সমস্যা ও সমাধান
ফতওয়া বিভাগ
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
মোবাইল: 01856-618367
ইমেইল: daruliftapatiya@gmail. com
পেইজলিংক: Facebook. com/Darul-ifta-Jamia-Patiya
তাহারাত-পবিত্রতা
সমস্যা: আমরা সর্বদা অজু অবস্থায় থাকতে পারি না, তাই অনেক সময় অজু ছাড়া কুরআনের আয়াত লিখতে হয়। জানার বিষয় হল, অজু ছাড়া কলম দ্বারা অথবা কম্পিউটারে কুরআনের আয়াত লেখা জায়েজ হবে কি না?
মাজেদ
সীতাকুণ্ড
সমাধান: কুরআনে করীম আল্লাহ তাআলার কালাম। সুতরাং এর স্পর্শ, পঠন, লিখনসহ সর্বক্ষেত্রে পূর্ণ আদবের প্রতি খেয়াল রাখা কর্তব্য। তাই আয়াত লেখার সময়ও অজুসহ অন্যান্য আদবের প্রতি লক্ষ্য রাখা কর্তব্য। অবশ্য বিনা অজুতে লিখতে গিয়ে যদি আয়াতের লিখিত অংশে হাত না লাগে বরং কাগজের সাদা অংশে হাত লাগে তাহলে না জায়েজ হবে না। তবে পারত পক্ষে বিনাঅজুতে কুরআনের আয়াত লেখা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। [দুররুল মুখতার: ১/৩১৭, মনিয়াতুল মুসল্লী: ১/১৭২, আল-ফতওয়া মিন আকাবীলিল মাশায়েখ: ১/১৬, ফতহুল কদীর: ১/১৭৩, আহসানুল ফতওয়া: ১/৩৬]
সমস্যা: অনেক ব্যক্তিকে দেখা যায়, অজু করার পূর্বে প্রথমে পা ভিজিয়ে নেয়, বিশেষ করে শীতকালে এমনটি বেশি করে, এরপর ধারাবাহিকভাবে অজু করে। জানার বিষয় হল, উক্ত পদ্ধতিতে অজু করা ঠিক কি না?
আবু তলহা আদনান
নোয়াখালী।
সমাধান: অনেক সময় শুষ্কতার কারণে চামড়ার ভাঁজে সহজে পানি পৌঁছে না, বিশেষ করে শীতকালে এমনটি বেশি হয়। তাই আগে পা ভিজিয়ে নিলে ধোয়া সহজ হয়। সুতরাং সতর্কতামূলক আগে পা ভিজিয়ে নেওয়া বা পানি ছিটিয়ে দেওয়া ভালো, এতে দোষের কিছু নেই। [রদ্দুল মুহতার: ১/২৫৬, আল-মুহীতুল বুরহানী: ১/৩৪, ইলাউস সুনান: ১/৭৬, আল-বাহরুর রায়েক: ১/২৬]
সমস্যা: অনেক সময় হাত এবং পায়ের নখের নিচে ময়লা বা আটা ইত্যাদি লেগে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, গোসল বা অজুর সময় নখের নিচের ময়লা বা আটার নিচে পানি পৌঁছানো জরুরি কি না? এবং নখের নিচে পরিষ্কার করে নেওয়া জরুরি কি না?
