জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-২৪শে রজব, ১৪৪৬ হিজরি-২৬শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১২ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাহাবায়ে কেরামের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও নেপথ্য কথা-আল্লামা মুফতি আবদুল হালীম বোখারী (রহ.)

সাহাবায়ে কেরামের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও নেপথ্য কথা

আল্লামা মুফতি আবদুল হালীম বোখারী (রহ.)

[সাহাবায়ে কেরাম দীনের ধারক-বাহক। তাঁরা সরাসরি রসুল (সা.)-কে দেখেছেন এবং তাঁর কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করেছেন। তাঁরা কোন প্রকার মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি ইসলামের বার্তা রসুল (সা.)-এর কাছ থেকে শোনার মহান সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। অতঃপর পূর্ণ আমানতদারির সাথে উক্ত হাদীস ও ইসলামি জ্ঞান-ভাণ্ডার সংরক্ষণ করত মুসলিম উম্মাহর উদ্দেশ্যে বর্ণনা করেছেন। রসুল (সা.)-এর একটি হাদীসও এমন পাওয়া যাবে না, যা সাহাবায়ে কেরাম ছাড়া অন্য কারো সূত্রে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। রসুল (সা.) থেকে সাব্যস্ত প্রত্যেকটি হাদীসের সূত্রে কোন না কোন বিশিষ্ট সাহাবী অবশ্যই রয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) সবাই ন্যায়পরায়ণ। মহান আল্লাহ এবং তাঁর রসুল (সা.) পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে এবং অসংখ্য হাদীসে তাঁদেরকে ন্যায়পরায়ণ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

তাই সাহাবায়ে কেরামের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও তাঁদেরকে নিঃস্বার্থে ভালোবাসা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জরুরি। কোন অবস্থাতেই তাঁদের নিন্দা কিংবা সমালোচনা করা যাবে না। তাঁদের নিন্দা করাই হল দীনকে নিন্দা করা। কারণ আলেমগণ বলছেন, ‘কোন কিছুর বর্ণনাকারীকে নিন্দা করার অর্থই হচ্ছে বর্ণিত বিষয়কে নিন্দা করা।’ অতএব যাঁরা আমাদের নিকট দীন পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁরা যদি হন নিন্দিত, ন্যায়পরায়ণতার ক্ষেত্রে সমালোচিত, বিশ্বস্ততা ও আমানতদারির ক্ষেত্রে কলঙ্কিত, তাহলে সেই দীনও হবে নিন্দিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ। সেজন্য ইমাম আবু যুরআ আর-রাযী (রহ.) বলেন,

«إِذَا رَأَيْتَ الرَّجُلَ يَنْتَقِصُ أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ فَاعْلَمْ أَنَّهُ زِنْدِيْقٌ، وَذَلِكَ أَنَّ الرَّسُوْلَ ﷺ عِنْدَنَا حَقٌّ، وَالْقُرْآنَ حَقٌّ، وَإِنَّمَا أَدَّىٰ إِلَيْنَا هَذَا الْقُرْآنَ وَالسُّنَنَ أَصْحَابُ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ، وَإِنَّمَا يُرِيْدُوْنَ أَنْ يُجَرِّحُوْا شُهُوْدَنَا لِيُبْطِلُوا الْكِتَابَ وَالسُّنَّةَ، وَالْـجَرْحُ بِهِمْ أَوْلَىٰ وَهُمْ زَنَادِقَةٌ».

অর্থাৎ ‘তোমরা কাউকে সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদাহানি করতে দেখলে বুঝবে যে, সে যিনদীক। কেননা রসুল (সা.) আমাদের নিকট হক, কুরআন আমাদের নিকট হক। আর এই কুরআন এবং হাদীস আমাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন সাহাবায়ে কেরাম। মূলত শত্রুরা কুরআন ও হাদীসকে বাতিল করার হীন উদ্দেশ্যেই আমাদের সাক্ষীসমূহ তথা সাহাবায়ে কেরামকে আঘাত করতে চায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বস্তুত তারাই নিন্দার উপযুক্ত এবং তারাই হচ্ছে যিনদীক।’[1]

সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.)-এর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ দীনের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যেরই একটি অংশ। কেননা তাঁরাই এই দীনের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছেন। সুতরাং তাঁদেরকে নিন্দা করা হলে দীনও নিন্দিত হবে। অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়, একদল লোক পথভ্রষ্টতার অতল গভীরে নিমজ্জিত হয়ে হাতেগোণা কয়েকজন সাহাবী ব্যতীত সকল সাহাবীকে নিন্দা করে থাকে। বিশেষত সাহাবায়ে কেরামের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও পারস্পরিক সংগঠিত যুদ্ধ-বিগ্রহকে নিয়ে সমালোচনা করে। অথচ তারা এই অন্তর্দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ-বিগ্রহের মূল নেপথ্য কারণ চিহ্নিত করতে অক্ষম। এর নেপথ্য কারণ ও ষড়যন্ত্রের মূলোৎপাটন করা সময়ের দাবি ছিল। এ সম্পর্কে আমাদের প্রিয় উস্তাদ আল্লামা মুফতী আবদুল হালীম বোখারী (রহ.) সহীহ বোখারী শরীফের দরসে একটি গঠনমূলক আলোচনা করেছেন। ঘটনাক্রমে এটিই ছিল হযরতের জীবনের আখেরি দরস। আল্লাহ তাআলা হযরতকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন, আমীন।

দরসটির শ্রুতিলিপি করেছেন মাওলানা সোহাইল কাসেমী (হাফি.)। প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন এবং পরিমার্জনসহ মাসিক আত-তাওহীদ পাঠকের সমীপে পেশ করা হলো।—সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী]

نحمده ونصلي علىٰ رسوله الكريم، أما بعد! باب: قال الله تعالىٰ: [وَاِنْ طَآىِٕفَتٰنِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ اقْتَتَلُوْا فَاَصْلِحُوْا بَيْنَهُمَاۚ ۰۰۹] {الحجرات: 9}، وقال رسول الله ﷺ: «إِذَا الْتَقَى الْـمُسْلِمَانِ بِسَيْفَيْهِمَا، فَالْقَاتِلُ وَالْـمَقْتُوْلُ فِي النَّارِ»، رواه البخاري .

