জামেয়া ওয়েবসাইট

সোমবার-৯ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-১৪ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভাষা আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিসের ভূমিকা

এদিকে দেখা যাচ্ছে এক শ্রেণির লেখক তমদ্দুন মজলিসের অবদানকে খাটো করে দেখতে চান। অথচ ইতিহাস কি বলে দেখুন। ড. সিদ্দিকী লিখেন, কংগ্রেস কর্মীরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবে আঁৎকে ওঠে। আর কমিউনিস্ট পার্টি ও বামপন্থী ছাত্র ফেডারেশন জানিয়ে দেয়, এই আন্দোলন সমর্থন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড ড. মোজাফফর আহমদ ভষার দাবি সম্বলিত স্মারকলিপিতে সই করতেও অস্বীকৃতি জানান

এদিকে বহুদিন পরও কোনো কোনো লেখক আবুল কাসেমকে ভাষা আন্দোলনের জনক বলতে নারাজ। অথচ কে না জানে, তার বাসা ১৯ নম্বর আজিমপুর ও বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রশীদ বিল্ডিংয়ে তমদ্দুন মজলিসের অফিস ছিল ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্র। আর আবুল কাসেম শুধু ভাষা আন্দোলনের জনকই ছিলেন না। তিনি বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করে হাতেকলমে দেখালেন যে, বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষা সম্ভবপর। বাংলা কলেজ আবুজার গিফারি কলেজ, ইসলামি একাডেমি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান হাতছাড়া করে তমদ্দুন মজলিস এখন দুর্বলতর। তাদের হাতে বাংলা কলেজটা রাখলে আজ এটাকে বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় করা যেত। আবুল কাসেমের নামে হল হতো।

ভাষা আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিসের ভূমিকা

    . মুহাম্ম সিদ্দিক

      লেখক: ইতিহাসবিদ গবেষক

ভাষা আন্দোলনে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বহু সংগঠন ও ব্যক্তির অবদান থাকলেও তমদ্দুন মজলিস ও তার প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের তরুণ শিক্ষক আবুল কাসেমের অবদান ছিল অনন্য। তমদ্দুন মজলিস ভাষার দাবিকে আন্দোলনে রূপান্তর করেছিল এই সংগঠনের মাধ্যমে। তবে এটাও ঠিক যে অনেক শ্রদ্ধেয় চিন্তাবিদ এ ব্যাপারে পূর্ব থেকে ব্যক্তিগতভাবে মুখ খুলেছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই ১৯৪৩ সালে বিশিষ্ট লেখক আবুল মনসুর আহমদ ‘বাংলাকেই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষারূপে গ্রহণ’ করার প্রস্তাব রাখেন।[1] বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মরহুম অধ্যাপক আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছেন ‘১৯৪৭ মানেই ‘সওগাত’ পত্রিকায় তিনি (কবি ফররুখ আহমদ) লিখেছিলেন…। একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বাংলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে।’[2]

লুৎফর রহমান জুলফিকার কবির পরবর্তী ভাষা কার্যক্রম নিয়ে লেখেন, ১৯৪৮ সালের পরিস্থিতিতে, ‘বিরোধী কবি সাহিত্যিক সাংবাদিকদের প্রথম কাতারের অন্যতম সৈনিক ছিলেন তরুণ নির্ভীক কবি ফররুখ আহমদ।’[3] ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে কমরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ থেকে বের হয়ে গণআজাদী লীগ এক ঘোষণায় বলল, ‘বাংলা হইবে পূর্ব পাকিস্তানিদের রাষ্ট্রভাষা।’ ১৯৪৭ সালের ৬-৭ সেপ্টেম্বরে নবগঠিত গণতান্ত্রিক যুবলীগ এক প্রস্তাবে বলে, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্বপাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক।’ ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর আবুল কাসেম ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করলেন তমদ্দুন মজলিস। ১৫ সেপ্টেম্বর তিনিই প্রকাশ করলেন ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম বই ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?’ এতে ছিল কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ ও আবুল কাসেমের মোট তিনটি প্রবন্ধ।

আবুল কাসেম ও তার সহযোগীরা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্বাক্ষর নিয়ে সরকারের নিকট স্মারকলিপি পাঠালেন। ১৯৪৭ সালে ১২ নভেম্বর তমদ্দুন মজলিস ফজলুল হক হলে সভা করল, সেখানে জনাব নুরুল আমিন বললেন, পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলাকে ঘোষণা করার কোনো প্রতিবন্ধক নাই বলে তিনি মনে করেন।[4] ১৪ নভেম্বর ১৯৪৭ তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাসেম তার দেয়া স্মারকলিপি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে আলোচনা করে আশ্বাস লাভ করেন।

৫ ডিসেম্বর ১৯৪৭ আবুল কাসেম, আবু জাফর, শামসুদ্দীনসহ প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি মাওলানা আকরম খাঁর সঙ্গে ভাষা নিয়ে আলোচনা করেন। আবুল কাসেম এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, মাওলানা আকরম খাঁ তাদের আশ্বাস দেন, পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাকে চাপানোর চেষ্টা করলে পূর্বপাকিস্তান বিদ্রোহ ঘোষণা করবে এবং তিনি নিজে সেই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেবেন।

৬ ডিসেম্বর ১৯৪৭ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি ছাত্রসভা হয়। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত গবেষক ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী লিখেন, ছাত্রদের এক বিরাট সভা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এই হলো সর্বপ্রথম সাধারণ ছাত্রসভা।[5]

১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষদিকে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে গঠিত হলো প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। গাজীউল হক এ নিয়ে লেখেন, ১৯৪৭ সালে ডিসেম্বরের শেষদিকে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে রশীদ বিল্ডিং নামে যে বিল্ডিং ছিল সেখানে একটি কক্ষে (তমদ্দুন মজলিসের অফিসে) একটি সভা হয়। প্রতিনিধি স্থানীয় ছাত্র, প্রফেসর ও বুদ্ধিজীবীরা এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। সেখানে মুসলিম ছাত্রলীগের কিছু নেতৃস্থানীয় ছাত্র, গণতান্ত্রিক যুবলীগের কর্মী এবং তমদ্দুন মজলিসের কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। সেই সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এটিই সর্বপ্রথম সংগ্রাম পরিষদ… পরিষদের আহ্বায়ক নিযুক্ত হন অধ্যাপক নুরুল হক ভুঁইয়া। তিনি তমদ্দুন মজলিসের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন।[6] সিদ্দিকী বলেন, এই কমিটিতে অধ্যাপক আবুল কাসেম প্রমুখ ছিলেন। তিনি আরও লেখেন, সংগ্রাম পরিষদের কাজকর্ম প্রায় সব গোপনেই হতো প্রথমদিকে।

সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সময় শামসুল হকের নেতৃত্বে পরিচালিত মুসলিম ছাত্রলীগের অল্প কয়েকজন কর্মী উপস্থিত ছিল।[7] ড. সিদ্দিকী লেখেন, ‘এ সময় ছাত্রলীগের মধ্যে দুটি উপদলের সৃষ্ট হয়। শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্ব অস্বীকার করে শামসুল হক, আজিজ আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫), নঈমুদ্দীন আহমদ প্রমুখ বেরিয়ে এসে পূর্বপাকিস্তান, মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন। এই উপদল ভাষা আন্দোলনের প্রতি তাদের সমর্থন জানায়।[8]

এদিকে ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ আবুল কাসেম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কয়েকজন সদস্যসহ কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান খানের সঙ্গে তার ঢাকার বাসায় দেখা করে ভাষার ব্যাপারে জোর তাগিদ দেন। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে রাষ্ট্রভাষা সাব কমিটি এবং পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল মন্ত্রী হাবীবুল্লাহ বাহার, নুরুল আমিন ও গিয়াস উদ্দীন পাঠানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক নুরুল হক ভুঁইয়া (তমদ্দুন মজলিসের নেতা) ও অন্যরা এক আবেদনপত্র প্রচার করলেন যাতে উল্লেখ করা হলো যে, মাওলানা আকরম খাঁ বলেছেন, বাংলা ভাষাবিরোধী অবস্থান নেয়া হলে ‘পূর্ব পাকিস্তান বিদ্রোহ করিবে।’

২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ভাষা সংক্রান্ত সংশোধনী প্রস্তাব নাকচ হলে ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ সভা হলো। সভাপতি ছিলেন আবুল কাসেম। ২৮ ফেব্রুয়ারি তমদ্দুন মজলিস ও পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের যুগ্ম রাষ্ট্রভাষা সাব কমিটির সিদ্ধান্ত ১১ মার্চ ১৯৪৮ সমগ্র পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হলো। দাবি বাংলাকে অবিলম্বে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্বপাকিস্তানের সরকারি ভাষা বলে ঘোষণা করা হোক।

বঙ্গবন্ধু লেখেন, ‘পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিসের (১৯৪৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের বাংলা ভাষা প্রস্তাব নাকচ) প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করল।[9]

২ মার্চ ১৯৪৮ দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হলো যাতে ছিল তমদ্দুন মজলিস, পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, গণআজাদী লীগ, পূর্বপাকিস্তান মুসলিম লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ। আহ্বায়ক হলেন শামসুল আলম। যিনি তমদ্দুন মজলিসের নেতা। ১১ মার্চ ৪৮ ধর্মঘটে আমি বগুড়ার কাগইল হাইস্কুলের ছাত্র হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক নিয়ে বিরাট মিছিল করে মহাস্থান হয়ে আমরা আর মাত্র আট কিলোমিটার দূরে গোকুল হাইস্কুল পর্যন্ত যাই এবং সেখানে দুই হাইস্কুলের যৌথসভা করি।

১৫ মার্চ প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে বসে আট দফা চুক্তি সই করলেন, যাতে প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করলেন যে, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার বিষয় গণপরিষদের তোলা হবে। এই বৈঠক হয় বর্ধমান হাউজে যেখানে আবুল কাসেম, কামরুদ্দীন আহমদ প্রমুখ ছিলেন। বিকালে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রাঙ্গণে জনসমাবেশে আবুল কাসেম ও কামরুদ্দীন চুক্তির কথা ঘোষণা করলেন। এভাবে ভাষার আন্দোলনের প্রাথমিক স্তরে সাফল্য আসে।

তবে এটি বাস্তবায়নে ১৯৫২ সালে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা হয়। পৃথিবীর অনেক চুক্তিই বাস্তবায়নে ঢিলেমিতে পড়ে। ইন্ডিয়ার সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন করতে কত বছর গেল। কাশ্মির, ফিলিস্তিন নিয়ে সিদ্ধান্তগুলো আজো বাস্তবায়ন হয়নি। বহু আগের আসা তিন লাখ রোহিঙ্গা এখনও বাংলাদেশে। পূর্ববর্তী চুক্তির বাস্তবায়ন নেই।

পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ২১ মার্চ ১৯৪৮ উর্দুর পক্ষে বললেন। এর প্রতিবাদে ২২ মার্চ আবুল কাসেম ও শাহেদ আলী বিবৃতি দেন।[10]

২৪ মার্চ ১৯৪৮ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল গভর্নর জেনারেলের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এতে ছিলেন আবুল কাসেম, কামরুদ্দীন আহমদ প্রমুখ। ফলাফল অবশ্য হয় শূন্য। তবে মজার ব্যাপার এই, যে স্মারকলিপিটি দেয়া হয় তাতে বলা হয়, ‘বাংলা ভাষার শব্দ সম্পদের মধ্যে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ পারসিক ও আরবি ভাষা হইতে গৃহীত।’[11]

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু লেখেন, ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো আমরা মুসলমান, আরেকটা হলো আমরা বাঙালি।’[12] তিনি সঠিক কথাই লিখেছেন। এজন্যই তো কুরআন-হাদীস পড়ুয়া মুসলমানদের ভাষায় প্রচুর আরবি ফারসি শব্দ এসেছে। বাঙালির এ ভাষা বৈশিষ্ট্য অস্বীকার করা হবে বাস্তবতার অস্বীকার।

এদিকে করাচি ফিরে যাওয়ার সময় গভর্নর জেনারেল বেতার ভাষণে বললেন, ‘এই প্রদেশের সরকারি ভাষা কী হওয়া উচিত, সেটা আপনাদের প্রতিনিধিরাই স্থির করবেন।’ ৮ এপ্রিল ১৯৪৮ পূর্বপাকিস্তানের অ্যাসেম্বলিতে সর্বসম্মতিতে প্রস্তাব গৃহীত হলো। পূর্ববাংলা এ দেশে ইংরেজির স্থলে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হইবে। ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ১১ মার্চ প্রতি বছর ভাষা আন্দোলনের স্মারক হিসেবে পালন করা হতে থাকে। প্রবন্ধটি সংক্ষিপ্ত করতে অনেক তথ্যই ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাদ দিতে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যা তমদ্দুন মজলিসের অবদানকে স্বীকার করে নিয়েছেন। সরকারের স্কুল পাঠ্যবইগুলোতে তমদ্দুন মজলিসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১লা ফেব্রুয়ারি ২০১৭ বাংলা একাডেমির বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে মুসলিম ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস এবং আরও কয়েকটি ছাত্র সংগঠন মিলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।[13] প্রধানমন্ত্রী গত কয়েক বছরের ভাষা দিবসের বাণীতে তমদ্দুন মজলিসের অবদানের কথা বারবার বলেছেন।

এদিকে দেখা যাচ্ছে এক শ্রেণির লেখক তমদ্দুন মজলিসের অবদানকে খাটো করে দেখতে চান। অথচ ইতিহাস কি বলে দেখুন। ড. সিদ্দিকী লেখেন, কংগ্রেস কর্মীরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবে আঁৎকে ওঠে। আর কমিউনিস্ট পার্টি ও বামপন্থী ছাত্র ফেডারেশন জানিয়ে দেয়, এই আন্দোলন সমর্থন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড ড. মোজাফফর আহমদ ভষার দাবি সংবলিত স্মারকলিপিতে সই করতেও অস্বীকৃতি জানান।[14]

এদিকে বহুদিন পরও কোনো কোনো লেখক আবুল কাসেমকে ভাষা আন্দোলনের জনক বলতে নারাজ। অথচ কে না জানে, তার বাসা ১৯ নম্বর আজিমপুর ও বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রশীদ বিল্ডিংয়ে তমদ্দুন মজলিসের অফিস ছিল ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্র। আর আবুল কাসেম শুধু ভাষা আন্দোলনের জনকই ছিলেন না। তিনি বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করে হাতেকলমে দেখালেন যে, বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষা সম্ভবপর। বাংলা কলেজ আবুজার গিফারি কলেজ, ইসলামি একাডেমি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান হাতছাড়া করে তমদ্দুন মজলিস এখন দুর্বলতর। তাদের হাতে বাংলা কলেজটা রাখলে আজ এটাকে বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় করা যেত। আবুল কাসেমের নামে হল হতো।

ভাষাসৈনিকদের তালিকা বানাতেও এদিক ওদিক করা হচ্ছে। প্রাথমিক সরকারি তালিকায় আবুল কাসেমের নাম সর্বনিম্নে। অধ্যাপক শাহেদ আলীর নামের নীচে তার বেগম চেমন আরার নাম। আর এমন কয়েকজনের নাম খুব উপরে ঠেলে দেয়া হয়েছে, যারা ভাষা আন্দোলনের কোনো কমিটিতেই ছিলেন না। এটা তো ইতিহাস বিকৃতি।[15] এ রকম তালিকা বানালে তো জনকও হয়ে পড়বেন পুত্র। তালিকা প্রণয়ের কমিটিতে জীবিত প্রবীণতম ভাষাসৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুরকে রাখলে ভালো তালিকা হতে পারত।

প্রতিষ্ঠিত ভাষাগবেষক এমএ বার্ণিক ৭৮৩ পৃষ্ঠার জাতীয় পুনর্জাগরণে তমদ্দুন মজলিস নামক বিশাল গবেষণা গ্রন্থের মুখবন্ধে লিখেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি তৈরি হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ক্রিয়া ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তমদ্দুন মজলিস উক্ত আন্দোলনের সূচনা করে। সুতরাং জাতীয় ইতিহাস তমদ্দুন মজলিসের একটি গৌরবজ্জল অবস্থান রয়েছে।… বাংলা একাডেমি, ইসলামিক একাডেমি, বাংলা কলেজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ার পেছনে তমদ্দুন মজলিসের সাংগঠনিক কার্যক্রম লক্ষণীয়।’ বার্ণিক নিরপেক্ষভাবে সঠিক কথাটিই লিখেছেন। ইতিহাসকে চেপে রাখা যায় না। তমদ্দুন মজলিস এখনো বেঁচে আছে। তারা দেশ, জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা ইত্যাদি নিয়ে তাদের সাধ্যমতো কাজ করে চলেছে। তারা বাংলাদেশকে সমৃদ্ধশালী দেখতে চায়।

[1] মাসিক মোহাম্মদী, কার্ত্তিক ১৩৫০

[2] বিবর্তন, ফররুখ স্মরণ সংখ্যা, ১৯৮৫

[3] ফররুখ একাডেমি পত্রিকা, অক্টোবর ২০১০ ও জুন ২০১১, পৃ. ১৮

[4] আজাদ, ১৫ নভেম্বর ১৯৪৭

[5] পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সাংস্কৃতি আন্দোলন, পৃ. ২৯১

[6] ড. সিদ্দিকী, পৃ. ২৯৩-২৯৪

[7] সিদ্দিকী, পৃ. ৫৪, আবুল কাসেম, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, পৃ. ৪২

[8] পৃ. ৫২-৫৩, আবুল কাসেম, পৃ. ১৭

[9] অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ৯১-৯২

[10] দৈনিক আজাদ, ২৪ মার্চ ১৯৪৮

[11] যুগান্তর, ২ এপ্রিল ১৯৪৮

[12] অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ৪৭

[13] নয়াদিগন্ত, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

[14] পৃ. ৫২, আবুল কাসেমের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, পৃ. ১৭-এর ওপর ভিত্তি করে মন্তব্য

[15] প্রথম আলো, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১২

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