নাফীস
নোয়াখালী, মাইজদি।
সমাধান: অজু-গোসলে নখের ফাঁকেও পানি পৌঁছানো জরুরি। পানি না পৌঁছলে অজু-গোসল হবে না। সুতরাং নখের ভেতর যদি এমন ময়লা জমে যা ভেদ করে ভেতরে পানি পৌঁছাতে বাঁধা দেয়, তাহলে সেটি পরিষ্কার করে নেওয়া আবশ্যক। অন্যথায় এ ময়লা থাকা অবস্থায় অজু-গোসল সহীহ হবে না। তবে নখের নিচে সাধারণত যে ময়লা জমে থাকে তা নখের ভেতরে পানি পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি করে না, তাই এ ধরনের ময়লা থাকা অবস্থায় অজু-গোসল সহীহ হয়ে যাবে। কিন্তু নখের নিচে বা ফাঁকে আটা বা খামিরা লেগে থাকে তবে অজু-গোসলের সময় যদি তা ভিজে নিচে চামড়াও ভিজে যায় তবে অজু-গোসল হয়ে যাবে। আর যদি পানি না পৌঁছে তাহলে অজু-গোসল হবে না। তবে সর্বাবস্থায় নখ পরিষ্কার করে পানি পৌঁছানো উত্তম। উল্লেখ্য যে, নখ অধিক বড় রাখা সুন্নাতের খেলাফ। নখের ভেতর ময়লা জমে থাকা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। তাই নখ বড় হলেই তা কেটে ফেলা উচিত। [আল-মুহীতুল বুরহানী: ১/২৯, খুলাসাতুল ফতওয়া: ১/২২, মারাকিল ফালাহ: ১/৬৩, ফতওয়া সিরাজিয়া: ৩২, আদ-দুররুল মুখতার: ১/৩১৭]
সালাত-নামাজ
সমস্যা: নামাজের মধ্যে সেজদার আয়াত পাঠ করার পর যদি সাথে সাথে সেজদা না করে সেই রকআতে কিছু দূর তিলাওয়াত করার পর সেজদা দিলে অথবা সেই রকআতে না দিয়ে অন্য রকআতে দিলে কোন অসুবিধা হবে কি না?
মুসা
মধ্যবাড্ডা, ঢাকা।
সমাধান: নামাজে সেজদার আয়াত পড়ার পর তিন আয়াতের চেয়ে বেশি পড়ার আগেই সেজদা করা ওয়াজিব। এর চেয়ে বিলম্ব করা মকরুহে তাহরীমী। ভুলে সেজদা দেওয়ার ক্ষেত্রে দেরি করলে সেজদায়ে সাহু করা ওয়াজিব। [ফতওয়ায়ে শামী: ২/৭০৪–৭০৫, ফতওয়ায়ে বাযযাযিয়া: ১/৪৬, হাশিয়াতুত তাহতাবী আলাদ দুর: ২/৫৫০]
সমস্যা: গতকাল মসজিদের দ্বিতীয় তলায় যোহরের নামাজ আদায় করেছিলাম। ইলেক্ট্রিক সমস্যার কারণে মাইক ডিস্টার্ব করার ফলে ইমামের অবস্থা বুঝতে পারিনি। ইমাম রুকুতে চলে গেছে মনে করে ইমামের আগে রুকুতে চলে গেছি। আর ইমাম যখন রুকু থেকে উঠে গেছেন তখন বিষয়টি বুঝতে পেরেছি। তখন তাড়াতাড়ি পুনরায় রুকু করে ইমামের সাথে সেজদায় শরিক হয়েছি। প্রশ্ন হল, আমার উক্ত নামাজ সহীহ হয়েছে কি না?
নুরুল কবীর
ঝিনাইদহ।
সমাধান: প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে যেহেতু আপনি ইমাম সাহেবের পরে পুনরায় রুকু আদায় করে দিয়েছেন। তাই আপনার নামাজ আদায় হয়ে গেছে। ইমাম সাহেবের সাথে বা পরে পুনরায় আদায় না করলে নামাজ সহীহ হত না। [ফতওয়ায়ে শামী: ২/২০৪, শরহুল মুনিয়া: ২৮০, আল-বাহরুর রায়েক: ২/১৩৬]
সমস্যা: সম্মানিত মুফতি সাহেবের নিকট একটি মাসআলা জানতে চাই, আমি গতকাল যোহরের নামাজ পড়া অবস্থায় পকেটে মোবাইলে কল আসার কারণে রিংটোন বন্ধ করে দিই। এমতাবস্থায় পাশের এক ভাই নামাজ শেষে বলল, আপনার নামাজ হয়নি। এখন আমার জানার বিষয় হল, আমার আদায়কৃত নামাজ সহীহ হয়েছে কি না?
