বুজুর্গ উমেদ খাঁ: চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধারের মহানায়ক
খালেদ মাহমুদ
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গহিরা ডিগ্রি কলেজ, রউজান, চট্টগ্রাম
বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এবং দেশের বাণিজ্যিক ও আধ্যাত্মিক নগরী হিসেবে চট্টগ্রাম আজ সারাবিশ্বে পরিচিত। অথচ একজন ব্যক্তির আগমন না হলে হয়তো এই চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত নাও হতে পারতো। আর সেই ব্যক্তিটি হলেন মোগল সুবাদার শায়েস্তা খাঁর পুত্র চট্টগ্রাম বিজয়ের মহানায়ক বুজুর্গ উমেদ খাঁ।
বঙ্গের সুলতানদের হটিয়ে এক জটিল রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে মধ্যযুগে প্রায় শত বছর চট্টগ্রামে রাজ কায়েম হয়েছিল মগদের! ফেনী নদী থেকে সমগ্র আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত এই রাজ্যটি আমাদের কাছে সাহিত্যের ভাষায় পরিচিত ‘মগের মুল্লুক’ নামে (অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন, মগ অধ্যুষিত চট্টগ্রামের তখন কি হাল!) আর এই অত্যাচারী মগদের চট্টগ্রাম থেকে হটিয়ে দেন মোগল সেনাপতি বুজুর্গ উমেদ খাঁ!
১৬৬৬ সালের ২৭ শে জানুয়ারি সেই যে চট্টগ্রাম বাংলাদেশের (তৎকালীন সুবা বাঙলা) অন্তর্ভুক্ত হলো, এরপর থেকে আর কখনো বাংলার প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক আওতার বাইরে যায়নি চট্টগ্রাম। মোগল, ব্রিটিশ, পাকিস্তানি, স্বাধীন বাংলাদেশ যখনই যার শাসন ছিল না কেনো এই ভূখণ্ডে, চট্টগ্রাম সবসময়ই ছিল বাংলার সাথে, বাংলার প্রবেশদ্বার হিসেবে।
কিন্তু বুজুর্গ উমেদ খাঁ কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয়ের আগে এই ভূমি বাংলা ছাড়াও কখনো মগরাজা তো কখনো ত্রিপুরা রাজার করায়ত্ব হতো। শায়েস্তা খাঁর পুত্র বুজুর্গ উমেদ খাঁ অত্যাচারী শাসকদের এমনভাবে বিতাড়িত করেছেন এই ভূমি থেকে যে, চট্টগ্রামকে আর বাংলা থেকে আলাদা করার দুঃসাহস দেখানোর সুযোগ পায়নি প্রতিবেশী রাজ্যগুলো।
- বুজুর্গ উমেদ খাঁর বিজয়ের আগেও দুবার চট্টগ্রাম বাঙলার অন্তর্ভুক্ত হলেও সে বিজয়গুলো দীর্ঘস্থায়ী ছিল না।
- প্রথমবার চট্টগ্রাম বিজয়: ১৩৪০ সালে ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের আমলে সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম বৃহত্তর বাঙলার অধীনে আসে। চট্টগ্রামের কিংবদন্তিতুল্য বদর পীরও এই বিজয়াভিযানে সুলতানের সঙ্গী হন। ১৩৪৬ সালে এই চট্টগ্রাম দিয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করেন বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা। তিনি তার ভ্রমণ কাহিনিতে চট্টগ্রামকে বঙ্গ সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত সুন্দর নগর হিসেবে বর্ণনা করেন।
- দ্বিতীয়বার চট্টগ্রাম বিজয়: প্রায় দুশ বছর মুসলিম শাসনামলের পর ১৫১৩ সালে চট্টগ্রাম আবার বাংলার হাতছাড়া হয়। হোসেন শাহী বংশের সুলতান আলাউদ্দীন হুসেইন শাহের আমলে পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্য কর্তৃক চট্টগ্রাম দখল করে নেওয়া হয়।
