সমাজকল্যাণে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ভূমিকা
মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দীন
মানবজাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন। জীবন ব্যবস্থার মহান আদর্শ শিক্ষক ও মডেল হিসেবে অবিস্মরণীয়। মহানবী (সা.) মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহ তাআলার সর্বশেষ প্রেরিত পুরুষ। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁকে সর্বোত্তম শিক্ষক ও আদর্শ মানব হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তিনি এ জীবন ব্যবস্থা প্রচার করেছেন, শিক্ষাদান করেছেন, নিজে এর অনুসরণ ও প্রয়োগ করে নমুনা স্থাপন করেছেন। সমগ্র মানবজাতির জন্য শান্তি, কল্যাণ, নিরাপত্তা ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একমাত্র অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ রেখে গেছেন যা কেয়ামত পর্যন্ত চিরভাস্বর ও অমলিন থাকবে। এক্ষেত্রে আল্লাহ রাববুল আলামীন কুরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘হে নবী আপনি নীতি-নৈতিকতা ও উত্তম চরিত্রের সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত।’ আর মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রসুল (সা.)-এর আদর্শ তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।’ (সুরা আল-আহযাব: ২১)
রসুল (সা.) তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সর্বযুগের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ একটি সমাজ কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। স্বাধীন ও উন্মুক্ত পরিবেশে যে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেন তা-ই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। সমাজকল্যাণে মহানবী (সা.) কর্তৃক গৃহীত কিছু ভূমিকা তুলে ধরার চেষ্টা।
সমাজকল্যাণে মহানবী (সা.)-এর প্রধান কর্মসূচি ছিল নৈতিক ও কল্যাণমুখী শিক্ষার বিস্তার। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। রসুলুল্লাহ (সা.) যে যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন সে যুগ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। ইসলামের ইতিহাসের পরিভাষায় এ যুগকে অজ্ঞতার যুগ বলা হয়ে থাকে। রসুল (সা.) শিক্ষাদানের মাধ্যমে অজ্ঞতাকে দূরীভূত করেন। তিনি জ্ঞানার্জন করাকে বাধ্যতামূলক করেন। কারণ বিদ্বান বা জ্ঞানীরাই সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এমনকি রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। নৈতিক ও কল্যাণমূখী শিক্ষার মাধ্যমে একটি চরিত্রবান জাতি উপহার দিয়েছিলেন বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)।
রসুল (সা.) একটি সুন্দর ভারসাম্য অর্থনীতির রূপরেখা প্রণয়ন করে গেছেন। তিনি রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক প্রশাসনিক উন্নয়ন তথা ধনী দরিদ্র বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে একটি উৎপাদনমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করে গেছেন। আর সুদমুক্ত সমাজ গড়তে সুদ প্রথা বিলুপ্ত করেন। সুদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় আজকের বিশ্বে বিরাজ করছে অস্থিরতা, ধনী-গরীবের মধ্যে আকাশ-পাতাল বৈষম্য, হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি। রসুল (সা.) সুদ দেওয়া ও নেওয়া এমনকি সুদের দলিল লেখক ও সাক্ষীকে অভিশপ্ত বলে ঘোষণা দিলেন। তিনি আরও বলেন, সুদের ৭০টিরও বেশি গুণাহ আছে। তার মধ্যে নিম্নেরটি হল নিজের মায়ের সাথে জিনা করা।
রসুলে পাক (সা.) সমাজে যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে সমাজে যাকাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আজকের সমাজের অর্থনৈতিক মেকানিজম হল যাকাত ব্যবস্থা চালু করা। রসুল (সা.) বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ সদকা ফরজ করেছেন, যা ধনীদের কাছ থেকে আদায় করে দারিদ্র্যদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।যাকাত আদায় ও বটনের মাধ্যমে আয় বৈষম্য দূর হয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অভাব-দারিদ্র মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