জাহেদুল ইসলাম
মহেশখালী।
সমাধান: নামাজে মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলে মোবাইলের দিকে না তাকিয়ে একহাত দ্বারা দ্রুত বন্ধ করে দিলে নামাজ ফাসেদ হয় না। কিন্তু মোবাইলের দিকে দেখে দেখে একহাত দ্বারা বন্ধ করলেও যেহেতু অন্য ব্যক্তি তাকে নামাজে আছে মনে করে না তাই এক্ষেত্রে নামাজ ফাসেদ হয়ে যায়। সুতরাং প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে যদি আপনি মোবাইলের দিকে না তাকিয়ে একহাত দ্বারা রিংটোন বন্ধ করে থাকেন তাহলে আপনার উক্ত নামাজ নষ্ট হয়নি। [সুনানে আবু দাউদ: ১/১৩৩, ফতওয়ায়ে কাযীখান: ১/৮১, আদ-দুররুল মুখতার: ২/৪৬৫, ফতওয়ায়ে কাসেমিয়া: ৭/৪৬৫]
সমস্যা: হযরত মুফতি সাহেব একটি মাসআলা জানতে চাই, অনেক সময় নামাজে মাথা থেকে টুপি পড়ে যায়। জানার বিষয় হল, যদি নামাজে টুপি পড়ে যায় তাহলে কি বাকি নামাজ টুপি ছাড়া শেষ করবো নাকি টুপি পরিধান করে নামাজ আদায় করবো? জানিয়ে বাধিত করবেন।
আবু হিশাম
হালিশহর, চট্টগ্রাম।
সমাধান: নামাজে টুপি পড়ে গেলে যদি এক হাত দ্বারা তা উঠিয়ে পরে নেওয়া সম্ভব হয় তাহলে টুপি উঠিয়ে পরে নেওয়াই উত্তম। আর যদি দুই হাত ব্যবহার করা ছাড়া উঠানো সম্ভব না হয় তাহলে সেক্ষেত্রে টুপি না উঠানোই উচিত। এতে নামাজের কোন ক্ষতি হবে না। প্রকাশ থাকে যে, দাঁড়ানো কিংবা রুকু অবস্থায় টুপি পড়ে গেলে তা উঠানোর চেষ্টা করবে না। আর সেজদা বা বৈঠকের সময় এমনটি হলে উপর্যুক্ত পন্থায় উঠিয়ে পরে নেবে। [ফতওয়ায়ে তাতারখানিয়া: ২/২০৩, দুরারুল হুক্কাম: ১১১, ফতওয়ায়ে শামী: ১/১২৬]
জানাযা-দাফন
সমস্যা: আমাদের এলাকায় এক ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছে, সেই ব্যক্তির জানাযা পড়া হবে কি না? এ নিয়ে সমাজের মানুষের মাঝে মতবিরোধ দেখা যায়। পরে কয়েকজন মানুষ মিলে তার জানাযা পড়ে তাকে দাফন করে। মুফতি সাহেবের নিকট জানতে চাই, আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির জানাযা পড়া এবং তার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করার কী হুকুম?
সাজেদুল্লাহ
ফরিদপুর।
সমাধান: আত্মহত্যা অনেক বড় গুনাহ। শরীয়তের দৃষ্টিতে আত্মহত্যাকারী ফাসেক। তবে সে কাফের নয়। কিন্তু ফাসেক হলেও তার জানাযা পড়তে হবে। হযরত ইমরান (রহ.) বলেন, আমি ইবরাহীম আন-নাখায়ী (রহ.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম,
عَنْ عِمْرَانَ، قَالَ: سَأَلْتُ إِبْرَاهِيْمَ النَّخَعِيَّ، عَنْ إِنْسَانٍ قَتَلَ نَفْسَهُ أَيُصَلَّىٰ عَلَيْهِ؟ قَالَ: «نَعَمْ، إِنَّمَا الصَّلَاةُ سُنَّةٌ».
অর্থাৎ আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়া যাবে কি না? তিনি বললেন, হ্যাঁ, নামাজ পড়াটাই নিয়ম। (মুসান্নাফে ইবনে আবু শায়বা: ১১৮৬৮)
অবশ্য জানাযা আদায়ের জন্য উপযুক্ত লোক থাকলে সমাজের কোন বড় আলেম এবং নেতৃস্থানীয় কোন লোক জানাযায় অংশগ্রহণ করবে না। যেন অন্যরা তা দেখে শিক্ষাগ্রহণ করে এবং এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকে। হযরত জাবের ইবনে সামুরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি ধারালো বস্তু দিয়ে আত্মহত্যা করল, তার ব্যাপারে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
«أَمَّا أَنَا فَلَا أُصَلِّيْ عَلَيْهِ».
