জামেয়া ওয়েবসাইট

শনিবার-৩০শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব, সতর্কতা অপরিহার্য

 ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

        লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

বর্ষায় ডেঙ্গু রোগ থেকে সাবধান থাকতে হবে, এ সময় প্রকৃতি সুন্দরভাবে সেজে উঠলেও, শারীরিক অসুস্থতায় কাবু হন কমবেশি সবাই। বর্ষা মৌসুমে বেড়ে যায় অনেক রোগের প্রকোপ। যখন তখন বৃষ্টি হওয়ার কারণে বর্ষাকালে আবহাওয়া সবসময় আর্দ্র থাকে। এ কারণে বর্ষাকালে বায়ুবাহিত, পানিবাহিত এবং মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। তাই বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু রোগ থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে সবারই যত্নবান হতে হবে। আর বর্ষার মৌসুম শুরু হলেই ফ্লু-জাতীয় রোগব্যাধি বেড়ে যায়। প্রায় সব পরিবারেই এই সময় কেউ না কেউ সর্দি, কাশি, জ্বরে ভুগে থাকে। তার মধ্যে রয়েছে করোনার ভয়। এখানেই শেষ নয়; এই মৌসুমে কিন্তু মশাবাহিত রোগের উপদ্রবও বেড়ে যায়।

ডেঙ্গুজ্বরের ব্যাপক প্রভাব ছিল গত বছর। এখনো ডেঙ্গু আক্রান্ত কিছু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ থাকে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গুজ্বরের সময়কাল এগিয়ে এসেছে ও দীর্ঘায়িত হয়েছে। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসকসহ অনেকে মারাও গেছেন। তাই ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে মানুষের মধ্যে চরম উৎকণ্ঠা ছিল এবং আছে। আজ বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু রোগের অজানা তথ্য নিয়ে বাংলাদেশের বিশিষ্ট হোমিও গবেষক ও জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ডা. এমএম মাজেদ তার কলামে লিখেন, বর্ষা মৌসুম আসায় রাজধানী ঢাকায় আবার মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছে।

গত জানুয়ারি থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এক হাজার ৭২৩ জন। দুই দশকের বেশি সময় ধরে ডেঙ্গুতে ভুগছে রাজধানীবাসী। দেশে এই রোগের হটস্পট হয়ে আছে ঢাকা মহানগর। আর ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। বাংলাদেশে ডেঙ্গু একটি পুনরাবির্ভূত রোগ হিসেবে গণ্য। সম্প্রতি (২০০০) বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন মোতাবেক এ দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বিস্ফোরক পর্যায়ে আছে। ১৯৮২-৮৩ সালের মধ্যে পরিচালিত ঢাকা মহানগরের স্কুলের শিশুদের মধ্যে পরিচালিত এক জরিপে সর্বমোট দুই হাজার ৪৫৬ রক্তের নমুনার মধ্যে ২৭৮টিতে ডেঙ্গুর লক্ষণ ধরা পড়ে। ১৯৮৪-৮৬ সালে ঢাকা শহরের হাসপাতাল থেকে সংগৃহীত রক্তের ২১টি নমুনার সবগুলোতেই সংক্রমণের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসার জন্য আসা প্রায় ১১ শতাংশ রোগীর (২৫০ জনের মধ্যে ২৭ জন) মধ্যে ডেঙ্গু অ্যান্টিজেনের পজিটিভ অ্যান্টিবডি টাইটার ধরা পড়েছিল। ১৯৯৯ সালে ঢাকার মহাখালীর স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে, বিভিন্ন জেলা থেকে পাঠানো রক্তের সন্দেহজনক নমুনা পরীক্ষা করে ২৪১টির মধ্যে ৯৮টিতে ডেঙ্গুর অস্তিত্ব ছিল।

ওই ইনস্টিটিউট প্রদত্ত বিস্তারিত তথ্যে এগুলোর মধ্যে কয়েকটি রক্তক্ষরা ডেঙ্গুরও তথ্য ছিল। ঢাকা শহরের চিকিৎসকদের দেয়া তথ্য থেকেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রক্তক্ষরা ডেঙ্গুর অস্তিত্বের কথা জানা গেছে ২০১৯ সালে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলা করেছে বাংলাদেশ। এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মৌসুমে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এত রোগী কখনোই হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। এমনকি এই সংখ্যা গত ১৯ বছরে দেশে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য মতে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ১৪৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। গত ১৯ বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মোট রোগী ৫০ হাজার ১৭৬ জন।