সমাজে নবী করীম (সা.) শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। কেননা শ্রমিকরা তাদের শ্রমের মাধ্যমে সমাজে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। তাই রসুল (সা.)-এর নীতি ছিল মনিব ও শ্রমিকের সম্পর্ক হবে ভাইয়ের সম্পর্ক। এখানে শ্রেণিসংঘাত, শ্রেণিসংগ্রাম কিংবা শ্রেণিবিদ্বেষের কোন সুযোগ নেই। শ্রমিকদের অধিকারকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে তাদের গায়ের ঘাম শুকানোর পূর্বেই ন্যায্য পাওনা আদায় করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে রসুল (সা.) শ্রমজীবীদের অধিকারকে নিশ্চিত করেছেন। শ্রমিকের মজুরির ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) এমন পরিমাণ ভাতা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন যদ্বারা সে নিজে ও তার পরিবারের ভরণ-পোষণ করা চলে। মহানবী (সা.) বলেন, মজুর ও শ্রমিকের খাদ্য ও বস্ত্র দিতে হবে মালিকের তথা রাষ্ট্রের।
সমাজকল্যাণের জন্য সুষম ব্যবসা-নীতি প্রণয়ন করেন। ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা অবলম্বন করতে এবং সর্বপ্রকার ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। সৎ ব্যবসায়ীদের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে সুসংবাদ। অসৎ ব্যবসায়ীদের জন্য দুঃসংবাদ। রসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী (কিয়ামতের দিন) নবী, সত্যবাদী ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিযী: ১২৫২ ও সুনানে দারিমী: ২৫৩৯)
মহানবী (সা.) আরও ইরশাদ করেছেন, ‘যেসব ব্যবসায়ী আল্লাহকে ভয় করে এবং ব্যবসায় সততা ও সত্যবাদিতা অবলম্বন করে তারা ব্যতীত কিয়ামতের দিন অন্য ব্যবসায়ীরা পাপিষ্ঠ রূপে উত্থিত হবে।’ (তিরমিযী: ১২১০ ও ইবনে মাজাহ: ২১৪৬)
এক হাদীসে রসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়, কোন উপার্জন সর্বোত্তম? তিনি বলেন, ‘নিজ হাতে কাজ করা এবং নিষ্ঠাপূর্ণ বেচাকেনা।’ (মুসনদে আহমদ: ১৭২৬৫ ও মিশকাত: ২৭৮৩)
কাতাদা (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি সততা ও ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে ব্যবসা করে, তার জন্য ব্যবসা আল্লাহর পক্ষ থেকে রিজিক ও হালালকৃত একটি বিষয়। (আস-সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী: ৫/৪৩২)
মূল্যবৃদ্ধির আশায় প্রয়োজনীয় দ্রব্য মজুদ রাখাকে তিনি নিষিদ্ধ করেছেন। মহানবী (সা.) আরও ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি বাজারে পণ্যের অভাবের সময় পণ্য মজুদ করে রাখে সে বড় পাপী।’ (মুসলিম শরীফ)
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমদানিকারক রিজিকপ্রাপ্ত হয়, আর মজুদদার হয় অভিশপ্ত।’ আরও বলা হয়েছে, ‘বিভ্রান্ত লোকই শুধু মজুদদারী করে। (ইবনে মাজাহ)
নবী করীম (সা.) মজুদদারকে কঠোর শাস্তি প্রদানের কথা ঘোষণা করেছেন, ‘যে মুসলিম সম্প্রদায়ের খাদ্যদ্রব্য চল্লিশ দিন যাবত মজুদ করে রাখবে আল্লাহ তাকে দূরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দিয়ে শাস্তি দেবেন।’ (ইবনে মাজাহ)
মুনাফালোভী অসৎ ব্যবসায়ী মজুদদারদের সঙ্গে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক নেই। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ রাত পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য মজুদ করবে তার সঙ্গে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক থাকবে না।’ নবীজি আরও বলেছেন, ‘মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি ৪০ দিন পর্যন্ত খাদ্যশস্য মজুদ রাখে, সে ব্যক্তি আল্লাহর দায়িত্ব থেকে মুক্ত এবং আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট।’ (মিশকাত শরীফ)
পণ্যের ত্রুটি প্রকাশ করার গুরুত্ব দিয়ে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দোষযুক্ত পণ্য বিক্রির সময় দোষ প্রকাশ করে না ফেরেশতারা তার ওপর অভিশাপ দিতে থাকে।’
ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতারণা না করার জন্য সতর্ক করে দিয়ে রসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি (বেচা-কেনায়) ধোঁকা দেবে সে আমাদের দলভুক্ত নয়!
