বুধবার-২১শে রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি-১৫ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আরবীতে যোগ্যতা বাড়ানোর জন্য আমি কী করতে পারি?

আরবীতে যোগ্যতা বাড়ানোর জন্য আমি কী করতে পারি?

সমস্যা : শাইখ, আমি আরবী নিয়ে অনেক চেষ্টা করেছি। কয়েক বছর সময় দিয়েছি। মুতাফাররাকা থেকে ছাহারুম পর্যন্ত আরবী নিয়ে পড়ে আছি। রমযান মাসে কয়েকবার কোর্সও করেছি। অনেক তামরীন করেছি। কিন্তু ফলাফল ভালো না। আমার ভাই একদিন আমাকে বলেন, স্কুলের ছাত্ররা ১ম শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া-লেখা করলে ইংরেজি বলা ও লেখার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। কিন্তু তুমি এত দীর্ঘ সময় ধরে আরবী চর্চার পরও কেন আরবীতে লিখতে ও বলতে পারছো না? এটা আমার মধ্যে বড় ধরনের হতশা তৈরি করছে। এমতাবস্থায় আমার করণীয় কী? বিশেষত আরবীতে যোগ্যতা বাড়ানোর জন্য আমি কী করতে পারি? জানিয়ে বাধিত করবেন।
নিবেদক
আব্দুর রহমান, (চন্দনাইশ)
জমাতে ছাহারুম। আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া।

সমাধান : আপনার চিন্তা ও অনুভূতিগুলো খুবই বাস্তব এবং আন্তরিক। আপনি যেভাবে আরবী ভাষা অর্জনের চেষ্টা করে গেছেন, সেটা প্রশংসনীয়। তবে এ ক্ষেত্রে হতাশ না হয়ে আপনাকে কৌশলগতভাবে পথ এগিয়ে নিতে হবে। মনে রাখবেন, আরবী আপনার মাতৃভাষা নয়। এটি একটি ভিনদেশী ভাষা। খুবই মেহনত করে তা অর্জন করতে হয়। আমাদের পাঠ্যপদ্ধতি ও পরিবেশ আরবীর জন্য পূর্ণ সহায়ক নয়। তাই সময় ও সঠিক কৌশল ছাড়া এটা আয়ত্ত্ব করা সম্ভব না। তবে এমতাবস্থায় হতাশ হওয়া নয়; ধৈর্য ধরা জরুরি। আর প্রচলিত স্কুল সিলেবাসে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে অনর্গল ইংরেজি বলার যোগ্যতা অর্জনের বিষয়টি বাস্তবসম্মত নয়, ইংলিশ মিডিয়াম হলে ভিন্ন কথা।
অনর্গল আরবী বলার জন্য পরস্পর আরবী কথোপকথন ও আরবী বক্তৃতার চর্চা করতে হবে। আর কুরআন-হাদীস বোঝার জন্য প্রথমত আরবী ভাষা এবং দ্বিতীয়ত কিতাব বোঝার যোগ্যতার প্রয়োজন রয়েছে। প্রাথমিকভাবে আপনি এই দুই উদ্দেশ্যের জন্য আপনার জামাআতের নাহব-সরফ ও আদবের কিতাবসমূহ খুব মেহনত করে পড়ুন। অনুশীলনের ব্যাপারে যত্নবান হোন। সর্বোপরি কোনো দয়াবান উস্তাদের জিম্মায় নিজেকে সঁপে দিয়ে তাঁর পরামর্শ মোতাবেক চলুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা আপনাকে কামিয়াব করবেন।
স্মরণ রাখবেন—লেখা ও বলা, রচনা ও বক্তৃতা—এই বিষয়গুলো অনুশীলন-নির্ভর। শুধু কিতাবি যোগ্যতা কিংবা ব্যাকরণের জ্ঞান এসব বিষয়ে যথেষ্ট নয়। তাছাড়া এটাও অপরিহার্য নয় যে, প্রত্যেকের মধ্যেই এই যোগ্যতা বিদ্যমান থাকবে। উল্লেখ্য যে, আমাদের পাঠ্যক্রমের মূল বিষয় হলো, কিতাব বোঝার যোগ্যতা এবং অন্যকে বোঝানো ও কিতাবের বিষয়গুলো সুন্দরভাবে উপস্থাপনের যোগ্যতা। এ-দু’টি যোগ্যতা যদি কারো মধ্যে থাকে তাহলে স্বভাবজাত সাহিত্যরুচি না থাকা সত্ত্বেও তা হাসিল করার জন্য পেরেশান হওয়া একেবারেই কাম্য নয়।
অবশ্য প্রয়োজন অনুপাতে কিছু যওক ও রুচি অর্জন করতে চাইলে ‘আতত্বরীক ইলাল আরাবিয়্যা’ ও ‘আততামরীনুল কিতাবী’ এবং ‘কায়ফা নাতাআল্লামুল ইনশা’ ইত্যাদি কিতাবগুলো সামনে রেখে অনুশীলন চালিয়ে যান। অন্তত দু’জন একত্র হয়ে ‘মুযাকারা’র আঙ্গিকে পড়তে থাকুন। আল্লাহ তাআলা অবশিষ্ট যোগ্যতাও দান করবেন, ইনশাআল্লাহ।

 

‘আকাবির ও আসলাফে’র অনুসরণ কী শরঈ দায়িত্ব?

সমস্যা : ‘আকাবির ও আসলাফ এবং সালফে সালেহীন’ বলতে কাদেরকে বোঝায়? ইসলামের ইতিহাসে সাহাবী, তাবেয়ীন, ওলামায়ে হক ও পুণ্যবানদের আদর্শ অনুসরণ কি কেবল সম্মানের বিষয়? নাকি আমাদের ওপর শারঈ দায়িত্ব? আর তাদের পথ থেকে বিচ্যুত হলে পরিণতি কী?
নিবেদক
মোহাম্মদ আনোয়ার
জমাতে ছাহারুম, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া।

সমাধান :
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা—যা কেবল বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে নয়; বরং সঠিক পথ ও রীতিনীতির অনুসরণের মধ্য দিয়েও পরিপূর্ণতা লাভ করে। এ পথ হচ্ছে আল্লাহর রাসূল ﷺ ও তাঁর বিশ্বস্ত অনুসারীদের পথ। যুগে যুগে এই পথকে রক্ষা করে গেছেন সাহাবাগণ, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন এবং তাঁদের অনুসরণকারী নেককার বুযুর্গ, যাঁদের বলা হয় ‘আকাবির ও আসলাফ এবং সালফে সালেহীন’।
আকাবির (أكابر) অর্থ: মহাপুরুষ, বয়োজ্যেষ্ঠ, পূর্বসূরি। সালফে সালেহীন (سلف الصالحين) অর্থ: নেককার পূর্বসূরি।শরঈ পরিভাষায়, এই শব্দগুলো সাধারণত এমন মনীষীদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, যারা:
সাহাবায়ে কেরাম (رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهُمْ),
তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীন,
চার ইমাম (ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ),
হাদীস ও ফিকহবিদগণ,
এবং পরবর্তী যুগের আলেম, মুজাদ্দিদ ও মুতাকাদ্দিমীন ওলামায়ে হক—যাঁরা কুরআন-সুন্নাহর যথার্থ ব্যাখ্যা ও আমল করে গেছেন। তাঁদের চিন্তার ভিত্তি ছিল কুরআন, সুন্নাহ ও পূর্বসূরি সাহাবা-তাবেয়ীনদের পথ।
ইসলামী শরীয়তে সাহাবী, তাবেয়ীন, ওলামায়ে হক ও পুণ্যবানদের আদর্শ অনুসরণ কেবল সম্মানের বিষয় নয়; বরং এটি আমাদের ওপর শরঈ দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা ও রাসূল ﷺ স্পষ্টভাবে তাদের পথ অনুসরণ করতে আদেশক রেছেন। পবিত্র কুরআনের আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ…
“প্রথম ও অগ্রগামী মুহাজির ও আনসার এবং যারা তাদের সুন্দরভাবে অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট…” (সূরা তাওবা: ১০০)। এখানে ‘যারা তাদের অনুসরণ করেছে’ বলতে পরবর্তী যুগের দীনদার আদর্শ ব্যক্তিবর্গ, আকাবির-আসলাফকে বুঝানো হয়েছে। তাদের ব্যপারেও আল্লাহ নিজের সন্তুষ্টির ঘোষণা দিয়েছেন।