আমি এর জানাযা পড়বো না। [সুনানে নাসায়ী: ১৯৬৩, ফতওয়ায়ে শামী: ৩/১২৭, ফতওয়ায়ে বাযযাযিয়া: ১/৫২, আল-বাহরুর রায়েক: ২/৩৫০ শরহুল মুনিয়া: ৫৯১, খুলাসাতুল ফতওয়া: ১/২১৭, ফতহুল মুলহিম: ২/৫১২]
মুআমালা-লেনদেন
সমস্যা: আমাদের চট্টগ্রাম শহরের কিছু দোকানে চোরাই মোবাইল, মেমোরি কার্ড, চার্জার ইত্যাদি স্বল্প মূল্যে বিক্রি করা হয়। মানুষ জেনে-শুনেই স্বল্প মূল্যে উপরোক্ত পণ্যগুলো ক্রয়ের জন্য সেখানে যায়। আমার কিছু বন্ধুর পীড়াপীড়িতে আমিও সেখান থেকে একটি মোবাইল কিনতে চাচ্ছি। এখন প্রশ্ন হল, জেনে শুনে চোরাই মোবাইল বা অন্য কোনো পণ্য ক্রয় করা যাবে কি? দলিল-প্রমাণসহ জানিয়ে উপকৃত করবেন।
আম্মার
শিকলবাহা, পটিয়া।
সমাধান: চোরাই মাল ক্রয়-বিক্রয় করা সম্পূর্ণ হারাম। কারণ বিক্রেতা এ মালের মালিক নয়। অথচ ক্রয়-বিক্রয়ের প্রধান শর্ত হলো, বিক্রেতা পণ্যের ও সম্পদের মালিক হওয়া। কারো কোনো জিনিস চুরি করা বা আত্মসাৎ করা মহাপাপ। এ পাপে লিপ্ত ব্যক্তির তাৎক্ষণিক ফরজ হলো, খাঁটি দিলে তওবা করা এবং চুরিকৃত জিনিসটি মালিককে ফেরত দেওয়া। তা না করে এটিকে বিক্রি করে দেওয়া চুরি এবং আত্মসাতের মতো অপরাধকে আরও প্রতিষ্ঠিত করার নামান্তর। যা স্বতন্ত্র কবীরা গুনাহ। আর যে ব্যক্তি জেনে-শুনে তা ক্রয় করল সেও এ কবীরা গুনাহে শরিক হলো। উপরন্তু এ ক্রয়-বিক্রয় যেহেতু ভুয়া তাই না ক্রেতা এ পণ্যের মালিক হবে না বিক্রেতা মূল্যের মালিক হবে। এদের উভয়ের ওপর ফরজ, পণ্য মূল মালিককে ফেরৎ দেওয়া। [মুসান্নাফে ইবনে আবু শায়বা, হাদীস: ২২৪৯৬, বাদায়িউস সানায়ি ৬/৫০২ আল-বাহরুর রায়িক: ৫/৪৩৩, আদ-দুররুল মুখতার ৬/১৭৪]
সমস্যা: একটি মাল নগদ মূল্যে ক্রয় করলে যে মূল্য নেওয়া হয় কিস্তিতে তা ক্রয় করলে তার চেয়ে বেশি মূল্য নেওয়া হয়। এরূপ ক্রয়-বিক্রয় শরীয়তসম্মত কি না? জমি, ফ্ল্যাট ইত্যাদি এই পদ্ধতিতে ক্রয়-বিক্রয় করা শরীয়তসম্মত হবে কি না?