ক্ষমতার মোহে ইবনে সাবার ইসলাম গ্রহণ

রসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর খলীফাদের জামানা আরম্ভ হয়। ইসলামের প্রথম খলীফা হলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাযি.), দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ফারুক (রাযি.), তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান গনী যিন্নুরাইন (রাযি.), তাঁকে ‘উসমানে গনী’ বলা হয়। গনী মানে সম্পদশালী। খলীফা হওয়ার পূর্ব থেকেই তিনি ছিলেন আরবের স্বনামধন্য শিল্পপতি। তিনি অভিজাত বংশের লোক ছিলেন। ইসলামের তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান গনী (রাযি.) দীর্ঘ দিন পর্যন্ত খলীফা হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। তিনি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর দুই মেয়েকে শাদি করেছেন; তাই তাঁকে ‘যিন্নুরাইন’ তথা দুই নুরের অধিকারী বলা হয়।

হযরত উসমান (রাযি.)-এর খিলাফতকালে মদীনা শরীফে এক মুনাফিক এসে ইসলাম গ্রহণ করল। তার নাম ‘আবদুল্লাহ ইবনে সাবা’। সে প্রকৃত ইসলাম নয়, রবং ইসলাম গ্রহণ করার ভান করল। তার উদ্দেশ্য ছিল, হযরত উসমান (রাযি.)-এর মন্ত্রী পরিষদে অন্তর্ভুক্ত হওয়া। কারণ সে শিক্ষিত ছিল।

সে মনে করেছিল, সে যদি ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে হযরত উসমান (রাযি.) তাকে মন্ত্রী বানাবেন, অথবা কোন দেশের গভর্নর বানাবেন। কিন্তু উসমান তো উসমান (রাযি.), তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর খোদাপ্রদত্ত বিচক্ষণতার মাধ্যমে আবদুল্লাহ ইবনে সাবার কপটতা ধরতে সক্ষম হলেন। হাদীস শরীফে আছে,

«اتَّقُوْا فِرَاسَةَ الْـمُؤْمِنِ فَإِنَّهُ يَنْظُرُ بِنُوْرِ اللهِ».

‘যার কাছে খাঁটি ঈমানদার আছে, তাঁকে কেউ ধোঁকা দিতে পারে না; তারা আল্লাহপ্রদত্ত নুর দিয়ে সবকিছু দেখেন ও উপলব্ধি করেন।’[2]

লক্ষ করুন, সে প্রকৃত মুসলমান নয়, তার অন্তরে কুফর ও জবানে ইসলাম; এটা হযরত উসমান (রাযি.) ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। যার কারণে তাকে গভর্নরও বানাননি, মন্ত্রীও বানাননি। এমনকি কোন দায়িত্ব দিয়ে অফিসারও বানাননি। এতে সে বেশ ক্ষুব্ধ হয়। সে হযরত উসমান (রাযি.)-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আরম্ভ করল।

মুসলমানদেরকে তাঁর বিরুদ্ধে এই বলে ক্ষেপাল যে, উসমান খলীফা হয়ে তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদেরকে বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত করেছে। অথচ ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাযি.)-এর ছেলে আছে, দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাযি.)-এর ছেলে আছে; এদের কাউকে কোন পদে অধিষ্ঠিত করেছেন? এভাবে সে ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করল।

তার সাথে আরও কিছু মুনাফিক একত্রিত হলো। মুনাফিকদের এই প্রতারণার শিকার হয় কিছু নিরীহ মুসলমান। মুনাফিকরা হযরত ওসমান (রাযি.)-কে কতল করার জন্য ঘেরাও করল। সেখানে কিছু অবুঝ মুসলমানও যোগ দিলো। হযরত উসমান (রাযি.)-এর কাছে সরকারি বাহিনী ছিল। তিনি ইচ্ছে করলে সরকারি বাহিনী দ্বারা ষড়যন্ত্রকারীদেরকে বিদ্রোহী (বাগী) হিসেবে হত্যা করতে পারতেন। তাঁর নিজস্ব অনেক চাকর-বাকর ও দাস-দাসী ছিল। তাদেরকেও কোন অর্ডার দেননি। কারণ তাঁর খিলাফতকালে খুনাখুনি হোক, এটা তিনি পছন্দ করেননি।

স্বপ্নযোগে হযরত উসমান (রাযি.)-কে রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সান্ত্বনা

হযরত উসমান (রাযি.) মুনাফিকদের ঘেরাও অবস্থায়ও নফল রোজা রেখেছেন। সেখানে বসে কুরআন তিলাওয়াত করেছেন। রোজা অবস্থায় কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করার সময় আসরের পর একটু তন্দ্রা আসলো। সেই সময় স্বপ্ন দেখলেন যে, রসুলুল্লাহ (সা.), হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাযি.), হযরত ওমর (রাযি.)-সহ কিছু সাহাবায়ে কেরাম দাঁড়িয়ে আছেন। হুযুর বলছেন, তুমি কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের নিকট চলে আসবে। তোমাকে স্বাগতম জানানোর জন্য আমরা দাঁড়িয়ে আছি। তোমার ইফতার আমাদের সাথে হবে, সুবাহানাল্লাহ।

ঠিক সে সময় কুরআন তিলাওয়াত অবস্থায় হযরত উসমান (রাযি.)-কে শহীদ করা হলো। হযরত উসমান (রাযি.)-এর রক্তের প্রথম ফোটা তাঁর তিলাওয়াতকৃত কুরআন শরীফের ওপর পড়লো। তাঁর তিলাওয়াতকৃত আয়াতটি ছিল, فَسَيَكْفِيْكَهُمُ اللّٰهُ١ۚ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُؕ۰۰۱۳۷।[3]