যদিও ত্রিপুরার এই দখলদারিত্ব বেশিদিন বজায় ছিল না। অচিরেই সুলতান আলাউদ্দীন হুসেইন শাহের পুত্র সুলতান নশরত শাহ কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয় (ফাতেহ) করা হয়। চট্টগ্রাম বিজয় করেই সুলতান অঞ্চলটির নাম দেন ‘ফাতেয়াবাদ’। আজও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন ফাতেয়াবাদ অঞ্চলটি সুলতান নশরত শাহের স্মৃতিকে ধারণ করে আছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নশরত শাহ কর্তৃক খননকৃত বড় দীঘি (ওই দীঘির নামানুসারে স্থানটির নাম বড়দীঘির পাড়) এবং সুলতান নশরত শাহ মসজিদ আজও অস্তিত্ব জারি রেখেছে স্বনামে।
সুলতান নশরত শাহ ত্রিপুরারাজ থেকে চট্টগ্রামকে বিজয় করে আনলেও এই বিজয় টেকসই ছিল না। যদিও সুলতানের মৃত্যুর পরে আরও ৫০ বছর চট্টগ্রাম বাংলার সাথে ছিল। কিন্তু নিত্যনৈমিত্তিক আরাকানরাজের সাথে চট্টগ্রামের দখল নিয়ে বাংলার সুলতানদের সংঘর্ষ লেগেই থাকতো।
১৫৮১ সালে এসে আরাকানরাজ বাংলার আধিপত্য খর্ব করে চট্টগ্রামকে পুরোপুরি আরাকানের অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়। বারো আউলিয়ার পূণ্যভূমি, বাংলার রাণী চট্টগ্রাম হয়ে যায় আরাকান মগ এবং পর্তুগিজ জলদস্যুদের (ফিরিঙ্গি) অভয়ারণ্য! মগ-পর্তুগিজ ঐক্যজোট সমগ্র ভাটি বাঙলার জনজীবনকে বিভীষিকাময় করে তোলে। চট্টগ্রামকে ঘাঁটি করে মেঘনা নদীর উপকূলের বিস্তীর্ণ ভূভাগে জলদস্যুতা এবং লুটতরাজ চালাতো এই মগ এবং হার্মাদ গোষ্ঠী!
- আরাকান রাজা কর্তৃক মোগল শাহজাদাকে হত্যার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বিজয়ের উপলক্ষ তৈরি হয়। ১৬৫৭ সালে মোগল সিংহাসন নিয়ে বাদশাহ শাহজাহানের চারপুত্রের মধ্যে সংঘটিত ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের কাছে তার অপর ভাইয়েরা পরাজিত হন। আওরঙ্গজেব আলমগীরের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইদের একজন হলেন শাহজাদা সুজা। শাহজাদা সুজা ১৬৪০ সাল থেকে ১৬৬০ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর বাংলার সুবাদার (বর্তমান হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী পদমর্যাদা) ছিলেন।
ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে পরাজয়ের পর শাহজাদা সুজার লক্ষ্য ছিল নোয়াখালী থেকে জাহাজে করে সমুদ্র পথে মক্কা অথবা ইস্তাম্বুল চলে যাবেন। কিন্তু বর্ষাকাল এসে যাওয়ায় তা আর হয়ে উঠেনি। এদিকে বাদশাহ আওরঙ্গজেবের বাহিনী প্রতিনিয়ত খোঁজ করছে শাহজাদা সুজার।
আওরঙ্গজেবের হাত থেকে রক্ষা পেতে তাই শাহজাদা সুজা পার্শ্ববর্তী আরাকান রাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে চলে যান। ১৬৬০ সালের আগস্ট মাসে এককালের পরাক্রমশালী বাঙলার সুবাদার শাহজাদা সুজার ঠাঁই হলো আরাকান রাজ্যে। কিন্তু ছয় মাসের মাথায় শাহজাদা সুজাকে খুন করে আরাকান রাজা। শাহজাদার পরিবারের মেয়েদের করা হয় লাঞ্ছিত এবং ছেলেদের করা হয় কারারুদ্ধ। মোগল শাহজাদার এই বিয়োগান্ত সংবাদ অচিরেই পৌঁছে যায় দিল্লির বাদশাহ তথা সুজার ভাই আওরঙ্গজেব আলমগীরের কাছে।
নিজ ভাই হলেও হয়তোবা ক্ষমতার প্রশ্নে কখনোই সুজার প্রতি সহানুভূতি দেখাতেন না বাদশাহ আওরঙ্গজেব। কিন্তু তাই বলে ভিনদেশি কারো হাতে ভাইয়ের খুন! এ যে তৈমুরি (মোগল) বংশের অবমর্যাদা! প্রতাপশালী বাদশাহ আওরঙ্গজেব কি করে এটা বরদাশত করবেন?
