বুধবার-২১শে রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি-১৫ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আল্লামা আবদুল মান্নান দানিশ রহ. : অমর কীর্তিমান এক শীর্ষ আলেমের বিদায়

কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক


 

জন্ম ও বংশ :
চট্টগ্রাম জেলার উত্তর ফটিকছড়ির এক শান্ত, সুনিবিড় অজপাড়া গাঁ ছোট বেতুয়া—এ গ্রামটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ধর্মীয় আবহে এক অনুপম আদর্শ গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এখানেই জন্মগ্রহণ করেন হাজারো আলেমের উস্তাদ, পটিয়ার ইতিহাসে অনন্য মানুষ গড়ার শ্রেষ্ঠ কারিগর আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান দানিশ রহ.।
তাঁর পিতা ছিলেন জনাব মোখলেসুর রহমান। যিনি ‘সূফী সাহেব’ নামে এলাকাবাসীর কাছে সুপরিচিত। তিনি ছিলেন একজন পরহেযগার, আল্লাহভীরু ও সচ্চরিত্রবান ব্যক্তি। পিতার ধর্মীয় অনুরাগ ও নিষ্ঠার ছায়ায় বেড়ে উঠেছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান দানিশ রহ.। হযরতের পিতামহ ইজ্জত আলী এবং প্রপিতামহের নাম হাশমত আলী।
আনুমানিক ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে (১৩৬১ হিজরি সন) তিনি এই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বহু আগে থেকেই দীনি পরিবেশ বিরাজমান ছিল তাঁর পরিবারে। যা তাঁর চরিত্র ও ভবিষ্যৎ গঠনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। পারিবারিক পরিবেশ, পিতার সোহবত এবং স্থানীয় দীনি ব্যক্তিত্বদের প্রভাবে ছোটবেলা থেকেই তিনি দীনি শিক্ষার প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠেন।
তিন ভাই ও এক বোনের পরিবারে হযরত হলেন সবার ছোট। ভাই-বোনেরা হলেন যথাক্রমে—১. জনাব আলী আহমাদ রহ., ২. রাবার বাগান ইউনুসিয়া মাদরাসার সাবেক মুহতামিম, পীরে কামেল মাওলানা ছিদ্দিক আহমাদ রহ, ৩. একমাত্র বোন (যিনি দাঁতমারাস্থ বারমাসিয়া নিবাসী প্রসিদ্ধ সুফি ব্যক্তিত্ব জনাব সুলতান আহমাদ রহ.-এর স্ত্রী), ৪. হযরত মাওলানা আব্দুল মান্নান দানিশ রহ.।
আল্লামা দানিশ রহ. কেবল জন্মসূত্রে নয়, কর্মজীবনেও হয়ে উঠেছিলেন সারাদেশ বিশেষতঃ চট্টগ্রামের মানুষের জন্য এক নির্ভরতার নাম। এক নীরব বিপ্লবের স্থপতি। তিনি দাওয়াত, তালীম, তাযকিয়া ও খেদমতের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন ইসলামের মিষ্টতা।

প্রাথমিক ও উচ্চতর দীনি শিক্ষা
আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান দানিশ রহ. তাঁর শিক্ষাজীবনের সূচনা করেন নিজ গ্রাম ছোট বেতুয়ার স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পাশাপাশি দীনি শিক্ষার প্রতি অগাধ অনুরাগের কারণে পার্শ্ববর্তী মক্তবে পবিত্র কুরআন মাজীদের নাযেরা পাঠ সম্পন্ন করেন। শৈশবেই তাঁর মধ্যে ইলমে দীনের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও একাগ্রতা লক্ষ করা যায়, যা ভবিষ্যতে তাঁর বৃহত্তর দীনি অবদানের ভিত্তি রচনা করে।
