিলাদের চুলের ব্যাস পুরুষদের চুলের অর্ধেক।
আমাদের হাতের নখ যা দিয়ে তৈরি ঠিক সেই পদার্থ দিয়েই চুল তৈরি হয়ে থাকে। ফলে হাতের নখ ও চুল উভয়ই একই পদার্থের তবে দু’টির ঘনত্ব আলাদা।
মানব দেহে যে পরিমাণ লোহা আছে তা দিয়ে তিন ইঞ্চি নখ বানানো যায়।
আমাদের মাথার খুলি ২৬ ধরনের ভিন্ন ভিন্ন হাড় দিয়ে তৈরি।
দাঁত হচ্ছে দেহের একমাত্র অঙ্গ যেটা নিজেকে নিজে নিজে সারাতে বা পুনর্গঠন করতে পারে না।
একজন মানুষের সারা জীবনে যে চুল গজায় তার দৈর্ঘ্য ৪৫০ মাইল।
দেহের চামড়ার প্রতি ইঞ্চি জায়গায় তিন কোটি ২০ লাখ ব্যাকটেরিয়া থাকে।
আমাদের প্রতি পায়ের পদতলে এক ট্রিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া থাকে।
উল্লেখ্য, এক ট্রিলিয়ান = ১,০০০,০০০,০০০,০০০।
একজন ব্যক্তি তার জীবনে প্রায় ১৬ হাজার গ্যালন পানি পান করে।
গর্ভধারণের তিন মাসের ভেতরে শিশুর হাতের রেখা গঠন হয়ে যায়।
১০ ওয়াট লাইট বাল্ব যে শক্তি দেয়, আমাদের ব্রেইন সেই পরিমাণ শক্তির সাহায্যে কাজ করে।
শিশু ৩০০ হাড় নিয়ে জন্ম নিলেও প্রাপ্তবয়স্ক হলে এটা কমে ২০৬-এ দাঁড়ায়।
গড়ে একজন মানুষের মাথায় এক লাখ চুল থাকে।
প্রাপ্তবয়স্কদের দেহে ১০০ ট্রিলিয়ন কোষ থাকে।
হাতের আঙুল পায়ের আঙুলের চেয়ে চার গুণ দ্রুত গতিতে বাড়ে।
দেহের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী পেশি জিহ্বার।
প্রত্যকেরই ঘ্রাণশক্তি অনন্য, কেবল যমজ সন্তান ছাড়া যাদের ঘ্রাণবোধ একই ধরনের।
জন্মের সময় প্রত্যেক শিশু colour blind হয়। তারা কেবল সাদা-কালো দেখে।
দেহের হাতের ও পায়ের নখ পুনর্গঠনে ছয় মাস দরকার হয়।
বয়স ৭০ বছরে পৌঁছলে এ সময়ে আমাদের হার্টে ২৫০ কোটিবার স্পন্দন সম্পন্ন হয়।
চোখের ভেতরের কর্নিয়ার ভেতর দিয়ে রক্ত চলাচল করে না তা সরাসরি বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে।
প্রতিদিন এক লাখ ৯০ হাজার ব্রেইন সেল নষ্ট হয় তার ভেতর নিউরন হচ্ছে ৯ হাজার।
প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন ৫০ থেকে সাত হাজার কোটি দেহকোষ নষ্ট হয় যেসবের বেশির ভাগ হচ্ছে রক্ত ও স্কিনকোষ, যারা প্রতিনিয়ত আবার তৈরি হচ্ছে। প্রতি মিনিটে এক কোটি ৮০ লাখ লাল রক্তকণিকা (RBC) দেহে তৈরি হচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্করা ২৪ ঘণ্টায় হারাচ্ছে ছয় হাজার কোটি। তার মানে প্রতি মিনিটে চার কোটিরও বেশি। প্রতি মিনিটে আমরা ৩০ থেকে ৪০ হাজার স্কিনকোষ হারাচ্ছি। এই লেখাটি পড়ার সময়ে দেহের ৪০ হাজার স্কিনকোষ নষ্ট হচ্ছে। তার অর্থ দাঁড়ায়, প্রতি বছর ৯ পাউন্ড (চার কিলোগ্রাম) দেহকোষ নষ্ট হয় যেটা শুরু হয় প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ২৫ বিলিয়ন দেহকোষ নষ্টের প্রক্রিয়ায়।
লেখক : সাবেক শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়