হযরত আলী (রাযি.) বাইরে ছিলেন। তিনিও রসুলের জামাতা ছিলেন। হযরত আলী (রাযি.), তাঁর দুই সন্তান হযরত হাসান (রাযি.) ও হযরত হুসাইন (রাযি.)-কে নিয়ে পাহারা দিচ্ছেন। হযরত উসমান (রাযি.)-এর ওপর যেকোনো ধরনের হামলা থেকে মানুষকে বিরত রাখার জন্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু মুনাফিকের দল ভারি ছিল। হযরত আলী (রাযি.)-এর কথা শুনেনি। শেষ পর্যন্ত মুনাফিকরা হযরত উসমান (রাযি.)-এর ওপর হামলা করল। একপর্যায়ে তারা তাঁকে শহীদ করল।

সিরিয়ার গভর্নর হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর পক্ষ থেকে উসমান (রাযি.) হত্যার বিচারের জোর দাবি

তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন দেশে হযরত উসমান (রাযি.)-এর পক্ষ থেকে গভর্নর নিয়োজিত ছিলেন। সিরিয়ার গভর্নর হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন হযরত মুআবিয়া (রাযি.)। মদীনায় যারা হযরত উসমান (রাযি.)-কে শহীদ করল, তাদের দল ছিল খুবই শক্তিশালী। ফলে তৎক্ষণাৎ বিচারকাজ সম্পাদন করা সম্ভব হলো না। অপরদিকে বিচারকাজ সম্পাদন করতে সাক্ষী ও শপথের প্রয়োজন। যেহেতু হত্যাকারীদের দল শক্তিশালী ছিল, তাই সেই মুহূর্তে বিচারকাজ সম্পাদন করার পরিবেশ ছিল না। কিন্তু খিলাফতের আসন তো শূন্য থেকে যেতে পারে না! দেশ তো পরিচালনা করতে হবে।

বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরাম বসে হযরত আলী (রাযি.)-কে খলীফা নিযুক্ত করলেন। বিভিন্ন দেশের গভর্নররা এসে হযরত আলী (রাযি.)-এর কাছে বায়আত গ্রহণ করলেন। তাঁরা বললেন, আপনি আমাদের খলীফা, আপনার অধীনে আমরা দেশ পরিচালনা করব। কিন্তু হযরত মুআবিয়া (রাযি.) হযরত উসমান (রাযি.)-এর হত্যাকারীদের ওপর খুব বেশি ক্ষুব্ধ ছিলেন। কারণ তারা হযরত উসমান (রাযি.)-কে শহীদ করার পর তাঁর রক্তমাখা জামাটি হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর নিকট পাঠিয়েছিল। তাতে তিনি আরও বেশি দুঃখিত হলেন। তাই তিনি বললেন, যতক্ষণ হযরত উসমান (রাযি.)-এর হত্যার বিচার না হয়, ততক্ষণ হযরত আলী (রাযি.)-কে আমি খলীফা হিসেবে মেনে নিতে পারি না। কিন্তু মদীনা শরীফের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল না।

হত্যাকারীদের বিচার করার মতো পরিস্থিতি আছে কিনা, সেটা হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর জানা ছিল না। এদিকে হযরত আলী (রাযি.) বারবার হুকুম দিচ্ছেন। মুআবিয়া! তুমি আমার খিলাফত মেনে নিয়ে আমার কাছে বায়আত গ্রহণ করো। হযরত মুআবিয়া (রাযি.) সংবাদ পাঠাচ্ছেন যে, হযরত উসমান (রাযি.)-এর হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমি আপনাকে খলীফা হিসেবে মেনে নিতে পারি না।

ঐতিহাসিক সিফফীন যুদ্ধ

শুধু তাই নয়, হযরত মুআবিয়া (রাযি.) সিরিয়ায় অবস্থানরত সাহাবা-তাবেয়ীনকে নিয়ে দলবদ্ধ হয়ে মদীনার দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। সিফফীন নামক স্থানে তারা একত্রিত হলেন। এদিকে হযরত আলী (রাযি.) সমর্থকরা দলবদ্ধ হয়ে সিফফীনে গিয়ে তাদেরকে বাধা দেন। যেন তারা মদীনায় আসতে না পারে। উভয়পক্ষ হাতিয়ার নিয়ে প্রস্তুত। একপর্যায়ে সেখানে উভয় দলের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এজন্য এটাকে সিফফীনের যুদ্ধ বলা হয়। অনেক সাহাবী-তাবেয়ীন মারা যান। ওই দলের হাতেও তরবারি, এই দলের হাতেও তরবারি। এখন হাদীস বলছে,

«إِذَا الْتَقَى الْـمُسْلِمَانِ بِسَيْفَيْهِمَا، فَالْقَاتِلُ وَالْـمَقْتُوْلُ فِي النَّارِ».

এখন তো উভয়পক্ষে মানুষ মারা গেছে। উভয়পক্ষে হত্যাকারীও আছে, উভয়পক্ষে নিহতও আছে। তারা আবার সাহাবীও। তারা তো জাহান্নামে যাবে, এই হাদীস মতে.

«فَالْقَاتِلُ وَالْـمَقْتُوْلُ فِي النَّارِ».

এ সম্পর্কে অনেক লেখালেখি হয়েছে। স্বতন্ত্র একটি কিতাব আছে, সাইয়েদুনা মুআবিয়া (রাযি.)। কিতাবটি সকলের অধ্যয়ন করা জরুরি।

শিয়া সম্প্রদায়ের আবির্ভাব

ওই দিকে এই সুযোগে কিছু মানুষ বলে উঠলো, نحن من شيعة علي (আমরা আলীর পক্ষের লোক)। এভাবে শিয়া ফেরকার সৃষ্টি হলো। এটি আরেক বড় মসিবত! এই শিয়া সম্প্রাদায়ের হাতেই হযরত আলী (রাযি.)-এর সন্তান হযরত হুসাইন (রাযি.) শহীদ হয়েছেন। বড় অদ্ভুত ব্যাপার! এ বিষয়ে ওলামায়ে কেরাম ডজন-ডজন কিতাব লিখেছেন। যেহেতু উভয়পক্ষ সাহাবী, তাই সাবধানে কথা বলতে হয়। কেননা রসুলে করীম (সা.) বলেছেন,

«أَصْحَابِيْ كَالنُّجُوْمِ فَبِأَيِّهِمُ اقْتَدَيْتُمْ اهْتَدَيْتُمْ».