পরবর্তী ধাপে তিনি ভর্তি হন ছোট বেতুয়া সিরাজুল উলুম মাদরাসায়। এখানে তিনি ইয়াজদাহুম থেকে হাফতুম জামাত পর্যন্ত দীনি শিক্ষা অর্জন করেন। এ সময় তিনি আরবী ভাষা, ফিকহ, আকীদা এবং অন্যান্য মৌলিক ইসলামী বিদ্যাবিষয়ে প্রাথমিক মজবুত ভিত্তি গড়ে তোলেন।
এরপর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যামিক ইলম অর্জনের লক্ষ্যে তিনি ভর্তি হন ঐতিহ্যবাহী দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাবুনগরের জামিয়া ইসলামিয়া আজিজুল উলুমে। এখানে তিনি অধ্যয়ন করেন শশুম জামাত থেকে উলা জামাত পর্যন্ত। এ সময় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর মেধা, অধ্যবসায় ও চরিত্রের উজ্জ্বলতা। জামিয়া ইসলামিয়া আজিজুল উলুমে অধ্যয়নকালে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহপাঠী ও অন্তরঙ্গ বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পরবর্তীকালে প্রখ্যাত মুফতী ও আলেম, মুফতীয়ে আজম মাওলানা মুফতী আবদুস সালাম চাটগামী (সাবেক মুফতীয়ে আযম, জামিয়া ইসলামিয়া বানূরি টাউন, করাচি)। তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল অত্যন্ত গভীর এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাপূর্ণ।
দীপ্ত মনোবল ও উচ্চতর ইলমের স্বপ্ন বুকে ধারণ করে, তিনি ১৩৮৭ হিজরি সনে (মোতাবেক ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে) ভর্তি হন বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ায়। সেখানে তিনি দাওরায়ে হাদীস (স্নাতকোত্তর স্তরের হাদীসের পূর্ণাঙ্গ পাঠক্রম) সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করেন। হাদীসের এই বিশাল পাঠক্রমের মাধ্যমে তিনি ইলমের গভীরে প্রবেশ করেন এবং ইলমে হাদীসের বিশুদ্ধ মর্মার্থ উপলব্ধি করেন।
‘আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ’ এর তত্ত্বাবধানে দাওরায়ে হাদিসের মারকাজী পরীক্ষার মেধা তালিকায় ৩য় তম স্থান অধিকার করেন।এই কৃতিত্ব তাঁর ইলমী প্রতিভা, অধ্যবসায় ও গভীর ইখলাসের উজ্জ্বল স্বাক্ষর হয়ে আছে।
পটিয়ায় অধ্যয়নকালে তাঁর অন্তরঙ্গ ও সুপরিচিত সহপাঠীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন—জামিয়া পটিয়ায় হযরত দানিশ সাহেব হুজুরের উল্লেখযোগ্য সহপাঠী ছিলেন হযরত আল্লামা রহমাতুল্লাহ কাউসার নিজামী রহিমাহুল্লাহ, বাঁশখালীর মাওলানা আবদুল লতিফ সাহেব, সাতকানিয়ার মাওলানা ফুজাইলুল্লাহ, নোয়াখালীর মাওলানা আজিজুল হক এবং মাতারবাড়ীর মাওলানা আমিন সাহেব প্রমুখ।

হযরতের সম্মানিত শিক্ষক ও মুরুব্বিবৃন্দ