২০০২ সালে দেশে প্রথম ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু রোগী দেখা যায়। সে সময় পাঁচ হাজার ৫১১ রোগী ভর্তি হয়েছিল। ২০০১ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কমলেও ২০০২ সালে রোগীর সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়িয়ে যায়। এরপর থেকে ক্রমান্বয়ে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।

গত ১০ ডিসেম্বর সংবাদপত্রে প্রকাশিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এক লাখ ৭৪২ জন। এর মধ্যে ছাড়পত্র পেয়েছেন এক লাখ ১৭৭ জন। প্রধানত এশিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকার একটি ভাইরাসঘটিত সংক্রামক ব্যাধি। ডেঙ্গু ভাইরাস গোত্রভুক্ত, যার প্রায় ৭০ ধরনের ভাইরাসের মধ্যে আছে ইয়োলো ফিভার ও কয়েক প্রকার এনসেফালাইটিসের ভাইরাস। ডেঙ্গুজ্বরের অনুরূপ একটি রোগের মহামারির প্রথম তথ্য পাওয়া যায় ১৭৭৯ ও ১৭৮০ সালে চিকিৎসা সংক্রান্ত বইপুস্তকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কলকাতায় প্রথম ডেঙ্গুজ্বর শনাক্ত হয়। ১৮৭১-৭২ সালে এ রোগ মহামারি আকারে দেখা দেয়। ওই সময় থেকে এ রোগের প্রকোপ এ উপমহাদেশে প্রায়ই ঘটে। ১৯৩৯-৪৫ সাল থেকে গোটা মহাদেশে ১০ থেকে ৩০ বছর পরপর ডেঙ্গুজ্বর দেখা দিতে থাকে।

কোনো একটি বিশেষ স্থানে বারবার ডেঙ্গুর মহামারি দেখা দিত না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বহু ডেঙ্গু ভাইরাস সেরোটাইপের সহসঞ্চালন দেখা দেয় এবং মহামারির ঘটনা বৃদ্ধি পায়। ক্যারিবীয় অঞ্চল (১৯৭৭-১৯৮১), দক্ষিণ আমেরিকা (১৯৮০ সালের শুরুতে), প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল (১৯৭৯) এবং আফ্রিকায় ব্যাপক আকারে ডেঙ্গু মহামারি দেখা দেয় যাতে লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়।

রক্তক্ষরা ডেঙ্গুজ্বর এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রমের প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটে ১৯৫৩-৫৪ সালে ম্যানিলায় এবং ১৯৭৫ সালের মধ্যে নিয়মিত বিরতিসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ দেশে। ১৯৮০ ও ১৯৯০ সালে মহামারি আকারে রক্তক্ষরা ডেঙ্গু ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও পূর্বদিকে চীনে ছড়িয়ে পড়ে। রক্তক্ষরা ডেঙ্গুজ্বর ও শক-সিনড্রম ডেঙ্গু এখন এশিয়ায় হাসপাতালে ভর্তি ও শিশুমৃত্যুর একটি প্রধান কারণ। ডেঙ্গুজ্বরের বাহক মশা।

চার প্রকারের ডেঙ্গু ভাইরাস ১.২.৩.৪ হলো ডেঙ্গু ও রক্তক্ষরা ডেঙ্গুর কারণ এবং এগুলো প্রতিজনীভাবেও ঘনিষ্ঠ। যেকোনো একটি সেরোটাইপ বিশেষ কোনো ভাইরাসের বিরুদ্ধে আজীবন প্রতিরোধ ক্ষমতা দেয়, কিন্তু অন্য ভাইরাসগুলোর বিরুদ্ধে নয়। উষ্ণমণ্ডলীয় ও উপ-উষ্ণমণ্ডলীয় শহরাঞ্চলীয় চক্রেই ডেঙ্গু ভাইরাস স্থিতি লাভ করে। এজন্যই শহুরে লোকদের মধ্যেই রোগটি বেশি। মানুষের আবাসস্থলের সাথে সংশ্লিষ্ট, দিনের বেলায় দংশনকারী মশা এসব ভাইরাসের বাহক। কোনো কোনো অঞ্চলে অন্যান্য প্রজাতি মশাও সংক্রমণ ঘটায়। রোগীকে দংশনের দুই সপ্তাহ পর মশা সংক্রমণক্ষম হয়ে ওঠে এবং গোটা জীবনই সংক্রমণশীল থাকে।