আরাকান রাজ কর্তৃক নিজ ভাইয়ের খুনের প্রতিশোধ নিতে তাই নিজ মামা ও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহচর শায়েস্তা খাঁকে বাংলার সুবাদার করে পাঠান দিল্লির বাদশাহ আওরঙ্গজেব। আর সুবাদার শায়েস্তা খাঁর প্রতি আওরঙ্গজেবের প্রথম নির্দেশই ছিল, ‘মগদের শায়েস্তা করো’।
১৬৬৫ সালের শীতকাল। সুবাদার শায়েস্তা খাঁ এক সুসজ্জিত সেনাবাহিনী গঠন করলেন মগদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধারের এই মিশনে প্রধান সেনানায়ক হিসেবে যোগ দিলেন সুবাদার শায়েস্তা খাঁর সুযোগ্য পুত্র বুজুর্গ উমেদ খাঁ!
- বুজুর্গ উমেদ খাঁ একজন ঠান্ডা মাথার কৌশলী সামরিক ব্যক্তিত্ব এবং দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। তিনি বুঝলেন, চট্টগ্রাম বিজয় করতে হলে সমুদ্র এবং স্থল দুপথেই আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে। সমুদ্রপথে আক্রমণ করতে হলে দরকার নৌঘাঁটি। আর এই নৌঘাঁটি স্থাপনে যুৎসই জায়গা হলো সন্দ্বীপ। কিন্তু সন্দ্বীপে তখন দিলাওয়ার খাঁ নামক সাবেক মোগল সেনাপতির শাসন বজায় ছিল। তিনি মোগলদের চট্টগ্রাম বিজয়ে সহায়তা করতে রাজি হননি। আর তাই বুজুর্গ উমেদ খাঁর প্রেরিত নৌবাহিনী সর্বপ্রথম দিলাওয়ার খাঁকে পরাজিত করে সন্দ্বীপ দখল করে। (সন্দ্বীপের ৫০ বছরের স্বাধীন সুলতানের প্রতি সম্মান জানিয়ে দ্বীপটির প্রধান সড়কটির নাম দিলাওয়ার খাঁর নামে নামাঙ্কিত সুদীর্ঘকাল ধরে।)
বুজুর্গ উমেদ খাঁর দ্বিতীয় কৌশল ছিল পর্তুগিজ এবং মগদের মধ্যে বিবাদ বাড়িয়ে মোগলদের পক্ষে সুবিধা আদায় করা। কূটনৈতিক উপায়ে এবং গোয়েন্দাদের মাধ্যমে এই কাজেও সফল হন তিনি। আর তাই মোঘলদের চট্টগ্রাম আক্রমণের সময় আরাকানদের কোনোরূপ সাহায্য করেনি পর্তুগিজরা।
১৬৬৬ সালের জানুয়ারি মাস। ফেনী নদী পার হয়ে চট্টগ্রাম অভিমুখে ক্রমশই অগ্রসর হচ্ছেন বুজুর্গ উমেদ খাঁ। যাত্রাপথে বুজুর্গ উমেদ খাঁ চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার এক গ্রামে যাত্রাবিরতি করেন এবং একটা মসজিদ নির্মাণ করেন। বুজুর্গ উমেদ খাঁ নির্মিত মসজিদটি আজও আছে এবং সেই গ্রামের নাম এখনো উমেদনগর হিসেবে রয়েছে।