‘আমার সাহাবীরা আকাশের নক্ষত্রের মতো। আকাশের নক্ষত্র কেন বলেছেন।’[4] কুরআন শরীফে আছে,

وَبِالنَّجْمِ هُمْ يَهْتَدُوْنَ۰۰۱۶[5]

মানুষ যখন রাতের বেলা সমুদ্রে স্টিমার চালায়, দিঙ্-নির্ণয় করা মুশকিল হয়ে পড়ে। কেউ আমেরিকা যেতে চায়, কেউ লন্ডনে যেতে চায়। কেউ বাংলাদেশে আসতে চায়, কেউ ইন্ডিয়া যেতে চায়। তখন আকাশের একটা তারকা ঠিক করে নেয়। এই তারকা ফলো করলে ইন্ডিয়া পৌঁছবে। তারকারাজিও আবার এক-দুটি নয়। কিছু তারকা আছে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে নড়াচড়া করে না। কিছু তারকা আছে নড়াচড়া করে। তারকার মাধ্যমে রাস্তা ঠিক করে। কোন তারকা অনুসরণ করলে কোন দেশে পৌঁছবো। এখন দেশ উন্নত হয়ে গেছে, কক্সবাজারে পাহাড়ের ওপর লাইট বসানো হয়েছে। লাইট হাউস। সমুদ্র থেকে ওই লাইট দেখে কক্সবাজারের দিকে আসে। উল্লিখিত আয়াত থেকে এটি আবিষ্কৃত। আর আল্লাহর রসুল (সা.) সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে বলেছেন,

«أَصْحَابِيْ كَالنُّجُوْمِ».

‘আমার সাহাবীরা আকাশের নক্ষত্রের মতো।’ বেহেস্তের পথ কোনটা, সেটা যদি তোমরা অনুসরণ করতে চাও, আমার সাহাবীদেরকে অনুসরণ কর। তুমি যদি আদর্শ রাষ্ট্রপতি হতে চাও, একটা নক্ষত্র আছে, তার নাম হলো হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাযি.) তাকে অনুসরণ কর।

چشم احمد بر ابو بکرے زدہ

از یکے تصدیق صدیق آمدہ

তুমি যদি আদর্শ রাজনীতিবিদ হতে চাও, তাহলে একটা নক্ষত্র আছে, তার নাম হলো, হযরত ওমরে ফারুক (রাযি.)। হযরত ওমরকে অনুসরণ করো।

«أَصْحَابِيْ كَالنُّجُوْمِ فَبِأَيِّهِمُ اقْتَدَيْتُمْ اهْتَدَيْتُمْ».

‘যেকোনো সাহাবীকে তোমরা অনুসরণ করবে, জান্নাতে পৌঁছে যাবে।’

গোনাহে নয়, সাহাবায়ে কেরাম তাওবার ক্ষেত্রে আদর্শ

খতীবে আযম হযরত আল্লামা সিদ্দিক আহমদ সাহেব (রহ.)-কে একজন প্রশ্ন করল যে, হুযুর সাহাবীদেরকে অনুসরণ করার জন্য বলছেন, একজন সাহাবী তো (হযরত মায়েয আল-আসলামী রাযি.) জিনাও করেছেন। তাঁকে তো পাথর মেরে হত্যা করা হয়েছে। তাঁকেও কি অনুসরণ করতে হবে? তাঁকে অনুসরণ করলে তো জিনা করতে হবে। খতীবে আযম (রহ.) বললেন, জিনা করেছে সেটা দেখেছো, জিনা করার পর তিনি যে পুনরায় রসুলের সামনে এসে স্বীকার করেছেন, অতঃপর রসুল (সা.)-এর নির্দেশে তাঁকে থাকে পাথর মেরে হত্যা করা হয়েছে এবং তাতে তিনি রাজি ছিলেন। তাঁর শরীরের রক্ত কোন কোন সাহাবীর গায়ে পড়েছে পাথর মারার সময়। তখন হুযুর (সা.) বলেছেন, ‘মায়েযে আসলামী পাথর খেয়ে এমন তওবা করেছেন যে, সমস্ত মদীনার সব মানুষের গুনাহ মাফ হয়ে গেছে, (আল্লাহু আকবর)। তাহলে হযরত মায়েযে আসলামী (রাযি.)ও আমাদের আদর্শ। কীসের? গুনাহ করার পর তওবা করার জন্য। হুযুর (সা.) বলেছেন,

«اللهَ اللهَ فِيْ أَصْحَابِيْ، لَا تَتَّخِذُوْهُمْ غَرَضًا بَعْدِيْ، فَمَنْ أَحَبَّهُمْ فَبِحُبِّيْ أَحَبَّهُمْ، وَمَنْ أَبْغَضَهُمْ فَبِبُغْضِيْ أَبْغَضَهُمْ».

‘আমি দুনিয়া থেকে যাওয়ার পর আমার সাহাবীদের সমালোচনা করবে না। আমার সাহাবীদেরকে যদি মহব্বত করো আমারও মহব্বত হবে।’

«وَمَنْ أَبْغَضَهُمْ فَبِبُغْضِيْ أَبْغَضَهُمْ».

‘আমার সাহাবীদের সাথে যারা দুশমনি রাখে, আমি মনে করব সে, আমার শত্রু।’[6] হুযুর (সা.) বলেছেন,

«إِذَا رَأَيْتُمُ الَّذِيْنَ يَسُبُّوْنَ أَصْحَابِيْ فَقُوْلُوْا: لَعْنَةُ اللهِ عَلَىٰ شَرِّكُمْ».