শিক্ষাজীবনে মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান দানিশ সাহেব বহু মনীষী ও আলেমে রব্বানীর সান্নিধ্য লাভ করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: আল্লামা শাহ হারুন বাবুনগরী রহ.—মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান দানিশ সাহেবের শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই মহৎ আলেমের সাহচর্যে কেটেছে। শায়খুল হাদীস আল্লামা উবাইদুর রহমান রহ.—প্রখ্যাত আলেম ও হাদীস শাস্ত্রের বড় মুরুব্বি, যাঁর কাছ থেকে তিনি ইলমী ফায়দা হাসিল করেন। আল্লামা ইয়ার মুহাম্মদ রহ.—নিষ্ঠাবান ও গভীর ইলমী দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন আলেম, যাঁর সান্নিধ্যে তিনি উপকৃত হন। শায়খুল হাদীস আল্লামা ইউনুস রহ.—বিশিষ্ট হাদীস বিশারদ, যাঁর শিক্ষাদীক্ষার ছোঁয়া তাঁর ইলমী যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আল্লামা মাওলানা শফিউল আলম (হাফিজাহুল্লাহ)—সমকালীন সময়ের একজন সম্মানিত ও নেককার আলেম। মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী (হাফিজাহুল্লাহ)—নামকরা আলেম ও জাতীয় নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিত্ব, যাঁর সান্নিধ্য তিনি পেয়েছেন। মাওলানা কবির আহমাদ সাহেব রাওজানী—গভীর জ্ঞানের অধিকারী শিক্ষক, যিনি তাঁকে ইলমের পথে অনুপ্রাণিত করেন। মাওলানা হাকিম উবাইদুর রহমান সাহেব নাজিরহাট—তিব্বীশাস্ত্র ও দীনি ইলমের সমন্বয়ে দক্ষ আলেম, যাঁর সাহচর্যে তিনি সমৃদ্ধ হন। মুহাদ্দিসে আসর, শায়খুল হাদীস আল্লামা ইমাম আহমাদ রহ.—শীর্ষস্থানীয় মুহাদ্দিস ও ইলমের বাতিঘর, যাঁর কাছ থেকে তিনি ব্যাপক উপকৃত হন। খতীবে আযম আল্লামা সিদ্দিক আহমাদ রহ.—জানপ্রিয় রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিদীপ্ত বাগ্মী, যাঁর প্রভাব শিক্ষাজীবনে গভীর রেখাপাত করে। আরিফে রাব্বানী শাহ আলী আহমাদ বোয়ালভী রহ.—তাসাউফ ও ইলমের সমন্বিত রাহবার, যাঁর আত্মিক ঘনিষ্ঠতা তাঁকে প্রভাবিত করে। আল্লামা আমীর হোসাইন (মীর সাহেব) রহ.—মেধাবী চিন্তাবিদ ও সুপরিচিত আলেম, যাঁর ইলমী আলোচনায় তিনি প্রশিক্ষিত হন। সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট লেখক আল্লামা মুহাম্মদ দানিশ রহ.—দীনি সাহিত্যক্ষেত্রে অনন্য অবদানকারী, যাঁর সান্নিধ্যে তিনি লেখালেখির অনুপ্রেরণা পান। আরিফে বিল্লাহ আল্লামা নূরুল ইসলাম কাদিম রহ.—তাসাউফের মুকুটমণি ও আত্মশুদ্ধির মহান পুরোধা, যাঁর কাছ থেকে তিনি রুহানিয়াতের শিক্ষা লাভ করেন। আল্লামা নূরুল ইসলাম জাদীদ রহ.—বিদগ্ধ আলেম ও সমাজসংস্কারক, যাঁর সাথে ইলমী ও রুহানী সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আল্লামা হোসাইন আহমাদ (বড় হুজুর সাতকানভী) রহ.—একজন প্রভাবশালী দীনি নেতা ও বুজুর্গ, যাঁর তত্ত্বাবধানে তিনি নানাভাবে সমৃদ্ধ হন। আল্লামা মুফতী ইবরাহীম সাহেব রহ.—বিশিষ্ট মুফতী ও ইলমী জগতের গৌরব, যাঁর থেকে তিনি নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। শায়খুল আরব ওয়াল-আজম শাহ হাজী ইউনুস রহ.—উচ্চ মর্যাদাপ্রাপ্ত আত্মিক ও ইলমী নেতা, যাঁর সংস্পর্শে তাঁর রূহানী জগত উন্মুক্ত হয়। এছাড়াও বহু আলোকিত ব্যক্তিত্ব তাঁর সাথী ও মুরুব্বি হিসেবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন।

