সমস্যা ও সমাধান
ফতওয়া বিভাগ
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
মোবাইল: 01856-618367
ইমেইল: daruliftapatiya@gmail. com
পেইজলিংক: Facebook. com/Darul-ifta-Jamia-Patiya
তহারাত-পবিত্রতা
সমস্যা: শীতকালে আমার হাত-পা অনেক বেশী ফেটে যায়। পানি লাগলে অনেক বেশী কষ্ট হয়। এ অবস্থায় আমি অজু কীভাবে করব? জানালে উপকৃত হব ।
হাফেজ রিয়াদুল ইসলাম
বাকলিয়া, চট্টগ্রাম।
সমাধান: উল্লিখিত অবস্থায় যদি ক্ষতস্থানে পানি পৌঁছানো বেশি পীড়াদায়ক হয় কিংবা পানি পৌঁছালে রোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দেয়, তাহলে ফেটে যাওয়া অংশে পানি না পৌঁছিয়ে ওই স্থানে ভেজা হাত দিয়ে মুছে নিলেই চলবে। অবশিষ্ট অংশ এবং অজুর অন্যান্য অঙ্গ ধুয়ে নেবে। আর যদি ক্ষতস্থানে মাসাহ করাও সম্ভব না হয়, তাহলে ওই অংশ ছাড়া বাকি অংশ ও অন্যান্য অঙ্গ ধুয়ে নেবে। [রদ্দুল মুহতার: ১/২২৮, আল-ফতওয়াস সমরকন্দিয়া ১/৪৬, ফতহুল কদীর ১/১৬১, আল-মুহীতুল বুরহানী: ১/২০৭]
সমস্যা: আমি ফটোস্ট্যাট দোকানে কাজ করি। বিভিন্ন রকম ডকুমেন্টস ইত্যাদি ফটোকপি ও লেমিনেটিং করে থাকি। অনেক সময় কুরআনের আয়াত লিখিত কাগজও লেমিনেটিং করতে হয়। কিন্তু সবসময় তো অজু অবস্থায় থাকি না। মুফতি সাহেবের কাছে জানার বিষয় হলো, এ অবস্থায় কুরআনের আয়াত লিখিত লেমিনেটিং করা কাগজ অজু ছাড়া স্পর্শ করা যাবে কি না? দলিলসহ জানিয়ে বাধিত করবেন।
মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম
রামু, কক্সবাজার।
সমাধান: কুরআনের আয়াত লিখিত কাগজ লেমিনেটিং করা হলেও আয়াত বা সূরা সরাসরি স্পর্শ করা জায়েয হবে না। তবে যেসব কাগজে অন্য লেখার মাঝে কুরআনের আয়াত লেখা থাকে সেই কাগজের যে অংশে কুরআনের আয়াত লেখা থাকে তা ব্যতীত অন্য অংশে স্পর্শ করা যাবে। আর যে কাগজে শুধুমাত্র কুরআন শরীফের আয়াতই লেখা থাকে তার সাদা অংশেও অজু ছাড়া স্পর্শ না করা উচিত। অন্যথায় আলাদা কোন আবরণ বা কাপড় ইত্যাদির মাধ্যমে স্পর্শ করবে। [সূরা আল-ওয়াকিয়া: ৭৯, মুয়াত্তা মালেক: ৪৭০, মুসন্নাফে আবদুর রযযাক: ১৩২৮, আস-সুনানুল কুবরা-৪০৯, ফতহুল ক্বদীর: ১/১৭২, ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/৯৩, বাহরুররায়িক: ১/৩৪৮-৩৪৯, রদ্দুল মুখতার: ১/৩৪৮, হাশয়িাতুত তাহতাবী: ১৪৩-১৪৮]
সালাত-নামাজ
সমস্যা: মহিলারা জামায়াতের সাথে নামাজ পড়লে আযান ও ইকামাতের কী হুকুম?
জান্নাতুল মাওয়া
রংপুর।
সমাধান: মহিলাদের জন্য জামায়াতে নামাজ পড়া মকরুহ, তা সত্ত্বেও যদি তারা জামায়াতে নামাজ পড়ে তাহলে নামাজের পূর্বে আযান-ইকামত বলবে না। আযান-ইকামতের হুকুম পুরুষদের জন্য। মহিলাদের জন্য আযান-ইকামত ছাড়াই নামাজ পড়া উত্তম। [আস-সুনানুল কুবরা: ১৯২০, কিতাবুল আসল: ১/১১১, আদ-দুররুল মুখতার: ২/৭২, বাদায়িউস সানায়ি: ১/৪৭৮, ফতহুল কদীর: ১/২৫৭, মাবসূতুস সারাখসী: ২/২৭৭]
সমস্যা: কিছু দিন আগে আমরা কয়েকেজন মিলে সিলেট সফরে গিয়েছিলাম। পথিমধ্যে নামাজের সময় হলে আমরা নামাজ পড়ার জন্য যাত্রাবিরতি করি। তখন আমাদের মাঝে সুন্নত পড়া নিয়ে মতানৈক্য দেখা দেয়। কেউ কেউ বলে, সফরে সুন্নত পড়তে হয় না। আর কেউ কেউ বলে, না, সফরেও সুন্নতে মুয়াক্কাদা পড়তে হয়। এখন জানার বিষয় হলো, সফরে সুন্নত পড়ার বিধান কী?
মুহাম্মদ বোরহান উদ্দিন
পুইঁছড়ী, বাঁশখালী।
সমাধান: মুকিম অবস্থার তুলনায় সফর অবস্থায় সুন্নত নামাজে কিছুটা শিতিলতা রয়েছে। তাই সফর অবস্থায় চলন্ত পথে তাড়াহুড়ার সময় সুন্নত নামাজ ছেড়ে ভালো। কিন্তু সফরের শান্তিপূর্ণ অবস্থায় সুন্নত পড়াই উত্তম। বিশেষত ফযরের সুন্নত সফর অবস্থায়ও অধিক গুরুত্ব রাখে। সুতরাং সফর অবস্থায় সুন্নত নামাজ পড়া যাবে না ঢালাওভাবে এমন মনে করা ঠিক নয়। [মুসান্নাফে ইবনে আবু শায়বা: ১/৪১৬, বাদায়িউস সানায়ি: ১/৩১০, রদ্দুল মুখতার: ২/৭৩৭, আল-বাহারুর রায়িক: ২/২২৯, ফতওয়া কাজী খান: ১/১৫২, ফতওয়া তাতারখানয়িা: ২/৪৮৯]
যাকাত-সদকা
সমস্যা: যাকাত প্রদানকালে ব্যক্তিকে যাকাতের কথা জানিয়ে দেওয়া জরুরি কি না? ঈদের দিন অনেক গরীব-মিসকিন বখশিশ চায়, তাদেরকে বখশিশস্বরূপ যাকাতের টাকা দেওয়া যাবে কি?
মুঈনুল ইসলাম
নাসিরাবাদ, চট্টগ্রাম।
সমাধান: যাকাত প্রদানের সময় গ্রহীতাকে যাকাতের বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া জরুরি নয়। এক্ষেত্রে দাতার নিয়তই যথেষ্ট। অতএব যাকাতের যোগ্য কেউ বখশিশ চাইলে তাকে না জানিয়ে যাকাতের টাকা প্রদান করলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু নিজ গৃহের কর্মচারী বা অধীনস্ত কর্মচারীদেরকে যাকাতের টাকা ঈদ বোনাস হিসেবে দেওয়া যাবে না। কারণ সেগুলো তাদের পারিশ্রমিকেরই অংশবিশেষ। অবশ্য কর্মচারীকে তার নির্ধারিত বেতন ও বোনাস দেওয়ার পর গরিব হওয়ার কারণে যাকাত থেকে কিছু দিতে চাইলে তা জায়েয হবে। [আল-বাহরুর রায়িক: ২/২১২, আদ-দুররুল মুখতার: ২/২৬9, আল-হাদিয়াতুল আলাইয়া: ১৫৫]
সমস্যা: আমি ব্যাংক থেকে সুদে-আসলে ১৪ লক্ষ টাকা এবং অন্যভাবে সুদবিহীন অন্য খাত থেকে তিন লক্ষ টাকা, মোট ১৭ লক্ষ টাকা কর্জগ্রস্ত হই। বর্তমান সম্পত্তির বিবরণ:
- আমার মালিকানায় প্রায় তিন লক্ষ টাকা মূল্যের একটি গাড়ি আছে। যা দ্বারা নিজের পরিবারের ব্যয়ভার বহন করি।
- পিতার মৃত্যুর পর পৈতৃক সূত্রে কিছু জায়গা ও বসত বাড়ির মালিক হবো। বর্তমান বাজারে বিক্রি করলে কোন রকম কর্জ শোধ হবে। কিন্তু পারিবারিকভাবে বণ্টন না হওয়ার কারণে এখনো আমার হস্তগত হয়নি। যার ফলে তা বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। এখন প্রশ্ন হলো, আমার ভাই আমার প্রতি সদয় হয়ে তার যাকাতের টাকা দিয়ে যদি আমার কর্জ শোধ করে, তাহলে তার যাকাত আদায় হবে কিনা? শরয়ী সমাধান চাই।
জনাব কামাল হোসেন
সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম।
সমাধান: প্রয়োজনীয় সম্পদ অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, উপার্জনের মাধ্যম (যার ওপর নিজ ও পরিবারের জরুরি খরচ নির্ভর করে) এবং ঋণ বাদ দিয়ে যদি আপনার মালিকানায় নেসাব পরিমাণ সম্পদ (বর্তমান মূল্য ৬০-৭০ হাজার টাকা) না থাকে, তাহলে আপনার ভাই যাকাতের টাকা দ্বারা আপনার পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ করে দিলে তার যাকাত আদায় হয়ে যাবে, তবে তা আপনার অনুমতি ও অবগতির মাধ্যমেই হতে হবে। অন্যথায় যাকাত আদায় হবে না। [রদ্দুল মুহতার: ২/৩৪৩ ও ১৭১, ফতহুল কদীর: ৪/১৯৫, আল-বাহরুর রায়িক: ২/৪২২]
রোজা-ইতিকাফ
সমস্যা: আমি একজন শ্বাসকষ্টের রোগী। শীত-গ্রীষ্ম সারা বছর আমাকে ইনহেলার ব্যবহার করতে হয়। রাতে এবং দিনে মোট চার বার ইনহেলার নিতে হয়। তাই জানতে চাই, ইনহেলার নেওয়ার দ্বারা রোজার কোনো ক্ষতি হবে কি না? যদি রোজা ভেঙে যায় তাহলে আমার কী করণীয়? জানালে কৃতজ্ঞ হব।
আযীযুল্লাহ
গাছবাড়িয়া, চন্দনাইশ।
সমাধান: রোজা অবস্থায় ইনহেলার ব্যবহার করলে রোজা ভেঙে যায়। তাই সাহরীর শেষ সময় এবং ইফতারের প্রথম সময় ইনহেলার ব্যবহার করলে যদি তেমন অসুবিধা না হয়, তবে রোজা অবস্থায় ইনহেলার ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা জরুরি। কিন্তু অসুস্থতা বেশি হওয়ার কারণে যদি দিনেও ব্যবহার করা জরুরি হয়, তাহলে তখন ব্যবহার করতে পারবে। সেক্ষেত্রে করণীয় হল:
- উক্ত ওজরে দিনের বেলা ইনহেলার করলেও অন্যান্য পানাহার থেকে বিরত থাকবে।
- পরবর্তীতে রোগ ভালো হলে এর কাযা করে নিবে।
- আর ওজর যদি আজীবন থাকে তাহলে ফিদিয়া আদায় করবে। [সূরা আল-বাকারা: ১৮৪, মাজমাউল আনহুর: ১/৩২২, রদ্দুল মুহতার: ২/৪২৭, মাজাল্লাতু মাজমায়িল ফিকহিল ইসলামী, সংখ্যা: ১০: ২/৩১-৬৫]
সমস্যা: আমার পিতা বার্ধক্যের দরুণ রোজা রাখার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছেন। জানতে চাই, তার ফিদিয়া আদায় করতে হবে কি না? আমার পিতার ওপর যাকাত ফরজ নয়। তিনি খুব একটা স্বচ্ছল নন। এ অবস্থায় কি তাকে ফিদিয়া আদায় করতে হবে? এক রোজার ফিদিয়া একাধিক ব্যক্তিকে দেওয়া জায়েয হবে কি না?
আদনান
রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।
সমাধান: হ্যাঁ, তাকে রমজানের প্রত্যেক রোজার পরিবর্তে ফিদিয়া আদায় করতে হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর যাদের রোজা রাখার সামর্থ্য নেই তারা একজন মিসকিনের খানা সমপরিমাণ ফিদিয়া দেবে।’ (সূরা আল-বাকারা: ১৮৪) এমন ব্যক্তির ওপর যাকাত ফরজ না হলেও ফিদিয়া দিতে হবে। কারণ ফিদিয়া দেওয়ার জন্য নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা জরুরি নয়। আর এক রোজার ফিদিয়া একাধিক ব্যক্তিকেও দেওয়া যায়। তবে একজনকে দেওয়া উত্তম। [আল-বাহরুর রায়িক: ২/৫০১, রদ্দুল মুহতার: ২/৪২৭]
কসম-মান্নত
সমস্যা: আমি একটি অপরাধমূলক কাজ করব না বলে এভাবে কসম করি যে, আল্লাহর কসম আমি আর এই কাজ করব না। কিন্তু পরে তা রক্ষা করতে পারিনি। সেই কাজটি আমার থেকে আবার সংঘটিত হয়ে যায়। এখন প্রশ্ন হল, আমি কসম ভঙ্গকারী হয়েছি কি না? হলে কাফফারা কীভাবে আদায় করবো?
আবদুল আহাদ
উখিয়া, কক্সবাজার।
সমাধান: প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে কসম ভঙ্গ করার কারণে আপনাকে কাফফারা আদায় করতে হবে। আর কসমের কাফফারা হল, দশজন গরীব মিসকিনকে তৃপ্তিসহ দুই বেলা খানা খাওয়ানো। অথবা তাদের প্রত্যেককে এক জোড়া করে কাপড় দেওয়া। এ দুটির সামর্থ্য না থাকলে এক নাগাড়ে তিনটি রোজা রাখা।
প্রকাশ থাকে যে, গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার সংকল্পের ক্ষেত্রে বান্দার দায়িত্ব হল, কসম না করে বরং আল্লাহ তাআলার প্রতি মুতাওয়াজ্জুহ হওয়া এবং তার তওফিক কামনা করা, কোনো আল্লাহঅলা বুজুর্গের সংস্রব অবলম্বন করা ও বেশি বেশি দোয়া করতে থাকা। [সূরা আল-মায়িদা: ৮৯, কিতাবুল আসল: ২/২৮১ ও ৩/১৯৭, মাবসূতুস সারখসী ৮/১৫৭, ইলাউস সুনান ১১/৪২৬, রুহুল মাআনী: ৭/১৪]
সমস্যা: পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার জন্য মান্নত করা কি জায়েয আছে? কেউ যদি কোনো আশা পূর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্যে বলে, আমি এ পরিমাণ টাকা মসজিদ, এতিমখানা অথবা কোনো গরীব মানুষকে দেব। তার একথা কি শরীয়তসম্মত হবে?
মোয়ায
চুনতি, লোহাগাড়া
সমাধান: কোনো বৈধ আশা পূর্ণ হওয়ার মান্নত করা জায়েয আছে। তাই পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার জন্য মান্নত করা যাবে এবং পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলে তা পূর্ণ করতে হবে।
তবে মান্নত সহীহ হওয়ার জন্য কছিু শর্ত রয়ছে। সেসব শর্তের আলোকে মসজিদের জন্য মান্নত করা সহীহ নয়। তাই মসজিদের জন্য মান্নত করলে তা ওয়াজিব হয় না। তবে মান্নত না হলেও এ ধরনের ওয়াদা পূর্ণ করা উত্তম।
উল্লেখ্য যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে মান্নতের চেয়ে নগদ দান-সদকার ফযীলত ও গুরুত্ব অনেক বেশি। সদকা দ্বারা আল্লাহ অধকি সন্তুষ্ট হন। আর মান্নত শরীয়তসম্মত। তবে সদকার চেয়ে উত্তম নয়। হাদীসে আছে, মান্নত দ্বারা কৃপণের মাল বের হয় অর্থাৎ মান্নত কৃপণ লোকের কাজ।
হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রসুলে করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, মান্নত এমন কোনো কিছুকে আদম সন্তানের নিকটবর্তী করে দিতে পারে না যা আল্লাহ তাআলা তার জন্য তাকদীরে নির্দিষ্ট করেননি। তবে মান্নত কখনো তাকদীররে সাথে মিলে যায়। এর মাধ্যমে কৃপণের নিকট হতে সেই সম্পদ বের করে নিয়ে আসা হয় যা কৃপণ থেকে মান্নত ছাড়া বের হতে চায় না। [সহীহ মুসলিম: ১৬৪০] অতএব কাঙ্ক্ষিত বস্তু অর্জনের জন্য মান্নত করা জায়েয। তবে মান্নত করা ছাড়া সার্মথ্য অনুযায়ী পূর্বেই দান-খয়রাত করা অধিক উত্তম কাজ। [সূরা আল-হজ: ২৯, আল-ইখতিয়ার: ৩/৪৪৫, আল-মুগনী ১৩/৬২১, বাদায়িউস সানায়ি: ৪/২৪১ ও ৪/২২৮, মিনহাতুল খালিক: ৪/২৯৬]
নিকাহ-তালাক
সমস্যা: গত বুধবার আমাদের এলাকার মসজিদে আমার ছোট বোনের বিয়ের আকদ হয়। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমার চাচা আমার ছোট বোন থেকে ইযিন নিয়ে যান। এ সময় সেখানে শুধু আমার বোন ছিলেন। আকদের পূর্বে ছেলে পক্ষের কয়েকজন মুরুব্বি বলে উঠলেন, বিয়ে সংঘটিত হওয়ার জন্য ইযিন নেওয়ার সময়ও সাক্ষীদের উপস্থিত থাকা জরুরি। উপস্থিত এক মুরুব্বি আলেম তাদেরকে কিছু বললে তাতে তারা শান্ত হন। এরপর বিয়ে হয়। এছাড়াও এটা জরুরি কি না এ নিয়ে অনেক সময় বিয়েতে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এখন জানতে চাচ্ছি, বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার জন্য ‘ ইযিন’ নেওয়ার সময় সাক্ষীদের উপস্থিতি জরুরি কি না?
শরীফুল ইসলাম
ফেনী, বসুরহাট।
সমাধান: বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার জন্য আকদের মজলিসে ইজাব কবুলের সময় সাক্ষীদের উপস্থিতি জরুরি। কনে থেকে সম্মতি নেওয়ার সময় কোনো সাক্ষী রাখা আবশ্যক নয়।
উল্লেখ্য যে, শরীয়তের কোনো বিষয়ে না জেনে কথা বলা মারাত্মক অন্যায়। [বাদায়িউস সানায়ি: ২/৫২৯, ফতহুল কদীর: ৩/১১০ আল-বাহরুর রায়িক: ৩/১৫৫, ফতওয়া হিন্দিয়া: ১/২৬৯]
সমস্যা: আমাদের এক আত্মীয় তার মেয়েকে সৌদিপ্রবাসী এক ছেলের সাথে মোবাইলের মাধ্যমে বিয়ে দেয়। বিয়ের সময় উভয় প্রান্তে লাউড স্পিকারে অনেক লোক বিয়ের সাক্ষী ছিল। বর্তমান তাদের সন্তানও হয়েছে। জানার বিষয় হল, মোবাইলে তাদের এ বিয়ে সহীহ হয়েছে কি? আর না হলে বর্তমান সন্তানের হুকুম কী? জানালে উপকৃত হবো।
ইনজামুল হক
সাতকানিয়া, চরতি।
সমাধান: বিয়ে সহীহ হওয়ার জন্য একই মজলিসে সাক্ষীদের সম্মুখে উভয় পক্ষ কিংবা তাদের প্রতিনিধিগণের উপস্থিতিতে ইজাব-কবুল হওয়া জরুরি। আর মোবাইলে বা ফোনে বিয়েতে এ শর্ত পাওয়া যায় না, তাই প্রশ্নোক্ত বিয়ে সহীহ হয়নি। এভাবে প্রবাসে অবস্থানরত ব্যক্তি বিয়ে করতে চাইলে সঠিক পদ্ধতি হল, ছেলে এ দেশে তার পক্ষে বিয়ে সম্পন্ন করার জন্য একজন উকিল তথা প্রতিনিধি নিয়োগ করবে। সেই উকিল বিয়ের মজলিসে উপস্থিত হয়ে সাক্ষীদের সম্মুখে প্রবাসীর পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব কবুল করবে। এ নিয়মে করলে বিয়ে সহীহ হয়ে যাবে। তাই এখন তাদের করণীয় হল, অনতিবিলম্বে নতুন করে মহর ধার্য করে সাক্ষীগণের সম্মুখে বিয়ে কিরে নেওয়া। আর বিগত জীবনের জন্য আল্লাহর নিকট তাওবা-ইস্তিগফার করা। প্রকাশ থাকে যে, তাদের ওই সন্তানটি বৈধ এবং সে পিতা-মাতার মিরাসেরও হকদার হবে। [ফতওয়া হিন্দিয়া: ১/৩৩৬ ও ১/৩৬৯, আদ-দুররুল মুখতার: ৩/৫১৬, ফতওয়া তাতারখানিয়া: ৪/৩৬, মাজাল্লাতুল মাজমায়িল ফিকহিল ইসলামী]
ওয়াকফ
সমস্যা:
- আগে মসজিদ ছিল এমন জায়গার ওপর অজুখানা তৈরি করা জায়েয হবে কিনা?
- ৩০ বছর আগে কবর দেওয়া হয়েছিল এমন কবরস্থানের ওপর দিয়ে মসজিদের নতুন রাস্তা দিয়ে নির্মাণ করা জায়েয হবে কিনা?