‘যদি এমন ব্যক্তিকে দেখো আমার সাহাবীদেরকে গালমন্দ করে, তিরস্কার করে, তুমি সাথে সাথে বলো, তুমি অত্যন্ত খারাপ মানুষ। তোমার ওপর আল্লাহর লানত।’[7] তুমি রসুলের সাহাবীর সমালোচনা করছো।

আসল ঘটনা হলো, হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর দল সাহাবী, হযরত আলী (রাযি.)-এর দলও সাহাবী। হযরত মুআবিয়া (রাযি.) তাঁর ইজতিহাদ মতে হযরত আলীকে (রাযি.)-এর সিদ্ধান্তকে সঠিক মনে করেননি। আর হযরত আলী (রাযি.) তাঁর ইজতিহাদ মতে হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর সিদ্ধান্তকে ভুল মনে করেছেন। ইজতিহাদ হলো,

بَذْلُ الْـجُهْدِ لإِدْرَاكِ حُكْمٍ شَرْعِيٍّ.

‘শরয়ী কোন হুকুম জানার জন্য চেষ্টা নিয়োজিত থাকাকে ইজতিহাদ বলে।’

যিনি এ ধরনের চেষ্টায় নিয়োজিত থাকেন তাকে মুজতাহিদ বলে। ইজতিহাদ সম্পর্কে শরীয়তের বিধান হচ্ছে, যদি ইজতিহাদ সঠিক হলে দ্বিগুণ সওয়াব। ইজতিহাদ যদি ভুল হয় তাহলে একটি সাওয়াব পাবে, তাতে কোন গুনাহ হবে না। এগুলো ইজতিহাদি ভুল। এগুলোর ওপর পাকড়াও করা হয় না।

গবেষণাগত (ইজতিহাদী) ভুল নবীদেরও হতে পারে

ইজতিহাদি ভুল নবীদেরও হয়েছে। যেমন সুরা আলাম নাশরাহে বর্ণিত হয়েছে। গতকাল আমি এর তাফসীর পড়ছিলাম,

وَوَضَعْنَا عَنْكَ وِزْرَكَۙ۰۰۲ الَّذِيْۤ اَنْقَضَ ظَهْرَكَۙ۰۰۳

‘হে নবী! আপনার পিঠের ওপর যে বোঝা, আপনার পিঠকে ঝাঁকিয়ে দিয়েছে। এত ভারী বোঝা যে, আপনার পিঠকে ঝাঁকিয়ে দিয়েছে। সে বোঝা আমি সরিয়ে দিয়েছি।’[8]

এর অর্থ, তাফসীরে মাআরিফুল কুরআনে আছে, হুযুর (সা.) বিভিন্ন জায়েজ কাজের ক্ষেত্র কিছু ইজতিহাদ করেছেন। সেখান থেকে কিছু অনুত্তম হয়ে গেছে। আফযল (أفضل) না হয়ে ফাযিল (فاضل) হয়েছে। যার কারণে হুযুর (সা.) খুব চিন্তিত হলেন। আমি তো অনুত্তম (خلاف أولىٰ) কাজ করে ফেলেছি। তখন আল্লাহ পাক বলেন, আপনি (خلاف أولىٰ) করেছেন, না জায়েজ করেননি। আমি সেটা মাফ করে দিয়েছি।

وَوَضَعْنَا عَنْكَ وِزْرَكَۙ۰۰۲ الَّذِيْۤ اَنْقَضَ ظَهْرَكَۙ۰۰۳

শুধু মাফ করিনি, বরং

وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَؕ۰۰۴

‘আপনার মর্যাদা, আপনার আলোচনা সকলের ঊর্ধ্বে রেখেছি।’[9]

এখানে মুফতি মুহাম্মদ শফী সাহেব (রহ.) হাদীস শরীফ দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন যে, ‘আপনার আলোচনা সকলের ঊর্ধ্বে রেখেছি’ এর অর্থ হাদীসে কুদসিতে আল্লাহ পাক বলেন, আপনার আলোচনাকে এত বড় স্থান দিয়েছি যে, যেখানে আমি আল্লাহর আলোচনা হয় হবে, সেখানে সাথে সাথে আপনারও আলোচনা হবে (সুবহানাল্লাহ)। আল্লামা ইকবাল (রহ.) বলেন,

تکبیر میں کلمے میں نمازوں میں اذان میں

نام خدا سے ہے ملا نام محمد

আযান ও ইকামতের মধ্যে আল্লাহর নামের সাথে আল্লাহর রসুলের নাম উচ্চারিত হয়। কালিমার মধ্যে আল্লাহর নামের সাথে রসুলের নাম। নামাজের তাশাহহুদে আল্লাহর নামের সাথে রসুলের নাম। এ কবিতায় উল্লিখিত ‘তাকবীর মে’ এই শব্দের মর্ম বুঝে আসছিল না। তখন আমি হযরত গাজী সাহেব হুযুর (রহ.)-কে বললাম, হুযুর ‘তাকবীর মে’ এর উদ্দেশ্য কী? তিনি বলেন, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ইকামত। ইকামতকে তাকবীরও বলে।