দাওরায়ে হাদীসের পরবর্তী জীবন
দাওরায়ে হাদীস সমাপ্তির পর মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান দানিশ সাহেব (রহ.) কিছু সময় তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা (রহ.)–এর খেদমতে নিবেদিতভাবে অতিবাহিত করেন। পিতার ইন্তেকালের পর তিনি ইলম ও শিক্ষা-সংক্রান্ত কাজে মনোনিবেশ করেন। প্রথমে এক বছর তিনি সৈয়দপুর দারুল উলুম-এ উচ্চতর শিক্ষকের আসনে দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে তাঁর প্রজ্ঞা, ইলমের গভীরতা এবং শিক্ষা প্রদানের দক্ষতা স্বীকৃত হয়। এরপর তিনি ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে তাঁর কর্মদক্ষতা ও মেহনতের কারণে সুনাম অর্জন করেন। তাঁর শিক্ষকতার ধাপসমূহ নিম্নরূপ:
জামিয়া কুরআনিয়া ইউনুসিয়া আজিজুল উলুম, চন্দ্রঘোনা, রাঙুনিয়া—এখানে তিনি দীর্ঘ ৭ বছর শিক্ষকতা করেন। তাঁর ইলমী মেহনত ও ছাত্রদের মাঝে নৈতিক চরিত্র গঠনে অবদান আজও স্মরণীয়।
মাদরাসা আজিজিয়া হাফিজুল উলুম, জামালপুর, মীরসরাই। এখানে তিনি ৪ বছর যাবত ইলমের আলো ছড়িয়েছেন এবং বহু ছাত্রের মননে দীনের বীজ রোপণ করেছেন।
মাদরাসা সিরাজুল উলুম ছোট বেতুয়া, ফটিকছড়ি। তিনি এখানে ২ বছর শিক্ষকতা করেন।
মাদরাসা ইউনুসিয়া মিসবাহুল উলুম, রাবারবাগান, ফটিকছড়ি। এই প্রতিষ্ঠানে তিনি ২ বছর ইলমের খেদমত করেন এবং মেধাবী ছাত্রদের গঠনমূলক তালীম দেন।
মাদরাসা মুনীরুল উলুম, চাঁদলা, ফেনী। এখানে তিনি ১ বছর যাবত দীনি শিক্ষার খেদমত করেন এবং প্রতিষ্ঠানের বিকাশে অবদান রাখেন।
১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দেহযরত হাজ্বী সাহেব হুজুর রহ. এর নির্দেশে আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়াতে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। জামিয়া পটিয়ায় তিনি তাফসীর হাদিস ও ফিকাহ উসূলে ফিকাহ, নাহু-সরফ, ইনশা, বালাগাত আরবি সাহিত্যের জটিল কঠিন কিতাব সমূহের দরস দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি দীর্ঘ সময় ধরে ইলমের সর্বোচ্চ আসনে, উস্তাদে আ’লা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর হাতে গড়ে ওঠা ছাত্রগণ আজ দেশ-বিদেশে দীনের খেদমতে নিয়োজিত আছেন। ইলমী ফিকর, আখলাকি গঠন ও আত্মিক শুদ্ধির ক্ষেত্রে তাঁর অবদান পটিয়া জামিয়ার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে।

পাঠদানকৃত গ্রন্থসমূহ
মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান দানিশ ছাহেব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহে উচ্চ শিক্ষকের আসনে থেকে অগণিত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের পাঠদান করেছেন। উল্লেখযোগ্য পাঠদানকৃত গ্রন্থাবলী নিম্নরূপ:
১। মিশকাত শরীফ (প্রথম খণ্ড), ২। মিশকাত শরীফ (দ্বিতীয় খণ্ড)৩। জালালাইন শরীফ (প্রথমার্ধ)৪। কাওয়াইদ ফি উলুমিল হাদীস৫। মোল্লা হাসান, ৬। মুখ্তাসারুল মাআনী (প্রথম ভাগ), ৭। শারহে জামী (ইসম অধ্যায়), ৮। শারহে বেকায়া, ৯। কুতুবী, ১০। সিরাজী, ১১। নাফহাতুল আরব, ১২। আখলাকে মোহসিনী, ১৩। শারহে তাহজীব, ১৪। লামিয়াতুল মুআজিযাত, ১৫। উসূলুশ শাশী, ১৬। রিয়াজুস সালেহীন, ১৭। কাফিয়া ইত্যাদি।
তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ
শিক্ষা ও গবেষণার ধারায় তিনি মূল্যবান কিছু গ্রন্থও রচনা করেন, যেমন:
১। কাশফুল মুআদ্দলাত (লামিয়াতুল মুআজিযাতের ব্যাখ্যাগ্রন্থ)।২। আল-কালামুল মুনতাজিম (তা’লীমুল মুতাআল্লিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থ)।৩। তাকরীবুল ওয়াসিলীন (যাদুত তালিবীনের ব্যাখ্যাগ্রন্থ)।৪। তাকরীবুল মাসীর (নাহবেমীরের ব্যাখ্যাগ্রন্থ)।৫। আকরাবুল মাআরিব (মীযান ও মুনশাইবের ব্যাখ্যাগ্রন্থ)।
৬। আফকারে দানিশ (কাব্যগ্রন্থ)।

উস্তাদ হিসেবে আল্লামা আব্দুল মান্নান দানিশ রহ.
পটিয়ার দীপ্ত ইতিহাসে মানুষ গড়ার মহান কারিগরদের একজন অবিস্মরণীয় নাম—আল্লামা আব্দুল মান্নান দানিশ রহমাতুল্লাহি আলাইহি। তিনি শুধু একজন উস্তাদ ছিলেন না; ছিলেন হৃদয় জয় করার অদ্ভুত এক কারিগর। তরুণ মননকে জাগ্রত করার এক অনন্য সাধক।
আল্লামা দানিশ রহ. একাধারে ছিলেন মননশীল লেখক, সুক্ষ্ম রুচিসম্পন্ন কবি এবং ভাষা ও সাহিত্যরসিক। তিনি নিজে ফার্সি ও উর্দু ভাষায় উচ্চমানের কবিতা রচনা করতেন। শিক্ষার্থীদেরও অনুপ্রাণিত করতেন সাহিত্যের প্রতি। উর্দু ও ফার্সি কবিতা লেখায় শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিতেন। পাশাপাশি বাংলা ভাষার ছড়া ও কবিতাকেও উৎসাহের দৃষ্টিতে দেখতেন। কোনো ছাত্রের বাংলা কবিতা বা ছড়া দেখলে তিনি অকৃপণ প্রশংসা করতেন। মনোবল বাড়িয়ে দিতেন। তাঁর হাতে গড়ে ওঠা সেইসব তরুণ কবিরা বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে সাহিত্যচর্চার জগতে নতুন আলোকচ্ছটা ছড়াতে শুরু করে।
শুধু সাহিত্য নয়—সামাজিক কর্মকাণ্ড, লেখালেখি কিংবা বক্তৃতার ময়দান—হাজারো শিষ্য তাঁর শিক্ষা ও আদর্শকে জীবনে ধারণ করে নিজ নিজ জায়গায় কীর্তি স্থাপন করেছেন। আল্লামা দানিশ রহ. ছাত্রদের অন্তরের গভীরে প্রবেশ করতে পারতেন। তিনি ছিলেন এমন এক উস্তাদ, যিনি সহজে স্থান করে নিতে পারতেন ছাত্রদের হৃদয়ে। যে কাজ তিনি চাইতেন, মমতার বাঁধনে জড়িয়ে ছাত্রদের সেই কাজের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারতেন। তাঁর কোমল হৃদয় ও মাধুর্যপূর্ণ আচরণে ছাত্ররা তাঁর প্রতি আবদ্ধ ছিল গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার বন্ধনে।