বিশাল সৈন্যবহর সাথে থাকলেও উত্তর চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ জঙ্গল বুজুর্গ উমেদ খাঁর সামনে বাঁধা হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিল। তাই তিনি সৈন্যদলকে নির্দেশনা দিলেন যে, গাছ কেটে কেটে রাস্তা তৈরি করে অগ্রসর হও। মোগল সৈন্যদল দিন রাত এক করে রাস্তা তৈরি করলো চট্টগ্রাম নগরে প্রবেশের।
- বুজুর্গ উমেদ খাঁর চট্টগ্রাম দুর্গ বিজয়। বাঙলা দেখলো তাঁর সালাউদ্দীন আইয়ুবীকে। জানুয়ারির শেষদিকে এসে বুজুর্গ উমেদ খাঁর বাহিনী মূল চট্টগ্রাম নগরে এসে পৌঁছায়। এদিকে সমুদ্রপথেও মোগল বাহিনী নৌসেনাপতি ইবনে হোসেন মনসুর খাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে নোঙর করতে সক্ষম হয়।
স্থল ও নৌ দুবাহিনী মিলিত হয়ে ১৬৬৬ সালের ২৪ জানুয়ারি আক্রমণ করে আরাকানদের ওপর আরাকানদের শক্ত ঘাঁটি চাটগিছা কিল্লায় (আন্দরকিল্লা) টানা তিনদিন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয় মোগল এবং মগদের। অবশেষে ২৬ জানুয়ারি পদানত হয় আরাকান বাহিনী।
১৬৬৬ সালের ২৭ জানুয়ারি বিজয়ী বীরের বেশে আন্দরকিল্লা দুর্গে হেলালী নিশান উড়ান সেনাপতি উমেদ খাঁ। মোঘল বাদশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীরের নির্দেশে চট্টগ্রামের নতুন নামকরণ করা হয় ‘ইসলামাবাদ’।
বুজুর্গ উমেদ খাঁর এমন বিজয়কে তুলনা করা যায় সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবীর বায়তুল মুকাদ্দাস (জেরুজালেম) বিজয়ের সাথে। শত বছর ক্রুসেডারদের দখলে থাকা মুসলিম উম্মাহর প্রথম কেবলাকে দখলমুক্ত করে সুলতান আইয়ুবী যে অসাধারণ কীর্তি স্থাপন করেন, ঠিক তেমনই একশ বছর মগ আর পর্তুগিজদের দখলে থাকা বারো আউলিয়ার পূণ্যভূমি চট্টগ্রামকেও দখলমুক্ত করে অবিস্মরণীয় এক কীর্তি স্থাপন করেন বুজুর্গ উমেদ খাঁ।
বারো আউলিয়ার পূণ্যভূমি চট্টগ্রামে যেনো নতুন করেই ইসলামের আবাদ করেন বুজুর্গ উমেদ খাঁ! তিনি চট্টগ্রামজুড়ে অনেকগুলো মসজিদ, লাইব্রেরি, সরাইখানা স্থাপন করেন। আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, চন্দনপুরার হামিদিয়া তাজ মসজিদ, বটতলীর বায়তুল হামদ হাশেমী মসজিদ (চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানার অন্তর্গত), মীরসরাইয়ের শায়েস্তা খাঁ মসজিদ আজও বুজুর্গ উমেদ খাঁর কীর্তির জানান দেয়।
