জামেয়া ওয়েবসাইট

বৃহস্পতিবার-১২ই শাবান, ১৪৪৬ হিজরি-১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উস্তাদের সান্নিধ্য ও তাওয়াজ্জুহ

 মুহাম্ম ত্বহা হুসাইন

জীবনে উন্নতি-অবনতির ক্ষেত্রে মা-বাবা ও উস্তাদের দোয়া ও বদ দোয়ার বিরাট প্রভাব রয়েছে। বিশেষত আমরা যারা তালিবুল ইলম, তাদের দুনিয়া-আখেরাতের কামিয়াবির জন্য উস্তাদের দোয়া ও তাওয়াজজুহর বিকল্প নেই। এটি আমাদের জীবন-পথের পাথেয়। উস্তাদের দোয়া-তাওয়াজ্জুহ যেমন একজন তালিবে ইলমকে উন্নতির পরম শিখরে পৌঁছে দিতে পারে, তেমনি তাঁদের অন্তরের চোট ও ব্যথাও চরম হতে পারে ক্ষতির কারণ। শুধু ইলমী যিন্দেগীতেই নয়, জীবনের সকল ক্ষেত্রেই এই উন্নতি ও অবনতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

এ কথা সত্য যে, মানুষের কৃতকর্মের ফলেই তার ওপর বালা-মসিবত আসে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বান্দা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারে না, কোন গুনাহর কারণে কোন মসিবতটি এসেছে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে অনুমান করা যায় যে, সম্ভবত অমুক গুনাহর কারণেই এই মসিবতটি এসেছে। কোনো ভুল আকীদা পোষণ না করলে নিজের ইসলাহ ও সংশোধনের জন্য এটুকু অনুমান করতে অসুবিধা নেই। সংশোধন ও শিক্ষাগ্রহণের জন্যই কয়েক যুগ আগের একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা এখানে তুলে ধরছি।

তখন আল্লামা সাইয়েদ সুলাইমান নদভী (রহ.) ভারতের নদওয়াতুল উলামা লখনউয়ের নাযিমে আলা। নদওয়াতুল উলামার এই দায়িত্ব পালনকালে তিনি কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তাঁর এসব পদক্ষেপ ও তার প্রতিক্রিয়ার কথা আলোচনা করতে গিয়ে আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) লেখেন, ‘দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামার রূহানি ও ফিকরি তরক্কির জন্য সাইয়েদ সুলাইমান নদভী (রহ.)-এর নতুন চিন্তা-ভাবনা ও পদক্ষেপগুলোর পক্ষে ছাত্রদের পক্ষ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। বরং ভেতরে ভেতরে এক ধরনের অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠে, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল নদওয়ার ১৯৪৩ সালের অনাকাঙ্ক্ষিত ছাত্র-ধর্মঘটের মাধ্যমে। যদিও ধর্মঘটের সূচনা হয়েছিল ব্যবস্থাপনাগত কিছু বিষয় থেকে, কিন্তু এর পেছনে মূল কারণ ছিল সাইয়েদ সাহেবের গৃহীত সংস্কার উদ্যোগ।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ধর্মঘটের নেতৃত্বে ছিল আমাদেরই স্নেহভাজন কিছু শাগরিদ, যারা ছিল দারুল উলূমের প্রথম সারির ছাত্র। যাদের নিয়ে আমাদের, বরং পুরো দারুল উলূমের অনেক স্বপ্ন ছিল। অনেক আশা ও প্রত্যাশা ছিল।

আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল আমার অতি প্রিয় ও স্নেহভাজন একজন ছাত্র। আমি দারুল উলূমে দশ বছর শিক্ষক ছিলাম। এরপর নায়েবে নাযিম ও নাযিম হিসেবেও বহুদিন কাজ করেছি। এই দীর্ঘ সময়ে এই নওজোয়ানের চেয়ে মেধাবী, প্রতিভাবান ও রুচিশীল কোনো তালিবে ইলম আমি দেখিনি।

দ্বিতীয়-তৃতীয় স্তরে পড়ার সময় তাঁর অবস্থা এমন ছিল যে, সাবলিল আরবিতে সে লিখতে ও বলতে পারত। তাতে নাহু-সরফের কোনো ত্রুটি হওয়াও মুশকিল ছিল। যখন সে তৃতীয়-চতুর্থ স্তরের ছাত্র তখন একবার তার পরীক্ষার খাতা দেখে আমার প্রিয় উস্তাদ আরবি সাহিত্যের পণ্ডিত মাওলানা খলীল আরব বলেছিলেন, খাতাগুলি দিন, এগুলো দেখিয়ে যত বেশি বলুন, নদওয়ার জন্য আমি চাঁদা তুলতে সক্ষম। যখন সে চতুর্থ-পঞ্চম স্তরে পড়ে তখন তাৎক্ষণিকভাবে যে কোনো বিষয়ের ওপর আরবি ভাষায় সাবলিলভাবে বক্তব্য দিতে পারত। স্মৃতিশক্তি এত প্রখর ছিল যে, সেই বয়সেই ইকবাল, আকবর ইলাহাবাদী ও যফর আলী খানের মতো কবিদের হাজারো শের তার ঠোঁটস্থ ছিল।

এই হাঙ্গামার পর যখন সে করাচি গেল, এত কম বয়সী হওয়া সত্ত্বেও করাচির ইলমী ও গবেষণা মজলিসগুলোতে আল্লামা খেতাবে বরিত হতে লাগল।