মীযানুর রহমান
জিরি, চট্টগ্রাম।
সমাধান: হ্যাঁ, নগদ মূল্যের তুলনায় কিস্তিতে বিক্রির ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি দাম নেওয়া জায়েয আছে। তবে এক্ষেত্রে বাকির মেয়াদ এবং পণ্যের মূল্য চুক্তির সময়ই নির্ধারণ করে নিতে হবে। আর পণ্য নগদে হস্তান্তর করতে হবে। উভয়টি বাকি রাখা যাবে না। এছাড়া কিস্তি আদায়ে বিলম্ব হলে চুক্তির সময় যে মূল্য ধার্য করা হয়েছিল তার চেয়ে দাম বাড়িয়ে নেওয়া জায়েয হবে না।
উল্লেখ্য যে, জমি এবং তৈরি ফ্ল্যাটও কিস্তিতে কেনা জায়েয। তবে এগুলোর ক্ষেত্রে অনেক সময় বিক্রেতার বা ক্রেতার পক্ষ থেকে শরীয়ত পরিপন্থী শর্তাবলিও আরওপ করা হয়ে থাকে। তাই এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয় করতে হলে বিজ্ঞ আলেম থেকে এর শর্তাবলি সুনির্দিষ্টভাবে জেনে নেওয়া আবশ্যক।
হযরত শুবা ইবনুল হাজ্জাজ (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হাকাম ইবনে উতাইবা এবং হাম্মাদ ইবনে আবু সুলাইমকে এক ক্রেতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, সে অন্যের থেকে পণ্য ক্রয় করে আর বিক্রেতা তাকে বলে যে, নগদ মূল্যে কিনলে এত টাকা আর বাকিতে কিনলে এত টাকা। (এতে কোনো অসুবিধা আছে কি?) তারা উভয়ে বললেন, ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে যদি (মজলিস ত্যাগ করার পূর্বে) কোনো একটি মূল্য চূড়ান্ত করে নেয় তাহলে এতে কোনো অসুবিধা নেই। [মুসান্নাফ ইবনে আবু শায়বা, হাদীস: ২০৮৩৬, জামে তিরমিযী: ১/২৩৩, মাবসূত ১৩/৮, রদ্দুল মুহতার: ৫/১৪২, বুহূস ফী কাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুআসিরা: ১/৭-৮]
ইজারা-ভাড়া
সমস্যা: চট্টগ্রাম বা ঢাকা শহরে যাওয়ার উদ্দেশে অনেক সময় গাড়িতে উঠা হয়। এক্ষেত্রে অনেক সময় দীর্ঘ জ্যাম পড়ে যায়। তখন গাড়ি থেকে নেমে কিছু দূর হেটে অন্য একটি গাড়িতে উঠি। এখন জানার বিষয় হলো, গন্তব্যে পৌঁছার আগে যদি কোন কারণে গাড়ি থেকে নেমে যান তখন ভাড়া কীভাবে দিবো? পূর্ণ ভাড়া দিবো না অর্ধেক?
মুহাম্মাদ হাসান জামিল
গাঠিয়াডাঙ্গা, সাতকানিয়া
সমাধান: পথে লোক নামায় এবং ওঠায় এমন লোকাল বাস না হলে পুরো টাকাই দিতে হবে। কিন্তু যদি লোকাল বাস হয় যাতে পূর্বে ভাড়া ঠিক হয়ে গেলেও পথে নামার সুযোগ থাকে এবং গন্তব্য অনুযায়ী ভাড়া কম-বেশি নেওয়া হয়, তাহলে এক্ষেত্রে যতদূর এসেছে সে অনুযায়ী ন্যায্য ভাড়া দেওয়া জরুরি। যদি তা অর্ধেকের বেশি হয় তবে তাই দিতে হবে। এক্ষেত্রে পূর্ব নির্ধারিত ভাড়ার অর্ধেক দেওয়া যাবে না। অবশ্য পুরো টাকাও দিতে হবে না। [আল-আশবাহ ওয়ান নাযায়ির: ৩৬০, আল-মুহীতুল বুরহানী ৯/৮৮ ও ৯০, ফতওয়া খানিয়া: ২/২১৫, ও ২২২, ফতওয়া হিন্দিয়া: ৪/৪৪৩, ৪৫৮, শরহুল মাজাল্লাহ, খালেদ আতাসী: ২/৫৫৯, মাদ্দাহ: ৪৭০ ও ২/৬৩৮, শরহুল মাজাল্লাহ, সলীম রুসতুম: ১/২৬৩, আদ-দুররুল মুখতার ৬/১০–১১]
সমস্যা: আমাদের দেশে অনেক মসজিদে ইমাম সাহেবকে দোয়ার জন্য টাকা দেওয়া হয়। যেমন বলে, হুযুর আমার ছেলে বিদেশ যাবে তার জন্য একটু দোয়া করবেন। এই বলে কিছু টাকা দেয়। এই টাকা নেওয়া জায়েজ হবে? কেউ কেউ বলেন, এই টাকা নেওয়া নাজায়েয। আবার কেউ কেউ বলেন, যদি খতমে শেফা বা বরকতের জন্য ঘরে বা দোকানে খতমে কুরআন পড়ে টাকা নেওয়া জায়েয হয় তাহলে এই টাকা জায়েয হবে না কেন? বিস্তারিত জানালে কৃতজ্ঞ থাকব।
মামুনুল্লাহ
মীরসরাই, চট্টগ্রাম।
সমাধান: হাদিয়ার একটি আদব হল, সব ধরনের বিনিময় ও উদ্দেশ্য থেকে মুক্ত হওয়া। তা হবে শুধু মহব্বত ও ইকরাম হিসেবে একমাত্র আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য। হাদিয়া প্রদান করে দোয়া চাওয়ার প্রচলনটি আসলেই সংশোধনযোগ্য। তবে হাদিয়া প্রদান করে দোয়া চাইলে এর অর্থ হয় না যে, হাদিয়াটি দোয়ার বিনিময় হিসেবে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে কারো নিয়ত যদি বাস্তবেই এমন হয়ে থাকে তাহলে তা খুবই আপত্তিকর। কারণ দোয়ার কোনো বিনিময় হয় না। দোয়া খালেস ইবাদত। তা দুনিয়ার জন্য হোক বা আখেরাতের জন্য সেটি ইবাদত। তাই দোয়ার বিনিময় হিসেবে কোনো কিছু নেওয়া যাবে না।
আর দুনিয়াবি বৈধ উদ্দেশ্যে খতম ইত্যাদি পড়ে পারিশ্রমিক নেওয়া জায়েয হওয়ার কথা ফিকহের কিতাবে উল্লেখ রয়েছে। সেটির সাথে দোয়ার বিনিময়কে তুলনা করা ঠিক নয়। দোয়া করে পারিশ্রমিক নেওয়া বৈধ হওয়ার কথা কেউ বলেননি।
দোয়া মুসলমানগণ একে অপরের জন্য বিনিময়হীনভাবেই করে থাকে এবং তাই করা উচিত। [জামে তিরমিযী: ৩৩৭২, বাযলুল মাজহুদ: ৭/২০০, মাজমুউ রাসায়িলি ইবনি আবিদীন: ১/১৫৬, রদ্দুল মুহতার: ২/৫৯৬, ইমদাদুল ফতওয়া: ৩/৩৩৪]
হেবা-মীরাস
সমস্যা:
- বিয়ের পূর্বাপর কোনো রকম দাবি-দাওয়া ছাড়া যেসব আসবাবপত্র ব্যবহারের জন্য স্ত্রীর বাপের বাড়ির পক্ষ হতে দেওয়া হয় তার প্রকৃত মালিক কে?
- বিয়ের সময় উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে মহরে ফাতেমী ধার্য করা হয়। মহর আদায়ে আমার আর্থিক পূর্ণ প্রস্তুতি না থাকায় কিছু স্বর্ণ অলঙ্কার আমার পিতা-মাতার কাছ থেকে পরবর্তীতে স্বর্ণ কিনে দেওয়ার সময় পর্যন্ত অস্থায়ীভাবে ব্যবহার করার জন্য স্ত্রীকে দিই এবং মৃত্যু অবধি তা তার কাছে ছিল।
এখন আমার জানার বিষয় হলো, আমার স্ত্রীর মহরানা কিভাবে আদায় করব? যেকোনভাবে মহরে ফাতেমীর সমপরিমাণ মূল্য আদায় করলে হবে? যদি মহরে ফাতেমী আদায় করতে হয় তাহলে কোন সময়ের (অর্থাৎ বর্তমান মহরে ফাতেমীর মূল্য না বিয়ের সময়ের) মূল্য আদায় করতে হবে?