শুধু মসজিদ নির্মাণ বা ইসলামের বিকাশ সাধন করে থেমে ছিলেন না বুজুর্গ উমেদ খাঁ। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক। আর তাই বাদশাহ আওরঙ্গজেব তাকে নবাব উপাধি প্রদান করে চট্টগ্রামের শাসনভার প্রদান করেন। বুজুর্গ উমেদ খাঁ নিযুক্ত হলেন চট্টগ্রামের প্রথম মোগল ফৌজদার। ফৌজদার হয়েই তিনি সমগ্র চট্টগ্রামকে অনন্যভাবে গড়ে তোলেন। তৈরি করেন সুদক্ষ প্রশাসন, সিস্টেমেটিক রাজস্ব ব্যবস্থা এবং সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
- চট্টগ্রামের বিজয় করেই আরাম আয়েশ ভোগ করার জন্য বসে না থেকে তিনি মোগল বাহিনীসহ চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণে যাত্রা করেন মগদের পুরোপুরি চট্টগ্রাম ছাড়া করতে।
মগদের ক্রমশ চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত করতে করতে কক্সবাজারের রামু পর্যন্ত পৌঁছান বুজুর্গ উমেদ খাঁ। কিন্তু বর্ষাকাল এসে যাওয়ায় তিনি আর অগ্রসর হননি। আর চট্টগ্রাম থেকে রামু পর্যন্ত রসদ সরবরাহে কষ্ট হওয়ায় বুজুর্গ উমেদ খাঁ রামু হতে কিছুটা পিছিয়ে শঙ্খ (সাঙ্গু) নদীর পাড়ে অবস্থান গ্রহণ করেন।
মোগল বাহিনী সাঙ্গু নদীর তীরে এসে দুর্গ স্থাপন করেন এবং মোগলদের সীমানা সাঙ্গু নদ পর্যন্ত কার্যকর করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এরই লক্ষ্যে সাঙ্গু নদীর তীরে দুজন সেনানায়ক (আধু খাঁ এবং লক্ষ্মণ সিং)-কে এই স্থানে মোতায়েন করেন বুজুর্গ উমেদ খাঁ। এই দু-সেনানায়ক ছিলেন হাজার সৈন্যের নিয়ন্ত্রক। তাই তাদের নামানুসারে স্থানটির নাম হয় দুইহাজারী>দোহাজারী।
ফিরতি বছর চট্টগ্রাম আবার দখল করতে আরাকান থেকে হামলা চালায় মগরা। সাঙ্গু নদী ও আশেপাশের এরিয়ায় মোগলদের সাথে মগদের ৪ টা যুদ্ধ হয়। বুজুর্গ উমেদ খাঁ কর্তৃক নিয়োজিত মোগল সেনাপতি আধু খাঁর বীরত্বে মোগলরা সবগুলো যুদ্ধে জয়ী হয় এবং সাঙ্গু নদী পর্যন্ত মোগল সীমানা বিস্তৃত হয়। নিশ্চিত হয় চট্টগ্রামের প্রতিরক্ষা।
উল্লেখ্য আধু খাঁর বীরত্বে সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রাম মোগলদের করায়ত্ত হয়। দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার ‘আধু নগর’ ইউনিয়ন আজও আধু খাঁর অস্তিত্বের জানায় দেয় চট্টগ্রামবাসীকে। মগদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ের পর দক্ষিণ চট্টগ্রামের পাহাড়ের চূড়ায় স্মারক হিসেবে একটা লোহা গেঁথে রাখেন আধু খাঁ। লোহা গেঁথে রাখা থেকে স্থানটির নামকরণ হয় লোহাগাড়া।