আন্দোলন-হাঙ্গামাগুলো যেমন ঘটে থাকে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সে এই অনাকাঙ্খিত ঘটনার নেতায় পরিণত হল। এই হাঙ্গামায় তার অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদানে তার সকল উস্তাদ, বিশেষত আমি খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম। কারণ আমি জানতাম, এই হাঙ্গামার সবচেয়ে বড় আঘাত আসবে সাইয়েদ সুলাইমান নদভী (রহ.)-এর ব্যক্তিত্ব ও তার পরিচালনার ওপর। কারণ তিনি তখন নদওয়ার প্রধান মুরববী ও একমাত্র অভিভাবক। নদওয়ার জন্য তিনি ছিলেন জান কুরবান।

এই হাঙ্গামার কারণে সাইয়েদ সাহেবের দিলে খুব চোট লেগেছিল। তাঁর মনে নদওয়ার খেদমত ও ছাত্রদের তারবিয়তের বড় বড় স্বপ্ন ছিল, যা তিনি এই হাঙ্গামার মধ্য দিয়ে ধুলোয় মিশে যেতে দেখলেন। তার সকল সাধনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার দৃশ্যও দেখতে পেলেন। তিনি বেচাইন হয়ে গেলেন এবং তাঁর দিল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।

এই সময়েরই ঘটনা। আমাদের সেই প্রিয় ছাত্রটি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেল। হালত এতই নাজুক হল, আত্মীয়-স্বজনরা তাঁকে রশি দিয়ে বেঁধে রাখতে বাধ্য হল। বহু চিকিৎসা করানো হল। একপর্যায়ে তার এক ভাই আমাদের বাড়িতে এসে আমার শ্রদ্ধেয় বড় ভাই ডাক্তার সাইয়েদ আবদুল আলী সাহেবকে তার চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেল। বিশেষ সম্পর্কের সুবাদে আমিও তার সাথে গেলাম। বিশ্বাস করুন, ‘রশিতে বাঁধা আমার প্রিয় ছাত্রকে দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।

আফসোস! মেধা ও প্রতিভায় যে ছিল সবার ঈর্ষার পাত্র, আজ তার এই করুণ অবস্থা!! আমার ভাই ওষুধপত্র লিখে তাশরীফ নিয়ে এলেন।

সে সময় সাইয়েদ সুলাইমান নদভী (রহ.) এতই ব্যথিত ছিলেন যে, রাতে দারুল উলূমে থাকতেন না। থাকতেন আমাদের ঘরে। একদিন একাকীত্বের সুযোগে আমি তাঁর কাছে আরয করি, ‘আমার ধারণা, অমুক ছাত্রটির মুখ থেকে আপনার ব্যাপারে কোনো শব্দ বের হয়ে গিয়েছিল। হাঙ্গামার তুফানে এটা অসম্ভব নয় যে, আবেগতাড়িত হয়ে কোনো অসৌজন্যমূলক আচরণ সে করে ফেলেছে। আর হাদীস শরীফে তো আল্লাহ বলেছেনই,

«مَنْ عَادَىٰ لِيْ وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْـحَرْبِ».

যে আমার কোনো ওলি-বুযুর্গকে কষ্ট দেবে, তার সাথে স্বয়ং আমি আল্লাহ যুদ্ধ ঘোষণা করলাম। আর আপনি তো তার অত্যন্ত মুহসিন অভিভাবক ও শফীক মুরববী!!

উত্তরে সাইয়েদ সাহেব তাওয়াযূ ও বিনয়ের সাথে বললেন, আমিই বা আর তেমন কে?

আমি পুনরায় একই কথা আরয করলাম এবং সেই ছাত্রটির জন্য দোয়ার দরখাস্ত করলাম। কিন্তু সাইয়েদ সাহেব চুপ রইলেন। কিছুই বললেন না।

দুই কি তিন দিন পর। তিনি আমাকে বললেন, ‘মৌলভী আলী! আমি আপনার হুকুম পালন করতে পেরেছি।’

এখন আপনি একে সাইয়েদ সাহেবের কারামত বলুন বা অন্য কিছু, এর পরপরই আমাদের এই প্রিয় ছাত্রটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেল। আমি যতটুকু জানি, দ্বিতীয়বার সে এই রোগে আক্রান্ত হয়নি।

কিন্তু খুব কম বয়সেই ১৯৫০ সালে ক্ষণিকের জ্বলে উঠা এই প্রদীপ শিখা চিরদিনের জন্য নিভে গেল।

حسرت ان غنچوں پہ جو بن کھلے مرجھاگئے

আফসোস! সেই কলির তরে, না ফোটেই যা গেল ঝরে। (দেখুন পুরানে চেরাগ, ১/৪০-৪২)

প্রিয় তালিবে ইলম ভাই! এই মর্মস্পর্শী ঘটনাটি বারবার পড়ুন এবং হৃদয়ে খোদাই করে রাখুন। উস্তাদদের ছায়ায় থেকে তাঁদের খেদমতে সঁপে দিতে না পারি, যদিও এটিই ছিল একজন হাকীকী তালিবে ইলমের প্রধান কাজ, অন্তত এতটুকু সতর্ক তো অবশ্যই থাকতে পারি যে, আমার কাজ-কর্মে এবং আচরণ-উচ্চারণে আমার উস্তাদকে ‘উফ’ বলতে না হয়।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