গবেষণাগত ভুলের শাস্তি হয় না

ইজতিহাদি ভুলের ওপর কোন শাস্তি হবে না। কিতাবে লেখা আছে, এক বুজুর্গ এশার নামাজের পরে ঘুমোতে যাচ্ছেন। ঠিক সেই সময় বসে বসে তিনি সিফফীনের যুদ্ধ সম্পর্কে গবেষণা করছেন। সিফিনের যুদ্ধে ওই দিকে সাহাবী মারা গেলেন, এদিকেও সাহাবী মারা গেলেন। এখন কি হযরত আলী (রাযি.) দোষী নাকি হযরত মুআবিয়া (রাযি.) দোষী? কে বেহেস্তে যাবে আর কে দোযখে যাবে? দুজনই তো সাহাবী। চিন্তা-গবেষণা করছেন, ঘুম আসছে না। গবেষণা করতে করতে শেষ রাতে তন্দ্রা আসছে। রাত গভীর হওয়ার পর চোখে ঘুম চলে আসলো। তখন তিনি স্বপ্ন দেখেন, কিয়ামতের ময়দান কায়েম হয়ে গেছে, আল্লাহ পাক বিচারের আসনে বসা। এক এক দলের বিচার হচ্ছে। সাইনবোর্ড লাগানো আছে। একেকজনের নাম আসছে। এখন অমুক আসো, এখন অমুক আসো। সব অটো ‍সিস্টেম। এখন অমুক দল আসো, বাইরে সাইনবোর্ডে নাম আসছে। সেই বুজুর্গ ওই দিকে তাকিয়ে আছে, কিছুক্ষণ পর দেখছেন যে, হযরত আলী (রাযি.) আর মুআবিয়া (রাযি.) উভয়কে ডাকা হলো। এখন হযরত আলী (রাযি.) ও হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর বিচার হবে। সেই বুজুর্গ চিন্তা করছেন, এখন কী বিচার হয় দেখি। দেখি, আল্লাহ কাকে বেহেশতে দেন আর কাকে দোযখে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই হযরত আলী (রাযি.) বের হয়ে আসলেন, হুযুর, কি বিচার হলো? বললেন, আল্লাহ পাক আমার পক্ষে রায় দিয়েছেন, (আল-হামদু লিল্লাহ)। এখন সেই বুজুর্গ মনে করছেন, হযরত আলী (রাযি.)-এর পক্ষে যখন রায় দিয়েছেন, তাহলে মুআবিয়া (রাযি.)-কে বোধহয় জাহান্নামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিছুক্ষণ পরে হযরত মুআবিয়া (রাযি.) বের হলেন। হুযুর! আপনার কি অবস্থা? বললেন, আমাকে আল্লাহ পাক বেকসুর খালাস দিয়েছেন। সেজন্য ওলামায়ে কেরামের মতামত হল, হযরত মুআবিয়া (রাযি.)ও ইজতিহাদ করেছেন, হযরত আলী (রাযি.)ও ইজতিহাদ করেছেন, কিন্তু হযরত মুআবিয়া (রাযি.)-এর ইজতিহাদ ভুল হয়ে গেছে, হযরত আলী (রাযি.)-এর ইজতিহাদ ভুল হয়নি। সুতরাং

«إِذَا الْتَقَى الْـمُسْلِمَانِ بِسَيْفَيْهِمَا، فَالْقَاتِلُ وَالْـمَقْتُوْلُ فِي النَّارِ».

এখানে যে فِي النَّارِ লিখেছেন, এটি ইজতিহাদি ভুলের ব্যাপারে নয়। সাহাবায়ে কেরামের বিষয়টি ছিল ইজতিহাদি ভুল। ইজতিহাদি ভুলের কারণে উভয় গ্রুপ হক ও সঠিক সাব্যস্ত হবে।

হযরত মুফতি মুহাম্মদ শফী সাহেব (রহ.) একটি আয়াত পেশ করেছেন। বনি কুরায়যার ইহুদিরা মদীনায় থাকতো। মুসলমানদের সাথে একটা চুক্তি ছিল, আমাদের ওপর মসিবত আসলে, তোমরা সাহায্য করবে। তোমাদের ওপর মসিবত আসলে আমরা তোমাদেরকে রক্ষা করব। কিন্তু এ বনি ‍কুরাইযা পরবর্তী সময়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। তখন রসুলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিলেন, বনি ‍কুরাইযাকে সরিয়ে দাও। বের করে দাও এই ইহুদিদেরকে। এখন সাহাবীরা বনি কুরায়যার এলাকায় যাচ্ছেন। কিছু সাহাবী গিয়ে তাদেরকে সরিয়ে দিচ্ছেন। মদীনায় তো খেজুরের বাগান বেশি। কিছু সাহাবী খেজুর বাগানের গাছগুলো কেটে ফেলছেন। কিছু সাহাবী বললেন, গাছ কেটে কী লাভ? তারা তো চলে যাবে। এগুলো তো আমরাই ভোগ করব। সুতরাং গাছ কাটা বন্ধ কর। অপর কিছু সাহাবী গাছ কেটেছেন। এখন কারা ভুল করেছেন? কারা সঠিক করছেন? এ সম্পর্কে কুরআন শরীফে আয়াত নাযিল হয়েছে,

مَا قَطَعْتُمْ مِّنْ لِّيْنَةٍ اَوْ تَرَكْتُمُوْهَا قَآىِٕمَةً عَلٰۤى اُصُوْلِهَا فَبِاِذْنِ اللّٰهِ ۰۰۵

‘তোমরা যারা গাছ কেটেছ, আর যারা কাটনি, গাছ খাড়া রেখেছ عَلٰۤى اُصُوْلِهَا; উভয়টিই আল্লাহর হুকুমে হয়েছে।’[10] উভয়দল হক। উভয়ের মধ্যে ইজতিহাদি মতপার্থক্য ছিল। সেজন্য মনে রাখতে হবে, আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আকীদা হচ্ছে, আম্বিয়ায়ে কেরাম মাসুম (معصوم)। সাহাবায়ে কেরাম (مغفور لهم) সাহাবীরা মাসুম নয়। কারণ রসুলে করীম (সা.) বলেছেন,

«كُلُّ بَنِيْ آدَمَ خَطَّاءٌ، وَخَيْرُ الْـخَطَّائِيْنَ التَّوَّابُوْنَ».

‘নবী ছাড়া প্রত্যেকে গুনাহগার হবে। গুনাহগার যারা আছে, তাদের মধ্যে ভালো গুনাহগার হলো, যারা তওবা করে।’[11] কেন?

«التَّائِبُ مِنَ الذَّنْبِ كَمَنْ لَا ذَنْبَ لَهُ».