আরাকানের মগদের সাথে মোগল বাহিনীর সাঙ্গু নদের পাড়ে সংঘটিত হওয়া যুদ্ধে অনেক মোগল সৈন্য শহীদ হন। তাদের মধ্যে ২২জনকে রাজকীয়ভাবে দাফন করা হয় চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের বাগিচাহাট (বাগ-ই-শাহ হলো আসল নাম) নামক এলাকায়। আজও সেই কবরস্থান তার অস্তিত্ব বজায় রেখে জানান দিচ্ছে, চট্টগ্রামের মাটি তাদের রক্তেই কেনা।
- চট্টগ্রাম নগর গঠনে মোগলদের ভূমিকা: মোগলরা শুধুমাত্র চট্টগ্রাম দখল করে এর সুবিধা নেওয়ার জন্য আসেনি। বরং মোগলরা চট্টগ্রামকে একটা পরিপূর্ণ নগর হিসেবে গড়ে তোলে। চট্টগ্রামজুড়ে স্থাপিত অনেক মোগল স্থাপনা কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও বেশকিছু এখনো টিকে আছে।
- আসকার দীঘি: চট্টগ্রামের দ্বিতীয় মোগল ফৌজদার আসকার খাঁ কর্তৃক নির্মিত এই সুবিশাল দীঘি নগরীর কাজির দেউড়ি ও জামালখান মোড়ের মাঝে আজও টিকে রয়েছে।
- ঘাট ফরহাদ বেগ: মোগল নবাব ফরহাদ খাঁ কর্তৃক নির্মিত ঘাট।
- আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, ওয়ালী বেগ খাঁ মসজিদ, হামজা খাঁ মসজিদ, কদম মোবারক মসজিদ, হামিদিয়া তাজ মসজিদ, শেখ বাহারুল্লাহ মসজিদসহ নগরজুড়ে থাকা বেশকিছু প্রাচীন মসজিদ মোগল আমলে মোগল স্থাপত্য রীতিতে তৈরি।
এই স্থাপনাগুলো ব্যাতীতও চট্টগ্রামের বেশিরভাগ অঞ্চলের নাম মোগল প্রভাবিত। যেমন-
(ক) আগ্রাবাদ: আগ্রা থেকে বুজুর্গ উমেদ খাঁর সাথে আগমনকারী মোগল ফৌজরা এই অঞ্চলে আবাদ গড়ে তোলায় নাম হয় আগ্রাবাদ।
(খ) চকবাজার: মোগলদের স্থাপিত বাজার।
(গ) আন্দরকিল্লা: বুজুর্গ উমেদ খাঁ চাটগিছা কিল্লার নামকরণ করেন আন্দরকিল্লা। পরবর্তীতে এইখানে অনেক স্থাপনা গড়ে তোলা হয়।
(ঘ) হাজারী লেইন ও হাটহাজারী: মোগল রাজত্বের বড় একটা পদ ছিল হাজারী। সেই হাজারী পদধারী আমলাদের মাধ্যমে গড়ে উঠে এলাকাদ্বয়।
(ঙ) ফৌজদারহাট, দেওয়ান হাট, দেওয়ান বাজার: মোগল আমলের প্রশাসক ফৌজদার এবং দেওয়ানদের নির্মিত হাট বাজার।
(চ) বাকলিয়া: আরবি বাকালুন অর্থ সবজিক্ষেত। সেখান থেকে নামকরণ।
(ছ) পতেঙ্গা: ফতেহ গাঁ থেকে পতেঙ্গা। আরবি ফতেহ অর্থ বিজয়।
(জ) নগরীর পাঁচলাইশ, হামজার বাগ, বকশীর হাট, নিজশহর (কাতালগঞ্জ), পোস্তগোলা, জামালখান, চাকতাই, বাগমনিরাম, সদরঘাট, কাপাসগোলা, মোগলটুলী, বিবিরহাট, পিলখানা, মির্জারপুল নামগুলো আজও মোগলদের ঐতিহ্যের সাক্ষী!