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ

ডেঙ্গুজ্বর, ডেঙ্গু-ভাইরাসের সংক্রমণ উপসর্গবিহীন থেকে নানা রকমের উপসর্গযুক্ত হতে পারে, এমনকি তাতে মৃত্যুও ঘটে। সচরাচর দৃষ্ট ডেঙ্গুজ্বর, যাকে প্রায়ই ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু বলা হয়, সেটি একটি তীব্র ধরনের জ্বর যাতে হঠাৎ জ্বর হওয়া ছাড়াও থাকে মাথার সামনে ব্যথা, চক্ষুগোলকে ব্যথা, বমনেচ্ছা, বমি ও লাল ফুসকুড়ির। প্রায়ই চোখে প্রদাহ এবং মারাত্মক পিঠব্যথা দেখা দেয়। এসব লক্ষণ পাঁচ-সাত দিন স্থায়ী হয় এবং রোগী আরও কিছু দিন ক্লান্তি অনুভব করতে পারে ও এরপর সেরে ওঠে।

বেশির ভাগ সংক্রমণই, বিশেষত ১৫ বছরের কম বয়সি শিশুর ক্ষেত্রে, সম্পূর্ণ লক্ষণহীন অথবা ন্যূনতম লক্ষণযুক্ত হতে পারে। ত্বকে স্ফোট দেখা দেয় প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে, যা প্রথমে হাতে, পায়ে এবং পরে ঘাড়ে ছড়ায়। জ্বর চলাকালীন মুখ, গলা বা বুক রক্তাভ দেখায়। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চোখে রক্তক্ষরণ হয়।

  • রক্তক্ষরা ডেঙ্গুজ্বর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধানত শিশুদের একটি রোগ। রক্তক্ষরা ডেঙ্গু হলো ডেঙ্গুর একটি মারাত্মক ধরন। মূল লক্ষণগুলো বয়স নির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রেই অভিন্ন। এ ডেঙ্গুজ্বরের শুরুতে হঠাৎ দেহের তাপ বেড়ে যায় (৩৮০-৪০০ সে) এবং দুই থেকে সাত দিন পর্যন্ত থাকে। রক্তক্ষরণ বা ডেঙ্গু শক সাধারণত তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে দেখা দেয়। এতে থাকে মাথাব্যথা, ক্রমাগত জ্বর, দুর্বলতা এবং অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশীর তীব্র ব্যথা। শ্বাসযন্ত্রের ঊর্ধ্বাংশের সংক্রমণসহ রোগটি হালকাভাবে শুরু হলেও আচমকা শক ও ত্বকের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ ও কান দিয়ে রক্তপাত শুরু হয়ে যায়। রক্তে ক্রমাগত অণুচক্রিকা কমতে থাকে এবং রক্তের বর্ধমান রক্তবিকেন্দ্রক প্রবণতা থেকে আসন্ন শকের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। রক্তক্ষরা ডেঙ্গু রোগীর প্রয়োজন উত্তম সেবা-শুশ্রূষা ও পর্যবেক্ষণ। কেননা উপরিউক্ত পরিবর্তনগুলো খুব দ্রুত ঘটতে পারে এবং রোগীর অবস্থা সংকটজনক হয়ে উঠতে পারে।
  • ডেঙ্গু শক সিনড্রম এটি রক্তক্ষরা ডেঙ্গুরই আরেকটি রকমফের, তাতে সংকুচিত নাড়িচাপ, নিম্ন রক্তচাপ অথবা সুস্পষ্ট শকসহ রক্তসঞ্চালনের বৈকল্য থাকে। দেহের বাইরে থেকে যকৃত স্পর্শ করা যায় ও নরম হয়ে ওঠে এবং উৎসেচনগুলোতে সাধারণত অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়, তবে কদাচিৎ জন্ডিস হয়ে থাকে। অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে রয়েছে অব্যাহত পেটব্যথা, থেকে থেকে বমি, অস্থিরতা বা অবসন্নতা এবং হঠাৎ জ্বর ছেড়ে ঘামসহ শরীর ঠান্ডা হওয়া ও দেহ সম্পূর্ণ নেতিয়ে পড়া।