‘গুনাহ থেকে তওবা করলে সেটা তার আমলনামা থেকে মুছে দেওয়া হয়।’[12]

আল্লাহ পাকের দরবারে এভাবে রেকর্ড করা হয় যে, যেন সে গুনাহই করেনি। তাফসীরে মাআরিফুল কুরআনে লেখা আছে,

وَوَجَدُوْا مَا عَمِلُوْا حَاضِرًاؕ ۰۰۴۹[13]

فَمَنْ يَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَّرَهٗؕ۰۰۷ وَمَنْ يَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَّرَهٗؒ۰۰۸[14]

কুরআন শরীফে আছে, আমি চিন্তা করছিলাম, আমরা তো সবসময় তওবা করছি, তওবার কারণে জাহান্নামে না দিলেও কিয়ামতের দিন ভালো কাজ ও খারাপ কাজসমূহকে মানুষের সামনে দেখানো হবে। এটা তো বিরাট লজ্জা! কুরআন শরীফে বলছে,

وَوَجَدُوْا مَا عَمِلُوْا حَاضِرًاؕ ۰۰۴۹[15]

কিন্তু অন্য আয়াতে আছে, যেসব কাজের জন্য তওবা করবে সেসব গুনাহ আল্লাহ দেখাবেন না (আল্লাহ আকবার)।

فَمَنْ تَابَ مِنْۢ بَعْدِ ظُلْمِهٖ وَاَصْلَحَ فَاِنَّ اللّٰهَ يَتُوْبُ عَلَيْهِؕ ۰۰۳۹[16]

সুতরাং আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আকীদা হলো, আম্বিয়ায়ে কেরাম (معصوم) মাসুম। আর কুরআনের বিভিন্নস্থানে রসুলকে ক্ষমা করার কথা এসেছে। যেমন-

لِيَغْفِرَ لَكَ اللّٰهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْۢبِكَ وَمَا تَاَخَّرَ ۙ۰۰۲[17]

অর্থাৎ আল্লাহ আপনার পূর্বাপর সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। এটা (خلاف أولىٰ) কাজ সম্পর্কে বলা হয়েছে। সুতরাং আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আকীদা হলো, সাহাবায়ে কেরাম মাসুম (معصوم) নয়, (مغفور لهم)। তাদের থেকে গুনাহ হবে, কিন্তু মউতের পূর্বে তাদের সব গুনাহ আল্লাহ পাক মাফ করে দিবেন।

وَعَدَ اللّٰهُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ مِنْهُمْ مَّغْفِرَةً وَّاَجْرًا عَظِيْمًاؒ۰۰۲۹[18]

আমাদের ভারত উপমহাদেশে একটি দল আছে, তারা সাহাবায়ে কেরামকে সত্যের মাপকাঠি মানে না। সাহাবায়ে কেরামকে আদর্শ হিসেবে মেনে নিতে চায় না। অথচ আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আকীদা হলো, সাহাবায়ে কেরাম           ‘মেয়ারে হক’ তথা উম্মতের জন্য আদর্শ। আল্লামা জালালুদ্দীন রুমী (রহ.) বলেন,

ما واصحابیم چوں کشتئ نوح

ہر کہ آن رستند ازو باید فتوح

‘আমাদের উদাহরণ আর সাহাবীদের উদাহরণ হচ্ছে, হযরত নুহ (আ.)-এর নৌকার মতো। হযরত নুহ (আ.)এর নৌকায় যারা উঠেছে, তাদেরকে আল্লাহ পাক হেফাজত করেছেন। সাহাবীদের নৌকায় যারা উঠবে, সাহাবীদেরকে যারা অনুসরণ করবে, তাঁদেরকেও আল্লাহ পাক জাহান্নাম থেকে হেফাজত করবেন।

ما واصحابیم چوں کشتئ نوح

ہر کہ آن رستند ازو باید فتوح

چشم احمد بر ابو بکرے زدہ

ہر یکے تصدیق صدیق آمدہ

একটি উদহারণ দিয়েছেন, রসুলুল্লাহ (সা.)-এর দৃষ্টি হযরত আবু বকর (রাযি.)-এর ওপর পড়েছে। তাই তিনি সিদ্দিকে রূপান্তরিত হয়েছেন। মূলত মেরাজ থেকে আসার পরে কাফেররা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাযি.)-এর নিকট এসে বললো, তোমার নবী তো আগে বারো আনা পাগল ছিল, এখন তো ষোল আনা পাগল হয়ে গেছে। তিনি বলেন, কেন? তারা বলল, তিনি বলেছেন, এক রাতে বায়তুল্লাহ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস, অতঃপর জান্নাত-জাহান্নাম সব সফর করে ফিরেছেন। এটা পাগলামি না? তখন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাযি.) বললেন, একথা কি আমার নবী বলেছেন? তারা বলল, জি, তিনিই বলেছেন। তখন হযরত আবু বকর (রাযি.) বলেন, তাহলে আমি এটি অবশ্যই বিশ্বাস করি। এ সংবাদ হুযুর (সা.) শোনার পর তিনি তাঁকে ‘সিদ্দিক’ উপাধিতে ভূষিত করেন। নবীদের পরেই সিদ্দিকের মর্যাদা। আল্লাহ বলেন,

الَّذِيْنَ اَنْعَمَ اللّٰهُ عَلَيْهِمْ مِّنَ النَّبِيّٖنَ وَالصِّدِّيْقِيْنَ۠ وَالشُّهَدَآءِ وَالصّٰلِحِيْنَۚ ۰۰۶۹[19]

মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহ.) লিখেছেন,

صدیقین کے ترجمہ ہے الاولیاء۔

چشم احمد بر ابو بکرے زدہ

ہر یکے تصدیق صدیق آمدہ

چوں عمر شیدائے آں معشوق شد

حق وباطل چوں دل فاروق شد

হযরত ওমর (রাযি.) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তিনি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর আশেক হয়ে যান।