(৭) বুজুর্গ উমেদ খাঁর চট্টগ্রামের দুর্গ বিজয় এবং তার অধীনস্থ সেনাপতি আধু খাঁর সাঙ্গু নদের পাড় পর্যন্ত বিজয় বাংলার ইতিহাসের অন্যতম যুগান্তকারী ঘটনা। এই বিজয়ের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
সাঙ্গু নদ পর্যন্ত একচ্ছত্র মোগল আধিপত্য পরে ধীরে ধীরে নাফ নদী পর্যন্ত প্রসারিত হয় অর্থাৎ কক্সবাজার ও বাঙলার অন্তর্ভুক্ত হয়। এছাড়াও চট্টগ্রাম বিজয় এই অঞ্চলে বাঙলার আধিপত্যকে সুদৃঢ় করে তোলে। পার্শ্ববর্তী আরাকান এবং ত্রিপুরাদের তুলনায় বাঙালি জাতি যে শক্তি সামর্থ্যে এগিয়ে, চট্টগ্রাম বিজয় তারই নিদর্শন।
চট্টগ্রাম বাংলাদেশের হলো! আজও বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সামনেও থাকবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু একজন বুজুর্গ উমেদ খাঁ না থাকলে এই চট্টগ্রাম হয়তো আজ আরাকানের মতো (বাঙালি আর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হয়েও) হয়তো বাংলাদেশের অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতো না। নাফ তীরের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মতো হয়তো ফেনী নদীর পাড় চাটগাঁইয়া শরণার্থীর ক্রন্দনে কম্পিত হতো একবিংশ শতাব্দীতে এসে।
কিন্তু যেই বুজুর্গ উমেদ খাঁর জন্য চট্টগ্রাম স্থায়ীভাবে বাঙলার অংশ হলো, সেই উমেদ খাঁকে কি আমরা মনে রেখেছি? চট্টগ্রাম জুড়ে অসংখ্য স্থাপনা বিভিন্ন রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গের নামে। বিভিন্ন ব্যক্তির জন্ম, মৃত্যু দিবসও পালন হয় আড়ম্বরপূর্ণভাবে। অথচ বুজুর্গ উমেদ খাঁর নামে কোনো কিছু নাই এই চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বিজয়ের দিবসও পালিত হয় না এই নগরের কোথাও।
জাতি হিসেবে চট্টগ্রাম বিজয় আমাদের জন্য যতটা গৌরবের, চট্টগ্রাম বিজয়ের মহানায়ককে স্মরণে না রাখাটা ঠিক ততটা লজ্জার।
তথ্যসূত্র
- ড. মুহম্মদ আব্দুল করিম, বাংলাদেশের ইতিহাস. মগ বিতাড়ন ও চট্টগ্রাম জয়. পৃ ২৬৯-২৭০।
- Sarkar, Jadunath, [First published 1948]. The History of Bengal. Vol. II, p378-379.
- আহমেদ শরীফ সম্পাদিত আলাওল সিকান্দারনামা পৃ ৩২-৩৩।
- NA VOC 1236, fol. 127-134 Letter from Gerrit van Voorburg to Batavia, dated Arakan 21 January 1661.
- Arakan and Bengal : the rise and decline of the Mrauk U kingdom (Burma) from the fifteenth to the seventeeth century AD, Galen, S.E.A. van, p192-193.
- চৌধুরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি, চট্টগ্রামের ইতিহাস পৃ : ৬১।
- Leider, Le royaume d’Arakan, p. 311.
- Muhammad Kazim, ‘Ālamgīrnāma, pp. 953–56.
বিজ্ঞপ্তি
এত দ্বারা মাসিক আত-তাওহীদের সম্মানিত গ্রাহক, অ্যাজেন্ট ও শুভানুধ্যায়ীদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে,
- মাসিক আত-তাওহীদের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি’২৩ সংখ্যা থেকে ম্যাগাজিনের সাইজ ও কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে।
- অন্যদিকে দুঃখজনকভাবে কাগজ-কালি, প্রিন্টিংসহ প্রকাশনাসংশ্লিষ্ট সকল খাতে অস্বাভাবিকভাবে মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
অতএব উপর্যুক্ত পরিপ্রেক্ষিতে মাসিক আত-তাওহীদের মূল্য নিম্নোক্তভাবে নির্ধারিত হল:
- নির্ধারিত মূল্য: ২০ টাকা
- বার্ষিক গ্রাহক (রেজি. ডাক) চাঁদা: ৩০০ টাকা
- অ্যাজেন্ট (নূন্যতম ১০টি সংখ্যা): ১৫০ টাকা
নতুন মূল্য আগামী এপ্রিল ২০২৩ সংখ্যা থেকে কার্যকর হবে। ইতোমধ্যে যারা এক বছরের জন্য টাকা পরিশোধ করে গ্রাহক হয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে এটি প্রজোয্য হবে না। তবে নবায়ন ও নতুন গ্রাহকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।