দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আলিম-ওলামার করণীয়
মুহাম্মদ গোলাম রব্বানী ইসলামাবাদী
লেখক: আলেম, লেখক ও চিন্তাবিদ
স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার। এ স্বাধীনতা তার মৌলিক চাহিদাকে আবর্তিত করে নিত্য। অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান ছাড়াও তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দিয়েছেন খোদ আল্লাহ। তবে মনে করার কারণ নেই, স্বাধীনতা মানে যাচ্ছেতাই করার অধিকার। মানুষকে সৃষ্টি করার সাথে সাথে ভালো-মন্দ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আল্লাহ দিয়েছেন। স্বাধীনতার ধাপ-উপধাপ চিন্তা করলে পাওয়া যায় স্তরভিত্তিক স্বাধীনতার অস্তিত্ব। যেমন- ব্যক্তি-স্বাধীনতা, পারিবারিক স্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা, নাগরিক স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি। এগুলো সর্বআইনে, সর্বক্ষেত্রে স্বীকৃত। তেমনি এক স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা। আজ সে বিষয়েই আলাপ। একটি বা কয়েকটি জনগোষ্ঠী একত্রিত হয়ে নির্দিষ্ট কোন ভূখণ্ডকে তাদের বসবাসের জন্য নির্ধারিত করে ব্যবস্থাপনার কাঠামো প্রতিষ্ঠা করলে, সেই ভূখণ্ড ওই জনগোষ্ঠী বা জনগোষ্ঠীসমূহের জন্য একটি স্বাধীন দেশ বা ভূখণ্ড বলে বিবেচিত হয়। উক্ত ব্যবস্থাপনার আলোকে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতি বসবাসকারী মানুষ যে শর্তসাপেক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ও অধিকার পাওয়ার নিশ্চয়তা প্রাপ্ত হয় সেটাই নাগরিক শর্ত। এ শর্তের কারণেই, নাগরিক বা জনগণ রাষ্ট্রের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে, প্রাণ দেয়। আমরা যে আজ বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে বসবাস করছি, সেখানেও উক্ত শর্ত প্রযোজ্য। দেশের সকল নাগরিক, আলিম-ওলামা, আপামর মেহনতি জনতা—সবাই উক্ত শর্তে আইনগত ও নৈতিকভাবে বন্দী।
আমাদের বাংলাদেশে ‘আলিম-ওলামা’ নামে যে ধর্মীয় গোষ্ঠী অস্তিত্বশীল তাঁরা মূলত ধর্মীয় জ্ঞানে পারদর্শী বলে পরিচিত। পারিভাষিকভাবে এবং অভিজ্ঞতার আলোকে এই শ্রেণি জাগতিক ও রাষ্ট্রীয় কর্তব্যে অনুপস্থিত বলে মনে করেন অনেকে। আলিম-ওলামার মধ্যেও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করেন, তাঁদের ওসবে অংশগ্রহণের প্রয়োজন নেই। ফলে দেশে বসবাস করেও তাঁরা নিজদেশে পরবাসী বলে অনেকে মনে করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, উপরের আলোচনার নিরিখে একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে নাগরিক শর্ত ভঙ্গ করা বা তাতে অনীহা প্রকাশ করার আইনত ও নৈতিক যুক্তি আছে কি না? যেহেতু রাষ্ট্র আমাদেরকে নিরাপত্তা ও অধিকার প্রদানে বাধ্য সেহেতু দেশের আলিম-ওলামা নাগরিক শর্তকে ভঙ্গ করার অধিকার রাখেন কি না? প্রশ্নটি এ জন্যই তুললাম, দীর্ঘদিন থেকে রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় কর্তব্যে আলিম-ওলামার দৃশ্যত দূরত্ব বজায় রাখার একটি অভিযোগ প্রচলিত। বিষয়টি নিয়ে আমাদের সম্মানিত আলিম-ওলামা কোন বক্তব্য রেখেছেন বলে আমার জানা নেই। তবে ২০১৭ সালে আমি বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত ‘কওমি-জগৎ এবং সামাজিক শক্তির খতিয়ান’ শীর্ষক গবেষণা-প্রবন্ধে বিষয়টি নিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছি, জাতীয় উন্নয়নে ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভূমিকায় কওমি-জগতের বিশাল অবদান রয়েছে।
এতে দেখানো হয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সামাজিক স্থিতিশীলতা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, মানবিক সাহায্য প্রদান ও সমাজ-সংস্কারের মতো জায়গাগুলোতে কওমি আলিম-ওলামার নীরব ও ঈর্ষণীয় অবদান রয়েছে। ব্যাপার হলো, কওমি আলিম-ওলামা এসব অবদানের কথা প্রচার করে বেড়ান না। তাই, জাতি সে সম্পর্কে অজ্ঞাত। এমন প্রেক্ষাপটে কেউ কেউ আলিম-ওলামাকে কথিত মূলস্রোতে সম্পৃক্ত করার দাবি তোলেন। মূলত এ দাবি সম্পূর্ণ অসার ও ভিত্তিহীন। আদর্শিকভাবে তাঁরা আগে থেকেই মূলস্রোতে আছেন। সমালোচকেরা যদি নিজেদের অবস্থানকে ‘মূলস্রোত’ বলে দাবি করেন, তবে এক-ই যুক্তিতে আলিম-ওলামা নিজেদের ধর্মীয় অবস্থানকে মূলস্রোত দাবি করার অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা রাখেন। ভূমিকা নীরব বলে জাতীয় অবদানে তাঁদের মূল্যায়ন করা হয় না।