যদিও তিনি বাংলা ভাষায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে পারতেন না, তবুও সাহিত্যিক ভাষায়, বিশেষ করে ছন্দময় কবিতার মাধ্যমে নিজের ভাবনা ও বক্তব্য সাবলীলভাবে প্রকাশ করতে পারতেন। তাঁর লেখনীতে ছিল কবিতার ছন্দ, ইলহামের দীপ্তি এবং আবেগের উষ্ণতা। তিনি ছিলেন একাধারে বড় শায়ের (কবি) এবং পারঙ্গম নাহবী (আরবী ব্যাকরণ বিশেষজ্ঞ)।
জীবনের বৃহৎ অধ্যায় তিনি কাটিয়েছেন জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার চৌকাঠে। পটিয়া তাঁর ইলমী সাধনার কেন্দ্র। তাঁর শিক্ষাদানের মুকুটমণি। এখান থেকেই তিনি হাজারো আলেম, লেখক, গবেষক ও সমাজসংস্কারকের চিন্তাজগত আলোকিত করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর এই অমর অবদান কবুল করুন, তাঁকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন—আমীন।

পরম মাওলার সান্নিধ্যে
গত ২৫ এপ্রিল ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, জুমাবারে রাজধানীর এক হাসপাতালে ইহজগতের সকল বন্ধন ছিন্ন করে চিরদিনের জন্য পরপারে পাড়ি জমান হাজারো আলেমের প্রিয় উস্তাদ, আল্লামা আব্দুল মান্নান দানিশ রহমতুল্লাহি আলাইহি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ইন্তেকালের সময় তিনি একমাত্র স্ত্রী, চার ছেলে ও চার মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান।
২৬ এপ্রিল রাবার বাগান ইউনুসিয়া মাদরাসা ময়দানে হযরতের সুযোগ্য সাহেবজাদা মাওলানা ত্বহা দানিশ মাক্কী হাফিজাহুল্লাহর ইমামতিতে হযরতের নামাযে জানাযায় অংশ নেন হাজার হাজার ওলামা-তলাবা ও ধর্মপ্রাণ জনতা। জানাযা শেষে ছোট বেতুয়া রহমানিয়া মাদরাসা সংলগ্ন পারিবারিক কবরস্থানে হযরতকে সমাহিত করা হয়।
স্বজনদের বর্ণনা অনুযায়ী, মৃত্যুর প্রাক্কালে তাঁর মধ্যে কোনো বড় ধরনের অসুস্থতার লক্ষণ দেখা যায়নি। মাত্র সামান্য জ্বর ছিল। এমনকি মৃত্যুর দিনও তিনি যথারীতি সুস্থতার সাথে পবিত্র জুমার নামাজ আদায় করেন। এ যেন ছিল তাঁর এই নশ্বর দুনিয়ায় শেষবারের মতো আল্লাহর সামনে দাঁড়ানো—এক অন্তিম সেজদার প্রস্তুতি।
নামাজের পর হঠাৎ করে তাঁর শরীরের অবস্থার অবনতি হতে থাকে। দ্রুত তাঁকে রাজধানীর মিরপুর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকগণ সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও তাঁকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। নিভে গেল ইলমের আলো ছড়িয়ে যাওয়া এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। চিকিৎসকেরা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন—আল্লামা দানিশ রহ. দুনিয়ার জীবন শেষ করে অনন্ত জীবনের পথে যাত্রা করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতে সুউচ্চ মাকাম দান করুন এবং তাঁর রেখে যাওয়া জ্ঞানের আলো দ্বারা আমাদের সবাইকে উপকৃত করুন—আমীন।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