حق وباطل چوں دل فاروق شد

হযরত ওমর (রাযি.) হক-বাতিলকে এভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছেন যে, তাঁর কথা অনুযায়ী প্রায় ২০টি বিষয়ে আয়াত নাযিল হয়েছে (সুবহানাল্লাহ)। তিনি মুসলমান হওয়ার পর ‘দারে আরকামে’ গিয়ে (যেখানে হুযুর (সা.) গোপনে অবস্থান করতেন) বললেন, হুযুর এখন তো আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। এখন কাজ কী? বললেন, নামাজ পড়তে হবে। নামাজ কোথায় পড়তে হবে? রসুল (সা.) বললেন, নামাজ তো কাবা ঘরের সামনে পড়তে হয়। তোমাদের জন্য তো পারিনি। বললেন, হুযুর আজকে আপনাকে নিয়ে কাবা ঘরের সামনে নামাজ পড়বো। এই বলে তিনি রসুলকে নিয়ে কাবার দিকে বেরিয়ে পড়েন। ওই দিকে আবু জাহলরাও আসছে। কাবা ঘরের সামনে উপস্থিত। কারণ তারা তো হযরত ওমর (রাযি.) কর্তৃক রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কল্লা নিয়ে আসার অপেক্ষায় আছে। দূরে থেকে দেখা যায় যে, হযরত ওমর (রাযি.) আগে আগে আসছে, আল্লাহর রসুল (সা.) আর কিছু সাহাবী পিছনে পিছনে আসছে। ওরা তো মহাখুশি। কল্লা নয়, একেবারে মুহাম্মদকে জীবন্ত ধরে নিয়ে আসছে! গ্রেফতার করে নিয়ে আসছে! তারা ধীরে ধীরে কাছে আসছে, হযরত ওমর (রাযি.)-কে ধন্যবাদ দেয়ার জন্য। হযরত ওমর (রাযি.) দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন, ওহে আবু জাহল! ওহে উমাইয়া ইবনে খালাফ! ওহে উতবা! ওহে শায়বা! আজকে মুহাম্মদকে নিয়ে প্রকাশ্যে কাবা ঘরের সামনে নামাজ পড়বো। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ নিজের বিবিকে বিধবা করতে চাও, নিজের ছেলে-মেয়েকে এতীম বানাতে চাও, তাহলে আমার সামনে আসো, আল্লাহু আকবার! সকলেই পালিয়ে গেলো। আকাশের মেঘ যেন পরিষ্কার হলো। সেখানেই জামায়াতে নামাজ পড়লেন। নামাজের পরে রসুলে করীম (সা.) দাঁড়িয়ে বলেন, এই লোকটার নাম ওমর। আমি আজ তাঁর একটি উপাধি বাড়িয়ে দিলাম, সেই উপাধি হল, ফারুক। অর্থাৎ হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী। তেমনি হযরত উসমান ‘যিন্নুরাইন’ হয়ে গেছেন রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সোহবতে। আগে ছিল উসমান গনী সোহবতের পর হয়ে গেছে উসমান (যিন্নুরাইন)। হযরত আলী (রাযি.)-কে আসাদুল্লাহ বানিয়ে দিয়েছেন। আসাদুল্লাহ মানে শেরে খোদা অর্থাৎ আল্লাহর সিংহ। তিনি দীনের জন্য সিংহের ন্যায় কাজ করেছেন। ‍এসব কিছু রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সোহবতের বদৌলতে সম্ভব হয়েছে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে সাহাবায়ে কেরামকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার তওফিক দান করুন, আমীন।

অনুলিখন

মাওলানা সোহাইল কাসেমী

সম্পাদনা

মুফতি সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী

[1] আল-খতীবুল বাগদাদী, আল-কিফায়া ফী ইলমির রিওয়ায়া, জামিয়াতু দায়িরাতিল মাআরিফ আল-উসমানিয়া হায়দরাবাদ, দাক্ষিণাত্য, ব্রিটিশ ভারত (প্রথম সংস্করণ: ১৩৫৭ হি. = ১৯৩৯ খ্রি.), পৃ. ৪৯

[2] আত-তিরমিযী, আস-সুনান, মুস্তফা মুস্তফা আল-বাবী আল-হালাবী অ্যান্ড সন্স লাইব্রেরি অ্যান্ড প্রিন্টিং কোম্পানি, কায়রো, মিসর (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৩৯৫ হি. = ১৯৭৫ খ্রি.), খ. ৫, পৃ. ২৯৮, হাদীস: ৩১২৭

[3] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-বাকারা, ২:১৩৭

[4] আত-তাবরীযী, মিশকাতুল মাসাবীহ, আল-মাকতাবুল ইসলামী লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর, বয়রুত, লেবনান (তৃতীয় প্রকাশ: ১৪০৫ হি. = ১৯৮৫ খ্রি.), খ. ৩, পৃ. ১৬৯৬, হাদীস: ৬০১৮

[5] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আন-নাহল, ১৬:১৬

[6] আত-তিরমিযী, আস-সুনান, খ. ৫, পৃ. ৬৯৬, হাদীস: ৩৮৬২

[7] আত-তিরমিযী, আস-সুনান, খ. ৫, পৃ. ৬৯৭, হাদীস: ৩৮৬৬

[8] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-ইনশিরাহ, ৯৪:২-৩

[9] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-ইনশিরাহ, ৯৪:২-৪

[10] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-হাশর, ৫৯:৫

[11] আত-তিরমিযী, আস-সুনান, খ. ৪, পৃ. ৬৫৯, হাদীস: ২৪৯৯

[12] ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, দারু ইয়াহইয়ায়িল কুতুব আল-আরাবিয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৩৭১ হি. = ১৯৫২ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ১৪১৯, হাদীস: ৪২৫০

[13] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-কাহফ, ১৮:৪৯

[14] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-যালযালা, ৯৯:৭-৮

[15] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-কাহফ, ১৮:৪৯

[16] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-মায়িদা, ৫:৩৯

[17] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-ফাতহ, ৪৮:২

[18] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আল-ফাতহ, ৪৮:২৯

[19] আল-কুরআনুল করীম, সূরা আন-নিসা, ৪:৬৯

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