এবার আসি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কথায়। এখানে আলিম-ওলামার ভূমিকা নিয়ে কিছু কথা শোনার ও বলার আছে। শোনার কথা মোটাদাগে সবাই কমবেশি জানেন। সত্যিকথা হলো, অন্তত এ বিষয়ে আলিম-ওলামার ভূমিকা দৃশ্যত প্রশ্নবিদ্ধ। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হলে দেশের রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহল যেমন বক্তব্য রাখেন, প্রশ্ন তোলেন; আলিম-ওলামা সে অবস্থান থেকে সরব হন না।
এ দেশের সুযোগ-সুবিধা কি তাঁরা নিচ্ছেন না? তবে তাঁরা কেন দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে দূরত্ব বজায় রাখেন? নীতিগতভাবে আপত্তির জায়গাটি ন্যায্য। বলার হলো, এ বিষয়ে কিছু শাসকগোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দল এবং তাদের সমমনা মিডিয়া স্বাধীনতার পর থেকে আলিম-ওলামাকে তির্যকদৃষ্টিতে দেখে ও অপপ্রচার করে এসেছে। এরা প্রচার করে এসেছে, আলিম-ওলামা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। এঁরা রাজনীতি করলে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তোলা হয়; দেশের হয়ে কোন কথা বললে সরকারবিরোধিতার তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়; কারও কারও সম্পর্কে ভিত্তিহীন অপবাদ দেওয়া হয় ইত্যাদি। এসব প্রতিকূলতার কারণে আলিম-ওলামা বিতর্ক ও বিভক্তি এড়াতে কিছু বলা ও করা থেকে দূরত্ব বজায় রাখেন। এ দায় সম্পূর্ণ তাঁদের নয়। বলাবাহুল্য, তাঁদের মূল দায়িত্ব দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা নয়; ইসলামী বিশ্বাস, শিক্ষা ও সংস্কৃতিরক্ষা। স্বাধীনতার দায়িত্ব মূলত সরকারের ও রাজনৈতিক দলের। তবে হ্যা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপদে পড়লে জাতীয় প্রয়োজনে তাঁরা যে ঘরে বসে থাকবেন না, সে তো কসম করে বলা যায়।
এখন প্রশ্ন হলো, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে আলিম-ওলামার কি কোন করণীয় নেই? আলবৎ আছে। আমি আগেই বলেছি, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অধিকার পাওয়ার শর্তে রাষ্ট্রের প্রতি আলিম-ওলামার করণীয় শর্তাবদ্ধ। এখান থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোন পথ নেই। আমি বলছি না, তাঁরা মূল দায়িত্ব বিসর্জন দিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের মতো মিছিল-মিটিং করুক, বিক্ষোভ করুক। তাঁরা যা পারেন তা হলো:
- সম্মিলিত একটি সুপ্রীম কাউন্সিল বা পরিষদ গঠন করা।
- পরিষদের মাধ্যমে উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের সাথে মতবিনিময় ও প্রস্তাব পেশ করা।
- পরিস্থিতির নির্মোহ পর্যবেক্ষণ করে জাতির কাছে বক্তব্য তুলে ধরা।
- স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে জাতিকে লিখিত বক্তব্যের মাধ্যমে পরামর্শ দেওয়া।
- পরিস্থিতি নিয়ে আপন-আপন এলাকায় জনগণকে সচেতন করে তোলা।
- শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করা।
এ ধরনের পদক্ষেপ আমলে নিয়ে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভূমিকা রাখার প্রয়াস হলে জাতি ও রাষ্ট্র ভালো কিছু পাবে বলে আশা করা যায়। অপরপক্ষে আলিম-ওলামার বিরুদ্ধে অহেতুক অপপ্রচার বন্ধে সর্বমহলে চেষ্টা থাকার বিকল্প নেই। কারণ জাতি বিভক্ত থাকলে বহিঃশত্রুর কাজ সহজ হয়ে যায়। আজ জাতি বিভক্ত বলে রাষ্ট্র ভেতরে-বাইরে নানাবিধ ষড়যন্ত্রের শিকার। এখানে আলিম-ওলামার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জায়গা আছে। জায়গা নিরাপদ হলে ঘর বাঁধতে অসুবিধা কোথায়?