মহিলা মাদরাসা নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা
মহিলা মাদরাসা আমাদের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশে বিগত ৫০ বছরে মহিলাদের দীনী শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে ঈর্ষণীয়ভাবে। এমন কোন উপজেলা নেই যেখানে কমপক্ষে ছোট বড় ১০-২০টি মহিলা মাদরাসা নেই। সাধারণ মানুষ তাদের নিজেদের মেয়েদেরকে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানকে জরুরি মনে করছেন। আবার অনেক মেয়ে মাদরাসার পাঠশেষে উচ্চশিক্ষাও লাভ করছেন। আধুনিক শিক্ষা গ্রহণকারী অনেক পুরুষ মাদরাসায় পড়ুয়া মেয়েদের বিয়ে করতে মুখিয়ে থাকেন। এর বহুবিধ কারণ রয়েছে। পরিবর্তনশীল সামাজিক চাহিদা পূরণে মহিলা মাদরাসা যুগোপযোগী ভূমিকা পালন করে আসছে। মেয়েদের হাফিযা, আলিমা বানানো হয় এসব প্রতিষ্ঠানে। মহিলাদের দীনী তালিম বন্ধ হয়ে গেলে পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থাপনায় একটা অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
কম বেশি সব মাদরাসায় পর্দাব্যবস্থা অত্যন্ত কঠোর। প্রায় মাদরাসায় মহিলা শিক্ষিকা দিয়ে মেয়েদের পাঠদান করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ পর্দার অন্তরাল থেকে দরস দেন। মাদরাসার পরিচালক পুরুষ হলেও তাঁদের স্ত্রী অথবা কন্যা অথবা পুত্রবুধূ অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত। আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু শিক্ষার্থী সংশয়বাদ, কমিউনিজম, উগ্র ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও নাস্তিক্যবাদী চেতনা নিয়ে বের হয়। মহিলা মাদরাসার যে ধারা অগ্রসরমাণতা অব্যাহত রাখা গেলে আগামী প্রজন্ম ধর্মভাবাপন্ন মানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। আরবি, বাংলা, ইংরেজি ও সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানে।
সাম্প্রতিক সময়ে দুয়েকটি মহিলা মাদরাসায় দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। তবে আমরা মনে করি এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ব্যক্তি বিশেষের অপরাধের জন্য মহিলা মাদরাসাব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় না। যারা দোষী নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রচলিত আইনে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করলে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। দুর্ঘটনায় কোন মাদরাসা পরিচালকের বা কোন দায়িত্বশীল শিক্ষকের যদি অবহেলা থাকে বা তাদের কেউ যদি তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হন তাহলে মাদরাসা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কঠোর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। অপরাধ ধামাচাপা দেয়া বা আড়াল করার প্রচেষ্টা যেমন গর্হিত তেমনি আদালত কর্তৃক দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগে ভিডিও বানিয়ে ভাইরাল করাও অত্যন্ত নিন্দনীয়। এটা মিডিয়া ট্রায়ালের নামান্তর। যেসব ব্যক্তি, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ার লোকেরা মাদরাসাকে পছন্দ করেন না তাঁরা শিক্ষক ও মাদরাসা নিয়ে আপত্তিকর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে জনগণ ও অভিভাবককে সচেতন থাকতে হবে।
দুর্ঘটনা বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সব জায়গায় আছে। নেই কোথায়? সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অহরহ যৌন নিপীড়নসহ বেদনাদায়ক ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হলে ছাত্রী কর্তৃক ছাত্রী নিপীড়ন এবং উলঙ্গ করে ভিডিও ধারণ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেন্সেশনাল কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছে। হল থেকে এমন কি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বহিষ্কৃত হচ্ছে। বাকি দুর্বৃত্তরা পার পেয়ে যাচ্ছে দলীয় বিবেচনায়। মহিলা মাদরাসায় তো এ জাতীয় ন্যাক্কারজনক ঘটনা নেই বললে চলে। এখানে শিক্ষার সুষ্ঠু ও মনোরম পরিবেশ বিরাজ করছে। এটা পবিত্র কুরআন ও হাদীসচর্চার বরকত এবং পরহেজগার উস্তাদদের নেকনজর।
আরেকটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। সেটা হল যত্রতত্র বাসা-বাড়ি ভাড়া নিয়ে মহিলা মাদরাসা গড়ে তোলার প্রবণতা। কে বা কারা মেয়েদের জন্য প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে তার কোন হিসাব নেই এবং এসব মাদরাসার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষও নেই। কারো কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হয় না। আমরা মনে করি যথাযথ সরকারি ও বেসরকারি কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি ছাড়া কেউ প্রাইভেট মাদরাসা খুলতে পারবে না। এমন কানুন থাকা অত্যন্ত জরুরি। প্রায় দুর্ঘটনা ঘটছে এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষার্থীরা মাদরাসায় আমানত। তাদের নিরাপত্তা, দেখভাল ও সুশিক্ষা প্রদান করা ওয়াজিব ও আইনত কর্তব্য।
বালক ও বালিকা মাদরাসার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা একান্ত আবশ্যক। বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড, কওমি মাদরাসার ছয়টি স্বীকৃত বোর্ড এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারেন। এ কথা চিরন্তন সত্য শিক্ষকতা প্রশিক্ষণ ছাড়া হয় না। মানসম্মত শিক্ষা দিতে হলে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। গোটা দুনিয়াব্যাপী শিক্ষা মনস্তত্ত্ব ও টিচিং মেথোডলজি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় আমাদেরও সংযুক্ত হওয়া প্রয়োজন।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন