আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যে মাওলানা মুমতাজুল করীম বাবা হুজুর (রহ.)
মাওলানা মনির আহমদ
বিশিষ্ট আলিমে দীন, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার সাবেক মুহাদ্দিস মাওলানা মুমতাজুল করীম বাবা হুজুর ১৯৪২ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলার সদর থানার ডুলিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাওলানা মুমতাজুল করীম নিজ এলাকার বিখ্যাত বটগ্রাম হামিদিয়া মাদরাসায় শিক্ষাজীবন শুরু করেন। এরপর ফেনী শর্শদি মাদরাসায় কিছুদিন পড়াশোনা করে দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন । পরে জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া মাদরাসা থেকে সুনাম ও কৃতিত্বের সঙ্গে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন। দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের নিমিত্তে ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান গমন করেন। পাকিস্তানের বিখ্যাত মাদরাসা জামিয়া আশরাফিয়া লাহোর থেকে তাফসীর ও আদব (আরবি সাহিত্য) বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৬৫ সালে দেশে ফিরে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার কাতলাসেন কাদেরিয়া কামিল মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে যোগ দেন। তবে বেশিদিন সেখানে ছিলেন না। ওই বছরই (১৯৬৫ খ্রি.) বরিশালের ঐতিহ্যবাহী চরমোনাই মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে যোগ দেন এবং মুসলিম শরীফের দরস দেওয়া শুরু করেন।
পরবর্তীতে ঢাকা আশরাফুল উলুম বড়কাটারা মাদরাসায় সাত বছর মুহাদ্দিস হিসেবে খেদমত করে চট্টগ্রামের পটিয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে নিয়োগ পান। পটিয়া মাদরাসায় তিনি টানা সাত বছর সুনামের সঙ্গে হাদীসের দরস দেন। এ সময় পটিয়া থেকে প্রকাশিত মাসিক আত-তাওহীদ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত জামিয়া হোসাইনিয়ার প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।
১৯৮৪ সালে দেশের ঐতিহ্যবাহী দীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে নিয়োগ পান। হাটহাজারী মাদরাসায় অত্যন্ত সুনাম-সুখ্যাতির সঙ্গে হাদীসের দরস দিতে থাকেন। হাটহাজারী মাদরাসায় অধ্যাপনাকালে শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের মাঝে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। শিক্ষার্থীদের প্রতি তার অপরিসীম দরদ, ছাত্রগড়ার প্রতি তার মেহনত থেকে ছাত্ররা তাকে ‘বাবা হুজুর’ বলে সম্বোধন করতে থাকে। তিনিও দেশব্যাপী ‘বাবা হুজুর’ নামে পরিচিতি পান। একজন শিক্ষকের জন্য এর চেয়ে পরম পাওয়া আর কী আছে? ১৯৮৪ সাল থেকে টানা ৩৫ বছর (২০১৯ পর্যন্ত) তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় হাদীসের দরস দিয়েছেন। এরপরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে ঢাকায় তার ছেলে মাওলানা মাহমুদুল হাসান মোমতাজীর কাছেই থাকছেন। অসুস্থতার জন্য দরস দিতে না পারলেও উস্তাদ হিসেবে তার নাম রয়েছে।