মহামারিতে নতুন জাতের ভাইরাস ও সেরোটাইপ দেখা দেয়ায় ডেঙ্গুর মহামারি আক্রান্ত দেশের সংখ্যা ১৯৮০ ও ১৯৯০ সালের মধ্যে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮০ সালের আগে মারাত্মক ধরনের সংক্রমণ খুব কমই দেখা গেছে। কিন্তু ১৯৯৭ সালের মধ্যেই রক্তক্ষরা ডেঙ্গু বাংলাদেশসহ উষ্ণমণ্ডলীয় ও উপ-উষ্ণমণ্ডলীয় দেশগুলোতে একটি স্বতন্ত্র রোগ হিসেবে বড় কয়েকটি এবং ছোট ছোট অনেকগুলো মহামারি ঘটায়। বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গু নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।

প্রতিবছর আক্রান্ত প্রায় ৫০ লাখ রোগীর মধ্যে অন্তত পাঁচ লাখ রক্তক্ষরা ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় যাদের একটি বড় অংশই শিশু এবং মারা যায় প্রায় ৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর এ পুনরাবির্ভাব এবং রক্তক্ষরা ডেঙ্গু উৎপত্তির মূলে আছে নজিরবিহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ, বিমান ভ্রমণ বৃদ্ধি, মশক দমনের অভাব এবং গত ৩০ বছরে জনস্বাস্থ্যের কাঠামোর অবনতি।

ডেঙ্গু কেন শীতের পরে?

এই শতাব্দীর শুরু থেকেই আমাদের দেশে প্রতিবছর শীতের পরপরই যখন বৃষ্টি হয়, বেড়ে যায় মশার উপদ্রব। বেড়ে যায় মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। তাই এই করোনাকালে থেমে নেই বৃষ্টি, থেমে নেই মশার প্রজনন। ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ খুব বেশি। তবে সারা দেশেই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এযাবৎকালে গত বছরই সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। মারাও যায় বেশি। ঢাকাসহ সারা দেশেই বছরব্যাপী মশার উপদ্রব। কিন্তু ডেঙ্গুর প্রকোপ সারা বছর থাকে না। কারণ ডেঙ্গু ছড়ানোর জন্য দায়ী এডিস মশা জন্মায় পরিষ্কার পানিতে। আর এই পরিষ্কার পানি পাওয়া যায় বৃষ্টির পরপরই। বৃষ্টির পানি কোনো স্থানে জমে থাকলে ওখানেই ডিম পাড়ে এই এডিস মশা।

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কী?

প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। শুধু উত্তম বললেও কম বলা হয়। এটিই বাঁচার ভালো উপায়। করোনার এই নাকাল অবস্থায় কারো ডেঙ্গু হলে অবস্থাটা কী হতে পারে এটি যার হবে সেই বুঝতে পারবে। তবে যার হয়নি সেও চিন্তা করলে মাথা ঠিক থাকার কথা নয়। তাই ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে মশার প্রজনন বন্ধ করা আর মশা নির্মূলের কোনো বিকল্প নেই। পানি জমতে পারে এমন কোনো অবস্থাই যেন না হয় সেটি খেয়াল রাখতে হবে। সর্ব প্রকারের ডাবের খোসা, গাড়ির টায়ার, ভাঙা বোতল, পরিত্যক্ত ফুলের টব ইত্যাদি সবই সরিয়ে ফেলতে হবে নিজ উদ্যোগেই। সরকারের একার পক্ষে ১৭ কোটি মানুষের ভাঙা বোতল, গ্লাস, ডাবের খোসা, বালতি, টায়ার খুঁজে বের করা বা সরিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। বাঁচতে হলে যার যার নিজ উদ্যোগেই এগুলোতে অংশগ্রহণ করতে হবে। মনে রাখবেন, আপনার বাড়ির পাশের মশা আপনাকেই আক্রমণ করবে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধ প্রতিকারে ঘরোয়া পরামর্শ

ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও প্রতিকারে কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে।