উল্লেখ্য, এখানে মসজিদে আসা-যাওয়ার রাস্তা আগে অন্য দিক দিয়ে ছিল, তবে এখন কবরস্থানের ওপর দিয়ে নতুন রোড নির্মাণ করা হলে মসজিদ কমিটির সুবিধাজনক বেশি মনে হচ্ছে। এ ছাড়া আর কিছু নয়। আশাকরি দ্রুত উত্তর দিয়ে বাধিত করবেন।
ইয়াকুব
রামু, কক্সবাজার।
সমাধান:
- কোনো জায়গা শরয়ী মসজিদ হয়ে যাওয়ার পর তা সর্বদা মসজিদ হিসেবে বহাল থাকে। তা অন্য কাজে ব্যবহার করা এবং তাতে নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির, দীনী তালিম ইত্যাদি ইবাদত ব্যতীত অন্য কোনো কাজ করা নাজায়েয ও অবৈধ। অতএব প্রশ্নোক্ত জায়গাতে অজুখানা বানানো বৈধ হবে না।
- ওয়াকফিয়া কবরস্থানে কবর পুরাতন হলেও কবরের ওপর দিয়ে মুসল্লিদের আসা-যাওয়া জায়েয হবে না। [ফতওয়ায়ে শামী: ৪/৩৫৮, আল-বাহরুর রায়িক: ৫/৪২১]
সমস্যা: বর্তমানে আমাদের দেশের প্রায় মসজিদে নামাজের সময় ছাড়া অন্য সময় তালা মেরে রাখতে দেখা যায়। এ ব্যাপারে কোনো কোনো মসজিদ কর্তৃপক্ষ বলেন, সবসময় মসজিদ খোলা রাখলে মসজিদ ময়লা হয়ে যায় এবং মসজিদের আসবাবপত্র চুরি হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। মসজিদ বন্ধ থাকার কারণে অনেক সময় বিপদ-আপদে সালাতুল হাজত পড়তে চাইলে সম্ভব হয় না এবং সময় পেলে তিলাওয়াত বা ফাজায়েলে আমল কিংবা অন্যান্য দীনী বইপত্র পড়তে চাইলে পড়তে পারি না। মাননীয় মুফতী সাহেবের কাছে জানতে চাই, উল্লিখিত সমস্যার শরয়ী সমাধান কী? জানিয়ে বাধিত করবেন।
আমীনুল্লাহ
রামু, কক্সবাজার।
সমাধান: মসজিদ মুসলমানদের ইবাদতের স্থান ও দীন শিক্ষার অন্যতম জায়গা। মসজিদ শুধু নামাজের জন্য নয়; বরং যিকির-আযকার, কুরআন তিলাওয়াত ও দীনী তালিমের জন্যও বটে। হযরত আনাস ইবনে মালেক (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেন,
«إِنَّمَا هِيَ لِذِكْرِ اللهِ b وَالصَّلَاةِ وَقِرَاءَةِ الْقُرْآنِ».
অর্থাৎ মসজিদ হল নামাজ, যিকির ও কুরআন পড়ার জন্য। [সহীহ মুসলিম: ২৮৫]
তাই নিয়ম হল, ফরজ নামাজের সময় ছাড়াও মসজিদকে প্রয়োজন মোতাবেক ইবাদত, তালিম ও যিকিরের জন্য উন্মুক্ত রাখা। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ বন্ধ রাখা ঠিক নয়। ইবনুল হুমাম রাহ. বিনা প্রয়োজনে মসজিদ বন্ধ রাখাকে মানুষকে মসজিদ থেকে বাধা প্রদান করার অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারা দলীল পেশ করেছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَمَنْ اَظْلَمُ مِمَّنْ مَّنَعَ مَسٰجِدَ اللّٰهِ اَنْ يُّذْكَرَ فِيْهَا اسْمُهٗ وَسَعٰى فِيْ خَرَابِهَاؕ ۰۰۱۱۴
‘তার চেয়ে বড় জালেম আর কে, যে আল্লাহর মসজিদসমূহে তাঁর নাম নিতে বাধা প্রদান করে এবং সেগুলো ধ্বংস সাধনে প্রয়াসী হয়।’ [সূরা আল-বাকারা: ১১৪]