কথায় আছে, রতনে রতন চেনে। চরমোনাই মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের কিছুদিনের মধ্যেই মরহুম চরমোনাই পীর মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাক (রহ.) মাওলানা মুমতাজুল করীমকে অত্যধিক স্নেহ ও ভালোবাসার পাত্রে পরিণত করে মেয়ে হুরুন নিসা বেগমকে তার সঙ্গে বিয়ে দেন। দীর্ঘ ৩০ বছর সংসার জীবন শেষে বাবা হুজুরের প্রিয়তমা স্ত্রী ১৯৯৫ সাল ৯ মে (হজের দিন) ইন্তেকাল করেন। পরে ১৯৯৬ সালে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন।
দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক বাবা হুজুর। তাঁর বড় ছেলে মাওলানা মাহমুদুল হাসান মমতাজী দেশবিখ্যাত আলেম। তিনি তেজগাঁও রহিম মেটাল জামে মসজিদের খতীব, ইন্টারন্যাশনাল খতমে নবুওয়ত মুভমেন্ট বাংলাদেশের আমীর ও ইসলামিক কালচারাল ফোরামের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বাবা হুজুর রহ. ছিলেন দিলখোলা মানুষ। ছিলেন আপোষহীন। স্পষ্টভাষী। সাহসী ও উদ্যমী। ছাত্রদের জন্য হাত ছিল উন্মুক্ত। সর্বদা হাদিয়া দিতেন তিনি। ছাত্রদের ছেলের মতো আদর করতেন। বাবা ডাকলে খুশি হতেন। নাস্তা করাতেন। পাগড়ি পরে থাকতেন সর্বদা। কথা কম বলতেন, তবে যা বলতেন তা ছিল ঘণ্টা বয়ানের চেয়েও উপযোগী।
ইসলামের প্রচারপ্রসার, কুরআনের তাফসীর, ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদসহ নানা দীনী কাজে তিনি দেশের আনাচেকানাচে ছুটে বেড়িয়েছেন। অংশ নিয়েছেন সভাসমিতি, ওয়াজ মাহফিল, জনসভা ও ইসলামি সম্মেলনে। একাধিক দেশও ভ্রমণ করেছেন। এর মধ্যে তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, আমেরিকা, চীন, হংকং, কুয়েত, কাতার, বাহারাইন, সৌদি আরব, পাকিস্তান ও ভারত অন্যতম।
শুধু হাদীসের খেদমত ও ওয়াজ মাহফিল নয় লেখালেখিতেও মাওলানা মুমতাজুল করীমের অবদান রয়েছে। সুলুক ও তাসাউফের মেহনতও তিনি করেছেন। হাকিমুল ইসলাম মাওলানা কারী তৈয়ব (রহ.)-এর নিকট বায়আত হন। পরবর্তীতে পীরে কামেল মাওলানা মুহাম্মাদ কামরুজ্জামান এলাহাবাদী (বখশিবাজারী) তাকে চিঠির মাধ্যমে চার তরীকায় খেলাফত প্রদান এবং বায়আত করার অনুমতি দেন। এছাড়া দারুল মাআরিফ চট্টগ্রামের শায়খুল হাদীস সন্দ্বীপের পীর সাহেব হজরত মাওলানা এহসানুল হক (রহ.) তাঁকে লিখিতভাবে খেলাফত দেন এবং খানকায়ে এহসানিয়া প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেন। ২০১৭ সালে মাহবুবুল উলামা হজরত মাওলানা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দিদীও তাঁকে খেলাফত প্রদান করেন। বাবা হুজুর মালয়েশিয়ার হলুলাংগাত মিফতাহুল উলুম মাদরাসা মিলনায়তনে আয়োজিত শায়খ নকশবন্দীর ইসলাহি মুলতাকায় যোগ দিয়ে ১০ মিনিটের মতো আলোচনা করেন। তার আলোচনায় মুগ্ধ হয়ে পীর নকশবন্দী তাকে খেলাফত দেন।
তার রচিত গ্রন্থাবলির অন্যতম হলো আরবি বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ বাদয়ুল কারী ইলা দিরাসাতিল বুখারী, বুখারী শরীফের উর্দু ব্যাখ্যাগ্রন্থ হাবিবুল বারী শরহিল বুখারী, আরবি কাওয়ায়েদে ফিকহিল হানাফী, তারিখুত তাফসীর, কুরআন-হাদীসের অমূল্য রত্ন, পরকালে মুক্তি কিসে (অনুবাদ), উলুমুল কুরআন, এসো কুরআনের অর্থ শিখি, আকীদায়ে খতমে নুবুওয়ত, রায়বেন্ডের দশদিন (অনুবাদ) ও আল্লাহকে পাওয়ার রাস্তা। এছাড়া বিভিন্ন মাসিক পত্রিকা, স্মরণিকা ও স্মারকগ্রন্থে তাঁর অনেক লেখা প্রকাশ পেয়েছে।