মাওলানা মুহাম্মদ আবু বকর
সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম।
সমাধান:
- বিয়ের সময় কোনো রকম দাবি-দাওয়া ব্যতীত স্ত্রীর বাবার বাড়ি থেকে স্বামী-স্ত্রীর সংসারে ব্যবহারের জন্য যে আসবাবপত্র দেওয়া হয়, দেশীয় প্রচলন হিসেবে সেসব আসবাব পত্রের মালিক স্ত্রী। স্বামী এবং স্বামীর পরিবারের কেউ সেসব আসবাব পত্রের মালিক নয়। সুতরাং স্ত্রীর মৃত্যুর পর সেসব আসবাবপত্র তার ওয়ারিসদের মাঝে শরয়ী মীরাস নীতি অনুযায়ী বণ্টন করতে হবে। [ফতওয়া শামী: ৩/১৫৮]
- প্রশ্নের বিবরণ থেকে বুঝা যায় যে, আপনার বিয়ের সময় মহরে ফাতেমী নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে সেই সময় মহর আদায় করেননি। তা বাকি রেখে দেওয়া হয়েছিল। ব্যবহারের জন্য কিছু স্বর্ণালঙ্কার তাকে দেওয়া হয়েছিল। যদি বিষয়টি এমন হয়ে থাকে তাহলে এখন তার মহরানা বাবদ বর্তমান (অর্থাৎ যখন আদায় করবেন) মহরে ফাতেমীর যে মূল্য হয় সেটিই আদায় করতে হবে। যা বর্তমান রুপার বাজার মূল্য হিসেবে ১৩১ তোলা রুপা অথবা তার মূল্য। [বাদায়িউস সানায়ি: ২/২২, আল-মাউসূআতুল ফিকহিয়া কুয়িতিয়া: ৩৯/১৬০]
সমস্যা:
- এক ব্যক্তি ১৩/১৪ বছর আগে তার ভাই ও ভাইয়ের ছেলেদের কাছে একটি জায়গা বিক্রি করেছেন। বিক্রি হয়েছে মৌখিকভাবে এবং টাকাও নিয়েছেন। বলেছিলেন, তার আর কোনো দাবি নেই এবং কাগজপত্র প্রস্তুত করে আনলে লিখিতভাবেও দিয়ে দেবেন একথাও বলেছিলেন। উক্ত জায়গার ওপর উনার ভাই ও ভাইয়ের ছেলেরা বাড়িও করেন। সেসময় তিনি কোন প্রকার বাধা দেননি এবং টাকাও দাবি করেননি। কিন্তু গত কয়েক বছর থেকে তিনি হঠাৎ টাকা দাবি করে বসেন এবং বলেন যে, তিনি যেহেতু লিখিত দেননি তাই এই জায়গার মালিক তিনি নিজেই। তাই তিনি তার আপন ভাই ও ভাইয়ের ছেলেদের হুমকি ধমকি ও নানারকমভাবে হয়রানি করে যাচ্ছেন। নিরীহ ভাই ও ভাইয়ের ছেলেদের কষ্ট দিচ্ছেন। এখন প্রশ্ন হলো, শরীয়তের দৃষ্টিতে এই জায়গার মালিক কে হবেন? তিনি এতদিন পর এসে টাকা ও ঘর দাবি করতেছেন। হয়রানি ও মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন। তাঁর পরিণতি কী হবে?
- জনৈক ব্যক্তি নিঃসন্তান এবং তার স্ত্রীও মারা গেছেন। তার একটা পালক কন্যা আছে। তিনি তার সমস্থ সম্পত্তি পালক কন্যাকে লিখিতভাবে দিয়ে দিছেন। অথচ তার আপন ভাই ও বোন এবং তাদের সন্তানও রয়েছে। শরীয়তের দৃষ্টিতে এই সম্পদ কারা পাবে?