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সব সময় মসজিদ খোলা রাখলে মসজিদের মালামাল হেফাযতের বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এ বিষয়টি বিবেচনা করে কোনো কোনো ফকীহ প্রয়োজনের কারণে নামাজের সময় ছাড়া অন্য সময় মসজিদ বন্ধ রাখাকে জায়েয বলেছেন। তাই এ ধরনের প্রয়োজনে অন্যান্য সময় মসজিদ বন্ধ রাখার অবকাশ আছে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও নামাজের পরপরই বন্ধ করবে না; বরং জামায়াত শেষ হয়ে যাওয়ার পরও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সময় খোলা রাখবে; যেন পরে আসা ব্যক্তিগণ ফরজ আদায় করতে পারে। এবং জামায়াতের পরে যারা একটু সময় নিয়ে নফল ইবাদত করতে চায়, তাদের জন্যও যেন সুযোগ থাকে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, কোনো কোনো মসজিদে দেখা যায়, জামায়াত শেষ করার সামান্য পরেই মসজিদের মুআজ্জিন/খাদেমগণ মসজিদে অবস্থানরত মুসল্লীদের বের হয়ে যাওয়ার জন্য তাড়া দিতে থাকেন, যা কিছুতেই সমীচীন নয়।
আর যেখানে নামাজের নির্ধারিত সময় ছাড়া অন্য সময়েও ইবাদত ও দীনী তালিমের উদ্দেশ্যে মুসল্লীদের মসজিদে ব্যাপক আসা-যাওয়া থাকে সেসব মসজিদ খোলা রাখার ব্যবস্থা করা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। এজন্য প্রয়োজনে মালামাল হেফাযত করা ও মসজিদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য অতিরিক্ত খাদেম নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। আর কোনো ক্ষেত্রে পুরো মসজিদ খোলা রাখা সম্ভব না হলে অন্তত মসজিদের কোনো অংশ অথবা বারান্দা (বাতি ও পাখাসহ) খোলা রাখার ব্যবস্থা করা আবশ্যক।
প্রাসঙ্গিকভাবে একথাও জেনে রাখা দরকার যে, মসজিদে যে দীনী কাজ করা হবে তা শরীয়তের আহকাম মোতাবেক হওয়া জরুরি এবং মসজিদ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে হওয়া আবশ্যক। এক্ষেত্রে যেমন শরীয়তের কোনো বিধান লঙ্ঘন করা জায়েয নয়, তেমনি মসজিদের বৈধ ও স্বীকৃত কোনো নিয়ম লঙ্ঘন করাও ঠিক নয়। [ফতহুল কদীর: ১/৩৬৭, শরহুল মুনয়া: ৬১৫, আল-বাহরুর রায়িক: ২/৩৩, ফতওয়া হিন্দিয়া: ১/১০৯, রদ্দুল মুহতার: ১/৬৫৬, রূহুল মাআনী: ১০/৬৫]
সমস্যা: আমাদের মসজিদের মাইকে মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করা হয়, জানাযার জন্য ডাকা এবং কারো কোনো কিছু হারিয়ে গেলে এর ঘোষণাও মসজিদের মাইকে দেওয়া হয়। জানতে চাই, এসব কাজের জন্য মসজিদের মাইক ব্যবহার করা বৈধ কি না?
মুমিনুল হক
ফটিকছড়ি, ভুজপুর।
সমাধান: মসজিদের মাইক আপন স্থানে রেখে (মাইক মসজিদের ভিতরে হোক বা বাইরে) এতে কারো জানাযার ঘোষণা করা, মৃত্যুর সংবাদ দেওয়া নাজায়েয নয়। আর মসজিদের বাইরে পাওয়া বা হারিয়ে যাওয়া বস্তুর এলান মসজিদে এসে করা বৈধ নয়। হাদীস শরীফে এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। [সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৫৬৮, উমদাতুল কারী: ৩/৫০২, ফতওয়া হিন্দিয়া: ২/৪৫৯, মাআরিফুস সুনান: ৩/৩১৩, ফতহুল কদীর: ৫/৩৫২, বিনায়া: ৭/৩২৯, রদ্দুল মুহতার: ১/৬৬০]
জাত’।