এমনিতেই মিথ্যা শপথ করা মারাত্মক গুণাহের কাজ। তার ওপর ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এর নিষেধাজ্ঞা আরও বেশি। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে অন্যের হক সংশ্লিষ্ট থাকে। হযরত আবু যর (রাযি.) বলেন, রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, তিন ব্যক্তির প্রতি আল্লাহতাআলা কেয়ামতের দিবসে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না। তাদেরকে মার্জনা করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আমি বললাম হে আল্লাহর রসুল তারা কারা? তারা তো বড় বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তারা হলো অনুগ্রহ করার পর তা প্রকাশকারী, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয়কারী। অতঃপর রসুল (সা.) এই আয়াত পড়েন। (মুসলিম শরীফ ও মেশকাত শরীফ: ২৪৩)
অপর এক হাদীসে রসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা দ্বারা কারও হক নষ্ট করে সে নিজের জন্য জাহান্নামের শাস্তি অবধারিত করে নেয়। তার জন্য জান্নাত হারাম হয়ে যায়। বর্ণনাকারী আরজ করলেন, যদি বিষয়টি সামান্য পরিমাণে হয় তবুও? উত্তরে তিনি ইরশাদ করেন, তা গাছের একটি তাজা ডালই হোক না কেন।’
ব্যবসার ক্ষেত্রে সত্য শপথ থেকেও বিরত থাকা উচিত। রসুল (সা.) বলেন, ‘শপথ পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করে ঠিক, কিন্তু তা ব্যবসার বরকত নষ্ট করে দেয়।’ অপর বর্ণনায় আছে ‘তোমরা বেচাকেনার ক্ষেত্রে অধিক শপথ থেকে বিরত থাক, কেননা তা পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করলেও বরকত নষ্ট করে দেয়।’ (মুসলিম শরীফ ও মেশকাত শরীফ: ২৪৩)
সমাজকল্যাণে মহানবী (সা.)-এর অন্যতম কর্মসূচি হচ্ছে দুর্নীতি প্রতিরোধ। সমাজ থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদে জবাবদেহি ও নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এ জঘণ্য অপরাধ থেকে মানুষকে মুক্ত রাখার ব্যাপারে রসুল (সা.)-এর নীতি ছিল অতুলণীয়। তিনি পরকালিন শাস্তির ভয় দেখিয়ে মানুষদের দুর্নীতি থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করেছেন। ঘুষের লেনদেন করে কাজ করিয়ে নেওয়া বা দেওয়ার ব্যাপারে কঠোর সতর্কবাণী করেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) হতে বর্ণিত রসুল (স.) বলেন, ঘুষ দাতা ও ঘুষ গ্রহীতা উভয়ই জাহান্নামে যাবে। (তাবারানী)
হযরত ইবনে ওমর (রাযি.) বর্ণিত অন্য হাদীসে আছে যে, ‘ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহীতা উভয়কেই রসুল (স.) লানত করেছেন।’ (আবু দাউদ)
হযরত সাওবান (রাযি.) হতে বর্ণিত আছে যে, ‘রসুল (স.) ঘুষ দাতা ও গ্রহীতা এবং ঘুষের দালাল সকলের ওপর লানত করেছেন।’ (আহমদ ও তাবারানী)
সমাজকল্যাণে মহানবী (সা.) কর্তৃক আরেকটি কর্মসূচি হচ্ছে মদ ও জুয়া নিষিদ্ধকরণ। মদ ও জুয়া সমাজের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। এটা পরীক্ষিত যে, মদ-জুয়া স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-পড়শীর মধ্যে সম্পর্কের ভীত নষ্ট করে দেয়। মদ ও জুয়া মানুষকে কাণ্ডজ্ঞানহীন করে তোলে। মানুষকে ব্যক্তিত্বহীন হতে বাধ্য করে। মদ ও জুয়ার কারণে আর্থিকভাবে দেউলিয়ায় পরিণত হয়েছে আমাদের সমাজে এমন নজির অসংখ্য। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘(হে রসুল সা.) লোকেরা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, উভয়ের মধ্যে আছে মহা পাপ এবং মানুষের জন্য উপকারও; কিন্তু এগুলোর পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক।’ (সুরা আল-বাকারা: ২১৯)
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘ওহে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা ও ভাগ্য নির্ণায়ক তীর হচ্ছে ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কারসাজি। সুতরাং তোমরা এসব বর্জন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’ (সুরা আল-মায়িদা: ৯০)
আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় শয়তান মদ ও জুয়ার দ্বারা তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদের আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে বিরত রাখতে চায়; তবু কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না।’ (সুরা আল-মায়িদা: ৯১)
মদ ও জুয়া সম্পর্কিত আল্লাহ পাকের দেওয়া বিধানকে কঠোরভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে রসুল (সা.) তৎকালীন সময়ে ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক হন। রসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘নেশা জাতীয় যে কোনো দ্রব্যই মাদক। আর যাবতীয় মাদকই হারাম। যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মাদক সেবন করে, অতঃপর নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মারা যায় এবং সে তওবা না করে, আখিরাতে সে মদপান করা থেকে বঞ্চিত হবে।’ (মুসলিম: ২০০৩)
হজরত আনাস ইবনে মালিক (রাযি.) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের কিছু নিদর্শন হলো ইলম লোপ পাবে, অজ্ঞতার প্রসার ঘটবে, মদ্যপান ও মাদকের বিস্তার ঘটবে, ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়বে।’ (বুখারী শরীফ: ৮০)
রসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মাদক ও নেশা পান করো না। কেননা, এটা সব অপকর্ম ও অশ্নীলতার মূল।’ (ইবনে মাজাহ: ৩৩৭১)
সমাজকল্যাণে মহানবী (সা.)-এর অন্যতম কর্মসূচির মধ্যে সন্ত্রাস দমন ও প্রতিরোধের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীকে সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ উপহার দিয়েছেন। ইসলাম কখনোই হত্যা, নৈরাজ্য সৃষ্টি, সহিংসতা ও সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেয় না। রসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কবীরা গোনাহসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় গোনাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া এবং মিথ্যা কথা বলা।’ (বুখারী: ৬৮৭১ ও মুসলিম: ৮৮)
বর্তমান পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, একদল ভিন্নমতের ওপর দিনের পর দিন অস্ত্রাঘাত কিংবা নির্যাতন করে যাচ্ছে। এমনকি বিনা দোষে দিনের পর দিন কারাগারে বন্দী রাখা হচ্ছে। অথচ রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের (মুসলমানদের) ওপর অস্ত্র উঠাবে, সে আমাদের (ধর্মের) দলভুক্ত না।’ (বুখারী: ৬৮৪৪)
অন্য হাদীসে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কাছে গোটা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোনো মুসলমানের হত্যার চেয়েও অধিক সহনীয়।’ (নাসায়ী শরীফ: ৩৯৯২)
চারিত্রিক সংশোধনের মাধ্যমে সন্ত্রাস নামক সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্ত করার জন্য রসুল (সা.)-এর নীতি ছিল অসাধারণ। সন্তানদের চরিত্র গঠনে মাতাপিতাকেই বেশি দায়িত্ব দিয়েছেন। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের সাথে সম্মানবোধের মাধ্যমে আচরণ কর এবং তাদেরকে আদব ও মূল্যবোধ শেখাও।’
সমাজে তাঁর শান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ ছিল অনন্য। যুদ্ধ-বিগ্রহ, কলহ-বিবাদ, রক্তপাত, অরাজকতা দূরীভূত করে শান্তিপূর্ণ একটি কল্যাণমূলক আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। একই সাথে যুব সমাজকে ঐক্যবদ্ধভাবে সুপথে রাখা ও কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত রাখার উদ্দেশ্যে গড়ে তোলেন হিলফুল ফুযুল নামক একটি সংগঠন। যা বিশ্ববাসীর জন্য অনন্য শিক্ষা।
লেখক: সংগঠক ও কলামিস্ট