- ওয়াকফ আলাল আওলাদের সম্পদের ডিডের মধ্যে জমি বিক্রি করতে নিষেধ করা হয়েছে। এক ব্যক্তি মসজিদের উন্নয়নের নামে ওয়াকফ এস্টেট থেকে অনুমতি নিয়ে জমি বিক্রি করেছেন। ওই টাকা দিয়ে মসজিদের উন্নয়ন না করে নিজের জন্য গাড়ি-ফ্ল্যাট ক্রয় করে ভোগ করতে থাকেন। আর সেই টাকা দিয়ে কেনা গাড়ি ফ্ল্যাট সব তিনি নিজের পালক কন্যাকে মালিক বানিয়ে দেন। এটি কি ঠিক হয়েছে? শরীয়তের দৃষ্টিতে জবাব দিলে খুশি হবো।
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ
চকবাজার, চট্টগ্রাম।
সমাধান:
- লিখিত দলীলপত্র না করলেও শুধু মৌখিক প্রস্তাব ও কবুলের মাধ্যমে শরীয়তে ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন হয়ে যায়।ক্রয় বিক্রয় সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর প্রত্যেকেই একে অপরকে হক বুঝিয়ে দেওয়া ওয়াজিব। এরপর এক পক্ষ অপর পক্ষ থেকে অতিরিক্ত কোন কিছু দাবি করা সম্পূর্ণ অবৈধ ও জুলুম। সুতরাং উল্লিখিত ঘটনায় লিখিত দলীলপত্র নাকরার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ক্রেতা থেকে বিক্রেতা টাকা, ফ্ল্যাট ইত্যাদি দাবি করা চরম অন্যায় ও জুলুম। তা কোনভাবেই তার জন্য বৈধ নয়। [সূরা আন-নিসা: ২৯, মাজমাউল আনহুর: ২/৪৪৩, আললুবাব ফি শরহিল কিতাব: ২/৪]
- প্রকৃত ওয়ারিসদেরকে সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে কাউকে অন্যায়ভাবে সম্পদ দান করে দেওয়া সম্পূর্ণ অবৈধ ও জুলুম। হাদীস শরীফে তার ব্যাপারে কঠিন ধমক এসেছে। রসুলে করীম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ওয়ারিসদেরকে সম্পদ থেকে বঞ্চিত করবে আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতের ওয়ারিস হওয়া থেকে বঞ্চিত করবে। তবে যদি কোনো ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় তার ধন-সম্পদ কাউকে দান করে অতঃপর তা তাকে বুঝিয়ে দেয় এবং তার ভোগ দখলেও দিয়ে দেয়, তাহলে উক্ত ব্যক্তি সেই সম্পদের মালিক হয়ে যাবে। সে হিসেবে প্রশ্নোক্ত ব্যক্তি যদি তার পালক কন্যাকে তার জীবদ্দশায় সম্পদ দান করে তা তাকে বুঝিয়ে দেয় এবং তার ভোগ দখলেও দিয়ে দেয়, তাহলে উক্ত পালক কন্যা তার দানকৃত সকল সম্পদের মালিক হয়ে যাবে। আর যদি দান করার পর তার ভোগ দখলে না দেয় তাহলে দান সম্পন্ন হবে না এবং সে সেই সম্পদের মালিক হবে না। [সুনানে ইবনে মাজাহ: ২৭০৩, মাজাল্লাতুল আহকামিল আদলিয়া: মাদ্দা: ৫৭, ফতওয়া হিন্দিয়া-৪/৩৯৯, রদ্দুল মুহতার: ৫/৬৯৬]
- ওয়াকফকারী যেহেতু ওয়াকফনামায় ওয়াকফকৃত জায়গা বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন তাই উক্ত জায়গা বিক্রি করা জায়েয ও বৈধ হয়নি। আর বিক্রি করার পর যে কাজের কথা বলে বিক্রি করা হয়েছে সে কাজে ব্যবহার না করে নিজের নামে গাড়ি-বাড়ি ক্রয় করে তার পালক কন্যাকে দিয়ে দেওয়া চূড়ান্ত পর্যায়ের অন্যায় হয়েছে। উক্ত ব্যক্তি ওয়াকফের সম্পদ আত্মসাৎকারী হিসেবে বিবেচিত হবে। সেই পালক কন্যা উক্ত সম্পদের মালিক হবে না। তা ভোগ করা তার জন্য কোনোভাবেই বৈধ নয়। বরং তা ফিরিয়ে দেওয়া তার ওপর ওয়াজিব। [জামে তিরমিযী: ১৩৭৫, দুরারুল হুক্কাম: ২/১৬৯, ফতওয়া শামী: ৪/৩৯৬]