  • মধু: প্রতিদিন সেবনে ইমিউন সিস্টেম উন্নত করে; রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
  • কালোজিরা তেল: কালোজিরা বা কালোজিরা তেলকে বলে সব রোগের মহৌষধ! তবে প্রতিদিন তিন চা-চামচের বেশি খাওয়া ঠিক নয়। আগে কখনো না খেয়ে থাকলে আধা চামচ করে শরীরে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারেন। যেকোনো পেশেন্ট ও গর্ভবতী মহিলা সেবনের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
  • নিমের তেল: বাড়িতে মশার উপদ্রব থেকে বাঁচতে পানির সাথে নিমের তেল মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে। এছাড়া ১০-১৫ ফোঁটা নিম তেল আধা কাপ নারকেল তেলের সাথে মিশিয়ে গায়ে লাগালেও মশারা আর ধারেকাছে ঘেঁষবে না।
  • নারকেল তেল: নারকেল তেল গায়ে লাগালে মশারা কাছে ঘেঁষে না।
  • হলুদের গুঁড়ো: হলুদের মধ্যে প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ লবণ, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, লোহা প্রভৃতি নানা পদার্থ রয়েছে। তাই হলুদ খেলে শরীরে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। প্রতিদিন দুধ বা পানির সাথে হলুদের গুঁড়ো বা রস মিশিয়ে খাওয়া অভ্যাস করলে অনেকটাই সুস্থ থাকা সম্ভব। হলুদ সাধারণত বিভিন্ন রান্নায় পরিমাণমতো ব্যবহার করা হয়। তা ছাড়া সরাসরি সেবন করা যায়, তবে অবশ্যই মাত্রাতিরিক্ত নয়! পেশেন্ট, বিভিন্ন ওষুধ সেবনকারী ও গর্ভবতী মহিলারা সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
  • দুধ, কলা ডিম: এগুলোকে সুষম খাদ্য বলা হয়। প্রতিদিন সেবনে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হয় ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। অনেকের এসব খাদ্যে অ্যালার্জি থাকে অথবা বিভিন্ন রোগে (যেমন- কিডনি রোগ, ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স ইত্যাদি) এ দুধ একটি নিষিদ্ধ খাদ্য।
  • পেঁপে পেঁপে পাতা: পেঁপে খুব দ্রুত রক্তের প্লাটিলেটের পরিমাণ বাড়াতে সক্ষম। মালয়েশিয়ার এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজির একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ডেঙ্গুজ্বরের কারণে রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে গেলে পেঁপে পাতার রস তা দ্রুত বৃদ্ধি করে। রক্ত প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে গেলে প্রতিদিন পেঁপে পাতার রস কিংবা পাকা পেঁপের জুস পান করুন।
  • ড্রাগন ফল: ড্রাগন ফলে আছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট! এটি ব্লাডের সাদা সেল বাড়াতে সাহায্য করে।
  • মিষ্টিকুমড়া এবং কুমড়া বীজ: মিষ্টিকুমড়া রক্তের প্লাটিলেট তৈরি করতে বেশ কার্যকর। এছাড়াও মিষ্টিকুমড়াতে আছে ভিটামিন এ যা প্লাটিলেট তৈরি করতে সহায়তা করে। তাই রক্তের প্লাটিলেটের সংখ্যা বাড়াতে নিয়মিত মিষ্টিকুমড়া এবং এর বীজ খেলে উপকার পাওয়া যায়।
  • লেবু: লেবুর রসে প্রচুর ভিটামিন সি থাকে। ভিটামিন সি রক্তে প্লাটিলেট বাড়াতে সহায়তা করে। এছাড়াও ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে তোলে। ফলে প্লাটিলেট ধ্বংস হওয়া থেকেও রক্ষা পায়।
  • দেশি মাছ: দেশি বিভিন্ন মাছ (যেমন- কই, শিং, মাগুর, শোল, বাইন, ছোট মাছ, পাঁচমিশালী মাছ ইত্যাদি) শরীরে রক্ত বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

করণীয়

ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীকে উচ্চ তাপমাত্রা রোধ করতে শরীর ঠান্ডা পানি দিয়ে মুছে দিতে হবে। শরীর বেশি ঠান্ডা মনে হলে খাবার স্যালাইন দিতে হবে। হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। তাকে পূর্ণ বিশ্রামে রেখে বেশি করে পানি খেতে দিতে হবে।

হোমিও প্রতিবিধান

রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয়, এজন্য একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসককে ডা. হ্যানিমানের নির্দেশিত হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি অনুসারে ডেঙ্গু রোগসহ যেকোনো জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যভিত্তিক লক্ষণ সমষ্টিনির্ভর ও ধাতুগতভাবে চিকিৎসা দিলে মহান আল্লাহর রহমতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতিতে ডেঙ্গুজ্বরের চিকিৎসা সম্ভব।

হোমিও চিকিৎসা

অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা যেসব মেডিসিন প্রাথমিকভাবে ব্যবহার করে থাকেন একোনাইট, বেলেডোনা, ব্রায়োনিয়া, রাসটক্স, ইউপেটেরিয়াম পার্ফ, আর্সেনিক অ্যালবাম, কার্বোভেজ, ইপিকাক, সালফারসহ আরও অনেক ওষুধ লক্ষণের ওপর আসতে পারে। তাই ডেঙ্গুজ্বরের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে হলে অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