মাওলানা মুমতাজুল করীম বাবা হুজুরের শিক্ষকদের অন্যতম হলেন পটিয়া মাদরাসার প্রবীণ মুহাদ্দিস যিনি মীর সাহেব হুজুর নামে খ্যাত শায়খুল উলুম ওয়াল মানতিক, রঈসুল মুহাদ্দিসীন আল্লামা আমীর হোসাইন (রহ.), শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.), আল্লামা আনওয়ারুল আজীম (রহ.), শায়খুল হাদীস মাওলানা নুরুল ইসলাম শর্শদীর হুজুর (রহ.), পাকিস্তানের শায়খুত তাফসীর ওয়াল ফুনুন আল্লামা ইদরীস কান্ধলভী (রহ.), শায়খুল হাদীস আল্লামা মুহাম্মদ সরফরাজ খান (রহ.), উস্তাযুল কুল, শায়খুল মাশায়েখ আল্লামা রসুল খান (রহ.) ও শায়খুল ফালসাফা মাওলানা গোলাম গউস হাজারভী (রহ.)।
বাবা হুজুর বাংলাদেশের সদর সাহেব হুজুরখ্যাত মুজাহিদে আজম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.)-এর সান্নিধ্যও পেয়েছেন। ১৯৬৭ সালের দিকে তিনি গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় গেলে সদর সাহেব হুজুর তাকে সাথে করে নিয়ে পুরো মাদরাসা ঘুরিয়ে দেখান এবং ছাত্রদের দরস দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সমকালীন সময়ে বাংলাদেশের বড় বড় আলেমদের সান্নিধ্য তিনি পেয়েছেন। তিনি নিবিড়ভাবে যাদের সান্নিধ্য পেয়েছেন তাদের অন্যতম হলেন পটিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুফতি আজিজুল হক (রহ.), শায়খুল হাদীস খতিবে আযম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ (রহ.) ও শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.)।
মাওলানা মমতাজুল করীম বাবা হুজুর একজন আশেকে কুরআন ও আশেকে কুরআনে হাফেজ। তার দুই ছেলেই হাফেজে কুরআন। সামাজিক মানুষ হিসেবে তার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। সীমাহীন পরোপকারী, লেনদেনে অসম্ভব ধরনের স্বচ্ছতা তার জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি কাউকে কোনো বিষয়ের ওয়াদা দিলে তা পূরণ করতেন। এ জন্য তাকে শতভাগ ওয়াদা পূরণকারী ব্যক্তিত্ব বলা হয়। ওয়াদা খেলাফকারীদের তিনি ভীষণ অপছন্দ করেন। দেশের আনাচে-কানাচে তার যেমন অনেক ছাত্র রয়েছে, তেমনি সরকারি উচ্চমহলে বাবা হুজুরের অনেক ভক্ত রয়েছে। তারা বাবা হুজুরকে প্রাণাধিক ভালোবাসেন, সম্মান করেন।
স্বাভাবিক গড়নের ফর্সা চেহারার অধিকারী বাবা হুজুর খুব কম আহার করেন। তবে লাউ, ছোট মাছ তার পছন্দের খাবার। এছাড়া খুরমা ও কাজুবাদাম খেতে তিনি ভালোবাসেন। হাটহাজারী মাদরাসায় অধ্যাপনাকালে শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের মাঝে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। শিক্ষার্থীদের প্রতি তার অপরিসীম দরদ ও ভালোবাসার কারণে ছাত্ররা তাকে ‘বাবা হুজুর’ বলে সম্বোধন করতেন।
২৭ মার্চ ২০২৩ দিবাগত রাত ১.২০ মিনিটে রাজধানীর সায়েদাবাদের আল-করীম হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।