তেমনি রাসূলুল্লাহ সা.হাদীসে বলেছেন,
عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين…
“তোমরা আমার সুন্নাহ এবং সৎপথপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ আঁকড়ে ধরো।” (তিরমিযী: ২৬৭৬) অর্থাৎ, তাঁদের অনুসরণ করা ঈমান ও হেদায়াতের শর্ত। অতএব, হেদায়াত ও সুন্নাহর ‍ওপর অটল থাকতে চাইলে আকাবির-আসলাফের আদর্শ অবলম্বন করা জরুরি।
আকাবির-আসলাফের পথ থেকে বিচ্যুতির পরিণতি :
আকাবির-আসলাফের পথ থেকে বিচ্যুতি হলে সরাসরি গোমরাহী ও বিভ্রান্তির আশঙ্কা রয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন,
وَمَن يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَىٰ وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ…
“যে ব্যক্তি সঠিক পথ স্পষ্ট হওয়ার পর রাসূলের বিরোধিতা করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে সে পথেই রেখে দেই এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করি।” (সূরা নিসা: ১১৫) মু’মিনদের পথ বলতে এখানেও সাহাবা-তাবেয়ীন ও নেককার উম্মাহ বোঝানো হয়েছে। তেমনি হাদীস শরিফে এসেছে,
من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو ردّ
“যে কেউ আমাদের দীনের মধ্যে নতুন কিছু সৃষ্টি করবে, যা এর অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।” (সহিহ বুখারী ও মুসলিম) অর্থাৎ, আকাবির ও আসলাফের সুন্নতপূর্ণ ও সঠিক পথ ছেড়ে অন্য রাস্তা ধরলে তা বিদআত ও বিভ্রান্তি বলে গণ্য হয়।
ওলামায়ে কেরাম বলেন: “যে ব্যক্তি আকাবিরের পথে চলে, সে ফিতনা থেকে নিরাপদে থাকবে।”
উপসংহার: আকাবির ও আসলাফে সালেহীন কেবল ইসলামের ইতিহাসের গৌরব নয়—বরং তারা হলেন এই উম্মাহর দীনের ব্যাখ্যাকারী, পথনির্দেশক ও বাস্তব আদর্শ। তাঁদের পথ অনুসরণ না করা মানেই হেদায়েতের বাইরে চলে যাওয়া।
আমাদের করণীয়:
আকাবিরদের দীনি চিন্তা ও ব্যাখ্যা পড়া, শেখা ও অনুসরণ করা।
তাদের পথের বাইরে গেলে আবার সঠিক পথে ফিরে আসা।
নতুন নতুন মতবাদ, উদ্ভাবিত তরিকা ও ‘নব্য ইসলামী চিন্তা’ থেকে সতর্ক থাকা।
আল্লাহ আমাদের আকাবিরদের মহব্বত দান করুন, তাঁদের পথে অটল রাখুন এবং বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করুন। আমীন।

তালিবুল ইলম ভাইদের শিক্ষাবিষয়ক প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন

মাওলানা সলিমুদ্দীন মাহদি কাসেমী

সিনিয়র শিক্ষক ও বিভাগীয় প্রধান, উচ্চতর তাফসীর বিভাগ
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